#অব্যক্ত ভালোবাসা
#পর্ব :৩৩
#সুমাইয়া ইসলাম নিশা
মানুষের জীবন খুবই ছোট।এই ছোট্ট জীবনে মানুষ নিজও অনেক মায়ায় জড়ায়।আর নিজের প্রতিও সবার ভিতর মায়া জন্মায়।এই মায়া কাটিয়ে উঠতে বেশ হিমশিম খেতে হয়।’মা’ শব্দটি ছোটো।এই ছোট্ট শব্দের ভিতর রয়েছে মায়া,ভালোবাসা,স্নেহ,শাসন,রাগ,আদর,যত্ন আরো কত কি।এই ছোট্ট শব্দের ভিতর হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি।মা ছাড়া জীবন অসহনীয় যন্ত্রণাময়।যার জীবনে মা আছে সে ভাগ্যবান।আর যার মা নেই বা একটা সময় পর হারিয়ে ফেলে তারমতো হতভাগা আর কেউ নেই।মাইজা সেই হতভাগিনীর দলে ভাগ বসিয়েছে।হ্যা,মিসেস রুনা আর নেই। হারিয়ে গিয়েছে না ফেরার দেশে। সেদিন হসপিটাল থেকে আসার সময় রোড পার হতে গিয়ে এক বিশাল দানব আকৃতির ট্রাক তার জীবননাশ করেছে।বলা বাহুল্য,মিসেস রুনা সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।পরে আশেপাশের মানুষজন তার কাছে গিয়ে দেখে যে সে আর নেই।মিসেস রুনার ফোনটা নিয়ে মাইজা কে কল করে।আর সেদিন মাইজা এটা শুনার পরই চিৎকার দিয়েছিল।
আজ দুইদিন হলো মিসেস রুনা নেই।শোকের ছায়া নেমে এসেছে মাইজা আর মেহবিনদের বাসায়।মাইজা নির্বিকার ভাবে বসে আছে সোফায়।রাফিজ বসে আছে অন্য পাশের সোফায়।তার পাশে মায়ান।রাফিজ কাদছেনা।ওর না কাদার কারণ মাইজা।কারন মাইজা নিজেও কাদছেনা।এমনকি মায়ের লাশ বাড়িতে আনার পরও কাদেনি।চুপচাপ বসে ছিলো।মেহবিন মাইজার পাশে বসে আছে।সে কেদেই যাচ্ছে অনবরত।নিজের আপন মাকে না হারিয়ে ও মা হারানোর যন্ত্রণা ভোগ করছে।মাইজাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মেহবিনের মন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।মাইজার প্রতি তার রাগ নেই।নাইবা আছে কোনো অভিমান।মিসেস রুনার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর মেহবিন মাইজাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদেছে।মাইজা ছিলো নিশ্চুপ।অতি শোকে যে কেউ পাথর হয়ে যেতে পারে সেটা মাইজাকে দেখে হারে হারে বুঝতে পারছে সবাই।মেহবিন মাইজার কাধে হাত রেখে বললো-
-”মাইজা কিছু খাবি?দুইদিন ধরে পানি ছাড়া কিছু খাস না।প্লিজ কিছু খেয়ে নে।
মাইজা তবুও চুপ।মেহবিনের এবার রাগ হলো।সে মাইজার বাহু ঝাকিয়ে বললো-
-”কি হয়েছে হ্যা?কাদছিস না কেনো তুই।কাদবি না কেনো।তোর মা মারা গিয়েছে তুই কেনো চুপ করে বসে থাকবি।কাদতে বলেছি তোকে প্লিজ কিছু তো বল।
বলতে বলতে মেহবিন ফের কেদে দিল।মাইজা এখনও নিশ্চুপ।রাফিজ বোনের মুমূর্ষু চেহারার দিকে একনজর তাকাল।তারপর উঠে কোনোরকমে বাইরে চলে গেলো।মায়ান রাফিজকে ডাক দিতে নিয়েও দিলো না।একা থাকা দরকার।মায়ান মেহবিনের দিকে তাকাল।মেয়েটা কতটা নিষ্পাপ।মাইজার প্রতি সমস্ত রাগ কিভাবেই একনিমেষে শেষ করে আগলে নিল মাইজাকে।মায়ান ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়াল।তারপর মাইজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো-
-”মাইজা এভাবে ভেঙে পড়োনা।কেউ চিরস্থায়ী নয়। সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।তফাত শুধু কেউ আগে তো কেউ পরে।নিজেকে সামলাও।এখন ঘরে গিয়ে রেস্ট নেও।
মাইজা মায়ানের কথা শুনলো।উঠে পা বারাল ঘরের দিকে।মেহবিন নিজেও উঠে দাড়াল।মায়ান মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বিষন্ন মুখে বললো-
-”তুমিও বাসায় যাও।তোমাকেও অনেক ক্লান্ত লাগছে।
মেহবিন কাঠ কাঠ জবাব দিলো-
-”আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবেনা।আর আমি কোথাও যাবোনা।মাইজাকে এই অবস্থায় ফেলে কখনোই যাব না।
মেহবিন নিজের চোখের জলটুকু হাতের উল্টো পিঠে মুছে মাইজার পাশের ঘরে পা বারাল।মায়ান সেখানে দাঁড়িয়ে রইল।মেহবিনকে যে সে চিরতরে হারিয়েছে সেটা তার মস্তিষ্কে প্রবল ভাবে কড়া নাড়ছে।ভগ্ন হৃদয় নিয়ে সে নিজেও চলে গেলো ঘরে।
———————
রাত এগারোটা বাজে হয়ত।মাইজা নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে।হঠাৎই তার ঘুম ভেঙে গেলো।মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছে।কিন্তু চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।তারপর উঠে বসল।শরীরটা ভেঙে পড়ছে।দুদিন না খাওয়ার ফল।মাইজা নিজের বেডে বসে রইল।হঠাৎ কেমন জেনো লাগলো তার।মাইজা চোখ মেললো।সামনে তাকাতেই মিসেস রুনা কে দেখলো।মিসেস রুনা হেসে তাকিয়ে আছে।অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে।মাইজা অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল তারপর কাপা কাপা কন্ঠে বললো-
-”আ-আম্মু,তু-তুমি এসেছো আমার কাছে।
মিসেস রুনা খাটে গিয়ে বসলেন।মাইজা কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।মিসেস রুনা সেদিনের মতোই মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
-”আসবো কেনোরে,আমি তো তোর কাছেই আছি।
মাইজা কেদে দিলো।মিসেস রুনা হেসে বললেন-
-”কাদিস না বোকা মেয়ে।আমি সবসময়ই তোর পাশে আছি।আর আমি ছাড়াও তো একজন তোর পাশে আছে।যে তার রাগ অভিমান সব ভুলে গিয়ে তোর পাশে দাড়িয়েছে।
মাইজা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
-”কার কথা বলছো!
-”মেহবিন।মেহবিন তোর ভালো চায় মা।তোর কষ্টে সে নিজেও কষ্টিত।তোর এই অবস্থায় চাইলেই সে তোকে ছেড়ে চলে যেতে পারতো।তোর কথা নাই ভাবতে পারতো।কিন্তু সেটা সে করেনি।এই দুইদিন তোর সাথে থেকেছে।তোকে বুঝিয়েছে।তোর কষ্ট কমাতে চেয়েছে।তোর ও কি উচিত না ওর কষ্ট লাঘব করা।
মাইজা ভেবে বললো-
-”হ্যা আম্মু,কিন্তু কিভাবে করবো?
-”সেটার উত্তর তুই নিজেই ভালো জানিস।
মাইজা না বুঝে বললো-
-”আমি জানিনা।তুমিই বলে দেও না।
আর কোন উত্তর এলোনা।মাইজা সেইভাবে শুয়ে থেকেই কয়েকবার মা বলে ডাকলো।কারো সাড়া না পেয়ে মাইজা চোখ মেললো।কিন্তু চোখ খুলে নিজের মাকে দেখতে পেলোনা।মাইজা ব্যাকুল হয়ে এদিক সেদিক খুজলো।কিন্তু মিসেস রুনাকে পেলোনা।উন্মাদের মতো নিজের মাকে ডাকলো।কিন্তু তার মা আর সাড়া দিলোনা।মাইজা কেদে দিলো আবার।জোরে মা বলে চিৎকার দিলো।মেহবিন মাইজার চিৎকারে ছুটে যায় ওর ঘরে।মাইজাকে এভাবে পাগলের মতো কাদতে দেখে মেহবিন মাইজার পাশে গিয়ে ওকে ধরে বলে-
-”কি হয়েছে তোর।এভাবে কাদছিস কেনো।
মাইজা কাদতে কাদতে বলে-
-”আম্মু এসেছিলো,আমার আম্মু আমার কাছে এসেছিলো।এখানেই ছিলো।আমি কোলে মাথাও রাখলাম।তারপর হঠাৎই কোথায় যেন চলে গেলো।
মেহবিন বুঝতে পারলো মাইজা কল্পনায় নিজের মাকে দেখেছে।সে মাইজাকে জড়িয়ে ধরে বলে-
-”কেউ আসেনি মাইজা।এসব তোর মনের ভ্রম।প্লিজ শান্ত হ।
মাইজাকে অতি কষ্টে শান্ত করাল।তারপর কাদতে কাদতেই একসময়ে মাইজা ঘুমিয়ে পড়লো।মেহবিন ও মাইজার পাশে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।তবে ঘুমালো না।মাইজার শুকিয়ে যাওয়া মুখপানে চেয়ে রইল।তারপর বিরবির করে বললো-
-”তোকে আর কষ্ট পেতে হবে না।মায়ান ভাই আর তোর মাঝে আমি আসবো না।বরঞ্চ আমি তোদের বিয়েতে যা যা করতে হবে সব করব।তবুও তোকে কষ্টে থাকতে দিবোনা।
মেহবিন সারারাত মাইজার কপালে হাত বুলিয়ে শেষ রাতে ঘুমালো।
——————–
রোদের আলো চোখে পড়তেই মেহবিনের ঘুম ভেঙে গেলো।ঘুমটা বেশি গভীর ছিলোনা।তাই চোখ মেলেই উঠে বসতেই মাইজার কথা মনে পড়ে।পাশে ফিরে তাকাতেই মাইজাকে পেলোনা।মেহবিন তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়ায়।মাইজা এই সময়ে কোথায় গেলো।সে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরোয়।ড্রয়িং,ডাইনিং কিচেন কোথাও নেই।তারপর কিছু মনে হতেই মিসেস রুনার ঘরে যায়।আর সেখানে পেয়ে ও যায়।মাইজা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছিলো।মেহবিন মাইজার পিছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে-
-”কি করছিস?
মাইজা তড়িঘড়ি করে কিছু একটা আলমারিতে রেখে দেয়।তারপর মেহবিনের দিকে তাকায়।মাইজার চোখ মুখ শান্ত।মেহবিন আবারো জিজ্ঞেস করে-
-”এতো সকালে এখানে কি করছিস মাইজা?
মাইজা উত্তর দিলোনা।মেহবিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই হুট করে ওকে জড়িয়ে ধরল।মেহবিন অবাক হলো।মাইজা মেহবিনের কাধে মাথা রেখে বললো-
-”আমাকে তোর বাসায় নিয়ে যাবি মেহু?এখানে আমার দম আটকে আসছে।
মেহবিন বুঝতে পারল মাইজার এখানে থাকলে ওর মায়ের কথা ভেবে কষ্ট পাবে।তাই সে মায়াভরা কন্ঠে বললো-
-”হ্যা মাইজা।তুই আমার সাথে আমার বাসায় চল।
মাইজা মেহবিনকে ছেড়ে দাড়াল।তারপর ঠোট এলিয়ে একটু হাসলো।মেহবিন বুঝতে পারল সেই হাসির পিছনেও যে কতশত কষ্ট লুকায়িত।
মধ্য সকালের দিকে মাইজা নিজের ঘর থেকে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো।তারপর ঘর থেকে বেরুলো।মিসেস তনয়া মাইজাকে দেখে বললেন-
-”আমরা এখানেই থাকবো মা।একেবারে বিয়ের সময় মেহবিনের ফ্লাটে যাব।ঠিকাছে?
মাইজা চুপ করে রইল।মিসেস তনয়া আবারো বললো-
-”ঠিকাছে তো মা?
মাইজা উপর নিচ মাথা নাড়াল।মেহবিন তখন ঘর থেকে বেরুলো।মাইজার হাতের ব্যাগটা নিয়ে বললো-
-”চল মাইজা।
মাইজা হুম বলে মেহবিনের পিছ পিছ গেলো।মেইন ডোর খুলে মেহবিন বেরুলো।তার পিছনে মাইজা বেরুতে নিয়ে ও থামল।ঘার ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল।পুরো ঘরে চোখ বুলাতেই ভেসে উঠল তার শৈশবের স্মৃতি।ছোট্ট মাইজা দৌড়াচ্ছে আর তার পিছন পিছন মিসেস রুনা।মাইজাকে ওর মা ধরে ফেলতেই মাইজা খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।তারপর চোখ গেলো মায়ের ঘরের দিকে।প্রথম যেদিন মাইজা স্কুলে যাবে সেদিন ওকে সুন্দর করে চুল বেধে দিলো ওর মা।মিসেস রুনা খাবার নিয়ে মাইজার পিছ পিছ দৌড়াচ্ছে।মাইজা হাসতে হাসতেই বলছে-
-”আমাকে তুমি ধরতে পারবেনা,পারবেনা।
অজান্তেই মাইজার ঠোটে হাসি চলে এলো।সাথে সাথেই চোখের কার্ণিস বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল।
(পরের পর্ব থেকে বিয়ের টপিক নিয়ে লিখা হবে।আর খুব দ্রুতই গল্পের ইতি টানব)