#অব্যক্ত ভালোবাসা
পর্ব :২৩
🍂
———
সিলেটে ট্রেনে করে যাওয়াটা মায়ানের কাছে আহামরি কিছু না।কিন্তু মেহবিন আর মাইজার কাছে এটা নতুন ।ভোর ভোর সবাই রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছেছে।বাড়ির বড়দের সবাই ট্রেনে যাওয়া নিয়ে ঘোর আপত্তি করলেও পরে মায়ান ব্যপারটা ম্যানেজ করেছে।একদিন ট্রেনে চড়ে গেলে কিছু হবেনা।ওরা একটু মজা পাবে।তারপরও যখন রাজি হচ্ছিল না তখন মায়ান সিলেট যাবে না বলে দেয়।গেলে ট্রেনে করেই যাবে নয়ত না বলে বেকে বসে।শেষে মায়ানের না যাওয়ার কথা শুনে সবাই রাজি হলেও মনে মনে এটা নিয়ে দ্বিধায় আছে।মেহবিনের বমির সমস্যা আছে।সেই নিয়ে সবাই একটু চিন্তিত।অবশেষে হার মেনে নিয়ে সব চিন্তা বিসর্জন দিয়ে ট্রেনে চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
এখন সকাল ৬ টা।ঢাকা সিলেট রুটের পারবত এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে ছাড়বে সকাল ৬ টা ৩৫ মিনিটে।যথাসময়ে ট্রেন এসে উপস্থিত হয়।
সিলেট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি, সবুজ চা বাগান,পাহাড়,নদী,ঝর্ণা, টিলা আর দিগন্ত জোড়া সবুজ বৃক্ষ,নীল আকাশের নিচে অপরূপ মায়াবি আভা সিলেটকে করেছে রূপের রানী।এ সৌন্দর্য আরো নতুনরঙের আলাপন যেকোনো ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে সিলেট স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। ট্রেন চলতে শুরু করেছে।মেহবিনের কাছে সবকিছু ভালো লাগছে।সে আর মাইজা একসাথে বসেছে। সিলেটে এখনও পৌছায়নি ।অথচ মেহবিন এখনি সিলেটের ঘ্রাণ পাচ্ছে।চা পাতার সুগন্ধ যেন মেহবিনকে এখনি মাতোয়ারা করে ফেলছে।মেহবিন চোখ বন্ধ করে আছে।চোখ বন্ধ করেও সে সবকিছু অনুভব করতে পারছে।ট্রেনের শব্দ,মৃদুমন্দ বাতাস সবকিছু সে চোখ বুজেই বুঝতে পারছে।ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসির রেখা ফুটে আছে।মাইজা তখন বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত।সে অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।তার কাছে সব নতুন নতুন লাগছে।মাইজা মোবাইল বের করে ফটাফট কয়টা ছবি তুলে নিল।মাইজা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল।মাইজা মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল মায়ানকে।মায়ান তার অনুরোধ রাখতে এতসব করেছে।তবে কি মায়ানও তার প্রতি দুর্বল।এসব উল্টো পাল্টা ভেবেই মাইজা লাজুক হাসে।মেহবিন এখনো চোখ বন্ধ করে আছে।তার ঠোটের হাসি আরো প্রসারিত হচ্ছে।মেহবিন বিশ্বাস করে নিল যে যেকোন নতুন অভিজ্ঞতা মনকে প্রফুল্ল করতে সক্ষম।কিন্তু মেহবিনের হাসি বেশিক্ষন রইল না।আচমকা মেহবিন পেট চেপে ধরল।ঠোটের হাসি গায়েব হয়ে গেল।চেহারার সেই উৎফুল্লতা সরিয়ে মেহবিন চোখ মুখ কুচকে ফেলল।আচানক মেহবিনের পেট ব্যাথা করছে।কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠছে।মেহবিন ব্যথায় পেটে হাত রেখে মৃদু চিৎকার দিয়ে আহ করে উঠে। চিৎকারে মাইজা হকচকিয়ে তাকাল মেহবিনের দিকে।মেহবিনকে এভাবে পেট চেপে বসে থাকতে দেখে মাইজা ফাল মেরে জানলার পাশ থেকে সরে মেহবিনের কাছে বসে চিন্তিত হয়ে বলে-
-”কি হয়েছে।পেট চেপে আছিস কেনো?পেট ব্যাথা করছে?
মেহবিন পেট চেপে রেখেই মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানায়।মাইজা আতঙ্কিত গলায় বলে-
-”এমন হচ্ছে কেনো?সকালে কিছু খেয়েছিলি?
-”নাহহ
মেহবিন অস্ফুট স্বরে জানাতেই মাইজা দিশাহারা হয়ে পড়ে।মেহবিনের জার্নিতে যে কত সমস্যা হয় সেটা মাইজার থেকে ভালো কেউ জানেনা।মাইজা ব্যাগ থেকে পানি বের করে তড়িঘড়ি করে মেহবিনকে দিয়ে বলল-
-”পানি খা মেহু।ভালো লাগবে হয়তো।
মেহবিন পানি নিয়ে এক ঢোক খেতেই মুখ ভরে বমি করে দিল জানলার বাইরে।মাইজা দ্রুত মেহবিনের মাথা চেপে ধরে।মেহবিনের দুর্বল লাগছে অনেক।মেহবিন চোখ বন্ধ করে আবারো সিটে হেলান দিয়ে বসে।মাইজা আতকে উঠে মেহবিনের চেহারা দেখে।মাইজার ভীষণ মায়া লাগছে মেহবিনের জন্য।মাইজা কিছু ভেবে বলে-
-”’মেহু বস একটু।আমি আন্টি কে ডেকে আনি।
বলে উঠতে নিলে মেহবিন মাইজার হাত টেনে দুইদিকে মাথা নেড়ে বলে-
-”না বলিশ না।আমার এই অবস্থা দেখলে আম্মু এখন অযথা চিল্লাচিল্লি করবে।
মাইজা কি করবে বুঝতে না পেরে মেহবিনের মাথা চেপে বসে থাকে।এরমধ্যেই মেহবিন আবারো বমি করে দিল।মাইজা অস্থির হয়ে গেল।সে আর বসে থাকতে পারল না।সিট থেকে উঠে মাইজা বেরিয়ে পড়ে।উদ্দেশ্য ওর আম্মু কে ডাকা।মাইজাদের দুই সিট পিছেই মিসেস রুনা আর মিসেস রুকাইয়া বসেছেন।মাইজা এক সিট পেরুতেই মায়ানের সাথে দেখা হয়ে গেলো।মায়ান মাইজার চেহারায় অস্থিরতা দেখে জিজ্ঞেস করল-
-”এনিথিং রং মাইজা?এমন লাগছে কেনো তোমাকে?
মাইজা উত্তেজিত হয়ে বলে-
-”মেহু বারবার বমি করছে মায়ান ভাই।আমার খুব ভয় লাগছে।তাই আম্মুকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।
মায়ান সব শুনে একটু চুপ করে থেকে বলে-
-”কাউকে ডাকতে হবেনা।এখন ওনাদের বললে শুধু শুধুই হাইপার হবেন।তুমি রাফিজের কাছে যাও।আমি মেহবিনকে দেখছি।
-”আপনি কি করবেন ভাইয়া?
-”দেখছি কি করা যায়।তুমি রাফিজের কাছে গিয়ে বস।
মাইজার কেনো জানি মেহবিনের সাথে মায়ানকে একা রাখতে ভালো লাগল না।সে মিনমিন গলায় বলল-
-”আমিও যাই আপনার সাথে?
মায়ান মাইজাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল-
-”আসতে হবেনা।তুমি তোমার ভাইয়ের কাছে গিয়ে বস।
মায়ান চলে গেলো।মাইজা নিজেও রাফিজের কাছে চলে যায়।
মেহবিন চোখ বন্ধ করে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে।পাশে কাউকে বসেছে টের পেতেই মেহবিন দুর্বল গলায় বলল-
-”কেনো বলতে গেলি বলতো।এখন শুধু শুধু চিন্তা করবে।
মায়ান মেহবিনের দিকে পানি এগিয়ে দিয়ে বললো-
-”এই মেডিসিন টা খেয়ে নেও।
মায়ানের গলা পেয়ে মেহবিন চোখ খুলে তাকায় মায়ানের দিকে।মায়ানকে দেখে অবাক হয়ে বলে-
-”আপনি এখানে কখন এলেন।
-”মাত্রই।তুমি এই ঔষধ টা খাও।
মেহবিন মায়ানের হাতে ঔষধের দিকে তাকিয়ে বলল-
-”কিসের ঔষধ এটা?
মায়ান মেহবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো-
-”আমার উপর বিশ্বাস আছে?
মেহবিন আর কোনো কথা বললোনা।মায়ানের হাত থেকে ঔষধ নিয়ে খেয়ে নিল।মায়ান মুচকি হেসে পানি নিয়ে ব্যাগে রেখে দিল।মেহবিন আবারো চোখ বন্ধ করে নিল।চোখ বুজতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল তাকে।মেহবিন আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগল ঘুমের রাজ্যে।পুরোপুরি ঘুমানোর আগে এইটুকু টের পেলো কেউ তাকে পরম যত্নে নিজের বাহুডোরে আগলে নিল।মেহবিনো পরম আবেশে উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে জড়িয়ে নিল।মায়ান পরম যত্নে মেহবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
——–🍂
মিস্টি রোদের আলো চোখে পড়তেই মেহবিন চোখ কুচকে ফেলল।এত সুন্দর ঘুমটা নষ্ট হওয়াতে বিরক্ত হলো।মেহবিন পিটপিট করে চোখ মেললো।জানলা দিয়ে বিকেলের রোদের ঝলক চোখে পড়ছে।মেহবিন জানলা থেকে চোখ সরিয়ে আবার চোখ বন্ধ করল।তারপর ফট করেই চোখ তুলে তাকাল।নিজের দিকে তাকিয়ে তার অবস্থান বুঝতে চেষ্টাকরল।মেহবিন আস্তে করে চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল।
পাশে তাকাতেই মায়ানের চেহারাটা সামনে দেখতে পেলো।মেহবিন মায়ানের দিকে তাকাতেই নিজের অবস্থান টের পেল।সে মায়ানের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।এইটুকু বোধগম্য হতেই মেহবিন তারাতারি সরে গেল।মায়ানের চোখ একটু লেগে গিয়েছিল।মেহবিনের এভাবে সরে যাওয়ায় মায়ানের ঘুম ভেঙে গেলো।মেহবিন জানলা ঘেষে বাইরে তাকিয়ে আছে।মায়ানের দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না।মেহবিন কে এভাবে ওদিকে ফিরে থাকতে দেখে মায়ান ভ্রু কুচকালো।তারপর কিছু বলতে নিয়ে ও থেমে গেলো।পুরো বিষয়টা ধরতে পেরেই মেহবিনের এমন আচরণ টের পেল।মায়ান শব্দহীন হাসল।সে আর মেহবিনকে ঘাটাল না।সিট থেকে উঠতে উঠতে বলল-
-”বস মাইজাকে পাঠাচ্ছি।
বিকেলের শেষ প্রহরে তারা সিলেট গিয়ে পৌছালো।ট্রেন স্টেশন থেকে মেহবিনের নানুবাড়ির রাজিম চাচা আর মেহবিনের মামা এসেছিল রিসিভ করতে।ভাইকে এতদিন পর দেখতে পেয়ে মিসেস রুকাইয়া সেখানেই চোখের জল ফেলে নিজের ভাইকে জড়িয়ে ধরল।আলাউদ্দিন আহমেদ ও নিজের বোনকে জড়িয়ে নিল।তাদের সবার কান্নাকাটির পর্ব শেষ হতেই মেহবিনের মামা তিনটা অটোরিকশা নিল।একটা তে মিসেস রুকাইয়া মেহবিন আর মেহবিনের মামা বসেছে।আরেকটা তে মিসেস রুনা মাইজা আর রাফিজ বসেছে।আর অন্যটায় মায়ান আর মেহবিনের বাবা।মেহবিন চুপ করে মামার কাধে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে।ওর মা আর মামা যেন কথার ঝুলি খুলে বসেছে।মেহবিনের মাথায় এসব কিছু ঢুকছে না আপাতত।তার মাথায় শুধু মায়ানের বুকে মাথা রেখে ঘুমানোটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।মেহবিন বুঝতে পেরেছে যে মায়ান তখন তাকে ঘুমের ঔষধ খায়িয়েছিল যাতে ঘুমিয়ে গেলে আর বমি বা পেট ব্যাথা না হয়।মায়ানের এভাবে খেয়াল রাখা মেহবিনকে দিন দিন আরো দুর্বল করে দিচ্ছে মায়ানের প্রতি।সব তো ঠিকই আছে।কিন্তু এভাবে বুকে ঘুমানোটা মেহবিনকে বারবার লজ্জায় ফেলছে।আর কতবার তাকে মায়ানের সামনে লজ্জিত হতে হবে কে জানে।
তিনটি রিকশা এসে বিশাল পুরোনো বাড়ির সামনে থামতেই সবাই রিকশা থেকে নামে।মেহবিন নামতেই মায়ানকে চোখে পড়ে।বাবা আর রাফিজের সাথে জিনিসপত্র নামাতে সাহায্য করছে।ট্রেনের কথা মনে পড়তেই মেহবিন লজ্জা পেয়ে যায়।মাইজা সহ বাকি সবাই ভিতরে চলে যায়।শুধু রাফিজ আর মায়ান শেষ ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে সবে।রাফিজ একটু সামনে এগুতেই মেহবিন কি ভেবে যেন মায়ানকে ডাক দেয়।
-”শুনুন একটু।
মায়ান পিছ ফিরে তাকায় মেহবিনের দিকে।মেহবিনকে এখনো এখানে দেখে মায়ান বলে-
-”এখানে কি করছো মেহু।সবার সাথে ভিতরে যাও নি কেনো?তোমার কি আবারো বমি পাচ্ছে?
-”উহু।
-”তাহলে?
মেহবিন বিড়াল ছানার ন্যায় মিউমিউ করে খুব ধীরে বললো-
-”তখনকার জন্য ধন্যবাদ।
মায়ানের কপালে ভাজ পড়ে।আবার কখনকার জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছে।মায়ান বুঝতে না পেরে বলল-
-”কখনকার?
মেহবিন এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।কিভাবে মুখে আনবে সে তখনকার কথা।মায়ান কোনো উত্তর না পেয়ে বলল-
-”কি হলো বল কখন-
মায়ান চুপ হয়ে যায়।মেহবিনের এই অস্থিরতা সে আগেও দেখেছে।তখন ট্রেনে এমন অস্থিরতা বোধ করছিল মেহবিন।মায়ান বুঝতে পেরে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে হিসহিসিয়ে বললো-
-”ট্রেনের ঐ সময়ের কথা বলছ।কিন্তু ধন্যবাদ কিসের জন্য দিচ্ছ?তোমাকে ঔষধ খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নাকি আমার বুকে ঘুমোতে দেওয়ার জন্য?কোনটা?
মেহবিন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।মায়ান কি সুন্দর অকপটে কথাগুলো বলে দিল।মেহবিনের এসব শুনেই দম আটকে আসছে।মায়ান মেহবিনের কাছে গিয়ে ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো সরিয়ে বললো-
-”বলেছিলাম না ধন্যবাদ লাগবে না।এই সবকিছুর বিনিময়ে আমার যা দরকার তা আমি আদায় করে নিব।
চলবে….