লাভ রেইন পর্ব-৩৫

0
1819

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৩৫

৯০.
বিস্ময়কর এক সন্ধ্যা। মহাসাগরের মাঝামাঝি অবস্থান করা এক সরুচিপূর্ণ জাহাজের অভিজাত্য কামরায় বসে আছে তেহভীন। শুধু কামরা বললে ভুল হবে,বিশাল একটা কামরা। আশেপাশে লাস্যময়ী রমণীদের ভিড়। নর-নরীদের উপস্থিতি মিলিয়ে জমকালো একটা অনুষ্ঠান। পাইলট অফিসাররা মিলে জমজমাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে আজ। সুঠাম দেহটা ডিভাইনে এলিয়ে দিয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অনুষ্ঠানের নাচ-গান দেখতে লাগলো তেহভীন। মন-মেজাজ তেঁতে থাকলেও,মার্জিত ঠোঁটজোড়ায় কৃত্রিম হাসির আভাস। সামনের কাচের বোতলে বিদেশীয় বিদঘুটে স্বাদের পানীয়জল সাজিয়ে রাখা। হাতছানি দিয়ে ডাকছে,প্রত্যেকের জিহ্বাকে তৃপ্তিময় করে তুলতে। তেহভীন অনুভব করলো তার পাশে কেউ একজন এসে বসেছে। হাতের আঙুলের ফাঁকে পানীয়জলের গ্লাস। থেমে থেমে চুমুক বসাচ্ছে গ্লাসে। কাঁধে হাত রেখে মি. মেথেউ এ্যাসফোর্ড গমগমে গলায় বললেন,

— টেহভীম! তোমার সিদ্ধান্ত কি?

তেহভীন তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো না। গান-বাজনার হুলুস্থুল আয়োজনের মাঝে তার ড্যাডের গলায় বলা কথাটুকু হজম করে নিলো সে।

— টেহভীন, আ’ম টকিং টু ইয়্যূ!

— বাট আ’ই ডু’নট ওয়েন্ট টু টক এভাউট ইট।

মি.মেথেউ তেহভীনের কথা তেমন গায়ে মাখালো না।
বললেন,

—- তুমি ওর সাথে দেখা করো। ভালো লাগবে তোমার।এবার আমি কোন মিস্টেক করতে চাই না মাই সন।

— ইউ আর অলরেডি ম্যাকিং এ মিস্টেক ড্যাড!

মি.মেথেউ এ পর্যায়ে বিস্মিত হলেন। বললেন,

— আমি কি মিস্টেক করছি টেহভীন? তোমার ফাদার হিসেবে তোমার জন্য একজন পিউর লাইফপার্টনার খুঁজে দেওয়াটা কি মিস্টেক? আমি চাইনা আমার মতো তুমিও শুরুতে ভুলটাকে আঁকড়ে ধরো। তাই তোমার জন্য পিউর কাউকে তোমার লাইফে এনে দেওয়া আমার দায়িত্ব নয় কি?

তেহভীন বিদ্রুপাত্মক চেহারায় ক্ষীণ হাসলো।
মি.মেথেউ তেহভীনে অধরে ভেসে উঠা হাসির রেশ দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

— মানলাম,ক্যাথরিনকে চুজ করে আমি ভুল করেছিলাম। চোখের সামনে বেড়ে উঠা ক্যাথরিনের অন্তরের আড়ালে থাকা চরিত্রটা আমি দেখিনি। কিন্তু তুমি এবার শেষবারের মতো আমার কথাটা রাখো। আমার ফ্রেন্ড ন্যালসিনের তোমাকে খুব পছন্দ।

তেহভীন টানটান চোয়ালে চমৎকার একটা আমোদ ভাব ফুটিয়ে বলল,

— ড্যাড,আমি একজনকে ভালোবাসি!

মি.মেথেউ এ্যাসফোর্ড ভীষণভাবে চমকে তাকালেন ছেলের দিকে। একটা অবিশ্বাস্য কথা শুনে ফেলেছে সে।ছোট থেকে কড়াভাবে গাইড করার পরও কাউকে ভালোবাসার মতো সুযোগ তেহভীনের হাতে ধরা পড়বে সেটা ভাবতেই বিস্মিত হচ্ছেন তিনি। তাঁর অনেক ইচ্ছে ছিলো তিন ছেলে-মেয়ের লাইফপার্টনার তিনি নিজে চুজ করে দিবেন।তন্মধ্যে মেয়ে তামান্নার লাইফপার্টনার তিনি নিজে চুজ করেছেন,আর মেয়ে স্বাভাবিক ভাবে ছেলেটির সাথে সম্পর্ক রেখেছে। মাঝখানে ছেলে দুটো কে নিজের পছন্দের ধারেকাছেও রাখতে পারছেন না। অনেক্ষণ পর তিনি দৃঢ় স্বরে বললেন,

— কে সে?

— সি ইজ বেংলাডেশী ড্যাড!

মি. মেথেউ কিংকর্তব্যবিূঢ় দৃষ্টি মেলে ছেলে মুখপানে চাইলেন। এই সময়টুকুকে ঠিক কেমন আচরণ দিলে শোভনীয় হবে সেটা বুঝতে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত রাখলেন তিনি। তেহভীন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সুন্দরীদের নাচ দেখতে লাগলো। অতঃপর মি.মেথেউ বলে উঠলেন,

— কি বলছো এটা তুমি টেহভীন?শেষমেশ বেংলাডেশী মেয়ে? তুমি জানোনা ওরা কতো খারাপ আর লোভী?

তেহভীন কপালে ভাঁজ তুলে, দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা এনে বলে উঠলো,

— ইয়্যু মিন মাই মম ইজ গ্র্যাডি?

মি.মেথেউ থমথম খেয়ে গেলেন। আসলে তো কেউ লোভী নয়। কিন্তু তিনি তেহভীনের নানাকে ভীষণ অপছন্দ করতেন। তানজিদ,তামান্না,তেহভীন তিনজনকে কি অদ্ভুত আচার-আচরণ শিখিয়েছেন তিনি।যারজন্য ভেতরে ভেতরে তিনি আজো প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন।সেই রেশ ধরে বাংলাদেশের মানুষকে বিরক্ত লাগে তাঁর।কিন্তু নিজের জেদের জন্য এবারে ছোট ছেলেকে হারাতে পারবেন না তিনি।মনে মনে এমন একটা অভিমত পোষণ করে তিনি হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে বললেন,

— হোয়াট ইজ হিজ নেইম?

— তেনজিলা ফারাশ!

— ছবি আছে? দেখাও একবার।

— ছবি নেই।

তেহভীনের মুখে ছবি নেই কথাটা শুনে অবাক হলেন তিনি। কাউকে ভালোবাসে অথচ,তার একটা ছবি সাথে রাখেনি, কথাটা অবিশ্বাস্য। নাকি ছেলে দেখাতে চাইছে না তাকে। সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটি যদি বেংলাডেশী হয়,তাহলে টেহভীন বারবার ক্যালিফোর্নিয়াতে ছুটে যাওয়ার রহস্য কি? শুধুমাত্র ব্রাদারের কাছে এতোবার যাওয়ার কোন কারণ তো নেই। তেহভীন উঠে দাঁড়ালো, তার ড্যাডের দিকে চেয়ে বলল,

— আমার ঘুম প্রয়োজন। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।

মি.মেথেউ হ্যাঁ,না, কোন অভিব্যাক্তি দেখালেন না।চুপ রইলেন।মনে মনে তহেভীনের উপর রেগে আছেন খুব। ক্যাথরিন যদি সমস্যাটা না করতো,তাহলে এতদিনে তাদের বিয়েটা হয়ে যেতো। আজকের সন্ধ্যায় এতোটা উদ্ধিগ্ন হতে হতো না।

৯১.

নিজের কামরায় ফিরে দরজা লকড করে দিলো তেহভীন। নিজের ভেতরে অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে তার। তীব্র উত্তেজনা এক পলক ‘সিলভারের’ আদুরে মুখটি দেখার জন্য। গায়ের শার্টটা খুলে রেখে দিলো পাশে।ফ্রেশ হয়ে এসে সোজা বিছানায় লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লো। একটা বদঅভ্যাস তেহভীনের,সে সর্বদা উদাম গায়ে ঘুমাতে পছন্দ করে।এতে শান্তি পায় সে। বিছানায় শরীর স্পর্শ করার পর ঘুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো তার। গত একটা বছরের মেমোরিয়াল ইভেন্টগুলো বারবার মনে পড়তে লাগলো। সিলিভিয়ার সাথে যোগাযোগ নেই আজ ছয়মাস। আগে মাঝেসাঝে খবর নেওয়া হতো। কিন্তু রেডউড পার্ক থেকে ফেরার পর আজ ছয়মাস তেহভীন সিলিভিয়ার সাথে কথা বলেনি,সিলিভিয়াকে দেখতে পায়নি। নিজের কর্মস্থানে ব্যস্ত সময় কাটাতে কাটাতে শেষরাতের দিকে ক্লান্তিটা চোখের পাতায় চাদর বিছিয়ে দিতো তার। ফলে সিলিভিয়ার কথাটা কমই মনে পড়েছিলো এতদিন। কিন্তু আজ কেমন যেনো নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তার। যোগাযোগের রাস্তাটাও বন্ধ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকেও সিলিভিয়াকে সে মুছে ফেলেছে। হটাৎ একদিন সিলিভিয়কে মনে পড়লে সে নিজেই এবার সিলিভিয়াকে খুঁজতে লাগে,কিন্তু ফলাফলটা এলো শূন্য। সিলিভিয়াও তাকে সবদিক থেকে ব্লক করে দিয়েছে। তেহভীন এটার শোধটা একদিন তুলবে পণ করলো সেদিন।কিন্তু যোগাযোগটা আর হয়ে উঠেনা।
ঘন্টাখানেক চেষ্টার পরও যখন নিজেকে সামলাতে পারলো না,তৎক্ষনাৎ তেহভীন কাউকে ফোন দিয়ে দিলো।
অনেকদিন পর ভাইয়ের ফোন পেয়ে ফোনটা দ্রুত তুলল তানজিদ।

— কি অবস্থা তেহভীন?

— ভালো নয়। তুমি কোথায়?

তানজিদ আঁড়চোখে পাশে বসা থাকা মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল,

— খেতে এসেছি একটা জায়গায়।

— খাওয়া শেষ করো দ্রুত। তোমার কাছ থোকে
একটা ফেবার চাই আমার।

— কি সেটা?

— তুমি এখুনি সিলভারের এ্যাপার্টমেন্টে যাও।
গিয়ে ওকে বলো আমার নাম্বার আনব্লক করতে।

তানজিদ বলল,

— আমি পারবো না,কর্ডলেস নেই? ওখান
থেকে ট্রাই করো।

— ব্রো,আ’ই ওয়ান্ট টু সি হার রাইট নাউ।

তেহভীনের কথাটা শুনে ঠোঁট চেপে হাসলো তানজিদ। এরপর বলল,

— ভিডিও কল দাও,সিলভার আমার সাথেই আছে।

— হোয়াট?

