#অব্যক্ত ভালোবাসা
#পর্ব :৩২
#সুমাইয়া ইসলাম নিশা
🍁
রাত দশটা।মাইজা মাত্র রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসেছে।শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত তার।সারাদিন মায়ান আর মিসেস তনয়ার মন রাখার জন্য নানান কারসাজি করেই যাচ্ছে।যার দরুন মাইজার শরীর চলছেনা।এত কিছুর ফলস্বরূপ মিসেস তনয়ার মন জয় করতে পারলেও মায়ানের আচরণ ঠিক আগের মতোই।তবুও মাইজার অগাধ বিশ্বাস মায়ান একদিন ঠিক তাকে ভালোবাসবে।এমনই আশা নিয়ে মাইজা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।তখন মিসেস রুনা ঘরে এলেন।মাইজা মিসেস রুনাকে দেখে বললেন-
-”কি হয়েছে আম্মু?কিছু বলবা।
মিসেস রুনা তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে।তারপর মাইজার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বেডে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলেন।তারপর মাইজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
-”একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
মাইজা আগ্রহ নিয়ে বললো-
-”কি কথা?
-”তুই কি মায়ানকে ভালোবাসিস?মানে এই বিয়েতে কি তুই খুশি?
মাইজা অবাক হলো।মিসেস রুনা এসব কেনো জিজ্ঞেস করছেন বুঝতে পারলো না।তবুও সোজাসুজিই বললো-
-”হ্যা আম্মু।আমি এই বিয়েতে খুশি।আর তুমি বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর এতকিছু কেনো জিজ্ঞেস করছো?
মিসেস রুনা উত্তর দিলেননা।মাইজার মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখলেন।মাইজাও মায়ের কোলে শুয়ে রইল।মিসেস রুনা মাইজার চুলে হাত বুলিয়ে বললেন-
-”শোন আম্মু,পৃথিবীর সব মায়েরাই নিজের সন্তানকে ভালোবাসে।নিজের সন্তানের সুখ দেখতে চায়।আমিও সেইসব মায়েদেরই একজন।তোর সুখ,তুই কিসে খুশি থাকবি সেটা নিয়ে আমার চিন্তা হয়।কিন্তু কোনো মাই চায়না তার নিজের সন্তানের জন্য অন্য কারো ক্ষতি হোক।জানিস সবসময় নিজের কথা ভাবলেই হয় না।অন্যের সুখদুঃখ ও দেখতে হয়।সবসময় এটা খেয়াল রাখতে হবে যে তোর জন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে কি না,তোর জন্য কারো জীবন নষ্ট হচ্ছে কিনা।এসব খেয়াল রাখতে হয়রে মা।
মাইজা অবাক চোখে তাকাল মায়ের দিকে।মায়ের কোনো কথাই তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে অক্ষম।সে ফেলফেল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
-”আমার জন্য কি কারো জীবন নষ্ট হচ্ছে?
মিসেস রুনা একটু হেসে বললেন-
-”এটা তুইই ভেবে দেখিস।
তারপর একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন-
-”মাইজা,শোন মা,তোর বাবা নেই।আমার পর তোর অভিভাবক তোর ভাই রাফিজ।রাফিজের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবিনা কখনো।জীবনে যতই খারাপ পরিস্থিতি আসুক না কেনো ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাখবি।তোর রুকাইয়া আন্টি, আঙ্কেল ওনাদের সাথে সম্পর্ক রাখবি।
মাইজা বিরক্ত হয়ে বললো-
-”আম্মু তুমি এসব এখন বলছো কোনো বলোতো-
-”আমার মনে হচ্ছে আজকে না বলতে পারলে এসব আর কোনো বলতে পারবোনা।
মাইজা ফট করে কোল থেকে উঠে পড়ে।তারপর রেগে গিয়ে বলে-
-”এসব কি কথা আম্মু?তোমার ঘুম প্রয়োজন।যাও গিয়ে ঘুমাও।
-”আমার তোকে একটা কথা বলার ছিলো।
-”কোনো কথা না আম্মু যাও।
মাইজা ঠেলেঠুলে মিসেস রুনাকে ঘুমোতে পাঠাল।তারপর এসে ক্লান্ত থাকায় নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
——————–
মিসেস রুনা ঘরের সব কাজ খুব দ্রুত করছেন।কাজ শেষ করে ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে একটৃ বোরখা পরে নিলেন।মাইজা রুম থেখে বেরিয়ে মাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করে-
-”এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছ আম্মু?
মিসেস রুনা নিকাব বাধতে বাধতে বললেন-
-”তোর ইয়াসমিন খালা আছে না আমাদের বাসায় আগে কাজ করতো ওনি নাকি অসুস্থ হসপিটালে ভর্তি।একটু গিয়ে দেখি আসি।
মাইজা ছোটো করে বললো-
-”ওহ।
মিসেস রুনা ব্যাগ নিয়ে ঘরথেকে বেরুলেন।মাইজাও পিছ পিছ গেলো।মিসেস রুনা মেইন গেইট খুলতে নিয়েও থেমে মাইজার দিকে তাকালেন।তাপর বললেন-
-”শোন মাইজা আমার ঘরে আলমারির নিচের ড্রয়ারে একটা জিনিস আছে।একটু দেখে নিস।
-”তুমি এসে পরে দিও।আমি তোমার আলমারিতে জীবনেও কিছু খুজে পাইনা।
-”আমি যদি না দিতে পারি তাই তোকে বললাম।
মাইজা অবাক হয়ে বললো-
-”দিতে পারবেনা কেনো?
মিসেস রুনা উত্তর দিলেননা।মাইজার কপালে চুমু খেলেন।তখন রাফিজও ঘর থেকে বেরুলো।মিসেস রুনা রাফিজ কে দেখে ওর কাছে গিয়ে দাড়িয়ে বললো-
-”শোন বাবা,তোর কাছে একটা দায়িত্ব আছে।সেটা হলো তোর বোন।তোদের বাবা নেই।ভাই-বোন মিলেমিশে থাকবি।পড়াশুনা শেষ করেছিস এখন নিজের পায়ে দাড়াবি।মেহুকেও দেখে রাখবি।ও তোর বোন।ঠিকাছে বাবা।
রাফিজ মায়ের এসব আধ্যাত্মিক কথার মানে বুঝলো না ।তবুও অযথাই হাসল।তারপর বললো-
-”আচ্ছা।
মিসেস রুনা রাফিজের কপালেও চুমু খেলো।তারপর মেইন গেইট খুলে বাইরে বেরোনোর সময়ে পুরো ঘরে চোখ বুলালেন।তারপর চলে গেলেন।মিসেস রুনা মেহবিনের ফ্লাটেও গেলেন।ডোর নক করতেই মেহবিন এসে দরজা খুললো।মেহবিন রুনাকে দেখে ঘরে আসতে বললেন।মিসেস রুনা ঘরে এসেই মেহবিনকে জড়িয়ে ধরল।মেহবিন ভরকে গেলো।হঠাৎ এমনটা আশা করেনি।মেহবিন বললো-
-”কি হয়েছে আন্টি?
মিসেস রুনা মেহবিনকে ছেড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
-”জানিস মা,তুই আর মাইজা দুজনেই আমার মেয়ে।তোদের দুজনকে আমি সমান সমান ভালোবাসি।কখনোই আলাদা ভাবে দেখিনি।আমি কখনোই চাইবোনা আমার এক মেয়ের জন্য আরেক মেয়ে কষ্ট পাক।এইটুকু বয়সেই অনেক কষ্ট পেয়েছিস।তোর কষ্ট আল্লাহ দূর করবেন।আমার মনে হয়।তুই সুখি হ মা।
মেহবিন বিষ্ময় নিয়ে তাকাল মিসেস রুনার দিকে।কিছু বলবে তার আগে মিসেস রুকাইয়া এসে বললেন-
-”আরে রুনা কখন এলি?কোথাও যাচ্ছিস নাকি?মাইজার বিয়ের কাজে নাকি?
বিয়ের কথা শুনে মেহবিনের বুক ভারি হয়ে এলো।সে কোনোমতে ছাদে যাচ্ছি বলে চলে গেলো।মিসেস রুনা সেদিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে মিসেস রুকাইয়ার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হলেন।আজ অনেকদিন পর দুই বান্ধবী অনেক কথা বললো।যাওয়ার সময়ে মিসেস রুনা পুরে ঘরে একনজর তাকাল।কেনো জানি তার সবকিছু বেশি আপন লাগছে আজকে।
—————
মেহবিন ছাদে দাঁড়িয়ে ভাবছে অতীতের কথা।মায়ান নামক কষ্ট তার জীবনে না এলে আজকে সে একটা সুন্দর জীবন পেতো।একসময়ে এই মায়ানকে নিয়েই সে সুন্দর জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখতো আর আজ মায়ানের জন্য তার সুন্দর জীবন বিষাক্তময় হয়ে উঠেছে।
-”কেমন আছিস মেহবিন?
মেহবিন পাশে ঘুরে তাকালো।মাইজা দাড়িয়ে আছে।দুই হাত বুকে গুজে ঠোটে হাসির রেখা টেনে দাড়িয়ে আছে।সেই হাসিতে ছিলো নিজের সাফল্য আর মেহবিনের প্রতি তাচ্ছিল্যতা।মেহবিনের শরীর বিষিয়ে গেলো।মাইজার মুখটাও তার দেখতে ইচ্ছে করছেনা।মেহবিন আবার মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাল।মাইজা ঠোটের হাসি প্রসারিত করে বললো-
-”কেমন লাগছে মেহবিন?তোর দিনকাল ভালো কাটছে তো?
মেহবিন তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।মাইজা আবারো বললো-
-”মায়ানভাইকে তুই পেলি নারে মেহবিন। সো সেড।খারাপ লাগছে তোর জন্য।বাট কি বলতো,মায়ান ভাই না শুরু থেকেই আমার ছিলো।নইলে কি আর আমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো বল।
মেহবিন আর চুপ করলোনা।মাইজার দিকে ফিরে রক্তচক্ষু নিয়ে বললো-
-”হ্যা ঠিক বলেছিস।মায়ান ভাই আমার ছিলোনা।আমার তো রূপ নেই যে সেই রূপের জোরে ওনি আমাকে ভালোবাসবেন।কিন্তু তোর তো অনেক গুন।আর রূপের কথা নাইবা বললাম।তা তুই কি মায়ান ভাইকে তোর এই রূপেরই অপব্যবহার করে নিজের জালে ফাসিয়েছিস।
মেহবিনের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাইজা রাগে ফেটে যায়।মেহবিন তাকে এসব বলতে পারে সেটা তার চিন্তার বাইরে ছিলো।মাইজা গলা উঁচিয়ে আরো কিছুবলবে তখনই মাইজার ফোন বেজে উঠে।আননোন নাম্বার জ্বলজ্বল করছে ফোনের স্ক্রিনে।সে ফোনটা তুলতেই মেহবিন ছাদ থেকে নামার জন্য পা বারাল।কয়েক পা যাওয়ার পরই পিছন থেকে ভেসে এলো মাইজার গগণ বিদারী চিৎকার।মেহবিন আতকে উঠে পিছে ফিরে তাকায়।মাইজা নিচে বসে আছে।হাতের ফোনটা পাশেই একটু দূরে পড়ে আছে।মেহবিনের মন ভয়ে কেপে উঠে।রাগ অভিমান ভুলে দৌড়ে মাইজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।মাইজার কাধে কাপা কাপা হাত জোরা রেখে জিজ্ঞেস করলো-
-”কি হয়েছে মাইজা?এমন ভাবে বসে পড়লি কেনো।
মাইজা কিছুই বললো না বসে রইল।মেহবিন নিজেকে ধাতস্থ করে পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে কানে তুলে হ্যালো বললো।ওপাশ থেকে কিছু শুনতেই মেহবিনের কম্পনরত হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো।টুপ করে গড়িয়ে পড়ল একফোটা জল।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা কোনোভাবেই।
চলবে…
( রেসপন্স কম।সবাই একটু রেসপন্স করুন।সবাই রেসপন্স করলে আগামীকাল দুইটা পর্ব দিবো)