লাভ রেইন পর্ব-৩৭

0
1983

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৩৭

৯৪.
ভেজা শরীর নিয়ে জবুথবু হয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো সিলিভিয়া। তায়্যিবা আর তামান্নার সামনে যেতে অদ্ভুত এক জড়তা কাজ করছে তার মনে।দরজার কাছে সিলিভিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তামান্না ফিচেল হাসলো।তায়্যিবা ফ্রেশ হয়ে লিভিং রুমে এলো।সুন্দর মুখশ্রীতে রাজ্যের চিন্তার প্রলেপ ছড়ানো। তারপরও ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসিটা জায়গা দখল করে আছে।সিলিভিয়া খেয়াল করলো হাসিটা হুবহু তেহভীনও পেয়েছে। মা-ছেলের হাসিটুকুই মিল পেলো সিলিভিয়া।তায়্যিবা এগিয়ে আসতে আসতে বলল,

— ওমাহ! তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন ওভাবে?
ঠাণ্ডা লেগে যাবে। যাও চেঞ্জ করে এসো।তেহভীন চলে গিয়েছে?

সিলিভিয়া উপর-নীচ মাথা নাড়লো। তায়্যিবা মৃদু হেসে বললেন,

— আমরা এসেছি বলে তোমার সমস্যা হবে না তো?

সিলিভিয়া চট করে বলল,

— না আন্টি একদমই নয়। আমার জন্য আরো ভালো হয়েছে। তবে আমি কিন্তু ভীষণ সারপ্রাইজ হয়েছিলাম আপনাদের দেখে।

— আমরা আরো দ্বিগুন সারপ্রাইজ হয়েছি তোমার সাথে তেহভীনের রিলেশনের কথা শুনে। আচ্ছা যাও এখন। আমি কফি বানাচ্ছি, জমিয়ে আড্ডা দিবো।

সিলিভিয়া চলে গেলো ভেজা কাপড় পাল্টাতে। তামান্না উঠে নিজের লাগেজ নিয়ে অন্য রুমটিতে চলে গেলো।সিলিভিয়া দরজার লক খুলে রেখে যাওয়ায় তামান্না সেখানেই নিজের লাগেজটা রাখে। কাজের সময় নির্ঘুমে রাত কাটানোর পরও কখনো তেমন মাথা ব্যথা হয়না। অথচ ছুটির দিনগুলোতে মনকে ফ্রেশ করতে গেলেই মাথা ব্যথাটা শুরু হয়ে যায়। অদ্ভুত নিয়ম। জীবনে নিয়ম জিনিসটাই সবকিছুর উর্ধে। অভ্যস্ত জীবন, সময় চক্রের বাইরে গেলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়।

সিলিভিয়া কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে ভাবছে নিজের নিয়তির কথা। কতো সহজ-সাবলীল তার আর তেহভীনের সম্পর্কটা। একদম নির্ঝঞ্ঝাট, শুধু দূরত্বটা বেশি। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশীফ এসে নতুন একটা জিনিস আবিষ্কার করলো সিলিভিয়া। অপেক্ষা’ একরকম দগ্ধ অনুভূতি দিলেও,অপেক্ষার শেষটা সুন্দরে পরিপূর্ণ হয়। মাঝের সময়টাতে কতোইনা চিন্তা-চেতনা, কাতরতা, অস্থিরতা সব লুকিয়ে থাকে।তখন ব্যপারটা তার জন্য বেশ আনন্দের হয়। সবশেষে, সহজলভ্য একটা পারিবারিক সম্পর্ক আশা করছে সিলিভিয়া মনে মনে। দ্রুত কাপড় পাল্টে,কিচেনের দিকে ছুটলো। তায়্যিবা তখন কফি বানানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলো। সিলিভিয়া এসে নিজেই কফি তৈরিতে লেগে যায়। তায়্যিবাকে রেস্ট নেওয়ার জন্য রুমে চলে আসতে বলে। তায়্যিবা লিভিং রুমের সোফায় বসলো, ফোনটা বের করে তানজিদকে ফোন দিয়ে আসতে বলল। মা’বোন লন্ডনের এডিনবার্গ থেকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে এসেছে শুনে তানজিদ তৎক্ষনাৎ শুটিং মাঝপথে বন্ধ রেখে দ্রুত ছুটে আসে এক ঝলক তাদের দেখার জন্য। মাকে জড়িয়ে ধরে তার ড্যাডের নামে সহস্র অভিযোগ বাণীও পেশ করলো তানজিদ। সিলিভিয়া অদূরে দাঁড়িয়ে শুধু তাদের দেখে যাচ্ছিলো। তার কপালেও সূক্ষ্ণ একটা ভাঁজ ফুটে উঠলো। গভীর একটা চিন্তাও এসে মস্তিষ্কে হানা দিলো। তেহভীনের ড্যাড নিঃসন্দেহে একজন কঠোর মেজাজের মানুষ। তাহলে তাদের সম্পর্কের শেষটা কি তাহলে উনার জন্য অপরিপূর্ণ রয়ে যাবে? তারপরের সময়টাও অতিদ্রুত শেষ হয়ে যায়। মাঝখানের কিছু সুন্দর স্মৃতি গড়ে উঠেছিলো তায়্যিবা ও তামান্নাকে নিয়ে।

৯৫.
আকবর হাসান জমি সংক্রান্ত বিষয়ে নিজের ভাইয়ের সাথে আলোচনা করছিলেন। গ্রামে একটা নিজেদের বাপের দেওয়া জায়গা আছে আকবর হাসানে,যেটার মূল্য এখন হীরে-জহরতের চেয়েও বেশি। বহু পুরোনো দিনের জমি। একজন ব্যবসায়ীর খোঁজ এনে দিলেন উনার বড়ভাই মুনতাসীর শেখ। জুয়ারি পুত্র মামুন সহ মিলে বোকা’ দূর্বল মস্তিষ্কের আকবরকে ঠকানোর নতুন পায়তারা। জমির ব্যাপারে কখনো কোন আলোচনা সায়মনের সাথে আজ অবধি করেননি তিনি। ফলস্বরূপ ভাই এবং ভাইপুত্র এর চক্রান্তের স্বীকার হতে যাচ্ছেন তিনি আজ। ঠকানো ধরণটা এমন, বেশি মূল্যে জমিটা বিক্রি হলেও তার অর্ধেক মূল্য আকবর সাহেবের হাতে তুলে দিবেন। আর বাকিটা নিজেদের পকেটের চালান করবেন। এজন্য নানা সুযোগ সুবিধার কথা বুঝিয়ে, জমিটা বিক্রি করানোর নামে আজকের বৈঠকে বসলেন তারা।
আল্লাহর অ’শেষ রহমতে তৎক্ষনাৎ একটা ফোন এসে ঢুকলো। আকবর হাসান ফোনে দৃষ্টি রাখলেন। নতুন স্মার্টফোন জায়গা নিয়েছে উনার হাতে। মাসখানেক আগে সিলিভিয়া টাকা পাঠিয়েছিলো তার জন্যে,সেখান থেকেই ফোনটা কেনা। মেয়ের ফোন পেয়ে আকবর হাসানের ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হয়। মুনতাসীর আর মামুন নড়েচড়ে বসলেন সিলিভিয়ার ফোন দেখে। আকবর হোসেন ফোন ধরে বললেন,

— বুড়ো বাপকে এতদিন পর মনে পড়লো তোর মা?
কেমন আছিস?

— ভালো আছি বাবা।তুমি কেমন আছো?
এতদিন পরীক্ষার ঝামেলায় ছিলাম। কি করছো?

— আমি ভালো আছি অনেক। শোন,তোর বড় আব্বুর বাড়িতে এসেছি আমি। ওই যে আমাদের পাহাড়ের কাছে জামিটা বিক্রি করার আলোচনা চলছে। ভালো মূল্য পাচ্ছি জমিটা দিয়ে।

সিলিভিয়া খুশী হতে পারলো না খবরটা শুনে। নাকমুখ কুঁচকে এক করে সিলিভিয়া বলল,

—- বাবা,এটা কি করছো তুমি? ওই জমিটাতে একটা রিসোর্ট করতে চেয়েছিলাম আমি বিদেশীয় ডিজাইনে। আর তুমি সেটা বিক্রি করে দিচ্ছো।

