#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ২৭
৬৯.
নিশিতে আবেগী মন একটা ছোটখাটো বাহানা করে বসলো। মৃদ্যু আলোকিত ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা। কোলাহলহীন। শুধু একজন নারীর নিঃশ্বাস আনাগোনার শব্দ। চোখে তখন ঘুমপাখিরা কিচিরমিচির করছিলো। সিলিভিয়া সেদিকে তোয়াক্কা না করে ব্যাগ থেকে তেহভীনের দেওয়া উপহারের প্যাকেটটি বের করলো।উপরের সাদা মলাট খুলতেই ভেতর থেকে পাতলা ফিরোজা রঙের একটা ছোট ব্যাগ দেখতে পেলো। রাতের বেলাটা ছোট ব্যাগ আর বাক্সটি অদ্ভুত ভাবে জ্বল জ্বল করতে লাগলো। সিলিভিয়ার হাত-পা অস্বাভাবিক কায়দায় কাঁপতে লাগলো। চোখের কোণ মৃদু অস্রুসিক্ত। ব্যাগটা মেলে চোখে সামনে রাখতেই ‘ Tiffany & CO.’ লেখা। ভেতরে দেখলো চকচকে স্বচ্ছ কাঁচের পারফিউমের বোতল। আর ছোট বাক্সটির উপরেও একি নাম।খুলে দেখলো চকচকে টিফানির রিং। ছোট একটা কাগজের টুকরোতে লেখা ‘ স্পেশাল গিফট ফর স্পেশাল পার্সন’ সিলিভিয়া নিঃশব্দে হাসলো।কখনো কারো এতোটা স্পেশাল হতে পারবে সেটা তার ধারণায় ছিলো না। তেহভীন, অতিপ্রিয় একজন ব্যাক্তি তার জীবনে।একজন পরুষ এবং বন্ধু হিসেবে। আঁধার ঘরের নিস্তব্ধতা চাপিয়ে হঠাৎ মৃদু শব্দ তুলে সিলিভিয়ার ফেনটা বেজে উঠলো।অকস্মাৎ, সর্বশরীর কেঁপে উঠলো সিলিভিয়ার।অপ্রত্যাশিত ফোনবার্তা,ভেতরটায় অদ্ভুত আতঙ্ক ঢেলে দিয়েছে যেনো। সিলিভিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো,ইংরেজী অক্ষরে লেখা ‘TEHVIN’ সিলিভিয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে থাকলো। ছোট করে ঢোক গিললো। অতঃপর ফোনটা রিসিভ করলো। অপাশ থেকে মৃদু ঘুমঘুম চোখের কপাট বন্ধ রেখে শান্ত,দৃঢ়কণ্ঠে তেহভীন বলে উঠলো,
— সিলভার, টু মিনিট এগো,ইয়্যু ওয়াজ ইন মাই ড্রিম।ইয়্যু লুকিং টু’মাচ প্রিটি!
তেহভীনের কথায় সিলিভিয়া আনন্দ’বিলাসীত মন তৎক্ষনাৎ ভড়কে গেলো। তেহভীনের কথার মানে খুঁজতে গিয়ে যখন বুঝলো তখন ফিক করে হেসে ফেললো। বলল,
—ইজ ইট ট্রু?
— ইয়েস সিলভার! কি করছিলে? ঘুমাওনি?
— নাহ, তোমার দেওয়া গিফট গুলো দেখছিলাম।
তেহভীন শোয়া থেকে বুকের উপর বালিশ রেখে উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো। এরপর বলল,
— এতদিন পর। আহ, শোন, ওই পারফিউম টা
আমাদের বিয়ের পর তুমি ইউজ করবে। ওকে?
সিলিভিয়া চমকালো,মস্তিষ্কে তেহভীনের কথাটি
পূনরায় স্মৃতিচারণ করলো।তারপর অত্যন্ত চাপা,মৃদু, কন্ঠে বলল,
— আমাদের বিয়ে হবে?
— হুয়াই নট। তুমি কি মনে করেছো
আমি বিয়ে করবো না? তোমার সাথে চিট করবো?কিছুদিন আগেও আমার মনে একটা বিষয় ছুটাছুটি করতো।সেটা হলো আমি কখনো বিয়ে করবো না। কারণ আমি একজন ভ্যাম্পেয়ার গার্লের সাথে এনগেজড।সি ইজ এ ভেম্পেয়ার। ট্রাস্ট মি,আমার মনে হতো আমার এই জীবনটা বৃথা যাবে। কিন্তু তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝলাম, নো,একচুয়েলি কিছু তো স্পেশাল আছে যারজন্য আমি বারবার বেংলাডেশে ছুটে যেতাম। কারণটা যে তুমি সেদিন ফিরে আসার পথে বুঝলাম।
সিলিভিয়া স্মিত হাসলো তেহভীনের কথায়।
এরপর শ্লেষাত্মক হেসে বলল,
— আচ্ছা, তো এতদিন পর নিজ থেকে ফোন দেওয়ার কারণ এটা? এসব বলার জন্য?
তেহভীনের ভ্রূঁ কুঁচকে গেলো সিলিভিয়ার কথায়,
— তুমি কি আমার সাথে রেগে আছো?
— অফকোর্স! মাস হয়ে যাওয়ার পর যখন
তোমার কোন খবর নেই।তখন,আমি কিভাবে বুঝবো
আমি কারো স্পেশাল কেউ? হাউ?
— এটা বলার কারণ কি সিলভার?
— নো ফোন,নো মেসেজে’স। আমি কষ্ট পেয়েছি।
তেহভীন কয়েক সেকেন্ড ঠোঁট চেপে চুপ থাকলো। এরপর ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
— সিলভার, আমি চাই না আমার জন্য তোমার স্ট্যাডির কোনো ক্ষতি হোক। তুমি একটা লক্ষ্য নিয়ে ওই ভিনদেশে এসেছো,থাকছো,পড়ছো। সেখানে আমার সাথে অনাকাঙ্খিত সাক্ষাৎকে তোমার লক্ষ্যের সাথে গুলিয়ে ফেলো না ‘ডিয়ার। আমাকে এক্সটের্নাল সাইডে রাখো,কিছু মনে করবো না।
— নো, ইয়্যু আর নট আউটওয়ার্ড সাইড ওফ মাই লাইফ। ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট ওফ মাই লাইফ তেহভীন।
তেহভীন প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আমোদিত হলো হৃদপিণ্ড। সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে।তার কারণে সিলভারের কোনো ক্ষতি তেহভীন মানতে পারবে না। সেজন্য সোশাল সাইডেও তার সাথে কানেক্টেড থাকে না।তেহভীন সন্তঃপর্ণে তার ড্যাডের দেওয়া পানিশমেন্টটা স্কিপ করে গেলো।অযথা,সে সিলিভিয়াকে এসব বলে চিন্তায় রাখতে চায় না। তেহভীনকে চুপ দেখে সিলিভিয়া বলল,
— তোমার কাজিনের কি হবে? আঙ্কেল মানবেন?
তেহভীনে মৃদু হেসে নেমে আসা মন খারাপের রেশটা আড়ালে ঠেলে দিলো। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
— আ’ই ওয়ান্ট টু সি ইউ!
সিলিভিয়া কিছু না বলে চুপ থাকলো। তেহভীন ফোন কেটে উঠে বসলো। পিলো’র উপর থেকে পোলো শার্ট হাতে নিয়ে গায়ে চাপালো।অতঃপর ফোন দিলো সিলিভিয়ার ফোনে। মাথায় কাপড় টেনে সিলিভিয়াও ফোনটা রিসিভ করলো। কিছুক্ষণ দু’জনে চুপ থাকলো। তেহভীনের ফর্সা মুখে ক্লিনসেভ দারুণ লাগছে দেখতে। আশ্চর্যভাবে কখনো বলায় হয়নি তেহভীনের নাকের উপরে ডান ভ্রূ এর হালকা নিচে লালচে তিলটা খুবই সুদৃশ্যমান,সিলিভিয়ার নিষ্পলক চেয়ে থাকলো,সাথে তেহভীনও। তেহভীন নীরবতা ভেঙে বলল,
— পায়ের ব্যাথা এখনো আছে?
