#Journey
#৩৫
রাইফ বেজমেন্টে আসে,পিছে পিছে জেসও চলে আসে।লোকটা এখনো ওভাবে পড়ে আছে।রাইফ তার পালস চেক করে,নাহ মরেনি।
“ওকে কি করবে তুমি?”
“সেটা নাহয় আমার উপর ছেড়ে দাও?অনেক তো একা একা পন্ডিতি করেছ,এখন আমাকে সবটাই সামলাতে দাও।আর এখানে এগুলো কি?এসিড কেন এনেছ? …দাঁড়াও!তুমি কি এর চেহারা এসিডে ঝলসে দেবার প্ল্যান করেছিলে?!”
জেসমিন অন্য দিকে তাকায়,যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না!রাইফ ভীষণ রেগে যায়।
“নিজে নিজে সব ডিসিশান নেয়া শিখে গেছ,না?!মানুষ খুনের প্ল্যান কর?!খুনী হওয়ার শখ জেগেছে,না?!থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিব!এসিড দিলে ও যদি না মারা যায়,তাহলে কি ধরনের কেস আসতে পারত তার ধারণা আছে?! এইটা কি বাংলাদেশ পেয়েছ যে যা মন চায় করে ধামাচাপা দিয়ে ফেলবা?এত সহজ?! আর এটা আমাদের প্রপার্টি,এখানে ওর মারা যাওয়ার পর একটা সামান্য কিছুও যদি পাওয়া যায়,হোক সেটা সামান্য চুল,ভুক্তভূগী আমি হব!আমার জেল খাটা লাগবে!এরচেয়ে বড় কিছুও হতে পারে!আমার নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার মত পরিস্থিতিও হতে পারে! না বুঝে কি সব করতে শুরু করে দিয়েছ,হ্যাঁ!??যাও এখান থেকে!!”
বকা খেয়ে জেসমিন ফুস করে বেজমেন্ট থেকে দৌড় দেয়।উপরে গিয়ে ডাইনিং এর করিডর পেরিয়ে উঠে যাবার সময় পাশে দেয়ালে টানানো আয়নায় খেয়াল করে দেখে মুখে-হাতে,কাপড়ে রক্তে মাখামাখি অবস্থা।নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়,সত্যিই কি সে খুনী হতে চেয়েছিল?গেব্রিয়েলকে অবশ্য সে মারতেই চেয়েছিল।হোক সেটা পিটিয়ে,কিংবা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে,অথবা এসিডে চুবিয়ে; তবে তাকে মারতে যে বদ্ধ পরিকর ছিল,তা নিশ্চিত।আজ ভাগ্যগুণে রাইফ বাসায় এসেছিল,তা নাহলে…!
একটা বড় নিশ্বাস ফেলে জেস ঘরে এসে কাপড় চোপড় নিয়ে শাওয়ারে ঢুকে যায়।রক্তাক্ত কাপড়গুলো একপাশে ফেলে রাখে।পানির ছোঁয়ায় রক্তের একটা ধারা ওর খুলে ফেলা কাপড় আর শরীর থেকে যেতে শুরু করেছে।যখন হাত মুখ ঘষে রক্তের দাগ তোলার চেষ্টা করে,তখন হাতের ক্ষতগুলো থেকে শক্ত হয়ে যাওয়ায় রক্তের দলা সরে নতুন করে আবার রক্ত ঝরতে শুরু করে,আর তাতে পানি লেগে নতুন করে যন্ত্রণা হচ্ছে।জেস টাবের একপাশে বসে পড়ে।শরীরে খুব একটা বল পাচ্ছে না।খুব করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে।এই কয়েক মাসে আবারো আগের মত অনুভূতি হচ্ছে।বারবার মনে হচ্ছে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।যেনো কোন কালো ছায়া সমস্ত সত্ত্বাকে দখল করে নিচ্ছে,মনের মাঝে শুধু কুচিন্তা আসে।নিজেকে নিজে আজকাল চিনতে কষ্ট হয়।মাথায় শুধু ভায়োলেন্ট চিন্তাভাবনা আসে।
এই কয়েক মাসে অনেকটা প্যারানয়েডের মত জীবন কাটিয়েছে জেসমিন।রাস্তা দিয়ে দুমিনিটের বেশি কেউ যদি পেছন পেছন হাঁটত,ওর মনে হত মানুষটা ওকে অনুসরণ করছে।আবার রাতের বেলা ঘুমুতে পারত না, মনে হত কেউ না কেউ উৎ পেতে আছে।কোন প্রকার মানসিক শান্তি সে পায়নি।সবসময় কাউকে না কাউকে সন্দেহ হত।এক বিছানা ভাগ করা মানুষটাকেও হুটহাট সন্দেহ হত প্রবল আকারে।
টাবের একপাশে শাওয়ারের নিচে বসে দেয়ালে শরীরের ভর ছেড়ে দেয়।উপর থেকে অনবরত পানি পড়ছে ওর মাথায়,আর সে পানি মাথা বেয়ে এসে ঠেকছে কাঁধে; সেখান থেকে গড়িয়ে পিঠ-বক্ষ পেরিয়ে পায়ে এসে ঠেকছে।চোখ বন্ধ করে জেসমিন ভাবে,ইশ,এভাবেই যদি সব কষ্ট গুলো পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে যেত!ইশ,যদি শরীরের সব লোমকূপ দিয়ে দুঃখগুলো উপচে পড়ত,আর গোসলের উষ্ণ পানির সাথে সেসব মিলে সব ময়লা পানির সাথে চলে যেত!