অনেকটা চেঁচিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো তেহভীন।প্রচণ্ড অবাক হয়ে যায় সে, একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে দ্রুতটা ভিডিও কল দিলো সে। তানজিদ চোখ তুলে সিলিভিয়ার দিকে চাইলো। সিলিভিয়া তখন পাইন-এ্যাপল জুসে চুমুক বসিয়েছে। মজাটা সে দারুণ পাচ্ছে আজ। গত একসপ্তাহে ‘ক্রেজি রেইনের’ তাণ্ডব শেষে আজ সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হয়েছিলো সে। ভাবঘুরের ন্যায় হাঁটতে হাঁটতে কাকতালীয় ভাবে তানজিদের সাথে একটা সুপারশপে দেখা। ব্যস, তানজিদের অনুরুধে সন্ধ্যাবেলায় একটা রেসট্রনে এসেছে। এখানে এসে সিলিভিয়া সর্বপ্রথম তেহভীনের নামে শ’খানেক অভিযোগ রাখলো।তানজিদে শুনেই মিটিমিটি হাসলো শুধু, উত্তর দিলো না। দ্বিতীয় বার কাকতালীয় ঘটনা ঘটালো তেহভীন আজ নিজ থেকে ফোন হঠাৎ ফোন দিয়ে।
তানজিদ ফোন টা রিসিভ করার সাথে সাথে তেহভীনের চেহারাটা দেখতে পেলো। তেহভীন এক হাতে ফোন ধরে রাখলো,অন্যহাতে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে স্ক্রিনে চোখ রাখলো। তানজিদকে দেখে বলল,

— তোমার চেহারা দেখাচ্ছো কেন?
সিলভার কোথায়?

তানজিদ মুখে করুণভাব ফুটিয়ে বলল,

— উফস! তেহভীন আরেকটু আগে ফোন
করলে হতো।এইমাত্র তোমার নাম শুনে সিলিভিয়া এখান থেকে চলে গেছে। যেতে যেতে বলেছে সে ‘তেহভীন’ নামের কাউকে চিনে না।

—- তুমি বসে আছো কেন? উঠো, গিয়ে আটকাও ওকে। ওয়ান সেকেন্ড,সিলভার তোমার সাথে কেন?

তানজিদ অনেক কষ্টে নিজের হাসিটা আঁটকে রাখলো। আজকের ঘটনায় তার আজীবন মনে থাকবে। তার ভাইকে আজ প্রথম এতোটা অস্থির হতে দেখেছে। উপর থেকে সে যতোই কঠিন সিদ্ধান্ত নিক না কেন,ভেতরে ভেতরে সে পুড়ে যাচ্ছে। আজ তো কেমন ছটফট করছে সেটা নিজ চোখে দেখোলো। তানজিদ হালকা হেসে তেহভীনের দিকে চেয়ে বলল,

— তোমাদের নাকি ব্রেক-আপ হয়েছে। সো, উই আর ইন এ হ্যাপি রিলেশনশীপ!

এতোটা অবাক জীবনে প্রথম হলো তেহভীন। নিজের মুখ থেকে বলে ফেলা কথাটা কখনো ফেরত নেওয়া যায় না। ব্রেক-আপ হলো কখন? সে তো সিলিভিয়াকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলে এসেছিলো।আর মাঝখানে সময়টা তে দূরত্ব মেন্টেইন করলে পড়াশোনায় ভালোভাবে কনসেন্ট্রেট দিতে পারবে।সেটা ভেবেই তেহভীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলো।কিন্তু নিয়তি বলেও যে কিছু একটা থাকে সেটার কথা তারা ভুলেই বসেছিলো। মানুষের ভাবনা একদিকে চললে,নিয়তি চলবে তার উল্টো দিকে। হলোও তাই। নাহলে সিলিভিয়ার জন্য মনটা কেমন করে উঠলো কেন আজ হঠাৎ। নিজের দিয়ে আসা কথাটা নিজেই রাখতে পারছিলো না। নিঃশব্দে ফোনটা কাটলো তেহভীন। তানজিদ ফোনটা নামিয়ে টেবিলে রেখে দিলো। সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

— হি লাভ ইউ টু মাচ!

সিলিভিয়া ম্লানমুখে হাসলো।এরপর বলল,

— আই নোউ ভেরী ওয়েল!

(চলবে)

দেরী হওয়ার জন্য দুঃখীত। আমার পাঠকরা ঝটপট কমেন্ট করে ফেলুন দেখি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here