#অব্যক্ত ভালোবাসা
পর্ব :২০
🍁
মেহবিন খুব সাবধানে পা টিপে টিপে মাইজার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।মাইজার ঘরের দরজা কখনো লক থাকে না।সবসময়ই সামান্য ভেরানো থাকে।মেহবিন হালুয়ার বাটি হাতে নিয়ে ভেরানো দরজা খুলে দিল।সে ঘরে প্রবেশ করতেই নজরে পড়ে মাইজার উদাস চেহারা।মাইজা পড়ার টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে।মেহবিন ধরতে পারছেনা মাইজার এমন অদ্ভুত আচরণের কারন।মেহবিন গিয়ে মাইজার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে।মেহবিন পাশে বসাতেও মাইজার কোনো হেলদোল নেই।সে হয়ত বুঝতে পারেইনি যে ওর ঘরে কেউ একজন প্রবেশ করেছে।মেহবিন মাইজার মাথায় হাত রেখে আলতো সরে ডাক দিল-
-”’মাজা।
মাইজা চোখ মেলে তাকাল মেহবিনের পানে।মাইজার কেনো জানি মেহবিনকে দেখে রাগ লাগছে খুব।যার কারন তার নিকট অজানা।সে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলল-
-”কেনো এসছিস?
মেহবিন একটু অসহায় ভঙ্গিতে বলল-
-”এমন করছিস কেন বল তো।দেখ আমি তোর জন্য কি আনছি।তোর পছন্দের গাজরের হালুয়া।
মাইজা মেহবিনের হাতের দিকে তাকাতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।গাজরের হালুয়া যে তার খুবই পছন্দের। এই একটা দুর্বলতা যার কারণে ওর সমস্ত রাগ নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে হালুয়ার বাটি নিতে গিয়েও মাইজা থেমে গেল।সে হাত সরিয়ে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল।তারপর কাঠ কাঠ কন্ঠে প্রত্যাহার করে বলল-
-”খাব না।
মেহবিন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।মাইজা গাজরের হালুয়া প্রত্যাক্ষান করছে।এই দিন ও তার দেখার ছিল।মেহবিন এইটুকু বুঝতে পারল যে যে কারণেই রাগ করুক না কেন,রাগের ধরণটা খুবি প্রখর।নাহলে এই মেয়ে কখনোই গাজরের হালুয়া খাব না বলত না।মেহবিন তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে-
-”এমন রাগ করিস না।দেখ তোর ক্রাস কিন্তু নিজ হাতে এটা তোর জন্য বানিয়েছে।তুই না খেলে কিন্তু এটা ওনার জন্য ঘোর অন্যায়।
মাইজা বুঝতে না পেরে বলল-
-”’ক্রাস মানে?কার কথা বলছিস?
মেহবিন এবার বিরক্ত হলো।ওর বরাবরই একটু ধৈর্য কম।এতক্ষণ ধরে যে বোঝাচ্ছে ওকে এই ঢের।মাইজা কে একটা কিল লাগাতে ইচ্ছা করছে এখন।এমন ভাব করছে যেন তার ভরি ভরি ক্রাস।সে একটু ব্যাঙ্গ করেই বলল-
-”এহহহ কোন ক্রাস?তোর কয়টা ক্রাস রে।মায়ান ভাইয়ের কথা বলছি মুখপুরি।
মাইজা অবাক হয়ে মুখটা হা করে বলল-
-”মায়ান ভাই আমার জন্য হালুয়া বানিয়েছে।আই কেন্ট বিলিভ!
-”বিলিভ না করলেও এটাই সত্যি।তোর মন খারাপ শুনে নিজ হাতে বানিয়ে আমাকে দিয়ে পাঠালো।বলল এটা খায়িয়ে তোর মন ভালো করতে।প্লিজ আর মন খারাপ করে থাকিস না।
মাইজার মন খুশিতে নেচে উঠল।সব মন খারাপ নিমিষেই জানলা দিয়ে উড়ে পালিয়ে গেল।সে হালুয়ার বাটা নিয়ে এক চামচ মুখে পুরে চোখ বুজে ফেলে।তার কাছে মনে হচ্ছে সে কোনো অমৃতর স্বাদ নিচ্ছে।মেহবিন মাইজাকে খেতে দেখে একটু স্বস্তি পেল।তারপর মুখ লটকিয়ে বলল-
-”দেখ মায়ান ভাই বানালে ও গাজরটা কিন্তু আমার বাসার।তাই তোর আমাকেও ক্ষমা করে দেওয়া উচিত।যদিও আমি জানি না আমার দোষ কি তাও।কি ভেঙেছে আপনার রাগ?
মাইজা বাটি টা টেবিলে রেখে এক হাতে মেহবিনকে পাশ থেকে জরিয়ে ধরে বলল-
-”’হালুয়া খেয়ে সব রাগ উধাও।তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই এখন।
মেহবিন ও খুশি হয়ে মাইজাকে জড়িয়ে ধরল।যাক অবশেষে এই মান অভিমানের চাপ্টার ক্লজ।
————
দিন গড়িয়ে প্রায় দুই মাস কেটে গেলো।এই দুই মাসে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি কারোর মাঝে।সবাই সবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত।মেহবিন আর মায়ানের সম্পর্কটা এখন বন্ধুসুলভ।মাইজার সাথেও মায়ান যথেষ্ট ভালো আচরন করে।যার দরুন মাইজার মনে মায়ানের প্রতি দুর্বলতা বেড়েই চলেছে।মনে মনে মায়ানকে নিয়ে নানান রকম জল্পনা কল্পনা শুরু করছে।আর মেহবিন ও মায়ানের সাথে বেশ মিশে গিয়েছে।মায়ানের কাছাকাছি থাকলে তার ভিতর অজানা অনুভূতি কাজ করে।যেই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত নয়।মায়ান মাঝে মাঝে তার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেই তাকানোতে মেহবিন মুহূর্তের মধ্যেই নেতিয়ে পড়ে।মেহবিন আর মাইজাদের ক্লাস টেস্ট শেষ হয়েছে দুইদিন হলো।স্কুল সপ্তাহ খানেকের জন্য ছুটি দিয়েছে।অথচ ওরা এই দুইদিনই বাসায় থেকে হাপিয়ে উঠেছে।বাসায় কোনোভাবেই ওদের মন টিকছে না।মেহবিন দিনের অর্ধেক সময়ই এখন মাইজাদের বাসায় কাটায়।মেহবিন আর মাইজা খাটে পা গুটিয়ে বসে লুডু খেলছিল।এই নিয়ে চারবার হলো মেহবিন হেরে গিয়েছে।এবারেও গুটি ফেলতেই সোজা গিয়ে পড়ে সাপের মুখ বরাবর।মেহবিন মাইজার দিকে তাকিয়ে দেখে মাইজা মুখ টিপে হাসছে।এই হাসি দেখে মেহবিনের গা জ্বলে ওঠে।সে লুডুর কোট টা ফেলে দিল নিচে।তারপর মাইজার উপর উঠে এলোপাথাড়ি কতকগুলি চড় থাপ্পর মারল।
-”তুই চিটিং করিস এইজন্য হারতাছি বারবার।
মাইজা হাসতে হাসতে বলল-
-”আমি চিটিং করছি কেমনে।এটা তে আবার চিটিং কেমনে করে বল তো।তুই তো বারবার সাপের গর্তে পড়ছ।ইসমে মে কেয়া করুওওও?
বলেই আবার হাসতে লাগল।মেহবিন আরো কয়েকটা মাইর লাগিয়ে তারপর বলল-
-”যাহ আর খেলমুই না।
বলেই হনহনিয়ে রুম থেকে চলে গেল।মেহবিন রাগে গজগজ করতে করতেই রাফিজের রুম ক্রস করে থেমে গেল।রাফিজের রুমের পাশে মায়ানের রুম।মায়ানের রম টা গেস্ট রুম ও বলা চলে।মেহবিন এসেছিল এর আগেও এই ঘরে।কিন্তু অজ কেন জানি এই ঘরে আবার যেতে ইচ্ছে করছে।মায়ান কি করছে ঘরে সেটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।সে নিজের ইচ্ছা কে দমাল না।মেহবিন পা ফেলে মায়ানের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে।দরজা একটু ধাক্কা দিতেই খুলে যায়।দরজা লক না দেখে মেহবিন একটু খুশি হলো। সে দরজা একটু ফাক করে রুমে উকি দিল।নাহ রুমে তো কেউ নেই।সে বেলকনির দিকেও মাথা উঁচু করে দেখল।নাহ সেখানেও তো নেই।মেহবিন এবার দরজা একদম মেলে দেয় ওয়াশরুমের দরজাটও অফ।মেহবিন এবার সিউর হলো যে রুমে কেউ নেই।মেহবিন কি ভেবে যেন ঘরে প্রবেশ করল।ঘরে ঢুকতেই মেহবিনের চোখ জুড়িয়ে গেল।মেহবিন আনমনেই বলল-
-”বাহ কি গোছানো ঘর।আসলেই অনেক পরিপাটি।
মেহবিন ঘুরে ঘুরে পুরো রুম দেখতে থাকে।তার কাছে এই পুরোনো চেনা ঘরটাও আজ নতুন লাগছে।মেহবিন ঘুরে এসে বেডের সাইড টেবিলে তাকিয়ে দেখে মায়ানের মোবাইল টা এখানেই।মেহবিন বুঝতে পারল না নিজের ফোন রেখে কোথায় গেলো মায়ান।মেহবিনের হঠাৎই মনে ইচ্ছা জাগে মায়ানের ফোনটা দেখার জন্য।কি আছে এই ফোনের ভিতর যে সে এই ফোনেই সারাদিন মুখ ডুবিয়ে থাকে।মেহবিন আগ্রহ নিয়ে ফোন হাত নিয়ে ওপেন করে দেখে পাসওয়ার্ড দেওয়া।মেহবিনের মনক্ষুন্ন হলো।সে কত আশা করেছিল এই ফোনে কি আছে সেটা দেখবে।কিন্তু এখন কি করবে।তবে মেহবিন দমে যায়নি।ও আন্দাজেই কতগুলো হাবিজাবি পাসওয়ার্ড দিয়ে ট্রাই করছে।আর তখনই আচমকা জোরে বাইরে কিসের যেন মাইকিং করল।মেহবিন পাসওয়ার্ড খোলায় এতো ই ডুবে ছিল যে আচানক শব্দে মেহবিনের হাত ফসকে ফোন টা নিচে পড়ে যায়।মেহবিন বিষ্ফোরিত চোখে তাকায় ফোনের দিকে।ইতোমধ্যে ফোনের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এদিক সেদিক ছিটকে পড়েছে।মেহবিন কলিজা লাফানো শুরু করে সে।এটা কি করলো।এত দামি মোবাইল ভেঙে ফেলল।মোবাইল টা মায়ানের ভীষণ পছন্দের ছিল।এখন একদম সিউর যে মায়ান ওকে এবার ছাদ থেকে ফেলে দিবেই এতে কোনো মাফ নেই।
-”এখানে কি করছো?