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল ও জানে না।ধ্যান ভাঙে রাইফের স্পর্শে।
“কি ব্যাপার?শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?এভাবে পানির নিচে বসে থাকলে তো জ্বর চলে আসবে!ওঠো!”
জেসমিন যে ওয়াশরুমের দরজা লাগায়নি,তা মাত্র খেয়াল হয়।এতটাই ধ্যানে মগ্ন ছিল যে কি করছে তার খেয়াল রাখা দায় হয়ে পড়েছে।টানা এতক্ষণ পানির নিচে বসে থাকায় ওঠার শক্তি তেমন পাচ্ছে না।রাইফ তখন শাওয়ারের পানি বন্ধ করে একটা টাওয়েল এনে ওকে পেচিয়ে পাঁজাকোলা করে কোলে তোলে।জেস দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে বাঁ কাঁধে মাথা রাখে।রাইফের সাথে একেবারে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে নিজেকে।বিছানায় বসিয়ে রাইফ ওর চুল মুছে দেয়।তারপর খাবার আনতে গেলে জেসমিন ওর হাত ধরে ফেলে।
“আমাকে রেখে যাচ্ছো কেন?”
“খাবার খেতে হবে না?তোমার জন্যে ডিনার আনব”
“আমি খাব না”
“উহু,খেয়ে নাও।তোমার ব্লাড প্রেশার কমে গেছে বোধহয়,চোখও লাল,জ্বর আসবে।”
“আসুক,তবুও তোমাকে ছাড়ব না”
“তাহলে খাবার আনব কি করে?আমারো তো খেতে হবে!”
“চুমু খাব!”
রাইফ চোখ রসগোল্লার মত বড় করে ফেলে।
“উহ!কি আব্দার!আর সময় পাওনি?এখন না,পরে…”
“না!!!আমার এখনই লাগবে!!!লাগবে লাগবে লাগবে এ এ এ এ এ এ!!!!”
রাফি দ্রুত ওর কপালের চুল সরিয়ে সেখানে চুমু খায়।তারপর চলে আসতে চাইলে জেস আবার হাত ধরে টান দেয়।
“কি হল,দিলাম তো!”
“না,আরো লাগবে!”
রাইফ দেখে ওর হাত বেশ গরম লাগছে।তারমানে জ্বর আসতে শুরু করেছে,আর ওর জ্বর আসলে একেবারে বাচ্চা বাচ্চা আচরণ করে।রাইফ এবার গাল দুটো টেনে দিয়ে দুগালে নাক দিয়ে ঘষে দেয়।এরপর টুপ করে এক টানে জেসমিনকে কোলে তুলে ডাইনিং এ রওনা দেয়।কারণ খুব ভাল করেই জানে,এই মেয়েকে এখানে রেখে গেলে কিছুতেই থাকবে না।প্রথমে চিৎকার করবে,তারপর কান্না করবে।আর এত রাতে যদি কান্না করে,মানুষ ভাববে খারাপ কিছু ঘটছে হয়ত!
এদিকে জেস রাইফের কোলে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে ওর গালে চুমু খাচ্ছে,সিল্কি চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিচ্ছে,চিমশে যাওয়া গাল ধরে কামড়ে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।সেই তখন থেকে কি যেন হল,শুধু রাইফকে খোঁচাতে ইচ্ছা করছে।ওর দাড়িতে গাল ঘষতে ঘষতে বলে,
“এই পচা দাড়িগুলো হয় ফেলে দাও,অথবা বড় করে ফেল।কিন্তু এরকম রাখবা না,আমার খোঁচা লাগে!”
“ঠিক আছে,করব”
“আর তুমি বেশি বেশি খাবা।তাহলে তোমার গাল গুলো ফুলবে।আর আমি তোমার গালে কামড় দিব!”
“ওকে!”
“আর চুল গুলো আরেকটু বড় করবা,আমি টানব”
“হুম! আমার উপর অত্যাচার করার জন্য আর কি কি হুকুম পালন করতে হবে শুনি?”
