লাভ রেইন পর্ব-৩৬

0
1817

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৩৬

৯৩.
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে তে আজ ঝুম বৃষ্টির আগমন। ঠাণ্ডাচ্ছন্ন পরিবেশ। বিশাল আকাশের বুকে ধূসর বর্ণের মেঘ। নির্জন,ফাঁকা পিচঢালা রাস্তায় বৃষ্টির পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুল পরিবেশকে ছন্দময় করে তুলছে। ফল-সামার পর্যন্ত সেমিস্টার শেষে লম্বা একটা ছুটি কাটাতে যাচ্ছে সিলিভিয়া। এখন প্রশান্তি নিঃশ্বাস নেওয়া যাবে। মোহনীয় একটা পরিবেশে হৃদপিণ্ডে কাঁটার ফুটার মতো একটা অনুভূতি হচ্ছে সিলিভিয়ার। কাঁটার মূল উৎস তেহভীন নামক পুরুষটি।
ওই যে সেদিন নিঃশব্দে ফোনটা কাটলো,তারপর বহুদিন ধরে তাঁর আর কোন হদিস পায়নি সিলিভিয়া। পৃথিবীর কোন শেষপ্রান্তে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে সিলিভিয়া জানেনা। তবে মাঝেমাঝে তীব্র রাগ মস্তিষ্কে জায়গা পেলে,তৎক্ষনাৎ সিলিভিয়ার ইচ্ছে করে তেহভীন ধরেবেঁধে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। তারপর রশি দিয়ে রুমের বেডে বেঁধে রাখবে। তারপর সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে বেহায়ার মতো চেয়ে থাকতে। নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেললো সিলিভিয়া। অদ্ভুত মানুষ, কোন অনুভূতি নেই মনে হয় তার। এমন একটা ভাবলেশহীন সম্পর্ক আর কেউ বয়ে বেড়াচ্ছে কি-না সেটার জানার প্রবল আগ্রহ হয় সিলিভিয়ার।
পিচঢালা রোডের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ভাবলো নিজের দেশে ফিরে গিয়ে ছুটি কাটিয়ে আসবে। তারপর পি.এইচ.ডি করবে। পরক্ষণে ভাবনাটা ক্যান্সেল করলো সিলিভিয়া। এখানে একটা জব নিয়ে থেকে যাবে। পড়াশোনাটা শেষ হলে তেহভীন বলেছিলো যেনো নিজ দেশে ফিরে যায়।কিন্তু যে কথাটা বলেছিলো তার তো হদিস নেই। সিলিভিয়া সিদ্ধান্ত নিলো এখানেই থেকে যাবে আজীবন।

ঝুম বৃষ্টির শব্দকে চাপিয়ে হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। সিলিভিয়া হকচকিয়ে যায় আকস্মিক ভাবে কলিংবেল বেজে উঠতেই।সচরাচর এখানে জাইমা ছাড়া আর কেউ আসেনা। আসলেও আগে ফোন দিয়ে তারপর আসবে। এমন অসময়ে কে আসতে পারে সেটা ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। লুকিং গ্লাসে চোখ রাখতেই কালো বোরকা পরিহিত কাউকে অস্পষ্ট নজরে এলো। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ তুলে দরজাটা খুললো সিলিভিয়া। বোরকা পরিহিত আগুন্তুকের চেহারা দেখে বাকরূদ্ধ হয়ে গেলো সিলিভিয়া। অনেকদিন পর স্বল্প পরিচিত চেহারাটা দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে যায়। শুধু তাই নয় পাশে দাঁড়ানো অতি সুন্দরী রমণী কে দেখেও অবাক হলো। রমণী চমৎকার হেসে বলল,

— শ্যাল উই কাম ইনসাইড?

সিলিভিয়া তৎক্ষনাৎ ঘোর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো।বোরকা পরিহিত মহিলাটির মুখপানে চেয়ে স্মিত হেসে বাংলায় বলল,

— আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভেতরে আসুন।

তায়্যিবা হেসে সালামটা নিলো। তামান্না সিলিভিয়াকে সালাম দিতে দেখে সে নিজেও সালাম দিলো। সিলিভিয়া সুন্দর করে হেসে সালাম নিলো।তায়্যিবা আর তামান্নাকে আজ হঠাৎ, এই সময়ে অনাকাঙ্খিত ভাবে এখানে দেখে সিলিভিয়া বুঝতে পারছেনা কি বলে তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করবে। তবুও ভেতরে আসতে বলে সে দরজাটা মেলে ধরলো। তামান্না লাগেজ টেনে ভেতরে আসতে আসতে সিলিভিয়ার কানের কাছে নিচু স্বরে বলল,

—- টেহভীন নিচে আছে। তুমি চাইলে দেখা
করে আসতে পারো।অথবা এখানে আসার আমন্ত্রণ ও জানাতে পারো।

সিলিভিয়া তামান্নার মুখ থেকে আঁড়চোখে নিচে তাকানোর চেষ্টা করলো। বুঝলো,তীব্র অভিমানে এখানে আসছে না তেহভীন।এখন করণীয় কি? ভেতরে আসতে বলবে?

