#Journey
#৩৪
রাইফ চমকে উঠে,শুধু চমকে না,ওর সারা পৃথিবী কেঁপে ওঠে,মনে হয় যেন এক্ষুণী পায়ের নিচে কোন বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটে গেছে,আর তা সাইক্লোনের রূপ নিয়ে রাইফের সাজানো জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে!মাথা চেপে রাইফ নাড়ায়।
” না না না,এটা হতে পারে না!আমি বিশ্বাস করি না!মা কেন এরকম করবে!”
“কেন আবার,হীরের জন্যে…”
“অসম্ভব!দেখ জেসমিন তুমি ভুল করছ,আমি জানি…!এতক্ষণ বসে বসে কি সব ছাইপাশ বললা আল্লাহ জানে,এখন আবার মাকে টানতেছ!”
“আমি কোন ভুল করিনি,সত্যি!এই দুর্ঘটনার আগে আমি জানতাম না যে মায়ের সাথে রুবায়েতের মায়ের পরিচয় আছে! সম্ভবত আমাদের বিয়ের কিছুদিন পর আমাদের ছবি কথা কথায় তাকে দেখায়।সে তখন আমাকে চিনতে পারে।ধীরে ধীরে মাকে হাত করে,তাকে লোভ দেখায়,তাকে জানায় তার ছেলের বউয়ের হাতে কি আছে!মাও সেই লোভ সামলাতে পারেনি,তাই কিলার ভাড়া করতে,তাকে টাকা দিতে এমনকি তোমাকে খুনের প্ল্যান করতেও…”
“থাম থাম থাম! আমি পারতেছি না তোমার এই কথাগুলো আর নিতে! আচ্ছা,আমার মায়ের নামে যে এতগুলো কথা বললে,কোন প্রমাণ আছে,হ্যাঁ?!আমাকে বললেই আমি বিশ্বাস করব!তখন থেকে যা যা বলতেছ,সব ফালতু,আমি জানি!”
জেসমিন মাথা নিচু করে থাকে,
“হায়রে পুরুষ মানুষ! আমরা বাবা মা,আগের জীবন,নিজস্বতা সব ফেলে তোমাদের কাছে চলে আসি,আর তোমরা মায়ের উপর আঙুল উঠলেই বউকে কথা শোনাও!বাহ…আমি ফালতু বকি?খুব ভাল…প্রমাণ লাগবে তোমার?এই যে দেখ প্রমাণ! এই যে এটা তোমার মায়ের ইন্সটা আইডি।তোমার মা প্রাইভেসি রক্ষায় খুব একটা পারদর্শী না দেখাই যাচ্ছে!এই যে,এটা রুবায়েতের মা। আরো প্রমাণ লাগবে?সবচেয়ে বড় প্রমাণ আছে আমার কাছে”
ফোন বের করে জেসমিন একটি রেকর্ড প্লে করে।সেখানে শোনা যাচ্ছে রাইফের মায়ের কন্ঠ।
“দেখ মেয়ে,তুমি বেশ বোকা,বোকা না হলে এরকম ভুল কেউ করে?কি আছে তোমার?বাড়ি,গাড়ি,প্রোটেকশন?কিছুই না।যা ছিল,সব তোমার মা উড়িয়ে দিয়েছে।যেটুকু বাকি আছে,তা আমাদের দিয়ে দাও। কথা দিচ্ছি কিছু মূল্য তো পাবেই।তবে সবচেয়ে বড় মূল্য হবে তোমার জন্য আমার ছেলের সাথে ভালভাবে সংসার করতে পারা।কেউ তোমাদের মারতে চাইবে না,কাটতে চাইবে না,তোমরা তোমাদের মত থাকবে।”
জেসমিন বলছে,
“না,মা,এটা দিয়ে দেয়া কোন সমাধান না।আপনাদের কেন দিব?ক্ষমতা,টাকার জোর দেখাচ্ছেন?দেখান,কিন্তু এসব দেখিয়েও যা চাচ্ছেন তা পাবেন না।আমার মায়ের জিনিস আমি দিব না।তাছাড়া আপনার ছেলে এখনও কিছুই জানে না,যদি জানাই,আপনার ক্ষমতা,টাকা সব বিফলে যাবে মনে রাখবেন!”
“আমার ছেলে!ওর এত ক্ষমতা নাই মা,আমি খুব ভাল করেই জানি।শোনো,ওকে জানানোর মত বোকামী করে নিজেই বিপদে পড়বে।আমার ছেলে শুধু ঝামেলা থেকে পালাতে জানে।তাই ওকে যদি জানাও,ও নিজেই আমার হাতে সব তুলে দিয়ে যাবে!”
