পূর্ণিমাতিথি পর্ব-৫৮

0
3348

#পূর্ণিমাতিথি
#লেখিকা-তাসনিম জাহান রিয়া
#পর্ব-৫৮
কেটে গেছে কয়েক মাস। আমাদের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হলো। সোফায় বসে নুডুলস খাচ্ছিলাম। ঠিক তখনি বেশ শব্দ করে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন রুদ্র। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের হাতে থাকা ফাইলটা আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। উনার কাজে আমি হতবাক। কিছুদিন ধরেই খেয়াল করছি উনি আমার সাথে অদ্ভুত বিহেইভ করছেন। ঠিক মতো কথা বলেন না। কেমন মন মরা হয়ে থাকেন।
উনার ছুঁড়ে দেওয়া ফাইলটা আমার পায়ের কাছে ফ্লোরে পড়েছে। ফাইলটা হাতে নেওয়া মাত্রই আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না যে এটা প্রেগনেন্সির রিপোর্ট। পজিটিভ লেখাটা দেখা মাত্রই আমার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠলো। আমি ফাইলটা হাতে নিয়ে ছুটলাম নিজেদের রুমের উদ্দেশ্যে।
আমি রুমে প্রবেশ করা মাত্রই উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি উনাকে দেখা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম। উনি সাথে সাথেই নিজেকে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে উনার দিকে তাকালাম। অতঃপর আহত গলায় বললাম,
আপনি এমন করছেন কেনো? আমি প্রেগনেন্ট এটা শুনে আপনি খুশি হননি?
আমি খুশি হয়েছি নাকি হয়নি সেটা জেনে তুমি কী করবে? তুমি তো ভীষণ খুশি হয়েছো। তাহলে নিজের খুশি নিয়েই থাক।
আপনি এভাবে কথা বলছেন কেনো?
আমার কথা শুনতে খারাপ লাগছে তোমার। আমাকে মেরে ফেলো তাহলে আর তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে না। এভাবে তিলে তিলে মারার থেকে একবারেই মেরে ফেলো না। আমি এতো টেনশন আর নিতে পারছি না। দশটা মাস এই টেনশন আমার মাথা থেকে নামবে না। দশ মাস টেনশন করতে হবে না এর আগেই আমি স্টোক করে তোমাকে বাঁধন মুক্ত করে দিয়ে যাব। আমি মরলেই বা তোমার কী? তোমার তো বাচ্চা লাগবে। সেটা তো পেয়েই গেছো। আমার কী নিজের বাচ্চার জন্য কষ্ট হয় না? নাকি তোমার আমাকে অনুভূতিহীন মানুষ মনে হয়? ঐ বাচ্চাটা তো আমারও ছিল। ওকে স্বপ্নের ঘর তো আমিও বেঁধেছিলাম। আমি কী বাচ্চা চাই না? খুব করে চাই। কিন্তু তোমার বিনিময়ে না। আমার জীবনে ফাস্ট প্রায়োরিটি তুমি। তুই কেনো বুঝিস না আমার সবকিছু ছাড়া চললেও তোকে ছাড়া চলবে না। আমার বাঁচতে হলে তোকে প্রয়োজন। তোর বাচ্চা চাই না? আমাকে মেরে তারপর তুই বাচ্চা নিয়েই সুখে থাকিস।
উনি কথাগুলো চিৎকার করে বললেন। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেলেন। আমি নির্বিকার চেয়ে আছি উনার যাওয়ার দিকে। উনার করা ‘তুই’ সম্বোধনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। উনি যতই রেগে থাকেন না কেনো কখনো আমার সাথে তুই তোকারি করেননি।
_________________
আমি উদাস হয়ে কলেজের ক্যান্টিনে বসে আছি। ত্রয়ী আমার হাতের ওপর আলতো করে হাত রাখে।
এখন মন খারাপ করে কী হবে? রুদ্র স্যারের এমন বিহেইভ করা কী স্বাভাবিক নয়? তুই তো জানিস উনি তোকে কতোটা ভালোবাসেন। এই কলেজের প্রত্যেকটা স্টু়ডেন্ট জানে রুদ্র স্যার কতোটা কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। উনার প্রতিটা কলিগ জানে উনি কতোটা শক্ত মনের মানুষ। এই প্রত্যেকটা মানুষ রুদ্র স্যারকে দেখেছে তোর জন্য ছটফট করতে, তোর জন্য কাঁদতে। তোকে স্বাভাবিক করার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছেন। এরপরও তুই ভালো বিহেইভ স্যারের কাছ থেকে ভালো বিহেইভ কী করে আশা করিস?
তুই বিয়ে কবে করছিস?
কথা ঘুরাচ্ছিস?