সিলিভিয়া তামান্নার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ছোট করে হাসলো। তামান্না লাগেজটা রেখে সোফায় বসলো। তায়্যিবা সোজা সিলিভিয়ার রুমে চলে গেলেন। উনাদের আচরণ এতোটা স্বাভাবিক যে,সিলিভিয়া নিজেই তাদের আচরণে ভয়ে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। তামান্না সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে মিটমিট হেসে ইশারায় তেহভীনকে ডেকে আনতে বলল। সিলিভিয়া বের হলো। লম্বা করিডোর দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো তেহভীন ছাতা হাতে নিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। সিলিভিয়া তাকালেই চোখাচোখি তাদের।সিলিভিয়ার চোখে এবং মস্তিষ্ক অন্যরকম একটা শান্তি অনুভব করলো। সেই প্রথম দিনকার মতো লাগছে তেহভীনের চেহারা। সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট পায়ের দিকে গুটানো। সিলিভিয়া তেহভীনের পায়ে থাকা লুইস’ভিটনের শো জোড়া পর্যন্ত দৃষ্টি নামিয়ে পূনরায় তুলে চেহারায় চোখ রাখলো। তেহভীনের চেহারায় তীব্র রাগ স্পষ্ট।তারপরও সৌষ্ঠবপূর্ণ শরীরের গঠনে এলিগ্যান্ট ভাবটা দৃশ্যমান। সিলিভিয়া দু’হাতে নিজের চুল পেছন থেকে টেনে সামনে এনে করিডোরের বাইরে এমনভাবে রাখলো যাতে বৃষ্টির পানিতে চুল ভিজে যায়। তেহভীন নড়েচড়ে দাঁড়ালো। হাবভাব দেখে বুঝা গেলো সিলিভিয়া না বলা অবধি জায়গা থেকে নড়বে না। সিলিভিয়া হাত তুলে ঘুষি দেখালো তেহভীনকে। ঘুষির মারার মতো ভঙ্গি দেখে তেহভীন ছাতাটা বাম হাত থেকে ডান হাত দিয়ে ধরলো।এরপর বাম হাত দিয়ে সে নিজেও সিলিভিয়াকে ঘুষি দেখালো। এ পর্যায়ে সিলিভিয়ার হাসি চলে আসলো। সে হাসি চেপে নিচে বসে গেলো। কয়েক সেকেন্ড হেসে আবারও দাঁড়ালো। তেহভীন আবারও ঘুষি দেখালো। সিলিভিয়া হাত নেড়ে বিদায় জানলো,ইশারায় বুঝালো যাতে এখান থেকে চলে যায়। তেহভীন ছাতাটা ফেলে দিলো হাত থেকে,বৃষ্টির পানিতে পুরুষ্টু শরীর ভিজতে লাগলো।সিলিভিয়ার কপালে চিন্তার রেখা ফুটলো। হিমশীতল বৃষ্টির পানি যে শরীর খারাপ হয়ে যাবে সেটা বুঝে গেলো সিলিভিয়া। তৎক্ষনাৎ দৌড়ে নিচে নামতে লাগলো। সিলিভিয়াকে দৌড়ে আসতে দেখে তেহভীনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। সে জানতো,সিলভার কখনো তার শরীর খারাপ সহ্য করবে না।চোখের সামনে তো নয়-ই। তেহভীন দু’হাত মেলে ধরলো। দুই’বছরের দূরত্ব, এটা কম সময় নয়। কিভাবে যে এতোদিন কাটালো। যদিও চার বছরের কথা ছিলো। তেহভীন এসময়ে আর অন্য কোন ভাবনা মনে আনলো না। মুহূর্তটা অনুভব করা খুব দরকার তার।
সিলিভিয়া দৌড়ে আসতে আসতে প্রায় ভিজে গেলো। তারপরও পদযুগল থামলো না তার। এক দৌড়ে তেহভীনে বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। তেহভীন শক্তভাবে সিলিভিয়াকে জড়িয়ে ধরে রাস্তা থেকে শূন্যে তুলে ফেললো। জনমানবহীন রাস্তায় তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। সিলিভিয়া চোখ বন্ধ করে মৃদুভাবে ফুঁফিয়ে তেহভীনের কাঁধে মুখ লুকালো। তেহভীনের নাক’ঠোঁট তখন সিলিভিয়ার গলায় গভীরভাবে ছুঁয়ে আছে। দু’জনের মাথার উপর বৃষ্টি। ভেজা ঠাণ্ডা শরীর,হালকা ঘনিষ্ঠতা দেখে প্রকৃতি যেনো মুখ লুকিয়ে ফেললো। আরো দ্বিগুন চেপে বৃষ্টি নামলো কিছু সময়ের জন্য।
তেহভীন শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— মিস করেছিলে?