মায়ানের গলার আওয়াজ পেতেই মেহবিনের ভিতর ধিরিম ধিরিম করতে লাগল।মেহবিন ভয়ে ভয়ে মায়ানের দিকে ঘুরে তাকালো।মায়ান তাকিয়ে আছে তার ভেঙেচুরে যাওয়া ফোনটার দিকে।তারপর চোখ তুলে মেহবিনের দিকে তাকাল।মায়ানের দৃষ্টি শান্ত।কিন্তু এই শান্ত চাহনি মেহবিনের ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ হারে।মায়ান শান্ত কন্ঠেই বলল-
-”ভেঙে ফেললে?
মায়ানের শান্ত কন্ঠ শুনে মেহবিনের পরান পাখি উড়ু উড়ু করছে।সে মুখ ফুটে কিছু বলবে তার আগেই মায়ান কে তার দিকে এগোতে দেখে একেবারে আকাশ থেকে পড়ে মাটির শেষ স্তরে ঢুকে গেল।মায়ান যত আগাচ্ছে মেহবিন তত পেছোয়।পেছোতো পেছোতে খাটের সাথে বারি খেয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ে।মেহবিন আরেকটু পেছোবে তার আগেই মায়ান মেহবিনের দুপাশে হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে গেলো।মেহবিন হকচকিয়ে গেল।মায়ান কে এত কাছে দেখে চোখের সামনে সব ঘোলা লাগছে।মায়ান আবারও শান্ত কন্ঠেই বলল-
-”প্রথম টার শাস্তিই তো এখনো দিলাম না।এর মধ্যেই আবার আরেকটা শাস্তি পাওয়ার কাজ করলে।আমার ফেভারিট ছিল এটা।ভেঙে দিলে।এবার তো শাস্তি দেওয়াই উচিত।কি রেডি তো শাস্তির জন্য?
শাস্তির কথা শুনে মেহবিনের মাথা ঘুরে গেলো।মায়ানের কোমল ব্যবহারে সে তো এই শাস্তির কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল।কিন্তু এখন মনে পড়ায় পুরোনো ভয় টা আবারো ঝেকে বসে।এবার আর রক্ষা নেই।মেহবিন আর না পেরে কেদেই দিল।তাও যেমন তেমন কান্না নয়।একদম ভ্য ভ্য করে কেদে দিল।হঠাৎ এভাবে কেদে দেওয়ায় মায়ান তাজ্জব বনে গেল।সে ভাবতেও পারে নি যে মেহবিন এতোটা ভয় পাবে যে কেদেই দিবে।মায়ান পূর্ণ নজর মেলে তাকাল তার পিচ্চির দিকে।মেহবিন কোনোদিক না তাকিয়েই কেদেই চলেছে। মায়ান খানিক হাসল।তারপর বিরবিরিয়ে বলল-
-”আমার ভীতুরানি।
মায়ান মেহবিনের দুপাশ থেকে হাত সরিয়ে হাটু ভেঙে তার সামনে বসল।তারপার এক হাত দিয়ে মেহবিনের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্য হাত দিয়ে মেহবিনের চোখ মুছে দিয়ে এক গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল-
-”ভয় পেয়েছো?বেশি ভয় পায়িয়ে দিলাম।এই দেখো মায়ান সরি বলছে।রিয়েলি ভেরি সরি।আমি অতটাও পাষান না যে এই সামান্য ফোনের জন্য আমার পিচ্চি কে শাস্তি দিব।নেভার এভার।
মেহবিন অবাক নয়নে তাকায় মায়ানের মুখপানে।মায়ান মেহবিনের বেবি হেয়ার গুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে কোমল কন্ঠে বলল
-”Nothing is more valuable than my little one❤
চলবে…….