এ পর্যায়ে রাইফ জোর করে রেকর্ডিং থামায়।ওর দুচোখ থেকে অশ্রুর স্রোত নামছে।দুহাতে মুখ চেপে রাখে ।
“এই রেকর্ডিং করেছিলাম তোমার মাকে ফাঁসাব বলে।তাকে বুঝাতাম যে আমার কিছু করে সে পার পাবে না।কিন্তু এই রেকর্ডিং যে তার ছেলেকেই শোনাতে হবে মায়ের দোষ বা নির্দোষীতা প্রমাণ করতে,তা আমি ভাবতে পারিনি!সত্যি,তুমি তো বলেছিলেই এগুলো দিয়ে দিতে! আচ্ছা,এখন কি দিয়ে দিবে? অবশ্য ওরা যদি আর কাউকে মারে,সেটা আমাকে মারবে।তোমাকে তো তোমার মা মারবে না,আরো ভালোবাসা দিবে,নতুন করে বিয়ে দিবে!জীবন শেষ হবে আমার,তোমার না…”
রাইফ উঠে রেগে টেবিল থেকে কাঁচের জগ দেয়াল ধ্রিম করে আছড়ে ফেলে।ঝনঝন আওয়াজ তুলে জগটা কয়েক কোটি টুকরা হয়ে যায়,আ সেই টুকরোয় সারা মাঝে ভরে যায়।রাইফ আরো দুটো গ্লাস দেয়ালে ছুড়ে মারে।ওর এই মুহুর্তে পুরো পৃথিবীটা এভাবে তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।জোরে জোরে হাপড়ের মত ওর নিশ্বাস উঠা নামা করছে,সেই সাথে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।এই জল দুঃখের না,জেদের,কাউকে না মারতে পারার জেদের,কিংবা জীবনের এই অনাকাঙ্খিত মানুষগুলোর উপস্থিতির জেদের।
রাইফ চিৎকার করে,
“আমাকে আগে কেন জানাও নি! কেন আমি জানতে পারিনি আমার নাকের ডগায় এত কিছু হচ্ছে!প্রতিটা বার আমি নিজে মাকে আমাদের শহর, ঠিকানা দিয়ে এসেছি,আমাদের সব বলেছি!আমাকে…কিন্তু…মা…উফ,বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে দিল!আগেও কম অশান্তি করেনি! আমি…মানুষের এরকম মা কিভাবে হয়!আমি বুঝলাম না!আমার মা একটা নির্দোষ মানুষকে মেরে দিল! সে আবার নিজের ছেলেকেও…!”
রাইফ মাটিতে টুকরো কাঁচের উপর বসে পড়তে নেয়,জেসমিন ওকে ধরে ফেলে।টেনে সোফায় এনে বসায়।দুহাতে নিজের সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখে কেঁদে ফেলে।
“জানো,কতবার চেষ্টা করেছি তোমাকে বলব!মুখ খুলেও বলতে পারিনি,অন্য কিছু মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে!কি করে একটা ছেলেকে বলি যে,তার মা তার ছেলের স্ত্রীকে মারতে চায়,তার ছেলেকেও মারার চেষ্টা করেছে?কি করে বলব,যে মা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে,সে তোমার জন্যে আরো কষ্টের আয়োজন করেছে? প্রথম যখন জানতে,তখন থেকেই আমার পাগলপ্রায় দশা।বাইরের শত্রুর সাথে যুদ্ধ করাটা সহজ,কিন্তু ঘরের ভেতর বসে যদি আগুনের ফুঁক দেয়,সেটা সামলানো যায় না।শুরুতে শুরুতে আমার মনে হত,তুমিও এর মাঝে জড়িত।তাই তোমার সাথে আমার দূরত্বও বেড়ে গিয়েছিল।আমি কি ভাবছি,কি করছি,কিছুই তোমাকে জানাতাম না।।আবার মনে হত,তুমি কিছুই জানো না।তুমি কিছুই জানো না নিশ্চিত হওয়ার পর আবার তোমার কাছে গেছি।প্লিজ…আমাকে ভুল বুঝো না!কাছের মানুষদের হাতের ছুরি খেতে খেতে আমি নিজেও……জানি,বিশ্বাসের বিচারে আমি হেরে গেছি,তবুও আমি সুখী,তুমি তো অন্তত আমার সাথে বেঈমানী করোনি!”
রাইফ জেসমিনের সারা মুখে চুমু দেয়।বুকের সাথে শক্ত করে চেপে বলে,
“আমার কাছে তোমার দাম ঐ চারশ কোটির হীরের চাইতেও বেশী।ঐ চারশ কোটি হীরের কাছে ভালবাসা নেই,বরং এগুলো আমার মায়ের ন্যূনতম
ভালবাসাটাও কেড়ে নিয়েছে।আমার কাছে আমার ভালোবাসার চাইতে বড় কিচ্ছু নেই!”
জেসমিন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।কিছুক্ষণ পর বলে,
“বেজমেন্টের লোকটা,গেব্রিয়েলকে কি করবে?”
রাইফ কঠিন মুখে জাবাব দেয়,
“ওর ভার আমার হাতে ছেড়ে দাও”
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMAria