#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪২
হুট করেই উনি চুপ করে গেলেন। উনি নিশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কর্ণগোচর হচ্ছে না। নিস্তব্ধ পরিবেশে বিকট একটা আওয়াজ হলো। পর পর কয়েকটা গাড়ির চাকার শব্দ হলো। আমার আর কিছু কর্ণগোচর হলো না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি থমকে গেলাম। ফোনটা হাত থেকে পরে গেলো।
উনার কিছু হয়নি তো এই ভাবনা মাথায় আসতেই আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বিছানার ওপর থেকে দ্রুত ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। উনাকে অনবরত ফোন করতে লাগলাম। কিন্তু বার বার ফোন বন্ধ বলছে। টেনশনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
আমি চিৎকার দিয়ে আব্বু-আম্মুকে ডাকলাম। আমার চিৎকার শুনে ছুটে আসলো ভাইয়া আব্বু-আম্মু। ভাইয়া বার বার জিঙ্গেস করে যাচ্ছে। কী হয়েছে? আমি চিৎকার কেনো করলাম? কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কথাগুলো যেনো সব আমার গলায় আটকে আসছে। যেনো কেউ আমার গলা চেপে ধরে আছে। আমি ঠোঁট নাড়িয়ে কোনো মতে রুদ্রর কথাটুকু বললাম। ভাইয়া কতটুকু আমার কথা বুঝলো তা আমার বোধগম্য হলো না।
ভাইয়া পরমুহূর্তেই কাউকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। যতটুকু বুঝলাম ভাইয়া রুদ্রকে ফোনে ট্রাই করছে। রুদ্রকে ফোনে না পেয়ে ভাইয়া ছুটে নিজের রুমে চলে গেলো। কিযৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই ভাইয়া হাতে করে একটা ডায়েরী নিয়ে আমার রুমে আসলো।
ডায়েরী থেকে কারো নাম্বার ফোনে তুলল। ভাইয়া ফোন করতে করতে বেলকনিতে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর বেলকনিতে কিছু পড়ার শব্দ শুনে আমি আম্মু আর আব্বু ছুটে গেলাম। ভাইয়ার ফোনটা তিন টুকরো হয়ে বেলকনিতে ছড়িয়ে আছে আর ভাইয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু-আম্মু অনবরত জিঙ্গেস করে যাচ্ছে কী হয়েছে? কিন্তু ভাইয়া কোনো কথা বলছে না। যেনো ভাইয়া বাক শক্তিহীন হয়ে গেছে। আমি ভাইয়াকে দু হাতে আঁকড়ে ধরে জিঙ্গেস করে যাচ্ছি, কী হয়েছে? রুদ্রর কোনো খবর পাওয়া গেছে কী না? ভাইয়া আমার দিকে অশ্রু সিক্ত চোখে তাকাল। আমি ভাইয়ার অশ্রু সিক্ত চোখ দুটো দেখে দু পা পিছিয়ে গেলাম। শুধু একটা কথায় মনে হচ্ছে রুদ্রর কিছু হয়নি তো? আম্মু আরেক বার জিঙ্গেস করতেই ভাইয়া ভাঙা ভাঙা গলায় উত্তর দেয়।
কোন ডক্টরের গাড়ির ওপর নাকি গাছ পড়েছে। গাড়ি থেতলে গেছে। গাড়ির ভিতর যে ডক্টরটা ছিল তিনি আর বেঁচে নেই। উনারও সারা শরীর থেতলে গেছে। অক্ষি কোঠর থেকে চোখ দুটো বেরিয়ে এসেছে। পা দুটো কেটে………..
আর কিছু আমার কর্ণগোচর হলো না। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসলো। মুহূর্তের মাঝেই ঢলে পড়লাম।
________________
ঙ্গান ফিরলে নিজের চোখের সামনে শুভ্র রঙটা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম। মস্তিষ্কে শুধু একটা কথার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। রুদ্রর কিছু হয়নি। রুদ্রর কিছু হতে পারে না। কিছুক্ষণ পর অনুভব করতে পারলাম। আমার মাথা কেউ আলতো হাতে সন্তপণে নিজের বক্ষঃপিঞ্জরে চেপে ধরে আছে। নাকে ঠেকছে খুব পরিচিত একটা পারফিউমের স্মেল। মাথাটা তুলে লোকটার মুখ দেখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। মাথাটা ভার ভার লাগছে। মাথা তুলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথা তুলার বৃথা চেষ্টা না করে ঘাড় কাত করে মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। কাঙ্ক্ষিত মুখটা দৃষ্টিগোচর হতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি থমকে গেলাম।
আমি এক হাত বাড়িয়ে রুদ্রর গালের এক পাশে হাত রাখলাম। কী নিষ্পাপ মুখশ্রী। এই ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে আমি এক জনম কাটিয়ে দিতে পারবো অনায়সে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না রুদ্র আমার চোখের সামনে শুয়ে আছে। আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে উনাকে দেখতে লাগলাম। আমি হালকা নড়েচড়ে ওঠতেই রুদ্রর চোখ দুটো উন্মুক্ত হয়ে গেলো। রুদ্র আমার সামনে উপস্থিত আছে এটা আমার অনুভূত হতেই সমস্ত ব্যথা যন্ত্রণা উপেক্ষা করে দ্রুত ওঠে বসলাম। আমাকে তড়িঘড়ি করে ওঠে বসতে দেখে রুদ্রও আমার সাথে ওঠে বসলো। উনি কিছু বলার আগেই আমি দু হাতে উনার মুখটা আগলে নিলাম।
এটা আপনিই না? আপনিই তো আমার সামনে বসে আছেন তাই না? আপনার কিছু হয়নি? কোনো এক্সিডেন্ট ফেক্সিডেন্ট আপনার হয়নি?
রিল্যাক্স আমার কিছু হয়নি।
আমি জানতাম আপনার কিছু হতে পারে না। আপনি আমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারেন না। জানেন ভাইয়া বলছিল আপনার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি আর নেই। এটা শোনার পর আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আপনার কিছু হলে আমি সত্যিই মরে যেতাম। আপনাকে ছাড়া এই পৃথিবীর অক্সিজেনও আমার কাছে বিষাক্ত লাগে। বিশ্বাস করুন আপনার কিছু হলে আমি সত্যিই মরে যেতাম।
উনি আমার অধর জোড়ায় আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দিলেন।
হুশশশ। চুপ একদম চুপ। আর কোনো কথা নয়। আমার কিছু হয়নি আমি একদম ঠিক আছি। আই’ম অল রাইট। ইচ্ছে করছে থাপড়ায়া তোমার গাল লাল করে দেই। আমার সামনে বার বার মরে যাওয়ার কথা বলতে তোমার বুক কাঁপছে না?
আমি উনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
তোমার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশের মোটামুটি বড় সাইজের গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। একচুয়ালি এই রাস্তাটার দু পাশেই সারিবদ্ধ ভাবে গাছ লাগানো। চোখের পলক ফেলার আগেই গাছটা ভেঙে একটা গাড়ির ওপর পড়ে যায়। আচমকা এমন ঘটনাই আমি স্তম্ভিত হয়ে যায়। দ্রুত ব্রেক কষতে গিয়ে আমার ফোনটা জানালা দিয়ে ছিটকে বাইরে পড়ে যায়।
আমার গাড়ির সাথে সাথেই আরো কয়েকটা গাড়ি থামে। সবাই ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিল। তাদের মাঝেই একজন পুলিশকে ফোন দেয়। আমরা কয়েক জন মিলেই গাছটা সড়ানোর ট্রাই করছিলাম। ততক্ষণে পুলিশ চলে আসে পুলিশ স্টেশনটা পাশেই ছিল। এতকিছুর মাঝে আমি তোমাকে ফোন করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। যে লোকটার এক্সিডেন্ট হয়েছিল তিনিও একজন ডক্টর ছিলেন। আমাদের সিনিয়র ডক্টর। অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আকস্মিক উনার এমন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না।
উনার ওয়াইফ আছে?
হ্যাঁ স্যারের ওয়াইফ আছে। উনাকে আমি যত বার দেখছি তত বারই উনাকে ভীষণ শান্ত দেখছি। কখনো কারো সাথে ঝগড়া করতে দেখি নাই। কারো সাথে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি। উনি নিচু স্বরে নমনীয় কন্ঠে কথা বলেন। আর আজকে উনার এক অশান্ত রূপ দেখে আসলাম পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছেন।
এটাই তো স্বাভাবিক। উনার জায়গায় তো আজকে আমিও থাকতে পারতাম এটা ভাবতেই আমার বুক কেঁপে ওঠছে।
কার এক্সিডেন্ট হইছে এটা না শুনেই মাথা টাথা ফাটিয়ে বসে আছো। যদি সত্যিই এটা আমি হতাম তাহলে না জানি তুমি কী করতে?
একদম বাজে কথা বলবেন না। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আপনি একদম ঠিক আছেন।
মাথায় চিন চিন ব্যথা অনুভব হতেই মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভেসে এলো আহ। আমি মাথা চেপে ধরলাম। আমাকে কুকিয়ে ওঠতে দেখে রুদ্র আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
মাথা কী বেশি ব্যথা করছে? ডক্টর ডাকবো?
আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না। আমি একদম ঠিক আছি।
কতটুকু ঠিক আছো তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দুই দুইবার মাথায় আঘাত পেলে।
আমি পুনরায় উনার বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম। উনিও পরম যত্নে আমাকে দু হাতে আঘলে নিলেন।
তুমি কবে নিজের খেয়াল নিতে শিখবে বলো তো? আজকে যদি তোমার মাথা বেলকনির রেলিংয়ে না লেগে তুমি বেলকনি থেকে পড়ে যেতে তাহলে কী হতো ভাবতে পারছো? এটা ভাবলেই আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপে। আল্লাহর রহমতে আজকে একটুর জন্য তোমার বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়নি।
চলবে…….