#Journey
#৩৯
রাইফ জানতে চায় জেসমিনের কাছে,
“কি করলে আমাদের উপর এই ঝামেলা কমবে?”
“দেখো,চারশ কোটি টাকা মানে অনেক কিছু!শুধু দু তিনটে মানুষের জীবন নিয়ে নেয়া না,পুরো একটা পরিবারকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট এই টাকা।তাই আর যাই হোক,এই মহীরে গুলোকে ঘাড় থেকে সরিয়ে অন্য কিছু করতে হবে”
“কি যে বলো না!এত দামী হীরে এই জীবনে দেখার ভাগ্য আর কখনো হবে নাকি?!আমি এই হীরেগুলো মরার আগে একবার হলেও দেখতে চাই!”
“দেখো,লোভ কিন্তু মানুষকে মারে!খবরদার,হীরের প্রতি লোভ দেখাবা না!”
“আরে বাবা,আমি তো হীরে দেখার লোভার দেখাচ্ছি,নেয়ার লোভ না”
“এই দেখার লোভটাই কাল হবে পরে!তোমার মা তোমাকে আমাকে সবাইকে মেরে দিবে”
রাইফ মুখ ভেংচি কাটে।জেস বাবুকে ঠিকভাবে শুইয়ে মাথাটা বালিশে এলিয়ে দেয়।তারপর স্বামীর সাথে কিছুটা গা ঘেঁষে শোয়।রাইফ আস্তে করে ওর মাথায় হাত বুলায়।
“খারাপ লাগছে খুব?”
“উম,পেট ব্যথা করছে।সাথে কোমর,পাও ব্যথা করছে”
“আজ তোমার একদম শুয়ে থাকার দরকার ছিল,অথচ তোমার সেরকম বিশ্রাম হয়নি”
“যা হয়েছে চলবে।এখন আমার মাথায় একটু হাত বুলাও”
রাইফ জেমিনের মাথা টিপে দিতে থাকে।
“শোনো,আমি বলি কি,এসব চিন্তা মাথা থেকে সরাও,এসব নিয়ে চিন্তা করার আরো সময় পাবে”
জেসমিন চোখ বন্ধ অবস্থায় কিছুটা নিচু স্বরে বলে,
“ভাবতাম না,একেবারে ভাবতাম না।তোমার ঐ পাঁজী মা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল”
“তা সে আর কি বলল যে তুমি এসব ভাবছ?”
“সেই পুরোনো কথা,তার সাথে বাবুকে নিয়েও কিছু থ্রেট দিল,এই আর কি”
“মেরে ফেলব,একেবারে মেরে ফেলব সবগুলোকে!”
“আরে,আমাকে মারবা নাকি!এরকম জোরে মাথায় টিপে দিচ্ছ কেন!শোনো,আমি ভাবছি এই হীরে গুলো দিয়ে আমাদের নিজেদের কোন কাজে লাগিয়ে ফেলি”
“যেমন?”
“আমাদের গ্রামের মানুষ গুলো অনেক গরীব।ওরা সবাই শহরে চলে আসছে কিছু টাকার জন্য।শহরে মানুষ বেড়ে যাচ্ছে,গ্রামে সুন্দর বাড়ি ঘর হচ্ছে,কিন্তু তেমন কেউ সেখানে থাকছে না।আমি ভাবছি,একটা ফ্যাক্টরী খুলব যেখানে গ্রামের দুঃস্থ মানুষগুলো কাজ করবে,যেমন মনে কর মাছের হ্যাচারী,সাইন্টিফিক নার্সারী,এগুলো কাজে লাগবে।পাশাপাশি দেশি কাপড়ের গার্মেন্টসও দেয়া যায়,আরো অনেক প্ল্যান আছে”
“ওরে বাবা! তুমি তো একবারে সব উন্নয়ন করে ফেলতেছ! এত কিছু কি একবারে হয় নাকি!”
“কেন হবে না!তুমি চারশ কোটি টাকা মানে বোঝো?!”
রাইফ ঠোঁট উল্টায়।
“বুঝব না কেন!চারশ কোটি টাকা হল আওয়ামী সরকারের আমলে হয়ে যাওয়া সেই হলমার্ক কলঙ্ক!”
“হুঁশ,এর মাঝে রাজনীতি আনো কেন তুমি!”
“বা রে!রাজনীতি তো তুমি করছ,আমাকে হীরে দেখতে দিচ্ছ না!”
“দেখবে,তবে সব গুলো না।স্পেশাল কিছু হীরে রেখে বাকীগুলো আমি বিক্রি করে দিব,ভাইয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে”
“এ্যাঁ! আলামিন ভাইয়ের সাথে কথাও শেষ!”