— কমেছে। তোমার ভাই আর ভাইয়ের ফ্রেন্ড খুবই যত্ন করেছে আমাকে।কাল ফিরেছি সেখান থেকে।
— কেউ তোমাকে আর ডিস্টার্ব করেছে?
সিলিভিয়া তেহভীনের কথার উত্তর দিলো,
— না করেনি। দেখি আগে গিয়ে কি হয়!
—- সিলভার,ঘুমাও এবার। স্যরি তোমায় ডিস্টার্ব করেছি।গুডনাইট। আমার হাতে আর আড়াই ঘন্টা সময় আছে।ততক্ষণে একটু ঘুমিয়ে নিই।
সিলিভিয়াও ‘গুডনাইট’ বলে চুপ থেকে ফোন কাটার অপেক্ষায় থাকলো। তেহভীন ফোন না কেটে বলল,
— তুমি কল কাট করো।আমি পারছি না।
সিলিভিয়া ঠোঁট টেনে হাসলো। ফোন কেটে বিছানায় রেখে ধপ করে শুয়ে পড়লো। হাত টেনে পারফিউম আর রিংএর বক্সটি বালিশের পাশে রেখে দিলো।সিলিভিয়া জানে কতো এক্সপেন্সিভ উপহার তেহভীনের কাছে থেকে পেয়েছে। কিন্তু ভারাক্রান্ত মনটা নিজেকে অন্যদের সাথে মেলাতে নারাজ।তাই তেহভীনের উপহার যেভাবে ছিলো ঠিক সেভাবেই রেখে দিবে তবে সেটা ঘুম থেকে উঠার পর। ভাবতে ভাবতে চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসলো সিলিভিয়ার।
৭০.
স্প্রিংমান্থ চলছে। চারপাশে রিনরিনে ফুলের সুমিষ্ট সুভাষ। সূর্যের মৃদু হলদে রশ্মি। সাউথরোডে একঝাঁক কবুতরের উড়াউড়ি। সিলিভিয়ার এক ধ্যানে চেয়ে আছে কবুতরগুলোর দিকে।মনটা হঠাৎ করে এখানে আর ঠিকছে না। নিজের দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। মায়ের বুকে মাথা রেখে ল্যাপ্টে যেতে মন চাইছে। একাকী বসে বসে জীবনের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছিলো সিলিভিয়া। তখন ড্যাবিয়ান এসে উপস্থিত হয়। সিলিভিয়ার পাশে বসলো। গতদিনের সব’বিষয়ে ড্যাবিয়ান অবগত।নতুনভাবে কিছু জানতে চাইলো না সে। একটা ক্যাপাচিনো সিলিভিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
— মন খারাপ?
— হি ইজ টু রুড ড্যাবিন!
ড্যাবিয়ান ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো,
— হু ইজ?
— সুপারভাইজার! উনার ব্যাবহার অনেক রুড!
ড্যাবিয়ান হাসলো,বলল,
— ফাইভ অথবা সিক্স ইয়ার পর্যন্ত এটা তো চলবেই।
কিছুদিন অপেক্ষা করো সয়ে যাবে।
তীব্র মন খারাপের রেশ নিয়ে সিলিভিয়া বলল,
— আমি শুধু এমফিল করবো। তারপর নিজ দেশে চলে যাবো।
ড্যাবিয়ান স্মিত হাসলো,বলল,
— এমফিলে কোর্স করে পি.এইচ.ডি না করাটা বোকামি।কেউ তো এমফিল ছাড়াও পি.এইচ.ডি তে এপ্লাই করে ফেলে। তুমি কার অধীনে গবেষণা করছো?
