#Journey
#৪১
জেসমিনের গোসল দেয়া শেষ।কয়েকজন জাফরিনকে বলেছিল মায়ের গোসলের সময় থাকবে কিনা,কিন্তু মাকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে পাগলামী শুরু করেছিল বেচারী,তাই সবাই মিলে আবার ওকে বের করে আনে।পৃথিবীতে মাকে হারানোর বেদনা সেই বুঝে যে হারায়।
যখন জেসমিনকে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়,তখন ওর দুই ছেলে,সেলিম আর জিহান দুজন খাটিয়ার প্রথম দুটো পা ধরে,দুজনেই অঝোরে কিন্তু নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে,ছেলে মানুষ যে,শব্দ করে কাঁদতে পারছে না! মাকে নিয়ে কবরস্থানের সেখানে যায় যেখানে ওদের বাবা,রাইফ সোবহান শুয়ে আছে।ওর মা চেয়েছিল যেন তার স্বামীর পাশেই তাকে দাফন করা হয়।মাকে পরম যত্নে ওরা শুইয়ে দিয়ে আসে,সাড়ে তিন হাতে মাটির নিচে শুধু একটুকরো সাদা কাপড়ে পেচিয়ে।দূর থেকে জাফরিন শুধু কাঁদে,মায়ের বেশি কাছে যাওয়ার অনুমতি যে ওর নেই!
মায়ের দাফন আর দুয়া শেষে তিন ভাই বোন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে,এমনকি সবাই চলে গেলেও।সেলিম দুপাশে দুই ভাই বোনকে আগলে ধরে রাখে।ও ভাবছে,চল্লিশ কদম দূরে গেলেই মায়ের পার্থিব জীবনের বিচার শুরু হবে,মার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?আচ্ছা,মাকে কি আল্লাহ মাফ করবে না?নীরবে আল্লাহকে বলতে থাকে,আমার মত অনাথকে জীবনে যা পাওয়ার কথা ছিল,তার সব দিয়েছে বলে সেজন্য হলেও মাফ করে দাও!
জিহান আর জাফরিনের দিকে তাকায়।ওরা নাকি ওর রক্তে ভাইবোন না?কে বলবে! অবশ্য ওরা জানে না,ওদের কি জানাবে?সেলিম ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খায় আর ভাবে, you guys are all I have!
পেছনে শুকনো ডাল ভাঙার শব্দে সেলিম ঘুরে তাকায়,রেবেকা আন্টি এসেছে।তাকে দেখে জাফরিন নতুন করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।রেবেকা
এখনও ভেনিসেই থাকে।জেসমিনের অসুস্থতার কথা শুনেছে কিন্তু সময় নিয়ে আসতে পারেনি।হুট করে জেসমিন মারা যাওয়ায় আজ সকালেই রওনা দেয়।ও কিছুটা সময় নিয়ে ওদের শান্ত করে,তারপর বুঝিয়ে নিজের সাথে গাড়িতে নিয়ে যায় বাসায় পৌঁছে দিবে বলে।সামনে জাফরিন বসে রেবেকার পাশে,সেলিম আর জিহান পেছনে।গাড়িতে বসে সবাই একটা কথাই ভাবতে থাকে,মাকে ছাড়া শূন্য ঘরে কেমন করে মন টিকবে?
রেবেকা ওদের বাসার সামনে ওদের ড্রপ করার জন্যে চলে এসেছে।সব শেষে সেলিম বের হতে চাইলে রেবেকা ওর হাত ধরে।
“তোমার জন্যে একটা জিনিস রেখে গেছে তোমার মা”
“আমার জন্যে?কি সেটা?”
রেবেকা একটা মলাট বাঁধা ডায়রী বের করে।ডায়রি হাতে নিয়ে সেলিম প্রশ্ন চোখে রেবেকার দিকে তাকায়।
“এটা তোমার মা অনেক আগে আমাকে দিয়েছিল।বলেছে,ও যদি মারা যায়,তবে এই ডায়রিটা যেন তোমাকে দেই,তার আগে না”
“ঠিক আছে।ধন্যবাদ আন্টি কষ্ট করে এটা রাখার জন্য”
“সেলিম,তুমি আমার ছেলের মত,আর জেস ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর লিস্টে সবার উপরের কয়েকটা নামের মাঝে একটা।ও চলে যাওয়াতে আমাদের সবার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।জেসের জন্যে আমি কিছুই করতে পারিনি।যদি কখনো আমাকে প্রয়োজন হয়,প্লিজ জানাবে।আমি সবসময় তোমাদের পাশে থাকব”
সেলিম মাথা নাড়ায়।রেবেকা চোখে পানি নিয়ে বলে,
“Your mom was the bravest lady ever. And she was always proud of you”
সেলিম হাসে।মা সবসময়ই অনেক ভালোবেসেছে ওকে।আচমকা প্রশ্ন করে,
“আমার পাপাকে…মানে জাফার নামে কাউকে চিনতেন?”
রেবেকা মাথা নাড়ায়।
“তোমার পাপা অনেক ভাল মানুষ ছিল,অনেক মজা করত।সেও তোমাকে অনেক ভালোবাসত”
“আচ্ছা,তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল জানেন কিছু?”
রেবেকা এক মুহূর্ত ভাবে।
“আমি যতদূর জানি,সেটা ভেনিসে।তবে কোথায় ঠিক বলতে পারছি না।”
“প্লিজ জানাবেন?আমার এক্ষেত্রে আপনার সাহায্য দরকার”
“আমি জানাব,কিছু সময় লাগবে,এই যা”
রেবেকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ও ঘরে ফিরে আসে।এরপর থেকে তিন দিন পেরিয়ে গেছে,সবার জীবন এখনো কিছুটা থমকে আছে।সকালে ঘুম ভেঙে মনে হয়,এই বুঝি মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে পাবে।রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হয়,এখনই হয়ত সেখান থেকে সুস্বাদু কিছু রান্নার ঘ্রাণ পাওয়া যাবে,সেই খাবার চুরি করতে গেলে মা ওদের দিকে চামচ নিয়ে দৌড়ে আসবে! মায়ের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বারবার কোন ছায়াকে মা বলে ভুল হয়, পরক্ষণেই খেয়াল হয়,সেখানে কেউ নেই,কিছুই নেই।
সেলিম কিছুদিন নিজেকে অফিসের কাজে ডুবিয়ে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করে,কিন্তু মাকে কখনোই ভুলে থাকা যায় না।সেলিম তাই একদিন রাতে মায়ের ঘরের এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সব দেখতে থাকে।সবকিছু একেবারে গোছানো,সেখানে কোন প্রকার নড়াচড়া নেই,কোন পরিবর্তন নেই।মায়ের বিছানায় বসে বসে সেখানে হাত বুলিয়ে কাঁদতে থাকে।এসমইয় খেয়াল হয় পাশের টেবিলে রাখা ডায়রীর দিকে।আরে,এটা রেবেকা আন্টির দেয়া সেই ডায়রীটা না?
সেলিম ডায়রী খোলে।সেখানে বাংলাতে কিছু লেখা আছে।সেলিম বেশ অবাক হয়,কারণ ওদের মাঝে শুধু সেলিমকেই জেস বাংলা পড়া ও লেখা শিখিয়েছিল জোর করে।জিহান বা জাফরিন কোনমতে বাংলা বতে পারে,কিন্তু লেখা বা পড়া ওদের শিখায়নি।এখানে সবকিছু বাংলাতে লিখা।তারমানে এটা শুধুই সেলিমের জন্যে?কিন্তু ওর মা ওকে কি বলতে চেয়েছিল?!হীরের ব্যাপারে নয় তো?!
সেলিম নিজের ঘরে গিয়ে পড়তে শুরু করে ডায়রীটা।
“প্রিয় সেলিম,যেহেতু তুই এটা পড়ছিস,তারমানে আমি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে এতক্ষণে চলে গিয়েছি।যেহেতু বাংলাতে লিখেছি,জানি পড়তে কষ্ট হবে,কিন্তু তোর বুঝে যাওয়ার কথা এতক্ষণে যে এটাই শুধুই তোর জন্যে লিখা।
জানি না তোকে বলতে পেরেছি কিনা মারা যাওয়ার আগে,আমি তোর জন্য অনেকগুলো আফ্রিকান হীরে রেখেছি যা তোর জীবনে তুই কাজে লাগাতে পারবি।তবে হীরে গুলো আমি অনেক চেষ্টা করেও এই দেশে আনতে পারিনি। বুঝতেই পারছিস,এগুলো এখানে নেই,তার মানে গুলো বাংলাদেশে আছে।
ভাবছিস,কেন এতকিছু?কারণ এই হীরে গুলোই দায়ী তোর পাপা,জাফার ভাইয়ের মারা যাওয়ার,তোর আজকের এই জীবনের।আমি জানি কিছুই তোকে দিতে পারিনি,তাই এই হীরেগুলো শুধু তোর জন্যে রেখেছি।কিছু আমরা কাজে লাগিয়েছি,অবশিষ্ট হীরে গুলো যা আছে,তা সব মিলিয়ে কয়েক মিলিয়ন ইউরোর সমমূল্য হবেই।
প্রশ্ন হচ্ছে,এগুলো এখন কোথায়?এত দামী জিনিস নিশ্চয়ই সাধারণ কোন যায়গায় থাকবে না,তাও আবার যেখানে এর জন্যে জাফার ভাইকে মরতে হয়েছিল! তার মানে কোথায়???