না জানতে চাচ্ছি। আমার জন্যই তো ঐ দিন তোর বিয়েটা হতে গিয়েও হলো না।
আমার তো নিজেকে দোষী মনে হয়। মনে হয় আমার জন্যই তোদের এক্সিডেন্ট হলো। আমার জন্যই তোর বাচ্চাটা আর নেই।
এটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল। এতে কারো হাত নেই। আমি সবকিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।
______________________
কেটে গেছে একটা সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহ রুদ্র আমার সাথে একটা কথাও বলেননি। কিন্তু আমার খেয়াল রাখার কথা উনি মোটেও ভুলেননি। নির্বিকার ভাবে উনি আমার সমস্ত খেয়াল রাখেন। যথাসাধ্য আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।
এখন বাঁজে প্রায় রাত ১০টা কিন্তু রুদ্রর রুমে আসার খবর নাই। অগত্যা আমিই রুদ্রকে খুঁজতে বের হলাম। মামুনির রুমে সামনে আসতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। ভিতর থেকে অস্পষ্ট কিছু কথা ভেসে আসছে। দরজা খোলাই ছিল বিধায় ভিতরে কী হচ্ছে সেটা দেখতে আমার বেগ পেতে হলো না। রুদ্র মামুনির কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে আছেন। রুদ্র যে কাঁদছেন সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
দেখ রুদ্র তুই রিয়াকে এভাবে এড়িয়ে চলতে পারিস না। এই সময় তোর সাপোর্ট রিয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তুই এমন করলে কীভাবে হবে বাবা?
আম্মু ও এতো অবুঝ কেনো? ও কেনো আমাকে বুঝতে চায় না? আমিও তো একটা মানুষ। আমি আর এতো টেনশন নিতে পারছি না। ওর কাছে আমার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। ও একটুও আমাকে বোঝার চেষ্টা করে না। ও বুঝতেই চায় না যে ওর জীবনের থেকে বেশি মূল্যবান আমার কাছে অন্য কিছু না। আম্মু ঐ সন্তানের বাবা তো আমিও ছিলাম। সবার সামনে আমার কষ্টগুলো মেলে ধরিনি বলে কী আমার কষ্ট হয়নি? ও তো চিৎকার করে কেঁদে নিজের কষ্টগুলো হালকা করতে পারে আমি তো তাও পারি না।
এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে। তোকে তো শক্ত হতে হবে। তোকেও রিয়াকে বুঝতে হবে। তুই বাবা হলেও ও মা। ও পাঁচটা মাস ওই বাচ্চাটাকে নিজের মাঝে বহন করেছে। সব সময় বাচ্চাটাকে অনুভব করেছে। তাই ওর যন্ত্রণাটাও বেশি। সবাই তো তোর মতো শক্ত মনের অধিকারি হতে পারে না। রিয়া অন্য কারো কষ্ট দেখলেও কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে পড়ে। সেখানে তো নিজের সন্তানকে হারিয়েছে। এই সময় রিয়াকে এভাবে এড়িয়ে না চলে ওর পাশে পাশে থাকা। ওকে সব সময় হাসিখুসি রাখা। আল্লাহ যা ভাগ্যে লিখে দিয়েছেন তা তো তুই খন্ডাতে পারবি না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
_________________
রুদ্র এখন আমার সাথে স্বাভাবিক আচারণ করেন। আমি উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কপালে পড়ে থাকা বেবি হেয়ারগুলো সন্তপণে সরিয়ে দিয়ে গভীর চুমু এঁকে দিলেন কপালে। আমি কোল থেকে মাথা সরিয়ে ওঠে বসলাম।
প্লিজ আজকে না ঘুমাই? একটুও ঘুম আসছে না। একদিন না ঘুমালে কিছু হবে না।
একদম না। আমি কোনো অনিয়ম বরদাস্ত করবো না। আমি তোমাকে যে চার্ট দিয়েছি তা ফলো করেই চলবে। একদিনও তার ব্যতিক্রম করবে না।
প্লিজ প্লিজ।
উনি কিছু একটা ভাবলেন তারপর বললেন, আচ্ছা যাও ঘুমাতে হবে না। তুমি এই প্লেটের সবগুলো ফ্রুটস এখনি খাবে।
না আমি খাব না আমি ঘুমাব। আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। এই দেখুন ঘুমের জন্য চোখ দুটো খোলা রাখতে পারছি না।
একবার ডিসিশান চেইন্জ করেছি আমার ডিসিশান আর চেইন্জ হবে না। আমি তোমার আর কোনো বাহানা শুনবো না। নাও ফিনিস ইট।
আমি কাচুমাচু মুখ করে খেতে শুরু করলাম।
________________
রুদ্রর এক দূর সম্পর্কের আত্নীয় বাড়িতে আসছেন। মহিলাটাকে একদম গ্রামের কুচুটে মহিলাদের মতো লাগে। যাদের নিজের সংসারের থেকে অন্যের সংসারে নজর বেশি। মহিলাটিকে দেখা মাত্রই আমি সালাম দিলাম। কিন্তু এতে এই কুচুটে মহিলার মন ভরলো না।
আজ কালকার মেয়েরা গুরুজনদের সম্মান করতেই জানে না। তোমার বউমা তো কোনো আদব কায়দাই জানে না। আমি ওর চাচি শ্বাশুড়ি কোথায় আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে তা না মুখে মুখে সালাম দিচ্ছে।
আপনি তো মনে হয় খুব আদব কায়দা জানেন? আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত করবো না। তাতে আপনি আমাকে বেয়াদব ভাবেন বা অন্য কিছু ভাবেন তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
উনি একটু থতমত খেয়ে গেলেন। ভাবেননি হয়তো আমি এভাবে উত্তর দিব।
তোমার তো সাহস তো কম না। আমার মুখে মুখে তর্ক করছো?
আমাকে যদি অবলা নারী ভেবে থাকেন তাহলে ভুল ভাবছেন। আপনি আমাকে যা তা বলে অপমান করবেন আর আমি মুখ বুজে সহ্য করে নিবো আপনার এই সহজ সরল বউমার মতো তাহলে ভুল ভাবছেন। আমার সাথে লাগতে আসবেন না।
চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here