আকবর হাসান থমথম খেয়ে নিজের বড় ভাইয়ের মুখপানে চাইলেন। মুনতাসীরের চোখেমুখে কিঞ্চিৎ রাগ আর কৌতূহল। সিলিভিয়ার প্রতি উনার অদৃশ্য এক ক্ষোভ আছে। আর সেটা হলো সবকিছুতে বাঁধা প্রধানের জন্য। মেয়েটা একঝলক দেখে,শুনেই পরিস্থিতি কেমন হতে পারে আগে সেটা বুঝে ফেলে। যেমন এখন। এই মুহূর্তে সে টের পেয়েছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে,নইলে অসময়ে ফোন দেওয়ার কারণ কি? মুনতাসীর গলা খাঁকারি দিয়ে আকবরের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে নিজের কানে ঠেকিয়ে ‘হ্যালো’ বললেন। সিলিভিয়া সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিলো। মুনতাসীর একটু অবাকই হলেন।এরপর ভাইয়ের দিলে চেয়ে ক্ষীণ হেসে বললেন,

— নিটওয়ার্কের সমিস্যা হয়তো।
আচ্ছা বাদ দে। মূল আলোচনায় ফিরে আসি?

আকবর হাসান ফোনটা হাতে নিয়ে ‘হুম’ বলার সাথে সাথে পূনরায় সিলিভিয়ার ফোন এসে ঢুকলো। আকবর হাসান রিসিভ করার সাথে সাথে সিলিভিয়া বলে উঠলো,

— বাবা,আমি আসি তারপর নাহয় জায়গা বিক্রি করো। আমার অনুরোধ বাবা এটা।তুমি রাখবেনা?

— তুই কখন আসবি?

— সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসছি আমি।
ভালো থেকো বাবা রাখছি।

ফোনটা রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সিলিভিয়া। তার সহজ-সরল বাবাকে যে কেউ ঠকাতে পারে। নিজের বাবা সমতূল্য বড় ভাই তো লেগে আছে ঠকানোর জন্য। সিলিভিয়া চাইলে সায়মনকে বলেও সব মিটমাট করাতে পারে।কিন্তু সায়মন একটুতেই রেগে যায়।সেজন্য আজ অবধি তার বাবা আর ভাইয়ের মধ্যে কখনো মতের মিল ঘটেনি।

সিলিভিয়া ফোন কাটলে মামুন বলে উঠলো,

— সিলিভিয়া কি বলছে ছোট বাবা?

— সিলিভিয়া আসছে দেশে। সে আসার পর বাকিসব আলোচনা হবে ভাবছি মামুন। তাহলে আজ এখানে এতটুকুই থাক আলোচনা।

আকবর হাসার আর কিছু বললেন না। মেয়ে ফিরে আসবেন শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। বাড়ি গিয়ে এলাহি আয়োজন শুরু করবে ভাবলেন তিনি।

৯৬.
গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের গবেষণায় অভিজ্ঞতা লাভ করার পর পি.এইচ.ডি এর পোগ্রামে ভর্তি হয়েছে সিলিভিয়া। ভর্তি হওয়ার পর জানতে পারলো এই প্রতিষ্ঠানে পি.এই.ডি এর সময়সীমা পাঁচবছর। তাছাড়া ফুল’টাইম ওয়ার্কের জন্য ফুল স্যালারি থাকবে প্রতিমাসে,মাঝে মাঝে বৃদ্ধিও হবে। পি.এইচ.ডি হলো একটা সিকিউর জব।বছরে নির্দিষ্ট ছুটি। চিকিৎসা ও অন্যান্য বাবদ খরচ পেয়ে থাকে। সবমিলে সিলিভিয়া ভাগ্যটা যে বেশ ভালো সেটা ধারণা করতে পারছে তেহভীন। নাহলে অনেককেই অনেক কষ্ট পোহাতে হয়।ক্যালিফের্নিয়ার একটা সবচেয়ে দামী ইন্ড্রাস্ট্রির সর্বোচ্চ পর্যায়ে চাকরির ব্যবস্থা করে রেখেছে সে। যদিও ভালো জব পাওয়ার যোগ্যতা সিলিভিয়ার আছে।তারপরও যাতে সিলিভিয়া কষ্ট,দুশ্চিন্তা না হয় সেজন্য আগেবাগে কথা বলে রেখেছে তেহভীন।তার একটাই প্রত্যাশা ‘সিলভার’ আজীবন খুশী থাকুক।
শ্বেতবর্ণ চেহারায় নিগূঢ় কষ্টের চাপ। সবসময়ের মতো উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চুল আজ কেমন যেনো এলোমেলো দেখাচ্ছে। স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে সিলিভিয়া বলল,

—- হুয়াই ইউ আর লুকিং আপ’সেট?