“আর কত এগুলো নিয়ে বসে থাকবে ভাইয়া?কিছু হীরে ভল্ট থেকে বের করেছে তো আরো আগেই।সে যাই হোক,সবগুলোই বিক্রি শেষ।অলরেডী গ্রামের বড় বড় নেতাদের সাথে কথা বলার কাজে ভাইয়া হাত দিয়েছে।ওর আবার এসবে ভাল আগ্রহ আছে।এতে অনেক মানুষের কাজের ব্যবস্থা হবে।আর বাকী হীরেগুলো…”
রাইফ উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“বাকি গুলো কি?”
জেসমিন রহস্যময় হাসি দেয়।
“সময় হলেই জানবে!”
এই রাত এর পর থেকে আরো আট হাজার তিনশত পঁচানব্বইটি রাত,অর্থাৎ দুইশত ছিয়াত্তর মাস অথবা প্রায় ২৩ বছর পরের কথা বলছি।
সেলিম এখন ২৭ বছরের পরিপূর্ণ যুবক।পড়ালেখার ওর শেষ।ওর ছোট ভাই জিহান এবার মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষে আছে।ওর এক ছোট বোনও আছে যার নাম জাফরিন,মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে দুই ভাই মিলেই রেখেছে।ওদের দুভাইয়ের বয়সের পার্থক্য মাত্র চার বছরের কিছু বেশি হলেও বোনের সাথে অনেক পার্থক্য।জাফরিন জিহানের চেয়ে আট বছরের ছোট,এখন হাইস্কুলে পড়ছে।ওরা এখন ইটালীর রোমে থাকে।যখন ওর ছোট ভাই জিহানের জন্ম হয় ,তার কিছুদিনের মাঝেই ওরা রোমে শিফট হয়।তার আগে ওরা সিসিলিতে ছিল,তবে সেখানে বেশিদিন থাকা হয়নি।
গতকাল জিহানের জন্মদিন ছিল,তবে সে উপলক্ষে কিছুই করা হয়নি।এমনিতেই ওরা জন্মদিন পালন করে না,কারণ সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম।তবুও ওর মা ভাল মন্দ রান্না করত যার যার জন্মদিন অনুযায়ী। তবে গতকাল জিহানকে ভুলে থাকার কারণটা ভিন্ন।ওদের মা হাসপাতালে।নিউমোনিয়া হয়েছে,গত দুসপ্তাহ ধরে ওদের মা,জেসমিন আয়াজ,খুব ভুগছে।কাউকে না কাউকে প্রতিদিন মায়ের কাছাকাছি থাকতে হচ্ছে।যদি বাবা আজ বেঁচে থাকত,তাহলে মা এমনিতেই সুস্থ হয়ে যেত।বাবা নেই বলে মাও ঘন ঘন অসুস্থ হয়।তারা দুজন সত্যিকারের জোড়া মানব মানবী ছিল,ম্যাজিকের মত ছিল তাদের মাঝে ক্যামিস্ট্রি! বাবা চলে যাওয়াতেই যেন মায়েরও আজ এই দশা…
এসব ভেবে ভেবে সেলিম ধীরে ধীড়ে গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তার আরেকটা মোড় ঘুড়ে।সামনেই হাসপাতাল।জাহিন আর জাফরিন দুজনেই যার যার স্কুল-কলেজে।সেলিম মাত্র অফিস থেকে ফিরছে।
মায়ের কাছে এসে কেবিনে প্রবেশ করে।চেয়ার টেনে পাশে বসে সবার আগে কপালে চুমু খায়।
“আসসালামু আলাইকুম মা।এখন কেমন আছো?”
জেসমিন হেসে ছেলেকে বুকে চেপে ধরেন।
“আলহামদুলিল্লাহ, তুই চলে এসেছিস,এখন ভাল আছি”
“নাকে একটা লিকুইড অক্সিজেনের পাইপ লাগিয়ে হাসাপাতালে সারাদিন একা একা বসে বসে যে কিভাবে বলো ভাল আছো আমি বুঝি না মা!”
“বাবা হ সন্তানের,সব বুঝবি।আর কে বলল আমি একা?এই যে আশেপাশে কত রোগী আছে,ওদের সাথে কথা বলে বলেই তো আমার সময় কেটে যায়!”
সেলিম ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায়। জেসমিনের ডান পাশের বেডে সেরেনা নামের ৬৮ বছরের এক বৃদ্ধা ছিল,গতরাতেও তাকে তার সন্তানদের সাথে কথা বলতে দেখেছে।কিন্তু আজ সে নেই।তার বদলে আরেকজন রোগী সেখানে চোখ বুঁজে পড়ে আছে।ওর বাম পাশের বেডে লুকাস নামের আরেকজন ছিল,লিভার সিরোসিস এর রোগী।সেও গতকাল এখান থেকে বেড ছেড়ে চলে গেছে।বলা যায় এই ঘরে আজরাইল,যমদূত দিনে কয়েকবার জান কবজ করে নিয়ে যায়।এখানে বসে মা কি গল্প করে,সেটা চিন্তা করতে গিয়েই সেলিমের মাথা গুলিয়ে আসে।তবুও মায়ের দিকে হাসিমুখে তাকায়।
“মা,তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে,জানো?”
