#Journey
#৪২
জেসমিনের মারা যাওয়ার তিন সপ্তাহ কেটে গেছে।তিন ভাই বোন অনেকটাই সামলে উঠেছে।তবে সেলিমের বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে করতে বেশ সময় লেগে গেছে।অফিসের সব কাজ গুছিয়ে ছুটি ম্যানেজ করা এতটা সহজ হয়নি।
আজ সেলিম লাগেজ গোছাচ্ছে,বাংলাদেশে যাওয়ার ফ্লাইট আজ কয়েক ঘন্টা পর।কি কি নেয়া হয়নি সেসব গালে আঙুল দিয়ে ভাবছে।ভাবতে ভাবতে খেয়াল হয়,আসল জিনিটাই নেয়া হয়নি,ডায়রী! কাপড় চোপড় সব সরিয়ে খুঁজতে থাকে,গেল কোথায় ডায়রীটা? টেবিলের গোছানো বই খাতা সব এলোমেলো করে ফেলে,কোথাও নেই।খাটের নিচে উঁকি দেয়,সেখানেও অতা নেই।ডায়রী ছাড়া তো কিছুই করা যাবে না। ডায়রী নিতে কি কেউ এসেছিল?!
এই সময় পেছন থেকে জিহান আর জাফরিন ঢোকে,জাফরিনের হাতে ডায়রিটা।সেলিম চুপ করে উঠে দাঁড়ায়।জিহান এসময় অর কাছে আসে।জাফরিনের কাছ থেকে ডসায়রিটা নিয়ে বলে
“ভাইয়া,এটা মনে হয় তোমার ডায়রী”
“হুম,কোথায় ছিল এটা?”
“ডাইনিং টেবিলের উপর।কিন্তু এখানে বাংলায় কি কি যেন লিখা!তুমি লিখেছ?”
“হুম আমিই,ঐ যে বাংলাদেশের ঠিকানা গুলো, কোথায় কোথায় কিভাবে যাব,এসব।থ্যাংকস”
“আচ্ছা, তুমি যে একা যাচ্ছো সমস্যা হবে না?”
“আমার আবার কি হবে!”
জাফরিন বলে,
“দেখ ভাইয়া,বাবা,মা দুজনেই নেই,তুমিও চলে যাচ্ছো।আমরা দুইজন থাকব কিভাবে এই বাসায়?!”
“সমস্যা হলে বন্ধুদের সাথে হ্যাং আউটে যা,ঘুরতে যা! এত চিন্তার কিছু নেই।বাসা থেকে বের হলে বরং ভালো লাগবে তোদের।আর তাছাড়া আমার খুব বেশিদিনের জন্য যাচ্ছি না,খুব দ্রুতই ফিরে আসব।You guys make a plan,go out,have fun, don’t ruin just because I’m away!”
দুই ভাই বোন সেলিমকে জড়িয়ে ধরে।এমনিতে যতই বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরুক,ওরা দুজনেই পরিবারের প্রতি খুব দুর্বল।বিশেষ করে বাবা মাকে হারিয়ে দুজনেই এখন বড় ভাইয়ের উপর নির্ভর করছে।আর সেলিমও সমস্তটা দিয়ে সবসময় ওদের আগলে রেখেছে।তবে এখন কিছুদিন দূরে থাকতে হবে,এই যা।
সব গুছিয়ে সেলিম ফ্লাইটের জন্যে বের হয়।ওরা দুজন ওর সাথে এগিয়ে দিতে আসে।জিহান গাড়ি ড্রাইভ করছে,সেলিম পাশে আর জাফরিন বসেছে পিছে।এয়ারপোর্টে পৌঁছে টিকেট,পাসপোর্ট আর ভিসার সব পেপারস চেক করে আরেকবার।
“বাংলাদেশে পৌঁছাতে কত ঘন্টা লাগবে?”
“৮ ঘন্টা ৪৫ মিনিট”
“তার মানে তোমার সাথে আবার যোগাযোগ হবে এতক্ষণ পর?!”
“হুম,কিছু করার নেই”
জাফরিন হুট করে কোন আগাম বার্তা ছাড়াই কেঁদে ফেলে হাউমাউ করে সেলিমকে জড়িয়ে ধরে। সবার ছোট হওয়ার সুবাদে দুই ভাইয়ের প্রচুর আদর পেয়েছে।ভাইকে এভাবে চলে যেতে দেখে খুব খারাপ লাগছে,যদি নিজেকে নিজে বারবার বুঝ দিচ্ছে এই বলে যে ভাই কিছুদিন পরেই চলে আসবে,তবুও বুকের ভেতরটা বারবার মোচড় দিচ্ছে।সেলিম দুজনকে শান্ত করে ইমিগ্রেশনের ভেতর চলে আয়।যতক্ষন ওদের দেখা যায়,ততক্ষন ঘুরে ঘুরে ওদের দেখে আর হাত নাড়ায়,আগে অনেক বার দেশের বাইরে যাওয়া হলেও এর আগে কখনো নিজের কাছেই এত অস্থির লাগে নি।যতবার ওদের দেখে,ততবার দেখে ওরাও ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখে যখন চোখের আড়াল হয়,তখন থেকেই খারাপ লাগা শুরু হয়।কে জানে বাংলাদেশে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে!
পর ৮ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের জার্নি শেষ করে ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখে।এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছে।ফোন বের করেসবার আগে জিহানকে একটা টেক্সট করে।তারপর ডায়াল করে ওর মামা,আলআমিন আয়াজের নাম্বারে।উনারই ওকে রিসিভ করতে আসার কথা। ফন রিসিভ করার পর উনি জানান উনার ব্যস্ততার কারণে আসতে পারছেন না,তাই তার ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগ করে সেলিম লাগেজ নিয়ে গড়িতে উঠে বসে।
৪০ মিনিট পর গাড়ি এসে পৌঁছায় গাজীপুরের শান্তিবাগ এলাকার এক শান্ত তিনতলা বাড়ির সামনে।বাড়িটা এককালে ইন্ডিগো রঙের ছিল,এখন ঝড় বাদলে যায়গায় যায়গায় রঙ উঠে গেছে।বাড়ির সামনে ছোট একটা উঠোনের মত আছে,সেখানে কিছু ফুল ফলের গাছ লাগানো।এখানকার পরিবেশটা এত চুপচাপ কেন সেলিম তাই ভাবতে থাকে।এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরের ভেতর ড্রাইভারের পিছে পিছে প্রবেশ করে।দরজা খুলে দেয়। দশ বারো বছরের একটা মেয়ে।সেলিম বুঝে না কি বলবে,তার আগেই ড্রাইভার বলে,
“চুমকি,বড় সাবরে ডাইকা দে,ক যেন খালারর পোলায় আইছে।আর এই ধর ব্যাগ,সাবধানে ল।এইডারে নিয়া যা।ভাইজানরে লইয়া যা ভিতরে,শরবত দে”
চুমকি ইশারায় সেলিমকে ভেতরে আসতে বলে।সেলিম বাসাটা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে ওকে অনুসরণ করে।মেয়েটা ওকে একটা লিভিং রুমে বসিয়ে রেখে ফ্যান ছেড়ে দেয়।চারপাশটা কেমন যেন ভেজা ভেজা গরম।সেলিম এর মাঝেই ঘেমে গেছে।টিশার্টের ভেতর থেকে ঘামের গন্ধে নিজেরই বিরক্ত লাগছে।ব্যাপার কি,এই বাসার মানুষগুলো কোথায়?
ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন মাঝবয়সী মহিলা পর্দা ঠেলে সেখানে প্রবেশ করে।সেলিম তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।
“তুমি সেলিম,তাই না?”
“হ্যাঁ”
“আসলে আমরা বাংলা ছাড়া ইংলিশ পারি না,তুমি বাংলা পার তো?”
সেলিম মাথা নাড়ায়।
“আচ্ছা।আমি তোমার মামী”
সেলিম তাকে সালাম দেয়।
“দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো বসো! এই চুমকি,লেবুর শরবত নিয়ে আয়!তাড়াতাড়ি! বাবা,তোমার গরম লাগছে বুঝি?”
“না,ঠিক আছি”
“আমি তো দেখতে পাচ্ছি ঘেমে গেছ।এক কাজ কর,শরবত খেয়ে গোসল করে আসো।চুমকি তোমাকে রুম দেখায় দিবে।তোমার মামা এখনো আসে নাই।আসুক,তারপর কথা বলবা,ঠিক আছে?”
সেলিম মাথা নাড়িয়ে বসে থাকে।
নাস্তা করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় ধপ করে বসে।
এই দেশটা কেমন যেন!লেমোনেডটা খারাপ না,কিন্তু এটাকে শরবত বলে কেন?চিনি মেশালেই শরবত হয়?তবে খাবার দাবার যাই হোক,বাথরুমের কোন গরম পানি নেই,সব ঠান্ডা! ওর তো সাইনাসের সমস্যা আছে,যদিও গোসল করার এখন একটু শান্তি লাগছে।বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে সেলিম ভাবে, মামা ওকে সাহায্য করবে তো?
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria