#অব্যক্ত ভালোবাসা
#পর্ব :৩৫
#সুমাইয়া ইসলাম
🍁
দিন গড়িয়ে রাত।রাত গড়িয়ে সকাল।শেষমেশ এসেই গেলো সেই কাঙ্খিত দিনটি।আসলেই কি দিনটি কাঙ্খিত।সবার জন্য না হলেও একজনের জন্য কাঙ্খিত।আজ মাইজার গায়ে হলুদ।মাইজা আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে।আজ সে বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে।মেহবিন আগেই উঠে গিয়েছে।আসলে উঠে গিয়েছে বললে ভুল হবে।সে তো ঘুমোয় নি।কাদতে কাদতে শুধু চোখ লেগে এসেছিলো।মেহবিন ওঠে বারান্দায় গিয়ে বসে রইল।তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে গেলো।মাইজা ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বারোটা বেজে গিয়েছে।সে ঘুম থেকে জেগে আর খেলো না।মেহবিন ওকে নাস্তার জন্য বলেছিলো কিন্তু সে না করে দিয়েছে।বলেছে একেবারে দুপুরের খাবার খাবে।মেহবিন দুপুরের দিকে ঘরে মাইজার জন্য খাবার নিয়ে গেলো।মেহবিন ঘরে গিয়েই দেখল মাইজা মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।মাইজা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলল।মেহবিনকে খাবার হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কান থেকে হেডফোন খুলল।তারপর মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বললো-
-”খাবার নিয়ে এসেছিস?একটু বস আমি মুখটা ধুয়ে আসছি।
মাইজা ওয়াশরুমে চলে গেলো।মেহবিন খাবারের প্লেট টা টেবিলে রেখে সোফায় গিয়ে বসল।মায়ানের আজ গায়ে হলুদ।হলুদ পাঞ্জাবিতে নিশ্চয়ই মায়ানকে আজ বেশ সুন্দর লাগবে।তবে এই সৌন্দর্য্যে ঘেরা মানুষটা যে তার না।সে আজ অন্য কারো জন্য সাজবে।মেহবিনের বুক ফেটে যাচ্ছে।কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আছে।সে কাদতে চায় না।তাকে যে হাসতে হবে।মাইজার খুশির জন্য হাসতে হবে।ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দে মেহবিন কয়েকবার পলক ঝাপটে চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু মিলিয়ে দিলো।মাইজা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে লাগল।মেহবিন তাকিয়ে রইলো মাইজার দিকে।মাইজার সৌন্দর্য যেন অধিক বেরে গিয়েছে।মাইজা মুখ মুছে তোয়ালে খাটে রেখে মেহবিনের সামনে বসল।তারপর বললো-
-”আমাকে খায়িয়ে দিবি মেহু।আমি মেনিকিউর করেছি।
মেহবিন মলিন হেসে খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিলো।তারপর এক লোকমা ভাত মাইজার মুখে পুরে দিল।মাইজা আরাম করে বসে খাবার খেতে খেতে বললো-
-”আমাকে খায়িয়ে দিয়ে তুই ও তারাতারি খেয়ে নে।অনেক কাজ বাকি।তোকেও ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিবো।
মেহবিন ভাত মাখিয়ে মাইজার মুখে দিয়ে বললো-
-”আমার এসব লাগবেনা।আমি এগুলো না দিয়েও যেমন থাকবো দিলেও তেমন থাকবো।
মাইজা মুখ লটকিয়ে বললো-
-”তোকে বেশি কথা বলতে বলেছি।দিয়ে দিবো মানে দিয়ে দিবো।
তারপর একটু চুপ থেকে বললো-
-”যতই হোক গায়ে হলুদ বলে কথা।
-”গায়ে হলুদ তো তোর।আমি এতকিছু করে কি করবো?
মাইজা মুখে শেষ লোকমা নিয়ে বললো-
-”গায়ে হলুদ তো গায়ে হলুদই।সেটা যার ই হোক।আর আজকে পার্লারের মেয়েরা এসে আমাকে সাজালেও তোকে কিন্তু আমিই সাজিয়ে দিবো।
মেহবিন বহু কষ্টে বললো-
-”আমি সাজবো না মাজা।প্লিজ জোর করিসনা।
মাইজা চেহারায় গাম্ভীর্য এনে বললো-
-”আমার জন্য এতকিছু করতে পারছিস।সাজতে পারবিনা?
মেহবিন তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।মাইজার খুশির জন্য তার এখন কষ্ট পাওয়াও বারণ।মেহবিন কিছু না বলে প্লেট নিয়ে চলে গেলো।মাইজা সেদিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি হাসল।
————————–
আকাশে বুকে সন্ধ্যা নেমেছে।সুর্য ডুবে নীল আকাশে কালো অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে।মায়ান নিজের ঘরে বসে রেডি হচ্ছে।রাফিজ আছে তার সাথে।মায়ান আজ হলুদ কমলার সংমিশ্রণে একটা পাঞ্জাবি পরেছে।চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা।হাতে ঘড়ি।মায়ানকে বেশ লাগছে।তবে চেহারার অবস্থা খারাপ।উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে।চোখের নিচে কালি পরে গিয়েছে। মুখের বেহাল দশা।অথচ তাতে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই।যেই ছেলে সবসময়ই নিজেকে টিপটপ অবস্থায় রাখত সে আজকে অগোছালো।রাফিজ গায়ে সাদা পাঞ্জাবী জড়িয়ে মায়ানের দিকে তাকাল।মায়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বন্ধুর এমন অবস্থা তার কাছে সহনীয় নয়।সে বেশ বুঝতে পারছে মায়ান কষ্টে আছে।একই সাথে মেহবিন ও কষ্টে আছে।সব জানার পরো সে নিরুপায়।গতকাল রাতে সে মাইজার সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছিল।মাইজা শুধু একটা কথাই বলেছে।তাকে একটু সময় দিতে।সে নাকি সব ঠিক করে দিবে।আর একটা অদ্ভুত অনুরোধ করেছে।এই বিয়ের কথা সে তার আত্মীয়,বন্ধু বান্ধব কাউকে জানাতে বারণ করেছে।রাফিজ এই বিষয়ে আপত্তি জানালেও পরে মাইজা জোর গলায় বলায় রাজি হয়েছে।রাফিজ মায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
-”এটা কি ঠিক হচ্ছে মায়ান?
রাফিজের কথায় ভাবনা থেকে ছিটকে পড়ল মায়ান।রাফিজের দিকে তাকিয়ে বললো-
-”কিসের কথা বলছিস?
-”তুই কেনো মাইজাকে বিয়ে করতে রাজি হলি।তুই তো মাইজাকে ভালোবাসিস না তাহলে কেনো এমন করলি?
মায়ান ছোটো করে শ্বাস ছাড়ল।তারপর পাঞ্জাবির উপর কমলা রঙের কটি পরতে পরতে বললো-
-”এসব বলে এখন আর কিছু বদলানো যাবেনা।আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আর প্রথম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দু’বছর মেহবিনকে ছেড়ে গিয়ে।সেই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে।
তারপর রাফিজের দিকে তাকিয়ে ওর কাধে হাত রেখে বললো-
-”মাইজাকে আমি কখনোই ভালোবাসতে পারবোনা।কিন্তু ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার।
শেষের কথাটা মায়ান মন থেকে বললেও কথাটা বলতে তার বুকে ব্যথা অনুভব করছিল।সে তো মেহবিনের ভালো খারাপের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল।অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস।রাফিজ মাথা নাড়ল।তখন মিসেস তনয়া ঘরে এসে মায়ানকে বললো ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসতে।
🍂
মাইজা ভারি লেহেঙ্গা পড়েছে।ওর লেহেঙ্গা পুরোটাই হলুদ।পার্লারের মেয়েরা কিছুক্ষন আগে সাজিয়ে দিয়ে গেছে।এখন সে বসে আছে মেহবিনের অপেক্ষায়।মেহবিনকে কিছুক্ষন আগে হলুদ কমলার সংমিশ্রণে একটা জামদানি শাড়ি দিয়ে বলেছে ওয়াশরুম থেকে পড়ে আসতে।মেহবিন বারবার না করছিলো।মাইজা ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে মেহবিনকে ওয়াশরুমে পাঠিয়েছে ঠিকি কিন্তু এখনো ওর বের হওয়ার নাম গন্ধ নেই।প্রায় আধঘন্টা ধরে মাইজা বসে আছে। বিরক্ত হয়ে দরজায় নক করবে তখনই মেহবিন বেরিয়ে এলো।গায়ে সেই হলুদ কমলা শাড়িটা।মেহবিনের চোখ মুখ একদম ফুলে আছে।মাইজা মেহবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে টিপ্পনী করে বললো-
-”কিরে মেহু,তোর চোখ মুখ এমন ফুলে আছে কেনো?যাক সুন্দরী লাগছে।আয় সাজিয়ে দেই।
মাইজা মেহবিনকে টেনে আয়নার সামনে বসাল।মেহবিন কিছু বলছেনা।তার যে কিছুটি ভালোলাগছে না।মাইজা মেহবিনকে একদম ভারি সাজ সাজিয়ে দিলো।মাইজা মেহবিনকে সাজিয়ে দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বললো-
-”হায়,কি সুন্দর লাগছে তোকে মেহু।আমিই তো তোর প্রেমে পড়ে যাব।
মেহবিন আয়নায় তাকাল না।মাইজা আরো কিছু বলবে তখনই মিসেস রুকাইয়া ঘরে এলেন।এসে তাড়া দিয়ে কিছু বলবেন তখনই মাইজার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো।মাইজাকে দেখে তার বুকটা ভরে গেলো।তিনি মাইজার কাছে দাঁড়িয়ে ওর গালে হাত দিয়ে বললো-
-”কি সুন্দর লাগছেরে তোকে।অনেক সুখী হো।
মাইজা হেসে বললো-
-”দোয়া কর।
——————-
সন্ধ্যার পর পরই মায়ানের হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো।মিসেস তনয়া এবার গেলো মাইজাকে হলুদ ছোয়াতে।তিনি গেলেই মাইজার হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে।তিনি একতলা নেমে মেহবিনের বাসায় গেলো।কলিংবেল প্রেস করতেই মিসেস রুকাইয়া দরজা খুললেন।হাসিমুখে ওনাকে ভেতরে আসতে বললেন।মাইজা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে।তার পাশে মেহবিন।তিনি মাইজার আরেক পাশে বসতেই মাইজা তার দিকে তাকাল।মিসেস তনয়া মাইজার থুতনি ধরে হেসে বললেন-
-”তোকে আজকে একদম রাজকুমারীর মতো লাগছে।মাশাআল্লাহ।
মাইজা লাজুক হাসে।মেহবিন শক্ত হয়ে বসে আছে।মিসেস তনয়া হাতের ফোনটা বের করে বললো-
-”আয় তোর কয়েকটা ছবি তুলি।মায়ানকে গিয়ে দেখাবো।আমার ছেলে আজ তোকে দেখে পাগলই না হয়ে যায়।
মাইজা থমথমে চোখে তাকাল মেহবিনের দিকে।মেহবিন শক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।মাইজা কিছু বলবে তখন মিসেস রুকাইয়া এসে বললেন-
-”আপা হলুদ ছোয়ানো শুরু করা উচিত এখন।
মিসেস তনয়া ছবি তোলার কথা ভুলে মিসেস রুকাইয়ার কথায় সায় জানায়।মিসেস রুকাইয়া হলুদের বাটি মিসেস তনয়া কে দিলো।মাইজা মেহবিনের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো-
-”তুই কি কিছু বলতে চাস মেহু?
মেহবিন চমকে মাইজার দিকে তাকাল।তারপর ঝটপট উত্তর দিলো-
-”না কি বলবো?
মাইজা আর কিছু বললোনা।মিসেস তনয়া হলুদ একটু হাতে নিয়ে মাইজার গালের কাছে নিতেই মাইজা জোরে হাচি দিতে লাগলো।একের পর এক হাচি দিতেই লাগলো।ঘরের সবাই হকচকিয়ে গেলো।মেহবিন মাইজার কাধে হাত দিয়ে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল-
-”কি হয়েছে তোর।এত হাচি দিচ্ছিস কেনো।
মাইজা হাচি দিতে দিতে বললো-
-”আরে আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার হলুদে কত এলার্জি।হাচ্চি।
মেহবিন চোখ ছোট ছোট করে বললো-
-”তুই না আজকে দুপুরেও কাচা হলুদের ফেসপ্যাক লাগালি?
মেহবিনের হাচির সাথে এবার কাশির উপদ্রব বেড়ে গেলো।তাকে দেখে এখন যে কেউ যক্ষ্মা রোগী বললেও ভুল হবেনা।
এমন একটা পরিস্থিতিতে রাফিজ সেখানে এলো।বোনের এমন দশা দেখে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই মিসেস রুকাইয়া সব বললো।পরিশেষে রাফিজ সিদ্ধান্ত জারি করল-
-”আমার বোনের যখন হলুদে সমাপ্তি।তখন হলুদ লাগাতে হবেনা।এমনিতেও ইসলামে তেমন কোনো নিয়ম নেই।
শেষপর্যন্ত মাইজার অনুষ্ঠান সেখানেই সমাপ্ত হলো।বাসা খালি হলো।মাইজা একটা হাই তুলে ঘরে চলে গেলো।মেহবিন এতক্ষণ যাবত চুপ করে সব দেখছিল
তার যে কিছুই ভালোলাগছে না।সেও ধীর পায়ে ঘরে গেলো।মাইজা তখন ওয়াশরুমে।মেহবিনের সব কিছু বিরক্ত লাগছে।তার শরীর ক্লান্ত।ক্লান্ত ভরা শরীরটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমের অতলে ডুবে গেলো।
গভীর রাত তখন।পুরো রুমময় অন্ধকার।মেহবিন বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।তখনই কেউ একজন মেহবিনের পাশে বসল।হাতে হলুদ নিয়ে খুব সাবধানে মেহবিনের গালে লাগিয়ে দিলো।ঠোটে হাসি ফুটে উঠল।সেই হাসির সাথে তাল মিলিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো-
-”হলুদের প্রলেপ সঠিক মানুষের গালেই ছোয়ানো হলো।
চলবে…..