— নো,

তেহভীন আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,

— মি টু।

সিলিভিয়া চুপ রইলো। কথা বললো না। বলার মতো কোন ভাষা আপাততে তার মনে আসছে না। দু’বছর ধরে প্রতিদিন,প্রতি মুহূর্ত একবার করে রোজ তেহভীনের কথা ভাবতো সে। আজও পূর্বের নিয়মমাফিক ভাবতে ভাবতে তেহভীন স্ব শরীরে তার কাছে এসে হাজির হলো। এতো খুশী কোথায় রাখবে আজ সে।
অনেক্ষণ পর তেহভীন সিলিভিয়াকে নিজের থেকে সরালো।নামিয়ে দিতে দিতে সিলিভিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— লাইয়ার!

সিলিভিয়া ভ্রূঁ কুঁচকে তাকালো। নিজের দিকে
আঙুল তাক করে বলল,

— আমি লাইয়ার?

— ইয়েস!

— ওহ, কেন লাইয়ার?

তেহভীন চোখ বড় করে তাকালো সিলিভিয়ার দিকে। সিলিভিয়া পূর্বের ন্যায় চেয়ে থেকে বলল,

—- তুমি খুব খারাপ তেহভীন?

— জানি।

— চলো উপরে,এভাবে ভিজলে তুমি সিক হয়ে পড়বে।

— আমি উপরে যাবো না সিলভার। তোমার সাথে একটু দেখা করতে এসেছি। এখনি চলে যাবো।

তেহভীনের মুখ থেকে ‘সিলভার’ ডাকটা শুনে যতটা মনটা শান্ত হলো,তার চেয়ে দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেলো তেহভীন চলে যাবে শুনে। কেন বুঝে না তেহভীন?
এতোদিনের দূরত্ব রাখার পর একটু করে দেখাটা ভালো লাগছেনা তার। সময়টা আরো বাড়াতে চায় সে। সিলিভিয়ার চোখ ভিজের আসলে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।তেহভীন সিলিভিয়ার মুখ ধর নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,

— আমি লেওভার নিয়ে এসেছি সিলভার। ছুটি নেই।
আমাকে ফিরতে হবে। তবে আর দেরী করবো না প্রমিজ করছি। ছয়মাস পর আবারও আসবো।তুমি ততদিনে প্রস্তুতি নাও। হোল লাইফ আমার সাথে কাটানোর জন্য।

— আন্টি আর তামান্না সিস?

তেহভীন চোখমুখ আঁধার করে বলল,

— ড্যাডের সাথে মমের একটু পার্সনাল ইস্যু ক্রিয়েট হয়েছে। আর সিস ছুটিতে এসে এমন ঝামেলা দেখে মন খারাপ করেছিলো খুব।সারপ্রাইজ দেওয়ার নাম করে তোমার এখানে নিয়ে এসেছি তাদের৷কারণ,তুমিও এখন ছুটিতে আছো। আমাদের রিলেশনের কথাটাও জানিয়েছি মম এন্ড সিসকে। দ্যে ‘আর ভেরী হ্যাপি ফর আচ।

সিলিভিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শুনে।মন খারাপটা তেহভীনের জন্য হচ্ছে। তেহভীন হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে সিটে বসে পড়লো। সিলিভিয়ার হাত টেনে আলতো ভাবে চুমু দিয়ে বলল,

— আমি আমার কথা রাখতে চাই সিলভার।
তোমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগ অবধি তোমাকে বিরক্ত বা জ্বালাবো না। কিন্তু এরপরে যা হবে তা তোমার কল্পনার বাইরে। ভালো থেকো,বায়!

সিলিভিয়ার হাত ছাড়তেই দরজা বন্ধ করলো তেহভীন। মনে মনে প্রচণ্ড চিন্তায় ভুগছে সে। ড্যাড হঠাৎ করে সিলিভিয়ার কথা শুনে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললেন। উনার রিচ কোন ফ্যামিলিতে বিলং করে এমন মেয়ে চায়।যে তেহভীনের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্য মি.মেথেউ এর ভাবনায়।সেখানে সিলিভিয়াকে মানতে নারাজ। তার উপর তেহভীন তার সিদ্ধান্তে অনড়। তার মম-সিস কে জানলে তার শুনেই রাজি হয়ে যায়। যারজন্য বিরাট একটা সমস্যা বেঁধে গেলো তাদের মধ্যে। ড্যাড ভীষণ রাগ করে আছে। রাগ কমার পর বাকিটা দেখা যাবে ভাবলো তেহভীন।ততদিন সিলিভিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার সকল প্রকার চেষ্টা সে আঁড়ালে চালিয়ে যাবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here