অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব-৩১

0
920

#অব্যক্ত ভালোবাসা
#পর্ব :৩১
#সুমাইয়া ইসলাম নিশা

বর্তমান।

পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন মুহুর্ত হলো কাউকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলা,তারপর উপলব্ধি করতে পারা যে ঐ মানুষটাকে সে কখনোই পাবেনা।মেহবিন সেই কঠিন মুহুর্তের সম্মুখীন হয়েছে।এতগুলো দিন পর ভালোবাসার মানুষকে দেখতে পেরেছে,অনুভব করতে পেরেছে।কিন্তু এই অনুভূতি মূল্যহীন।মায়ান যে তার না।সে যে নিজ ইচ্ছায় অন্য কারো হতে চাইছে।তবে কোথায় গেলো তার ভালোবাসা।দু’বছর আগের সেই স্পর্শ?সেসব কি তবে নিরর্থক।হ্যা,সবকিছু অর্থহীন।মেহবিন শুভ্র রঙের কাগজটায় আবার চোখ বুলাল।মায়ানের দেওয়া শেষ চিঠি।চিঠিতে রয়েছে নিজের ভালোবাসা হারানোর কঠিন সত্য।তবুও মেহবিন যত্নে রেখেছে।শত হোক মায়ানের দেওয়া।মেহবিন চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করল।চিঠিটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিলো।মেহবিন দাড়াতে পারছেনা।সকল ক্লান্তি এসে হানা দিচ্ছে।মেহবিন বেডে গিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ল।চোখ বুঝতেই পারি দিলো ঘুমের রাজ্যে।ঘুমের মধ্যেও মেহবিনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল বিষাক্তময় অশ্রু।

————

মাইজা ঘরকুনো মেয়ে নয়।সবসময় এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেই ও পছন্দ করে।তবে মায়ানের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে মাইজা বাসা থেকেই বের হচ্ছে না।সারাক্ষন মিসেস তনয়াকে কিভাবে ইমপ্রেস করা যায় ওসবেই ব্যস্ত।এবং মাইজা তাতে সফল ও হচ্ছে।মিসেস তনয়া যত দিন যাচ্ছে মাইজার প্রতি তার ভালোলাগা আরো বাড়ছে।মাইজা কিচেনে চা বানাচ্ছিলো।এই বিকেলে সাধারণত মিসেস তনয়া চা খেতে বেশ পছন্দ করে।তার জন্যই এতো মনোযোগ দিয়ে বানানো।মিসেস তনয়া কিচেনে এসে মাইজাকে চা বানাতে দেখে মুচকি হাসলেন।মাইজার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন-

-”চা বানাচ্ছো মা?

মাইজা মিসেস তনয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো-

-”জ্বি।

মিসেস তনয়া আর কিছু বললেন না।বোয়াম থেকে কফি নিয়ে কফি বানাতে লাগলেন।মাইজা চা বানাতে বানাতে মিসেস তনয়ার ও কফি বানানো শেষ।মাইজা তনয়ার হাতে কফি দেখে জিজ্ঞেস করল-

-”কফি কার জন্য আন্টি?

-”মায়ানের জন্য।ওর নাকি মাথা ধরেছে।

মাইজা কিছু একটা ভাবলো।তারপর আমতা আমতা করে বললো-

-”আপনি চা খেয়ে নিন।চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।কফিটা নাহয় আমি দিয়ে আসি।

মিসেস তনয়া এতে এক পায়ে রাজি। ছেলেটা বিয়েতে রাজি হয়েছে ঠিকই তবে বিয়ে নিয়ে কিছু বললে অথবা মাইজার সাথে কথা বলতে বললে রেগে যায়।এই নিয়ে বেশ চিন্তিত তিনি।মিসেস তনয়া হেসে সায় জানিয়ে কফির মগটা মাইজার হাতে দিলো।মাইজা কফি নিয়ে মায়ানের ঘর পর্যন্ত এলো।দরজা লাগানো তবে লক করা না।মাইজা আরষ্ট হয়ে নক করল।কিন্তু ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না।মাইজা একটু গলা বাড়িয়ে ডাক দিলো-

-”মায়ান ভাই?

