#অব্যক্ত ভালোবাসা
#পর্ব :৩৪
#সুমাইয়া ইসলাম নিশা
————–
আজ বুধবার।খুব সকাল সকাল মাইজার ঘুম ভাঙলো।নিজ হাতে দুই কাপ কফি বানিয়ে পা বাড়াল মেহবিনের খোলা চারকোনা বেলকনিতে।এক কাপ কফি বেতের টেবিলে রেখে আরেক কাপ কফি হাতে নিয়ে চেয়ারে বসল।ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিতেই ভিতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো।আজ পনেরো দিন হলো মিসেস রুনা নেই।নিজেকে বেশ সামলে নিয়েছে।তাকে তো সামলে উঠতেই হবে।তার যে অনেক দায়িত্ব।কিছু সম্পর্ক নিজ হাতে সাজিয়ে দিতে হবে।এটা তার দায়িত্ব।তার ভাবনার মাঝে মেহবিন বেলকনিতে এলো।মাইজার পাশের চেয়ারে বসে বেতের টেবিল থেকে কফি নিয়ে নিজেও চুমুক দিলো।মাইজার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো-
-”বাহ রে মাজা,বেশ ভালোই তো কফি বানাতে পারিস।
মাইজা মৃদু হাসল।কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রেখে দিল।তারপর মেহবিনের দিকে তাকালো।বললো-
-”শিখে নিয়েছি।সময় হলে অনেক কিছুই মানুষ শিখে নেয়।চা বানানো,কফি বানানো,রান্না করা,ভালো থাকার অভিনয় করা।তাইনা?
মেহবিন কফিতে চুমুক দিতে নিয়েও থেমে গেলো।মাইজার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে বললো-
-”মানে?
-”কিছুনা।
মেহবিন আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।কফি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।মেহবিন আর মাইজার সম্পর্কটা হঠাৎই ঠিক হয়ে গেলো।পুরোনো রাগ গুলো সমুদ্রের স্রোতের ন্যায় কোথায় যেন ভেসে গেলো।মাইজাকে এই পনেরো দিন মেহবিন যথেষ্ট যত্ন করেছে।মাইজাও নিজের সমস্ত রাগ ভুলে মেহবিনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।মাইজা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো।কিছু একটা ভেবে নিয়ে মেহবিনের পানে তাকাল।তারপর চঞ্চল চোখে তাকিয়ে বললো-
-”আমায় শাড়ি পড়িয়ে দিবি মেহু?
মেহবিন তাকাল মাইজার দিকে।তারপর হেসে বললো-
-”আমি পড়িয়ে দিবো।তুই তো আমার থেকেও ভালো করে শাড়ি পড়তে পারিস।
-”হুম তবুও আমি চাই তুই পড়িয়ে দিস।আর জানিস আমি চাই কালকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেও তুই আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিবি।
মেহবিন থমথমে মুখে তাকাল।মেহবিনের ভিতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হয়ে যেতে দেখেও কিছু করতে পারছেনা।কাদতে পারছেনা।বরং হাসি মুখ নিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে নিয়ে প্ল্যান করছে।মাইজা আবারো বললো-
-”বল পরিয়ে দিবি?আর আজকে শাড়ি পরে একটু মায়ান ভাইকে দেখিয়ে আসব।যতই হোক তার হবু বউ।
মেহবিন চোখ সরাল মাইজার থেকে।তারপর ঠোটে মিথ্যে হাসির রেখা একে বললো-
-”দিবো।
মাইজা নিষ্পলক তাকিয়ে রইল মেহবিনের দিকে।তারপর কিঞ্চিত হেসে বললো-
-”তাহলে চল পরিয়ে দিবি।
মাইজা মেহবিনের হাত ধরে ঘরে চলে এলো।আলমারি থেকে একটা কালো শাড়ি বের করে মেহবিনের হাতে দিলো।মেহবিন শাড়ি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইল।যার জন্য নিজে সাজবে ভেবেছিল তার জন্যই এখন অন্য কাউকে সাজাতে হচ্ছে।মাইজা মেহবিনের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-”কি ব্যাপার মেহু।কোনো সমস্যা?
মেহবিন শুধু মাথা নাড়াল।তারপর মাইজাকে শাড়ি পরিয়ে দিলো।শুধু এইটুকুই না।সাজিয়ে দিলো।চোখে মোটা করে কাজল,মাসকারা,ঠোটে মিস্টি কালার লিপস্টিক।সবশেষে চুল বাধতে নিলে মাইজা থামিয়ে দিয়ে বললো-
-”বাধিস না।মায়ান ভাইয়ের খোলা চুল পছন্দ।
কথাটা বলে মাইজা লাজুক হাসলো।মেহবিন আয়নায় মাইজার দিকে তাকিয়ে রইল।মেহবিন নিজের কথা ভেবে নিজেই অবাক হলো।সে কি করে এতটা শক্ত হয়ে গেলো।মাইজার ভালো থাকা নিয়ে ভাবতে গিয়ে কি সে নিজেই বুকে শক্ত পাথর রেখে ফেললো।মায়ানকে অন্য একজনের হাতে তুলে দিতেও যে তার কান্না পাচ্ছে না।ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে।তবুও চোখে অশ্রু নেই।মাইজা উঠে দাড়াল।ঘর থেকে বের হতে নিতেই মেহবিন মাইজাকে ডেকে উঠলো।মাইজা মেহবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-”কিছু বলবি?
মেহবিন তৎক্ষণাৎ কিছু বললো না।সে নিজেই জানে না কেনো সে মাইজাকে ডেকেছে।হয়তো চায়না মাইজা মায়ানের কাছে যাক।মেহবিন আলতো হেসে বললো-
-”সুন্দর লাগছে তোকে।
মাইজা ভ্রু উচিয়ে বললো-
-”এইটুকুই?
-”হ্যা আর কি হবে?
মাইজা কিছু বললো না।মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রহস্যজনক হেসে চলে গেলো।মেহবিন সেখানেই থম মেরে দাড়িয়ে রইল।তার জীবন যেনো কবেই থমকে গেছে।
——————–
আকাশের আজ শুভ্র নীলের সম্মিলনে মেঘ জমেছে।শুভ্র মেঘগুলো নীল রঙে ঘেরা আকাশময়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কোথাও কালো মেঘের কোন চিহ্ন নেই।তবে ঘন কালো মেঘ জমেছে মায়ানের হৃদয়ে।ভেতরের অশান্ত মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছেনা।আজকের দিন আর রাতটুকু শুধু বাকি।কাল মাইজার সাথে গায়ে হলুদ পরশু বিয়ে।শেষ।তবে কি এক জোড়া প্রেমপায়রা আলাদা হয়ে যাবে চিরতরে।হ্যা যাবেই তো।আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।আজ পনেরো দিন হয়ে গেলো মেহবিনের সাথে দেখা হয়না।সে নিজে থেকেই দেখা করেনি।কি লাভ শুধু শুধু মায়া বারিয়ে।মায়ান ছাদের রেলিং এ হাত রেখে সুদূর আকাশে তাকাল।
-”শুনছেন?
পাশ থেকে মেয়েলি মিহি কন্ঠ শুনে মায়ান ঘার ঘুরিয়ে তাকাল।মাইজা দাড়িয়ে আছে।মাইজাকে বর্তমানে নজর কাড়ার মতো সুন্দর লাগছে।কালো শাড়ি,খোলা চুল,চোখে কাজল।সব মিলিয়ে সুন্দরীদের মধ্যে সেরা।তবে মায়ানের নজর কাড়ল না।সে তো তার শ্যামলতাতেই আসক্ত।মায়ান মাইজার থেকে চোখ সরিয়ে আবারো সামনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-”কিছু বলবে মাইজা?
মাইজা মায়ানের আরেকটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।মায়ান মাইজার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো।মাইজা হঠাৎ বলে উঠলো-
-”আমাকে শাড়িতে কেমন লাগছে মায়ান ভাই?
বলেই একটু স্টাইল নিয়ে দাড়াল।মায়ান বিরক্ত হলো।সুন্দর লাগলে এমনিতেই লাগবে।এমন বেকিয়ে দাড়ানোর কি আছে।মায়ান বিরক্তি প্রকাশ করলনা।বললো-
-”ভালো।
-”শুধুই ভালো।আরো কিছু বলুন।নিজের হবু বউকে একটু কম্প্লিম্যান্ট ই নাহয় দিবেন।তাতে সংকোচের কি আছে।
মায়ান কতিপয় বিরক্ত হলো।ভেতরটা এমনিতেই বিষাক্ততায় ঘিরে আছে।তার উপর মাইজার করা এসব পাগলামি তার ভালো লাগছে।মায়ান চোয়ালে গম্ভীরতা রেখে বললো-
-”বললাম তো ভালো।এর বেশি কিছু বলতে পারবোনা।
মাইজা তাকিয়ে রইল মায়ানের দিকে।তার ফেইরিটেলের রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে থেকেই আকস্মিক ভাবে বলে ফেললো-
-”আমাকে একবার ভালোবাসি বলবেন মায়ান ভাই?
মায়ান চমকে গেলো।মাইজার কথা কর্ণকুহুরে প্রবেশ করতেই মায়ানের বিরক্তি চরমে গিয়ে ঠেকলো।মায়ান কথা বললো না।এখন কথা বলতে গেলেই উল্টো পাল্টা বলে ফেলবে।পরে মাইজা কষ্ট পাবে।সে চায়না মা হারা মেয়েটা কষ্ট পাক।হয়ত সহানুভূতি বা মনুষ্যত্বের খাতিরেই চায়না।মায়ানের থেকে জবাব না পেয়ে মাইজা হাসল।সেই হাসিতে আদোও কি ছিলো বুঝা গেলোনা।মাইজা নিজের শাড়ির আচল ঠিক করতে করতে বললো-
-”থাক বলতে হবেনা।সবাই যদি শুধু অভিনয় করে তাহলে বাস্তবতা যে হারিয়ে যাবে।
মায়ান মাইজার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।এই প্রথম মাইজার কোনো কথা তার বুঝতে একটু সময় নিতে হচ্ছে।কথাটাতে কেমন যেনো বাস্তবিক বাস্তবিক ব্যাপার আছে।মাইজা আচল ঠিক করে মায়ানের দিকে তাকাল।তারপর সুন্দর করে হেসে বললো-
-”থাকুন আপনি।আমি গেলাম।
মাইজা চলে গেলো।মায়ান আবারো সামনে তাকাল।নিচে তাকাতেই দেখল ডেকোরেশনের লোকরা এসে পরেছে।রাফিজ আর মেহবিনের বাবা ওদের সাথে কথা বলছে।হয়ত একটু পর থেকেই ডেকোরেশনের কাজ শুরু হবে।চারিপাশে রঙিন আলো জ্বালিয়ে তার হৃদয়ের সব আলো নিভিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দিবে।মাইজা কয়েক সিড়ি নেমে থেমে গেলো।পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।এখান থেকে শুধু মায়ানের একপাশ দেখা যাচ্ছে।মাইজা সেদিকে তাকিয়ে ঠোট প্রসারিত করে হেসে বললো-
-”সব ভালোলাগাতে ভালোবাসা থাকেনা,তেমনি সব ভালোবাসা পূর্ণতা ও পায়না।
( প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে লিখেছি।জানিনা কেমন হয়েছে।সবাই একটু রেসপন্স করবেন প্লিজ।)
চলবে……..