জেসমিন দাঁত কেলাতে কেলাতে চেয়ারে বসে চোখ ঘুরায়,এর মানে হচ্ছে আরো অনেক বাকি।রাইফ চেয়ার টেনে পাশে বসে ওকে খাওয়াতে শুরু করে।একেবারে বাচ্চা হয়ে গেছে মেয়েটা কিছুক্ষণের মাঝে।বাচ্চাদের মত রাইফের হাতে খেতে খেতে হাতের দিকে তাকায়।ওর রগ ফুলে থাকা হাতটা জেসমিনের আরেকটা প্রিয় বস্তু।হাতের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে লোকমা গুলো মুখে পুরে।তিন লোকমা খাওয়ার পর চতুর্থবারে ওর হাতে খপ করে কামড় দিয়ে বসে।
“আরে কি!এরকম কামড়া কামড়ি করছ কেন!”
জেস দন্তবিকশিত হাসি দেয়।
“এখানে কামড়া কামড়ি করছ আমার সাথে,ওদিকে সেলিমের কোন খোঁজ নিয়েছ?”
জেসমিন ঠোঁট উলটে জোরে জোরে মাথা দুপাশে নাড়ায়।রাইফ পরের লোকমা মুখে দিতে দিতে বলে,
“ও অদ্রের সাথে ঘুমিয়ে গেছে।ওর মা ওদের ডিনার করিয়ে দিয়েছে।গেব্রিয়েলকে কি করেছি জানতে চাইবে না?”
জেসমিন আবার ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ায়।
“ঠিক আছে,তবুও আমি বলছি।আমার এক বন্ধু আছে,তার হাতে দিয়ে দিয়েছি।ওর নামে নাকি থানায় অনেক রকম অভিযোগ আছে,বেশ কিছু বড় ক্রাইমের সাথে ওর নাম জড়িয়ে আছে।ভালই হলো,সময় মত এই আপদকেও বিদায় করা গেছে!আসলে হয়েছে কি,আমাদের…”
রাইফ কথা শেষ করতে পারে না,জেসমিন ও ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে।ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমি ঘরে যাব,আমার শীত লাগছে! আর আমি ঘরে গিয়ে আমি খাব,কিন্তু এগুলো না।আমি তোমাকে খাব!”
রাইফ ওর কপালে হাত দেয়।জ্বর আরো বেড়েছে,তাই সে আরো বেসামাল হয়ে পড়ছে।এরচেয়ে বেসামাল হওয়ার আগেই ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিতে হবে,তানাহলে কামড়ে মাংস তুলেও ফেলতে পারে,ওর কোন বিশ্বাস নেই!
বউটাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।জ্বরের ওষুধ খাইয়ে ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে একপাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।এতক্ষণ পাগলামী করলেও বিছানায় এসে জেসমিন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে,ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে।রাইফ সাবধানে ওকে দেখে শুইয়ে দেয়।তারপর নিজে উঠে ট্যারিসে এসে বসে।ছোট কাউচটায় বসে সিগারেট বের করে ধরায়।আজ অনেক দিন পর সিগারেট খাচ্ছে।জেসমিনের কথাগুলো এখন আবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
ওর মা,জেসমিনের মা,দুজনের এই সাথে এত জঘন্য রকম খারাপ কেন হল?কেন একজন মাও ভাল হলো না যার কাছে ওরা সন্তান হিসেবে আশ্রয় পেত?কেন ওদের দুজনের বাবাই ওদের ছেড়ে চলে গেল?জোরে জোরে নিকোটিনের ধোঁয়া বুকের ভেতর শুষে নেয়।বুকের ভেতর যন্ত্রণার সাথে ধোঁয়াগুলো মিলে যেন জট পাকায়,বুকটা আরো ভারী করে দেয়।রাইফের মন খারাপ হয়।তবুও জোর করে আরো কয়েক টান দেয়।
এসময় ট্যারিসে জেসমিনের উপস্থিতি টের পায়।ওকে দেখে রাইফ কিছুটা ভূত ভেবে চমকে যায়।জেস আস্তে করে এসে ওর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দেয়,আর কোলে বসে গভীর ভাবে স্বামীর মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য।
ভালোবাসার কিছু প্রহরের পর জেস বলে,
“জানি কষ্ট হচ্ছে,আমারো হচ্ছে জানো।কিন্তু এই কষ্ট নিতে পারছি না।প্লিজ,চলো না ঘরে?আজকের রাতের জন্য ভুলে যাই সব?ভুলে যাই আমাদের এত সমস্যা?একটা রাতের জন্যে…প্লিজ?”
রাইফ স্ত্রীর কপালের ভালবাসার স্পর্শ দেয়।
“এক রাত কেন?যত রাত বলবে,তত রাত ভোলাতে আমি রাজী!পৃথিবী উলটে যাক,তোমার আমার ভালবাসা কমানো সম্ভব না!জানি না কালকের সূর্য কি নিয়ে পৃথিবিতে আলো ছড়াবে,জানি না কাল আমাদের জন্য কি আছে…শুধু এটুকু জানি,আমরা দুজন একত্রে ছিলাম,আছি,আর ভবিষ্যতেও থাকব…ইনশাআল্লাহ…!”
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria