#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৪৫
একদম ছাড়ব না। পারলে তুমি নিজেকে ছাড়িয়ে নাও। কী হয়েছে তোমার? বলবে না আমায়? কেউ কিছু বলেছে তোমায়? তুমি কী কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছো? আমি কী কোনো ভুল করেছি যার জন্য তুমি আমার ওপর রেগে আছো?
আমি নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলাম। উনাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিলাম। হঠাৎ এভাবে কেঁদে দেওয়ায় উনি হকচকিয়ে গেলেন। পরক্ষণেই অস্থির হয়ে পড়লেন। আমাকে এভাবে কাঁদতে উনি কখনো দেখেননি। তাই হয়তো একটু বেশিই অস্থির হয়ে পড়েছেন।
এই তুমি কাঁদছো কেনো? কী হয়েছে তোমার?
আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। আপনার সব ভালোবাসা অরি আপুর জন্য তাই না?
‘অরি’ নামটা শুনেই মনে হল উনি থমকে গেলেন। হাত আটকে গেলো আমার চুলের ভাজে। আমি উনাকে ছেড়ে দিয়ে ওঠে বসলাম। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
আমি তো শুধু আপনার অভ্যাস অরি আপু আপনার ভালোবাসা। আপনার ভালোবাসা, হাসি, সুখ সবই তো অরি আপুর।
উনি আমার বাহু চেপে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলেন, কী তখন থেকে অরি আপু, অরি আপু করে যাচ্ছো? অরিকে চিনো তুমি? কতটুকু জানো ওর সম্পর্কে?
অরি আপু আপনার প্রাক্তন। উনার হাত জোড়া থেমে গেলো। উনি আমাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে বসলেন। উনি অন্য দিকে তাকিয়ে বার কয়েক বার নিশ্বাস নিলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই আমাকে জিঙ্গেস করলেন,
এসব তুমি জানলে কী করে? তোমাকে অরির কথা কে বলেছে?
আপনি আজও আমাকে কিছু বলবেন না? প্রত্যেক বার আপনি খুব সূক্ষ্ম ভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে যান। আমি আর এসব মানতে পারছি না। আজ আপনি সব আমাকে বলবেন নাহলে সত্যি সত্যি আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব।
আমার আর অরির পরিচয়টা হয়েছিল কলেজে পড়াকালীন। পরিচয় বললে ভুল হবে ও নিজে এসে শুধু আমার পরিচয় জেনে নিয়েছিল। আমি ওর সম্পর্কে কিছু জিঙ্গেস করি নাই। ইনফ্যাক্ট নামটা পর্যন্ত জিঙ্গেস করি নাই। হুট করে আমি কারো সাথে মিশে যেতে পারি না। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতেও আমার ভালো লাগে না। অরির সাথে মিশার বা ওর পরিচয় জানার কোনো ইচ্ছে অথবা প্রয়োজন আমার ছিল না। কারণ আমাদের একটা ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল মোট পাঁচ জনের। রুনা আর ইলানকে তো চিনোই। আরো দুজন আছে। তারা দেশের বাইরে থাকে। আমি বরাবরই পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। প্রয়োজন বাদে আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের বাইরের কারো সাথে আমি কথা বলতাম না। আমি ক্লাসে কখনো আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কারো সাথে বসতাম না। কারণ ফ্রেন্ডরা একসাথে বসলে কথা হবেই এটা স্বাভাবিক। কথা নাহলে সেটা অস্বাভাবিক। আর ক্লাস চলাকালীন কেউ আমাকে ডিস্টার্ব করুক সেটা আমার পছন্দ ছিল না। আমার অপছন্দের কাজটাই অরি করতো। আমাকে ক্লাসে অরি বরাবরই ডিস্টার্ব করতো। প্রচণ্ড ডিস্টার্ভ করতো। বিরক্ত হয়ে স্যারকে বিচার দিতে গিয়েও দিতাম না। কারণ একটা মেয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করে ব্যাপারটা হাস্যকর। একদিন আমি কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করে দেই আমাকে যেনো ক্লাসে বিরক্ত না করে। ক্লাসে বিরক্ত করা ছেড়ে দিলে নতুন ওয়েতে আমাকে বিরক্ত করা শুরু করে। কলেজ শেষে আমি লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তাম। আমার ঐ দুই বন্ধু হোস্টেলে থাকতো। তাই তারা কলেজ ছুটি হওয়ার পর পরই চলে যেতো। কারণ সময় মতো না গেলে খাবার পাবে না। রুনা আর ইলান যেতো ঘুরতে। তাই আমি একাই লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তাম। লাইব্রেরীতে এসে বিরক্ত করা শুরু করে। অরি আমার পাশে বসে বক বক করতো। এভাবে কিছুদিন চলে। ও একা একাই কথা বলতো। আমি কখনো অরির কথার প্রতিত্তর করতাম না। প্রথম কিছু দিন ভীষণ বিরক্ত হতাম। বিরক্তি প্রকাশও করতাম কিন্তু ও আমার বিরক্তিটাকে পাত্তা দিত না। আস্তে আস্তে ওর বক বক করাটা আমার ভালো লাগতে শুরু করে। ওর বক বক শোনা আমার রোজকার রুটিন হয়ে গিয়েছিল। হুট করে ও একদিন আমাকে প্রোপোজ করে বসে।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম উনার পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য। উনি কিছু বলছেন না দেখে অধৈর্য হয়ে আমিই বলে ওঠলাম,
কী হলো চুপ করে গেলেন কেনো? এরপর কী হলো সেটা বলুন? আপনি কী অরি আপুর প্রোপোজেল এক্সেপ্ট করেছিলেন?
কথাটা বলার পর আমি বুঝতে পারলাম আমি কতটা বোকামি করেছি। প্রোপোজেল এক্সেপ্ট না করলে প্রাক্তন প্রেমিকা কীভাবে হবে?আসলেই আমি বিখ্যাত আবাল। তাই তো আবাল মার্কা আবাল মার্কা প্রশ্ন করি। উনি আমার দিকে মৃদু হেসে বলেন,
সহ্য করতে পারবে পরের কথাগুলো। কষ্ট হবে না তোমার? কেনো পুরোনো ঘটনা ঘেটে নিজের কষ্ট বাড়াতে চাইছো?
প্লিজ আপনি বলুন। সবটা না জানলে আমার কষ্ট বাড়বে বই কমবে না। এখন যদি না জানি তাহলে আক্ষেপ থেকে যাবে। রোজ আমি একটু একটু করে জ্বলবো। রোজ রোজ জ্বলার থেকে একবারে জ্বলা ভালো না।
উনি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলেন, তুমি বড্ড জেদী। যেটা করবে বলে ঠিক কর। ঠিক সেটাই কর। ও আমাকে প্রোপোজ করেছিল সবার সামনে ক্যান্টিনে। তাই ওকে রিজেক্ট করতে পারিনি। সবার সামনে একটা মেয়েকে রিজেক্ট করা সেই মেয়েটার জন্য কতোটা অসম্মান জনক তুমি নিশ্চয়ই বুঝো। আমি কিছু না বলে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসি। এরপর কেটে যায় কিছুদিন। এর মাঝে অরি আর আমার সামনে আসেনি ইনফ্যাক্ট কলেজেও আসে নাই। হয়তো এভাবে কিছু না বলে বেরিয়ে যাওয়ায় হয়তো ওর ইগোতে লাগে। এদিকে আমি ওকে ভীষণ ভাবে মিস করা শুরু করি। ওর প্রতি একটা এট্রাকশন কাজ করা শুরু করে। ওর বক বক এক সময় বিরক্ত লাগতো। ঐ সময় ওর বক বক শোনাটা নেশায় পরিণত হয়ে যায়। ওর সাথে কোনো ভাবে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। কেমন একটা ডিপ্রেশনে ভুগ ছিলাম। ওর বান্ধবীরাও ওর কোনো খোঁজ দিচ্ছিল না আমাকে। এদিকে সবাই আমাকে বলছিল অরির প্রোপোজেল এক্সেপ্ট করে নিতে। অরি সব দিকে দিয়েই পারফেক্ট। আমার জন্য একদম পারফেক্ট। কলেজের সেরা সুন্দরী ছিল অরি। সবাই বলতো কলেজের সেরা সুন্দরী তোমাকে প্রোপোজ করেছে আর তুমি তাকে রিজেক্ট করছো। ওর প্রতি আমারও একটা ভালো লাগা কাজ করতো আর বন্ধুদের পীড়া পীড়িতে আমি রাজি হয়ে যায় প্রোপোজেল এক্সেপ্ট করার জন্য। এটাই হয়তো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আবেগের বশে মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। অরি বান্ধবীকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে অরির নাম্বার নিয়েছিলাম। এর ক্রেডিট অবশ্য নাইমের। ও মেয়েদের সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারতো। অরিকে ফোন দিয়ে আমি সরাসরি আই লাভ ইউ বলে দেই। তখন থেকেই আমাদের প্রণয়ের সূচনা। এরপর থেকে শুরু হয় লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করা, ফোনে কথা বলা, কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া। এসব করে পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে যাই। এতে আমার আফসোস ছিল না। কারণ ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে আর কী চাই? এভাবে কেটে যায় কলেজের দিনগুলো টেস্ট পরীক্ষায় ভয়াবহ রকম রেজাল্ট খারাপ হয়। আব্বু ভীষণ বকা দেয়। পড়াশোনা নিয়ে আবার সিরিয়াস হয়ে যাই। এর ফলে অরিকে আগের মতো সময় দিতে পারতাম না। বুঝতে পারছিলাম অরি আমার কাছ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম পরীক্ষার পর পুরোটো সময় ওকে দিব। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে অরির সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন হয়ে যায়। ভালো ভাবে সবগুলো পরীক্ষা কম্পলিট হয়ে যায় আমি আবার অরির সাথে যোগাযোগ করি। সবকিছু আগের মতোই চলতে থাকে। দুজনেই মেডিক্যাল এডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হই।
উনি একটু থামলেন। উনার চোখে অভি চিকচিক করছে। উনি ঠোঁট কামড়ে ধরে অন্যদিকে তাকালেন। আমার বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন জাগছে উনি কী এখনো অরি আপুকে নিজের জীবনে ফিরে পেতে চান?
চলবে………..