তেহভীন চট করে ফোন থেকে চোখ তুলে বাঁ পাশে তাঁকালো। সামান্য দূরত্বে বসে আছে সিলিভিয়া। তেহভীন মৃদু হাসলো সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে। এরপর মাথা দু’দিকে নেড়ে না ইঙ্গিত দিলো। সিলিভিয়া মানলো না। আবারও জিজ্ঞেস করলো,

—- ইয়াং’ম্যান তোমার মন আসলেই খারাপ।
কি হয়েছে বলো।

—- কিছু হয়নি।তুমি বলো সাডেনলি তোমার কান্ট্রিতে যাওয়ার ইচ্ছে হলো কেন? আমাকেও সাডেনলি আসতে বললে।

—- বাড়ির কথা মনে পড়ছিলো খুব সেজন্য।আর…

—- থেমেছো কেন? বলো কি বলতে চাইছিলে।

—- আর কিছুনা, সবাইকে মিস করছিলাম?

—- আমাকেও?

সিলিভিয়া হেসে উঠলো,বলল,

— তুমি কে, যে তোমাকে মিস করবো?

— কেউ না বলছো?

এই প্রশ্নে সিলিভিয়ার মুখ চুপসে গেলো। সেটা দেখে তেহভীনও দূরন্ত হাসলো। এরপর বলল,

—- সিলভার, চলে যায় আমি?

সিলিভিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকালো। এরপর নিভু স্বরে বলল,

—- যাওয়ার আগে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব। সবসময় আমি তোমাকে বিদায় দিয়েছি,এবারে তুমি বিদায় জানাবে।

তেহভীন সিলিভিয়ার কথায় অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।এরপর হুট করে বলে উঠলো,

— তোমাকে বিদায় জানাবো না,কারণ,আমিও যাবো তোমার সাথে,তোমার কান্ট্রিতে।

সিলিভিয়া ফিক করে হেসে উঠে বলল,

— তোমার ড্যাড? উনার চোখকে ফাঁকি
দিতে পারবে?

সিলিভিয়ার কথা শুনে তেহভীন কাউচে টান টান হয়ে বসলো।এরপর বলল,

—- তুমি হয়তো জানোনা সিলভার। ড্যাডের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি এ পর্যন্ত অনেক জায়গায় গিয়েছি। যেটা শুধুমাত্র আমিই জানি।

— এটা কিন্তু ভালো নয়।

—- খারাপ, তাও কিন্তু নয় সিলভার। ডোন্ট ওয়ারি।
আমিও যাবো তোমার সাথে।যদিও কান্ট্রিটা তোমার,কিন্তু তোমাকে একা ছাড়তে চাইছে না মন।

সিলিভিয়া নিগূঢ় হাসলো তেহভীনের কথায়। মস্তিষ্ক একটা সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে তার।ব্যপারটা অসম্ভব ও বটে।কিন্তু সিলিভিয়া সবটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলো।

তেহভীন সিলিভিয়ার কাঁধে মাথা রাখলো দৃঢ়ভাবে।সিলিভিয়ার হাতটা ধরে মাথায় রেখে বলল,

— চুল টেনে দাও।’

সিলিভিয়া চুপচাপ তেহভীনের চুল টানতে লাগলো।কিন্তু তেহভীনের স্বভাবগত দোষ সিলিভিয়াকে কোনমতে স্থির থাকতে দিচ্ছিলো না। সিলিভিয়ার চুল নিয়ে টানাটানি করাটা তেহভীনের কাছে বেশ মজার মনে হচ্ছিলো৷ সিলিভিয়া রেগে গেলো,অতিষ্ট হয়ে তেহভীনের ক্লিনসেভ,মসৃণ ত্বকে একটা চড় মেরে দিলো। এরপর উঠে চলে গেলো। তেহভীন হাসতে হাসতে গালে হাত রাখলো। সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

— চড়টা অনেক সুস্বাদু ছিলো সিলভার।
এমন চড় আরো চাই।

সিলিভিয়া ঘুরে আবারও আসতেই তেহভীনে উঠে সোজা নিজের কামরায় ঢোকে পড়লো। সিলিভিয়ার হাসি চলে আসলো তেহভীনের কাণ্ডে।

(চলবে)

ভেবেছিলাম,তেহভীনকে বাদ রেখে বাকি কয়েক পর্ব লিখবো।কিন্তু আমি নিজেই তেহভীনকে মিস করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here