পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৫১

0
2316

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫১

ফোনের কর্কশ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো। চরম বিরক্তি নিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিলাম। ফোনের স্কিনের নামটা দেখেই ভয় আমার গলা শুকিয়ে আসছে। রুদ্র যদি এখন দেখে ইফাদ স্যার আমাকে কল দিচ্ছে। এই ফোন দিয়ে বারি মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিবে। আমি ভয়ে ভয়ে রুদ্রর দিকে তাকালাম। উনি গভীর ঘুমে আচ্ছন। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেলো। জানি আবার ফোন দিবে। এদিকে আমি এক চুল নড়তেও পারছি না।

রুদ্র নিজের সাথে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। রুদ্র ঘুমের ঘোরে একটু নড়ে চড়ে ওঠতে হাতের বাধন আরো দৃঢ় হলো। আবার ফোন বেজে ওঠলো। আমি দ্রুত ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেললাম। কিন্তু ততক্ষণে রুদ্র সজাগ হয়ে গেছে। উনি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন, কে ফোন দিয়েছে?

আমি উত্তর দিলাম না। আমি যদি বলি ইফাদ স্যার ফোন দিয়েছে। উনি আমার সম্পূর্ণ কথা না শুনেই রাগারাগি শুরু করে দিবেন। উনি আমাকে ছেড়ে দিতেই আমি ওঠে বসলাম। উনি দুই হাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলেন। পেটে মুখ গুঁজে দিয়ে বললেন, বললে না তো কে ফোন দিয়েছে?

উনার এমন স্পর্শে আমার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। আমার হাত থেকে ফোনটা বিছানায় পড়ে গেলো। উনি নিজেই বিছানার ওপর থেকে ফোনটা হাতে নিলেন। ফোনের স্কিনের নামটা দেখেই উনি আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকালাম। আমি কিছু বলার প্রয়াশ করার পূর্বেই উনি ফোনটা রিসিভ করে নিলেন। ফোন স্পিকারে দিয়ে আমাকে কথা বলার জন্য বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

আসসালামু আলাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো রিয়া?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কথাটা বলে উনি একটু থামলেন। বুঝতে পারছি উনি কিছু বলার প্রয়াশ করছেন। উনি আমতা আমতা করে বললেন,

রিয়া তোমাকে আমি ঐদিন কিছু কথা বলেছিলাম। তুমি তো সেই ব্যাপারে কিছু বললে না। আমি তোমার কথা শোনার জন্য অপেক্ষাই আছি।

রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, এই সত্যি করে বলো তো ও তোমাকে প্রোপোজ করেনি তো?

আমি হাত দিয়ে রুদ্রর মুখ চেপে ধরলাম। হালকা কেশে বললাম, স্যার ঐ ব্যাপারে আমি কী বলবো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না? ত্রয়ীকে ব্যাপারটাকে কীভাবে বলবেন?

ত্রয়ীকে প্রোপোজ করি।

রুদ্র আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়।
হয়তো উনি এতক্ষণে সবটা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। ইফাদ স্যার আমাকে নয় ত্রয়ীকে পছন্দ করেন। আমি উনার মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলাম।

প্রোপোজ করার বিষয়টা একদমি ঠিক হবে না। যদি ত্রয়ী পুরো বিষয়টা ভালো ভাবে না নেয়। আমি ত্রয়ীকে যতটুকু চিনি ত্রয়ী বিষয়টা এতো ইজিলি নিবে না। পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হবে। দেখা যাবে ত্রয়ী রেগে গিয়ে আপনাকে দু চার কথা শুনিয়ে দিবে। ত্রয়ী শিক্ষকদের ভীষণ সম্মান করে। ত্রয়ী হয়তো একটু ফাজিল কিন্তু এই বিষয় নিয়ে অনেক পসেসিভ। প্রোপোজ করাটা মোটেও ঠিক হবে না। রেগে গেলে ত্রয়ীর হুশ থাকে না। দেখা যাবে ত্রয়ী রেগে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিবে। এটা আপনার ক্যারিয়ার জন্য মোটেও শুভ হবে না।

তাহলে আমি কী করবো? নিজেকে কেমন হেল্পলেস লাগছে। ত্রয়ীকে হারিয়ে ফেলার ভয় হয়। ত্রয়ীকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে প্রতিমুহূর্তে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। ওকে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলেও ভয়ে আমার বুক কাঁপে। মনে হয় এই বুঝি আমি ত্রয়ীকে হারিয়ে ফেলছি। আমি কতোটা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি সেটা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। ত্রয়ীকে প্রথম দিন দেখেই আমি ভালোবেসে ফেলি। যাকে বলে লাভ এট ফাস্ট সাইড। তাই তো তোমাদের কাছাকাছি থাকতে চাইতাম। এতগুলো দিন নিজের মনের কথা নিজের মাঝেই চেপে রেখেছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম নিজের মনের কথা নিজের মনে চেপে রাখলে হয়তো আমি ত্রয়ীকে হারিয়ে ফেলবো। তাই তো হেল্পলেস হয়ে তোমার কাছে সাহায্য চাইছি। প্রথমে অনেক দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম নিজের ছাত্রীর কাছ থেকে হেল্প নিব বলে। ত্রয়ীর যদি আমার প্রফেশন নিয়ে প্রবলেম থাকে। তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে দিব।

চাকরি ছেড়ে দেওয়া তো কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। আপনি যদি কারো জন্য নিজেকে পরিবর্তন করেন। তাহলে তো সে আপনাকে নয় আপনার পরিবর্তনটাকে ভালোবাসবে। ত্রয়ীকে অন্যভাবে বুঝাতে হবে।

কী করবো আমি? ত্রয়ীকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব।

ইফাদ স্যারের কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এখন হাসা যাবে না। সিরিয়াস টাইপ কথা বার্তা চলছে। আমি নিজের হাসি চেপে রেখে বললাম,

স্যার আপনি একটাই কাজ করতে পারেন। আপনি ত্রয়ীকে ডিরেক্ট বিয়ে করে ফেলুন। ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

ত্রয়ী রাজি নাহলে তো ওর বাবা-মা তো আমার কাছে বিয়ে দিবে না।

হয়তো দিবে না। কিন্তু বুঝাবে তো। কারণ নিজের মেয়ের জন্য এমন সুপাত্র হাতের কাছে পেয়ে কেউ নিশ্চয়ই হাত ছাড়া করতে চাইবে না। যদি ত্রয়ী নিজের বাবা-মার কথা শুনে যদি কনভেনস হয়ে যায়।

আচ্ছা তাহলে আমি আজকেই ত্রয়ীদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছি। এখন তাহলে রাখি। তোমাকে এই সময় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।

না না স্যার সমস্যা নাই। আচ্ছা তাহলে রাখি স্যার। আসসালামু আলাইকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

রুদ্র বেডে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বললেন, ড. ইফাদ তো নিজের ছাত্রীর প্রেমে মজনু হয়ে গেছে। কিন্তু লাইলি তো মজনুর মনের দুঃখ বুঝে না।

আমি উনার দিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকালাম। উনি চোখ দিয়ে আমার ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বললেন,

সুইট টেস্ট।

_________________

রুমের দিকে আসতে নিলেই রুদ্র আর ইলান ভাইয়ার কিছু কথা আমার কর্ণগোচর হলো।

কীরে রুদ্র তুই বিড়াল টিড়াল পোষা শুরু করেছিস নাকি? আমি তো জানতাম তুই বিড়াল পছন্দ করিস না। কিন্ত তোর হাতে বুকে বিড়ালের খামচির মতো দাগ। কী ব্যাপার?

ইলান ভাইয়ার কথা শুনে আমার কাশি ওঠে গেলো। আমি নিজের মুখ চেপে ধরলাম। রুদ্র ইলান ভাইয়ার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকান।

থাপ্পড় খাবি হারামি।

বাহবা আমাদের রুদ্র বাবু ব্লাশ করছে। লজ্জায় গাল দুটো লাল টমেটো হয়ে গেছে। মামা তোমার বউ এখানে থাকলে নিশ্চয়ই এটা বলতো,

আপনি এতো লজ্জা পাচ্ছেন কেনো? লজ্জায় আপনার গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে কামড়ে কুমড়ে খেয়ে ফেলি।

ইলান ভাইয়ার কথা বলার স্টাইল দেখে রুদ্র না চাইতেও হেসে দিল। আস্তে করে ইলান ভাইয়ার পিঠে থাপ্পড় মারল। নাইম ভাইয়া আর এনাম ভাইয়াকে আসতে দেখে আমি দরজার কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ালাম। রুমে ঢুকেই নাইম ভাইয়া বলল,

আমাদের বাদ দিয়ে কী এতো কথা হচ্ছে হুম?

ইলান ভাইয়া রুদ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বলল, রুদ্রর বাসর নিয়ে কথা হচ্ছে।

এনাম ভাইয়া চোখ টিপ দিয়ে বলেন, ইলান তোর মনে আছে তোর বাসর রাতে আমরা কী করছিলাম?

তা আবার মনে থাকবে না। আমার স্মরণীয় বরণীয় দিনটা আমার আলাভোলা বউকে উল্টা পাল্টা বুঝিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল। বাসর রাতে বসে বসে লুডু খেলছি। এই কথা মনে হলে এখনো বুকে চিন চিন ব্যথা হয়।

ইলান ভাইয়ার কথা শেষ হতেই নাইম ভাইয়া, এনাম ভাইয়া রুদ্র উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। হুট করে নাইম ভাইয়া রুদ্রর হাত দুটো চেপে ধরে।

তুই নিজের লাইফে মুভ অন করেছিস এটা দেখার পর নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে একটা অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেলাম। তুই ভাবির সাথে ভালো আছিস, সুখে আছিস এটা জানার পর আমাদের থেকে বেশি খুশি হয়তো কেউ হয়নি। এতোদিন ধরে একটা অপরাধবোধ আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।

চলবে……

[আপনাদের এক প্রশ্ন আমি গল্প দেরি করে দেই কেনো? এতো অনিয়মিত গল্প লিখি কেনো? আমাকে সপ্তাহ সাতদিনের মাঝে সাতদিনই ক্লাস করতে হয়। ইনফ্যাক্ট সপ্তাহে তিনদিন সকাল বিকাল দু বেলাই ক্লাস করতে হয়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলোও আমাদেরটা হয়নি। আপনাদের আমার অসুবিধা বুঝতে হবে। সবকিছু সামাল দিয়ে গল্প লেখাটা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। গল্পটা শেষ করে দিতাম। কিন্তু গল্প লেখাটা নেশায় পরিণত হয়ে গেছে চাইলেও ছাড়তে পারছি না। বৃহস্পতিবার থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here