এই কোথায়ের প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে তোকে বাংলাদেশে যেতে হবে,তোর মামার কাছে। তোর মামা তোকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে।তবে হ্যাঁ,এগুলো পাওয়া মোটেই সহজ হবে না।আমি এগুলো লুকিয়ে রেখেছি এমন এক যায়গায় যা তোকে খুঁজে বের করতে হবে।
মনে আছে ছোট বেলা আমি তোদের ট্রেজার হান্ট খেলা খেলাতাম?বিভিন্ন ক্লু তৈরী করে তোদের দিয়ে দিতাম,তোরে খুঁজে খুঁজে এক এক করে ট্রেজারের কাছে চলে আসতি। এবারও ঠিক সেই খেলাটাই আমরা খেলব,তবে পার্থক্য থাকবে এই যে,তখন মিছিমিছি ট্রেজার থাকত,এবার থাকবে সত্যিকারের হীরে!
ভাবছিস,কেন আমি এত নাটক করছি?কারণ আমি চাই তুই তর প্রাপ্য অর্জন করে নে!হীরে এমনি পেলে তো দাম থাকবে না যা এই খেলার মাধ্যমে পাওয়ার পর থাকবে।তাহলে আমরা শুরু করি?
প্রথমেই তোকে যেতে হবে পাবনা জেলার সুজানগর গ্রামে।এই গ্রামে মাতবর আলী এক লোককে খুঁজে বের করতে হবে।লোকটা পাওয়া খুব সহজ না,তবে মন থেকে খুঁজলে তাকে পাওয়া কঠিন কিছুও না! আর ওকে বের করাই তোর প্রথম ক্লু!
দ্বিতীয় ক্লু হচ্ছে মাতবর আলীর কাছে।সে যেই ক্লু তোমাকে দিবে,খবরদার সেটা অনুসরণ করবে না! সেখানে যা বলা হয়েছে,ঠিক তার উল্টো করবে!
তৃতীয় ক্লু তুই যখন পাবি,তখন দুই আর তিন নাম্বার ক্লু পাশাপাশি রাখবি।তিন নাম্বার ক্লু এর প্রথম শব্দ আর দুই নাম্বার ক্লু এর শেষের শব্দ নিয়ে যে স্থানের নাম পাবি,সেই গ্রামেই আছে চার নাম্বার ক্লু।কিন্তু কার কাছে আছে?সেটা বের করতে হলে তিন নাম্বার ক্লু ভালো করে পড়তে হবে,সেখানেই নামটা বলা আছে।এক্টু খেয়াল করে বের করতে হবে বৈকী!
পঞ্চম ক্লু চার নাম্বার অনুযায়ী কয়েকটা কাজ করলেই পাওয়া যাবে।আর ধীরে ধীরে এই ক্লুগুলো তোকে হীরের কাছে নিয়ে যাবে!
শেষ একটা কথাই বলব,এই হীরে গুলো শুধুই তোর,তুই এদের নিয়ে যা ইচ্ছা করতে পারিস।তবে আমি জানি,তুই কখনোই ভুল কিছু করবি না!
আরেকটা কথা সবসময় মনে রাখবি, Your own mother,me, your own father and my husband,we always loved you and will love you till end!”
সেলিম ধপ করে ডায়রী বন্ধ করে। তার মানে এখন ওর জার্নি করতে হবে হীরের জন্যে! May be the last journey for the diamonds!!!
লেখনীতে, #AbiarMaria