#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৩৪
৮৭.
রাতটুকু রেডউড ন্যাশপার্কে থাকার ইচ্ছেটা দমন করতে হলো তেহভীনকে। ছুটি শেষ হওয়ার আরো দুইদিন বাকি। কিন্তু পাইলট অফিসার তেহভীনকে কালই কাজে ফিরে যাওয়ার বার্তা পাঠালেন। তেহভীনের মস্তিষ্কে একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মেছে সেটা হচ্ছে পাইলট অফিসারের পেছনে অন্য কেউ আছে যে চায়ছে না তেহভীন বারবার ছুটি কাটাক। কয়েকমাস আগেও তেহভীন ছয়মাস টানা ছুটি বিহীন কাজ করে গিয়েছে। বাহ্যিক কোন চিন্তা ছিলো না তার,ছিলো শুধু তার ড্যাডের উপর অভিমান। তার ভিত্তিতে সে বাড়িতে কম যেতো। সে যে এডিনবার্গ ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে এসেছে, সেটা তার ড্যাডের উপর জেদ করে।
ক্যাথরিনের সাথে এনগেজমেন্ট ভাঙার পরপর তেহভীনের ড্যাড তার কর্মস্থানের একজন বন্ধুর মেয়ের সাথে দেখা করার আদেশ করলো। প্রথমবারের মতো,তেহভীনও জেদ ধরে তার মমকে (তায়্যিবা) বলে সোজা ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে চলে আসলো।তারপর থেকে ড্যাডের সাথে আর কথা হয়নি। তেহভীনকে চলে যেতে বাধ্য মি.মেথেউ করছেন। ফ্লাশব্যাক থেকে ফিরে তেহভীন বাঁ দিকে তাকালো।সিলিভিয়া গাড়ির জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে।তেহভীনের ভ্রূ জোড়া হঠাৎ কুঁচকে যায়।সিলিভিয়ার কাঁধে নিশ্চয় ব্যাথা করছে?
তেহভীন সিলিভিয়ার ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করলো।সিলিভিয়ার নিকটে এগিয়ে গিয়ে শাল গায়ে জড়িয়ে দিলো। উষ্ণতা পেয়ে আরো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো সিলিভিয়ার। তবে কাপলের কুঁচকানো ভাবটা নিজ দায়িত্ব মিলিয়ে গেলো। তেহভীন সিলিভিয়ার কপালের পাশে ডানদিক থেকে চুল সরিয়ে দৃঢ়ভাবে নিজের ঠোঁটদ্বয় স্পর্শ করলো।তারপর অতি সন্তপর্ণে সিলিভিয়ার কাছ থেকে সরে এলো। হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো। বুকটা অজানায় আতঙ্কে খামচে ধরছে তার। তেহভীন বুকে হাত দিয়ে তার গ্রেন্ডফাদার হায়াত উদ্দিনকে স্মরণ করলো। বিশুদ্ধ, খাঁটি একজন বাঙালি মানুষটা ভীষণ প্রিয় ছিলো তেহভীনের। নানার সাথে তার জার্নিটা শৈশব থেকেই। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণরূপ হায়াত উদ্দিন নামক ব্যাক্তিটির কাছ থেকে পাওয়া। তার এতোটা পথ বিশুদ্ধভাবে এগোনোর পেছনে তার গ্রেন্ডফাদারের হাত। অত্যন্ত রসিকতাপূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। একমাত্র মেয়ের দুই’ছেলে বিদেশের সংস্কৃতিতে যাতে মিলিয়ে না যায় সেজন্য নিজ দেশ ছেড়ে মেয়ের কাছে পড়ে থেকেছিলেন। খুব ভালোবাসতেন তিনি তাদের। তানজিদ আর তেহভীন এই নামও তাঁর রাখা। হায়াত উদ্দিনের দূরন্ত স্বভাবটা তেহভীন পেয়েছে। মি.মেথেউ এর বিরক্তির সর্বশেষ কারণ ছিলো একমাত্র হায়াত উদ্দিনের আচরণ।নাতিদের নিজের স্বভাবের তৈরি করাতে মনঃক্ষুণ্ন হয় উনার। পরিবারকে তেমন সময় দিতে না পারার সুযোগটা বুঝি তিনিই নিয়েছিলেন।
তেহভীন গাড়িতে স্থিরভাবে বসে এসব ভাবতে ভাবতে শেষপর্যায়ে দেখলো ‘রিভেরিয়া এপার্টম্যান্টের’ সামনে চলে এসেছে। তেহভীন পূনরায় বাঁ দিকে ‘স্লিপিংগার্ল’ টির দিকে তাঁকালো। ঠোঁটের কোণে মৃদ্যুময় হাসি ফুটলো। এগিয়ে গিয়ে দৃঢ়ভাবে ডাকলো। কয়েকবার ডাকার পর সিলিভিয়া চোখ পিটপিট করে তাঁকালো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তেহভীনের দিকে তাঁকালো সিলিভিয়া। তেহভীন বলল,
— উঠো,চলে এসেছি আমরা।
সিলিভিয়া অবিশ্বাস্য সুরে বলল,
— এতো তাড়াতাড়ি? আমার ঘুম এখনো অপরিপূর্ণ।
— সিলভার, আমরা ছোটখাটো
ট্যুরে গিয়েছি,নট হানিমুন। তোমার ঘুম অপরিপূর্ণ
হওয়ার কথা তো নয়?
তেহভীনের কথায় ঠাস করে চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেলো সিলিভিয়ার। বিমূঢ় দৃষ্টিপাত করলো তেহভীনের মুখের দিকে।তেহভীন তখন ঠোঁটে চাপ প্রয়োগ করে সিলিভিয়ার উত্তরের আশায় চেয়ে রইলো। সিলিভিয়া অপ্রস্তুত হলো খুব। গায়ের শালটা ভালোভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে বলল,
— তোমার কথাটির জবাব আজ দিলাম না।
কোন একসময় অবশ্যই জবাব পেয়ে যাবে।এখন সরে যাও।
তেহভীন মৃদু হেসে সরে বসলো। সিলিভিয়া নেমে গেলো, তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো তেহভীন আজ চলে যাবে। কথাটা মস্তিষ্কে আবির্ভাব হতেই সিলিভিয়ার সর্বশরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো কিছু সময়ের জন্য। অদ্ভুত ভয় এসে আঁকড়ে ধরলো মুহূর্তেই। সিলিভিয়া তেহভীনের দিকে তাঁকালো।তেহভীন সিলিভিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো আগে থেকে। সিলিভিয়া বলল,
— আজ-ই চলে যাবে? কাল গেলে হয়?
— এখুনি যেতে হবে।
সিলিভিয়া কিছু বলতে পারলো না। চোখমুখ শক্তকরে তাকিয়ে রইলো। তেহভীন নিজের ব্যাগের প্রয়োজনীয় জিনিস ঠিকঠাক আছে কি-না চ্যাক করায় মনোযোগ দিলো।সিলিভিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো। তেহভীন গাড়ি থেকে বেরিয়ে সিলিভিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালো।
—- তোমার এমফিল শেষ হতো কতো বছর লাগবে?
— তিন-চার বছর,কেন?
তেহভীন দৃঢ়ভাবে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— আমি যদি আর ফিরে না আসি,তাহলে
নিজ দেশে ফিরে যেও।
সিলিভিয়া চমকে গেলো তেহভীনের কথায়,কথাটার মানে কি? তেহভীন কি বিচ্ছেদ চায়ছে? কয়েক মাসের সম্পর্কে এতো দ্রুত বিচ্ছেদ? সিলিভিয়া সাধ্যমতো চেষ্টা করে নিজেকে শক্ত রাখলো।কারণ তেহভীন মজাও করতে পারে তার সাথে। সে তো এমন নয়।সিলিভিয়া জিজ্ঞেস করলো,
— ফিরে আসবে না কেন?
তেহভীন চট করে বলল,
— বিকজ,আই নিড ব্রেক-আপ!
ভয়ংকর বাক্যটা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না সিলিভিয়া।মনটা অদৃশ্য এক বেড়াজালে বন্দী যেনো৷ নিষ্পলক চেয়ে থাকলো তেহভীনের মুখের দিকে। কি বলতে চায়ছে তেহভীন এটা?
কিন্তু সিলিভিয়ার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেলো খুব। তাই সে হেসে ফেললো,তেহভীনও হেসে দিলো সিলিভিয়ার হাসি দেখে। মানুষকে বিশ্বাসটা খুব ভালোভাবে করতে পারে সিলিভিয়া।তাই তেহভীনের কথার জালে সে ফাঁসেনি। তেহভীন ঘড়িতে আবারও সময় দেখলো। এরপর হাত দু’টো পেছনে রেখে সিলিভিয়ার কাছে এগিয়ে তার নাকের সাথে সিলিভিয়ার নাক ছুঁয়ে দিলো আলতো ভাবে।সিলিভিয়া নড়লো না।তেহভীন সেটা দেখে তারপর বলল,
— এমফিল শেষ হলে নিজের দেশে ফিরে যেও।
এখানে সেটেল্ট না হওয়ার অনুরোধ রইলো। আরো একটা অনুরোধ ‘ডোন্ট ফরগেট মি। ‘
সিলিভিয়া অবিশ্বাস্য চোখে তেহভীনের দিকে চেয়ে থাকলো।মানুষটা আবারও স্বার্থপরের মতো কাজ করবে।নিজের বলা কথাটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।প্রেমটা অবশ্যই থাকবে,তবে দূরত্ব বেশি। এখানে স্বার্থটা সিলিভিয়ার,কিন্তু ত্যাগটা করছে তেহভীন।সময়ের ত্যাগ,কয়েক হাজার দূরত্বের প্রেম,দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। দেখা-সাক্ষাৎ সব বন্ধ।কিভাবে থাকবে সিলিভিয়া? দমবন্ধ হয়ে আসবে তার। আচ্ছা সুন্দর একটা ভবিষ্যতের জন্য পড়াশোনাটা কি খুবই জরুরি।নাকি নিজের লক্ষ্যের সুন্দর সমাপ্তি ঘটার নতুন এক প্রয়াস।
তেহভীন ডানহাতটা সিলিভিয়ার
গালে স্পর্শ করে বলল,
— তোমার পড়াশোনা আগে সিলভার,
আমি আগেও বলেছি।আমাদের বিয়ের আগ পর্যন্ত
এটাই শেষ দেখা। অনেক অনেক ভালো থাকার জন্য ‘চৌদ্দ’শ ষাট দিন আমরা খারাপ থাকি?
সিলিভিয়ার নিরুত্তর চেয়ে রইলো সৌষ্ঠবপূর্ণ চেহারাটার দিকে। তেহভীন স্মতি হেসে গাড়িতে বসলো। জানালার গ্লাস নামিয়ে দিয়ে বলল,
— ভালো থেকো সিলভার।
সিলিভিয়া চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
—- হার্টলেস!
গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেলো। চলতে শুরু করলে হঠাৎ তেহভীন মাথা বের করে সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলল,
—” বৃষ্টির মতো করে, হঠাৎ তোমার কাছে ফিরবো, তোমাকে চমকে দিবো।ততদিন অপেক্ষায় থেকো।”
সিলিভিয়া তীর্যক দৃষ্টি মেলে প্রথমদিনের মতো চেয়ে থাকলো। চাপা কন্ঠে অনবরত বলতে লাগলো,’হার্টলেস’, ‘হার্টলেস’, এন্ড হার্টলেস’।
৮৯.
পাঁচদিন পর ‘সাটার গেইটের’ ভেতরে পা রাখলো সিলিভিয়া। সমাপ্তিতে এসে আজকের সূচনালগ্ন প্রথমবারের তুলনায় অন্যরকম। অদ্ভুত এক লক্ষ্য মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া,সুনাম কুড়িয়ে নিজ দেশে ফেরা। কতোদিনে তা সম্বভ সেটা সিলিভিয়া জানেনা। তবে এবার আর কারো অপেক্ষায় চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করতে হবে না। সে আর আসবে না,তাই অপেক্ষাও নেই।
ক্লাসে ঢোকার পর চোখে পড়লো অসহ্যকর একটা দৃশ্য। সিলিভিয়া গটগট করে মাঝখানের সাড়িতে পরিচিত একজন মুসলিম মেয়ের পাশে বসলো। মেয়েটি সিলিভিয়াকে দেখে হাসলো। এরপর ইশারায় সামনে তাকাতে বললো। সিলিভিয়া না তাকিয়ে বলল,
— কি হচ্ছে ওখানে?
— দু’জন সম’কামী মেয়ের বিয়ের আলোচনা
চলছে।তারা এতেই ভীষণ খুশী।
— অসহ্য! এখানে এসব কি হচ্ছে আল্লাহ জানে।
আর ছেলেগুলা? তারা আছে কিসের জন্য?
মুসলিম মেয়েটি সটান হয়ে বসলো, মেয়েদুটোর দিকে ঘৃণ্য দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,
— এখানে তুমি খুব সহজে একটা ছেলের হাত
থেকে বাঁচতে পারলেও,একটা মেয়ের হাত থেকে অন্য মেয়ে বাঁচা খুবই কঠিন এবং কষ্টকর। জান দিয়ে দেয় এরা।তাদের কালচারও তো ভিন্ন। এখানে তাদের স্কুল থেকেই সমকামীতার শিক্ষা দেওয়া হয়।বড় বড় হতে হতে তারা একেবারে অভ্যস্ত। বাই দ্যা ওয়ে,
তুমি এতদিন পর?
মেয়েটির কথার জবাব দিতে পারলো না সিলিভিয়া। সচেতন মন জেরিন্ডেলের কথা ভেবে যাচ্ছে।মেয়েটা মরেছে কি-না কে জানে।মরলে সিলিভিয়া শান্তি পেতো। এতো ঝামেলা ভালো লাগে না আর তার।
(চলবে)
রি-চ্যাক দেওয়া হয়নি।সময় পেলে সংশোধন করা হবে।
আরেকটা কথা,যাদের কাছে এই পোস্ট পৌঁছাবে? ছোটা একটা কমেন্ট করে যাবেন। পেজের রিচ কমে গিয়েছে।