— প্রপেসর লিয়াম এইডেন।
—-চলো, কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।
সিলিভিয়া দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
— ইচ্ছে করছে না।
ড্যাবিয়ান জোর করলো না। সিলিভিয়াকে রেখে চলে গেলো। মাঝে মাঝে দেখে সিলিভিয়া একা একা বসে আছে। তাই সে এসে সঙ্গ দেয়। তবে জোর দেয় না।
সিলিভিয়া একমনে চেয়ে থাকলো ড্যাবিয়ানের যাওয়ার দিকে। এখান থেকে সে ‘রুমি এ্যাপার্টমেন্ট যাবে জাইমার সাথে দেখা করতে।বেশ অনুরোধ করেছে সে।
৭১.
ভেজা চুল মুছার কাজ শেষ করে জেলের কৌটা হাতে নিতে যাবে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো তেহভীনের। তেহভীন ভাবলো ফোনটা রিসিভ করবে না। কিন্তু শেষমেশ ভাবনা পরিবর্তন করতে হলো। মি.মেথেউ এ্যাসফোর্ড এতক্ষণ তেহভীন ফোন তুলার অপেক্ষায় ছিলেন, তেহভীন ফোন রিসিভ করলে সাথে সাথে বলে উঠে,
— তোমার পাঠানো পেপার্স আমি সাইন করে দিয়েছি মাই বয়। কনগ্রেচুলেশন মাই সন। আজ থেকে বাড়িটা তোমার। শুধুমাত্র তোমার। এবার তুমি চলে এসো,বিয়েটা অন্তত এবার করে নাও।
তেহভীন সম্পূর্ণ কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কোমড়ের বেল্টটা পরিপাটি ভাবে বেঁধে নিয়ে বলল,
— আর গাড়িটা? ওটা ছাড়া আমার হবে না।
— তেহভীন তোমার কাছে একটা অলরেডি আছে যেটা কম এক্সপেন্সিভ নয়।বাচ্চাদের মতো বিহেভ করছো একদম। বাড়ি এসো, টামান্নাও তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করিয়েছে।আমার পছন্দ হয়েছে। আমি চাইছি তোমাদের ম্যারেজ চেরেমনি একসাথে করতে।
ক্ষ্যান্ত মস্তিষ্ক প্রচণ্ড তেঁতে উঠলো। কপালের রগ ফুলেফেঁপে উঠলো তেহভীনের। তারপর ও নিজেকে যথা শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। রাগ চাপানোর তোড়ে মুখ ফসকে বলে উঠলো,
— ওকে ড্যাড গাড়ি লাগবে না। আমি এই জবটা ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি চাইলে আমার লাইসেন্স ক্যান্সেল করে দিতে পারো। আমার আপত্তি নেই।
বাট রিমেম্বার ওয়ান মোর থিং, আমি জব ছেড়ে দিলে ক্যাথ আর এই রিলেশন রাখবে না। আমি শতভাগ নিশ্চিত। যদি বিশ্বাস না হয়? তাহলে চেষ্টা করতে পারো। বাই ড্যাড!
তেহভীন কথা বলার আর কোন সুযোগ দিলো না মি.মেথেউকে। লাইনটা কেটে ফোনটা সজোরে ড্রসিং টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারলো।মি.ম্যাথেউ প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলেন তেহভীনের কথায়। দূরন্ত স্বভাবের ছেলেটা হঠাৎ রেগে গেলে সামলানো কষ্টকর হয়ে পড়তো। কিন্তু আজ তেহভীন রেগে আছে সটা কন্ঠস্বর শুনেই আন্দাজ করতে পেরেছেন উনি।
(চলবে)
দেরী হওয়ার জন্য দুঃখিত।পারিবারিক সমস্যায় ছিলাম। সবাই একটু বলবেন গল্পটা বোরিং হচ্ছে কি না? নাহলে আমার লিখতে মন চাচ্ছে না কেন?