তাও কোনো সাড়া শব্দ নেই।মাইজা দরজাটা হালকা খুলে ভেতরে উকি দিলো।ভেতরে কেউ নেই।মাইজা ঘরের ভিতর এলো।ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ হচ্ছে।মাইজা বুঝতে পারলো মায়ান ওয়াশরুমে।সে কফির মগটা টি টেবিলে রেখে দিলো।ঘর থেকে মায়ানের পারফিউমের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।মাইজা চোখ বন্ধ করল।এই ঘ্রাণ যে সারাজীবন সে পেতে পারবে।মাইজার ভাবনায় ছেদ পড়ে ফোনের রিংটোনে।মায়ানের ফোন বাজছে।মাইজা ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবল মায়ানকে ডাক দিবে,তারপর আবার ভাবল যে ডাকাডাকির প্রয়োজন নেই।তারপর আবার ভাবল যে সে নিজেই ফোনটা তুলবে।যতই হোক মায়ান তার বাগদত্তা।মাইজা অধিকার বোধ নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো।একটা আননোন নাম্বার।মাইজা রিসিভ করতেই মায়ান এসে খপ করে হাত থেকে ফোনটা নিয়ে যায়।মাইজা ভয় পেয়ে মায়ানের দিকে তাকায়।মায়ান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে।মায়ান ধমক দিয়ে বললো-

-”হাউ ডেয়ার টু টাচ মাই ফোন।

মাইজা কেপে উঠে।তারপর মিনমিন করে বলে-

-”আ-আপনি তো ও-ওয়াশরুমে ছিলেন।

-”তো?তুমি আমাকে আস্ক না করেই আমার ফোনে হাত দিয়েছো কোন সাহসে।লিমিট ক্রশ করবেনা মাইজা।তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি বলে ভেবো না তোমার সবকিছুই টলারেট করব।

মাইজা টলমল চোখে মায়ানের পানে তাকায়।মায়ান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবারো ধমক দিয়ে বলে-

-”গেইট আউট।

মাইজা আর দাড়ায় না।চলে যায় ঘর থেকে।মায়ান নিজের চুল খামছে ধরে রাগ নিবারণ করছে।মায়ান মনে মনে বলল-

-”তোমার উপর রাগ দেখাতে গিয়ে অনেক বড় ভুল ডিসিশন নিয়ে ফেললাম মেহু।তোমার সাথে আমাকে কথা বলতেই হবে যে করে হোক।

———
দিন গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে আবার সকাল।এভাবে সময় গড়িয়ে প্রায় একমাস কেটে গেলো।একমাস কারো জীবন ছিলো বিষাক্তময়।কেউবা নিজের সুখের স্বপ্ন বুনতে ব্যস্ত।মাইজা আর মায়ানের বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের মাসের ১৫ তারিখ,শুক্রবার।আর মাত্র সতেরো দিন বাকি বিয়ের।মাইজা এখন ভীষণ খুশি।মায়ানের সাথে তার সম্পর্কের তেমন উন্নতি হয়নি তবে সে আশা করে বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।মায়ান বহু চেষ্টা করেছে মেহবিনের সাথে কথা বলতে,কিন্তু মেহবিন যে ধরা ছোয়ার বাইরে।তাকে যে এই এক মাস চোখের দেখাও দেখেনি।মায়ান আশাহত।সে কোনোভাবেই নিজেকে সামলে উঠতে পারছেনা।

——–
মেহবিন শুয়ে ছিলো ঘরে।মিসেস রুকাইয়া মেহবিনের ঘরে এসে মেয়েকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে গর্জে উঠলেন-

-”সারাদিন ঘরে শুয়ে কি করিস।যাহ ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়েছিলাম,নিয়ে আয়।

মেহবিন নড়ল না শুয়েই থাকলো।এতে ওর মা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠল।কি মেয়ে জন্ম দিলাম,কোনো কাজের না,মাকে সাহায্য করেনা,মার প্রতি দরদ কম এমন হেনাতেনা নানা কিছু বকবক করত লাগলেন।মেহবিন আর শুয়ে থাকতে পারলেননা।ঘর থেকে বেরিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে ছাদে চলে গেলো।মেহবিন ছাদে গিয়ে কাপড় নিতে থাকে।সব কাপড় নেওয়া হয়ে গেলে পেছনে ফিরতে নিলেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেয়।সামনের মানুষটি শক্ত করে মেহবিনের কোমর জড়িয়ে সোজা করে দাড় করায়।মেহবিন ভয়ে চোখ কুচকে ফেলে।একটু পর চোখ মেলে তাকাতেই সামনে মায়ানকে দেখতে পায়।মেহবিনের বুক ধক করে উঠে।মায়ানকে সে যতবারই ভুলে যেতে চায় ততবারই লোকটা তার সামনে আসে।মায়ান করুন চোখে তাকিয়ে আছে মেহবিনের দিকে।তারপর কাতর কন্ঠে বললো-

-”আই’ম সরি মেহু।

মেহবিন তাচ্ছিল্য হাসে।সেই হাসিতে কষ্ট ছিলো।ঠোটে তাচ্ছিল্য হাসি বজায় রেখেই বললো-

-”সরি?ফর হোয়াট?কিসের সরি বলছেন আসলে?আমাকে দু’বছর আগে অনুভূতির সাগরে ডুবিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য,নাকি এখন আমারই সামনে অন্য কারোর সাথে নিজেকে জড়িয়ে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য?

মায়ানের বক্ষস্থল কেপে উঠে।তার ছোট্ট মানবী যে ভীষণ কষ্টে আছে।মায়ান হাত বাড়িয়ে মেহবিনের এক গালে রাখে।তারপর মেহবিনের অতিনিকটে দাড়িয়ে পড়ে।তারপর আবেগী কন্ঠে বলে-

-”আমার তোমাকে চাই মেহু।প্লিজ আমায় ক্ষমা করো।

তারপর নিজের ওষ্ঠধয় ছোয়ালো মেহবিনের ললাটে।মেহবিনের চোখ বুজে এলো আবেশে।আজ কতদিন পর সে এই স্পর্শ অনুভব করতে পারছে।তবে এবার নিজেকে অনুভূতির সাগরে তলিয়ে দিলো না।সজোরে ধাক্কা দিলো মায়ানকে।হঠাৎ ধাক্কায় মায়ান দুপা পিছিয়ে যায়।মায়ান অবাক হয়ে তাকায় মেহবিনের দিকে।মেহবিন ক্রোধে আরষ্ট হয়ে বলে-

-”আপনি কোন অধিকারে ছুয়েছেন আমায়?আপনি না অন্য কারো বাগদত্তা।কিছুদিন পর তো আপনি অন্য কারো হয়ে যাবেন।আপনি আমার এত কাছে আসছেন কোন অধিকারে।আপনি ঠকবাজ জানতাম,কিন্তু ক্যারেক্টারল্যাস সেটা তো জানতাম না।

মায়ানের চোয়াল শক্ত হলো।মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠছে তার।মেহবিন তাকে ক্যারেক্টারল্যাসের তকমা লাগিয়ে দিলো কিভাবে।মায়ান মেহবিনের গাল শক্ত করে চেপে ধরল।মেহবিন ব্যথায় চোখ মুখ খিচে ফেলে তবুও মুখ দিয়ে টু শব্দ করল না। মায়ান দাতে দাত চেপে বলে-

-”তোর সাহস কি করে হয় আমার ক্যারেক্টার নিয়ে কথা বলার।তুই কোন সাহসে আমাকে এসব বললি?

মায়ান ছেড়ে দিলো মেহবিনের গাল।তারপর সাপের মতো ফোসফোস করতে করতে বললো-

-”আমি ঠকবাজ তাইতো?আমি সব ঠিক করতে চেয়েছিলাম মেহবিন।তবে তুমি সেটা হতে দিলে না।সেদিন রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মাইজাকে বিয়ে করার,তবে আজ তোমার সামনে মন থেকে বলছি আমি মাইজাকেই বিয়ে করব।গট ইট।

মায়ান ধপধপ করে পা বাড়িয়ে সিড়ির দিকে গেলো।মেহবিন অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে মায়ানের দিকে।মায়ান সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই সিড়ির নিচ থেকে সরে গেলো এক ছায়ামূর্তি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here