জেসমিন ছেলের কথায় হেসে আধাপাকা চুলে হাত বোলায়।
“বাবার মত হয়েছিস,তাই না?তোর বাবা প্রথম যেদিন আমার মাথায় আধাপাকা চুল দেখল,তখন থেকে প্রতি সকালে আমাকে দেখেই বলত, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে! ও আমাকে বুঝতে দিতে চাইত না যে আমি বুড়ি হচ্ছি!”
“কে বলল তুমি বুড়ি হচ্ছো?তুমি মাত্র মধ্যবয়সে পা রেখেছ!”
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“হতে পারে আর সবার দৃষ্টিতে কিংবা পৃথিবীর সময়ের হিসাবে এরকমটাই,তবে আমার শরীরের মাঝে যে বার্ধক্য যেঁকে বসেছে,তা আমি খুব ভাল করেই বুঝি রে!”
সেলিম খাবারের বক্স খুলতে খুলতে বলে,
“কি যে সব কঠিন শব্দ ব্যবহার কর তুমি মা,আমি ধরতে পারি না!…একি!খাবার খাও নি কেন বল তো?!”
“তোর সাথে খাব বলে”
“প্রতিদিন এই এক কথা।বলি,আমাকে তো খেয়ে নিতে হয়,কিন্তু তুমি…”
“শোন,তোর বাবা নেই,বাবা থাকলে আমাকে এভাবে একা খেতে হত না।ও নেই,কিন্তু একা খাওয়ার অভ্যেস তো তবুও করতে পারলাম না…”
জেসমিন কাঁদছে।সেলিমের মায়ের চোখ দ্রুত মুছে দিয়ে মুখে খাবার গুঁজে দেয়।
“সরি মা,আমি বুঝিনি।আসলে বাবাকে তুমি খুব মিস কর বুঝি,কিন্তু দেখো,আমি,জিহান বা জাফরিন কেউ তোমার কাছে থাকতে পারি না”
“মন খারাপ করিস না বাবা,আমি ঠিক আছি।আগে অথবা পরে,সবাইকেই তো চলে যেতে হবে রে”
খাবার শেষে জেসমিন সেলিমের হাত ধরে পাশে বসায়।
“বাবা,আমি যদি মরে যাই,আমাকে মাফ করে দিস…”
“ছিঃ মা!তুমি কি বলছ এসব!ভুল তো আমরা করি,তুমি কেন আমার কাছে এভাবে মাফ চাচ্ছো??!”
“কি করব বল?কেন যেন মনে হচ্ছে আমার সময় শেষ”
“মা!”
সেলিম জেসমিনকে দুহাতে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।
“পাপা আমাকে ফেলে গেল,বাবাও চলে গেল,এখন যদি তুমিও চলে যাও…আমি কি করে থাকব মা?প্লিজ মা,আল্লাহকে বলো না,আমাকে যেন আর একা না করে,প্লিজ?!”
জেসমিন খুব অবাক হয়।সেলিমের বাবা জাফারকে ও পাপা ডাকত,আর ওদের একসময় আংকেল আন্টি থেকে বাবা মা ডাকতে শুরু করে।কিন্তু জাফারের মারা যাওয়ার অনেক বছর পর আজ সেলিম ওর কথা বলল।সেলিমের মুখ ধরে উপরের দিকে তোলে।
“তোর মনে আছে পাপার কথা?”
“সেভাবে মনে নেই,তবে আবছাভাবে মনে আছে।আমি এখন ঠিক পাপার মত দেখতে,তাই না মা?”
জেসমিন সেলিমের সারামুখে চোখ বুলায়।হ্যাঁ,ঠিক জাফার ভাই যেন ওর সামনে! মাথাভর্তি কোকড়া গাঢ় বাদামী চুল,রোদে পুড়ে চামড়ার রঙ বাবার মত হয়েছে অনেকটা,ছোট বেলায় মায়ের চেহারা ভেঙে গড়ে এখন বাবার মত পুরুষত্বপূর্ণ চেহারা হয়েছে,আর সেই বিখ্যাত নাক।জেসমিন ওর সারা মুখে হাত বুলায় আর কাঁদে।
“হ্যাঁ,ঠিক জাফার ভাইয়ের মত হয়েছিস তুই!”
“মা,পাপাকে আমি মনে করতে পারি না কেন?কেন পাপা আমাকে ফেলে এত চলে গেল?তোমাদের কাছে দিয়ে গেছে,কিন্তু কেন কিছু স্মৃতি আমার মনে রেখে গেল না ?”
জেসমিন মন খারাপ করে বলে,
“আমাকে মাফ করে দিস বাবা।তোর পাপা চলে যাওয়ার পিছে আমিই দায়ী”6
সেলিম যেন আকাশ থেকে পড়ে।
“কি বলছ মা!!!”
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria