#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৩৪
ধীরে সুস্থ চোখ খুলে তাকালাম। বাম হাতটা কেমন যেনো ঝিম ধরে আসছে। ঘাড় কাত করে বাম দিকে তাকালাম। রুদ্র আমার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। বাঁচার আশা যখন ছেড়ে দিয়েছিলাম ঠিক তখনি রুদ্রকে দেখতে পাই। বাঁচার ক্ষীণ আশা জেগে ওঠে মনে। কিন্তু পরমুহূর্তেই শরীর অসাড় হয়ে আসে। তলিয়ে যাই পানির নিচে।
এই তো বউমার ঙ্গান ফিরেছে।
আচমকা কারো গলা শুনে চমকে ওঠলাম। রুদ্র ফট করে চোখ খুলে তাকাল। চোখাচোখি হলো দুজনের। আমি ঘাড় কাত করে ডান দিকে তাকালাম। মামুনি বিছানার এক পাশটায় বসে আছে। আংকেল চেয়ারে বসে আছেন। সোফায় দাদু, ফুফি আর ফুফির এক মেয়ে বসে আছে। এখানে উপস্থিত অনেকেই আছে। কিছু অপরিচিত কিছু অর্ধপরিচিত মুখ।
এতগুলো লোকের সামনে আমি শুয়ে আছি। ভাবতে কেমন লাগছে। আমি দ্রুত ওঠে বসতে নিলে মামুনি আমাকে ধমক দিয়ে পিছনে বালিশ দিয়ে আধশোয়া করে বসিয়ে দেয়। কিয়ৎক্ষণ রুদ্র আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হুট করেই রুদ্র এক ঘর লোকের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা রুদ্রের কাজে আমি চমকে ওঠি। পরমুহূর্তেই এক ঘর লোকের সামনে রুদ্র আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ভাবতেই লজ্জায় আমি মাথা নুইয়ে ফেললাম।
কারো দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস আমার হলো না। লজ্জা, অস্বস্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। রুদ্রকে দূরে সরানোর জন্য এই যে ধাক্কা দিচ্ছি। কিন্তু রুদ্রকে এক চুলও নড়াতে পারলাম না। বুঝতে পারছি না রুদ্র কী লজ্জা সরম বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন।
দরজা লাগানোর শব্দে বুঝতে পারলাম আমাদের স্পেস দিতে সবাই চলে গেছে। উনার হিম শীতল করা স্পর্শে আমি জমে গেলাম। উনার হাত পা অসম্ভব রকম ঠান্ডা। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই উনি বলে
ওঠলেন,
তুমি এতো কেয়ারলেস কেনো? তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার কী অবস্থা হয়েছিল তুমি জানো? দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এই বুঝি আমার নিশ্বাসটাও চলে গেলো। বার বার মনে হচ্ছিল তোমাকে হয়তো আমি হারিয়ে ফেলবো। তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিল। তোমার কিছু হলে আমি কী নিয়ে বাঁচতাম? আমি মরেই যেতাম।
ঘাড়টা ভিজে ভিজে লাগায় আমি ঘাড়ে হাত দিলাম। উনি ফট করেই আমাকে ছেড়ে দিলেন। একদম রুমের বাইরে চলে গেলেন। আমি উনার যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল দিকে তাকালাম। আঙ্গুলের ডগায় পানি চিকচিক করছে। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা উনারই চোখের জল। উনার রুম থেকে চলে যাওয়ার কারণটাও আমার কাছে অজানা নয়। উনি নিজের অনুভূতি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
একটু পরেই মামুনি রুম আসলো হাতে খাবারের প্লেট। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো। প্রতিত্তরে আমি মৃদ্যু হাসলাম। মামুনি খাবারের প্লেটটা নিয়ে আমার পাশে বসলো।
রুদ্র তোকে আজকাল চোখে হারাচ্ছে।
মামুনির কথা শুনে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। মামুনি আলতো হেসে বলে,
হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। রুদ্র কোথায়? একটু আগে তো এখানেই ছিল।
তুমি আসার কিছুক্ষণ আগেই রুম থেকে চলে গেলো।
এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না। কারো কথা
শুনে না। নিজে যা বলে তাই ঠিক। কিন্তু তোকে নিয়ে ভীষণ পসেসিভ। আমার মনে হয় আমার ছেলেটা তোকে ভালোবেসে ফেলেছে।
আমি মামুুনি দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকাই। মামুনি আলতো হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
তোকে পুকুর থেকে তুলে এনে পাগলের মতো চিৎকার করছিল। তোর ঙ্গান ফিরছিল না বলে পাগলামি করছিল। অস্থির হয়ে পড়েছিল। এর আগে আমি কখনো ওকে এতোটা ডেস্পারেট হতে দেখিনি। ড. আরাফ আয়মান রুদ্র যার মন নাকি পাথরের মতো। জটিল জটিল অপারেশন করতেও যার হাত কাঁপে না। তার নাকি আজকে একটা সামান্য ইনজেকশন পুশ করতে হাত কাঁপছিল। পরে তোর আংকেল ইনজেকশন পুশ করে। ভেজা জামা কাপড় নিয়েই তোর হাত ধরে বসেছিল। আমরা কেউ ঠেলেও ওকে ড্রেস চেইন্জ করতে পাঠাতে পারিনি। রুদ্রর এক কথা যতক্ষণ পর্যন্ত না তোর ঙ্গান ফিরছে ততক্ষণে সে এখান থেকে এক পা নড়বে না।
মামুনি আমার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিতেই আমি কাচুমাচু মুখ করে মামুনির দিকে তাকালাম। উনি হয়তো এখনো খাওয়া দাওয়া করেননি। আমি কী করে খাই? মামুনি আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বলে,
কী সমস্যা খাচ্ছিস না কেনো? চুপচাপ হা কর।
মামুনি উনি কিছু খাননি। আমি কী করে উনাকে রেখে…..
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হুড়মুড়িয়ে রুমে মানুষ ঢুকে পড়ে। মানুষগুলোকে ভালো করে দেখে বুঝতে পারলাম একটু আগে যারা এসেছিলেন। দাদু রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
কী গো নাতবৌ আমার নাতিকে কিসের আঁচলে বাঁধছো? সে তো বউ ছাড়া কিছু বুঝে না। এই বুড়ো বউটাকেও ভুলে গেছে।
দাদুর কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। এভাবে কেউ বললে আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। দাদু এসে আমার পাশে বসে।
হয়েছে হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। লজ্জায় গাল দুটো তো লাল হয়ে গেছে। দোয়া করি সারাজীবন এমনি থাক। তোদের ভালোবাসা অটুট হোক। কারো নজর যেনো না লাগে। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যেমন বিশ্বাসের প্রয়োজন। তেমনি ভালোবাসারও প্রয়োজন হয়।
_______________
রুদ্র ল্যাপটপে কাজ করছে আর আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আমাকে ছটফট করতে দেখে রুদ্র চিন্তিত কন্ঠে বলে,
কী হয়েছে এমন ছটফট করছো কেনো?
কথাটা বলতে বলতে রুদ্র আমার কপালের ওপর হাত রাখে। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠ বলে,
সবসময় তোমার কেয়ারলেসপানা আমার আর ভালো লাগে না। এতো জ্বর তুমি আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করলে না।
রুদ্র আমাকে ছেড়ে দ্রুত ঔষধ নিয়ে আসেন। রীতিমতো আমাকে জোড় করে খাইয়ে দেন। লাইট অফ করে এসে শুয়ে পড়লেন। আমাকে ও টেনে শুইয়ে দিলেন। আলগোছা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। উনি ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন,
কী হলো ঘুমাচ্ছো না কেনো? তোমার এখন রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।
ঘুম আসছে না তো। আমার এখন আলাদা থাকা উচিত। আমার জ্বর হয়েছে যদি এটা ভাইরাল ফিভার হয় সেটা আপনার জন্য সমস্যা। আপনারাও হয়ে যাবে। আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন।
উনি এক টানে আমাকে উনার বুকের মাঝে নিয়ে যান। আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।
হুশশ। আর কোনো নয় চুপচাপ ঘুমাও।
হঠাৎই উনার ফোনটা বেজে ওঠলো। উনি এখানেই বসে ফোনটা রিসিভ করলেন।( উনার একটা কথায় আমার কর্ণগোচর হলো প্রীলিয়ে মারা গেছে।
চলবে…