#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ৩
(৭)
বিকেল সাড়ে চারটায় মিশরাত আর ইশরাতকে নিয়ে সাদমান বাইরে বের হলো। সাদমানের নিজস্ব গাড়ি থাকলেও ইশরাত বলেছে আজকে রিকশা করে তারা ঘুরে বেড়াবে। সমস্যা ঠিক এখানেই। রিকশায় তিনজন উঠে বসা যায় ঠিকই কিন্তু খুবই গা ঘেঁষা অবস্থায় থাকা লাগে যেটাতে সাদমান একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। সরাসরি ইশরাতকে সে কিছু বলেনি। মিশরাতকে বলেছিলো এই আইডিয়া বাদ দিতে। কিন্তু ইশরাত নাছোড়বান্দা। সে গেলে রিকশা করেই যাবে নয়তো যাবেই না বলেছে। অগত্যা সাদমানকে রাজি হতেই হলো। সাদমান বলেছে একসাথে তিনজন রিকশায় উঠতে পারবে না। মিশরাত আর ইশরাত এক রিকশায় যাবে এবং সাদমান আরেক রিকশায়।
বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাদমান প্রায় বারো মিনিট অপেক্ষা করার পর দু’বোনকে দেখতে পেয়েছিলো। মিশরাত থ্রি পিস পরে আসলেও ইশরাত ছিলো কালো শাড়ি পরিহিতা। দুধে-আলতা গায়ের রঙ হওয়ায় ইশরাতকে দেখতে নজরকাড়া সুন্দরী লাগছিলো। কানে ঝুমকো, দু’হাতে চুড়ির আধিক্য, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ, ঠোঁট হালকা লাল রঙে রাঙানো, চোখে টানটান করে কাজল আর আই-লাইনার দেওয়া এবং চুল খোলা। মাথার বাম পাশে কানে একটা কাঠগোলাপ গুঁজে রাখা। অন্যদিকে থ্রি পিসের সাথে একেবারেই সাদামাটাভাবে বের হলো মিশরাত। তেমন কোনো সাজুগুজু ছিলো না। মুখে একটু পাউডার, চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লিপ বাম। ইশরাতের মতো তার চুলগুলোও ছাড়া ছিলো।
—-আমরা কী যাবো না?
মিশরাতের ডাকে সাদমানের ধ্যান ভাঙলো। এতোক্ষণ যাবত সে কোথায় তাকিয়ে ছিলো তা ঠাউর করতে পারলো না দুই বোনের কেউ-ই।
—-অ্যাঁ? ওহ হ্যাঁ, চলো।
একটা রিকশা ডাকলো সাদমান। উদ্দেশ্য ইশরাত আর মিশরাতকে সেটাতে উঠিয়ে দেবে।
রিকশায় ইশরাত উঠে বসার পর সবেমাত্র মিশরাত উঠতে যাবে এরমধ্যেই তার ফোনে একটা কল এলো।
বিপরীত প্রান্তের ব্যক্তি কী বললো তা ইশরাত বা সাদমান কেউ বুঝতে পারলো না। তবে কান থেকে ফোন নামিয়ে মিশরাত বললো
—-আমি তোমাদের সাথে একটু পর জয়েন করবো। তোমরা পার্কে চলে যাও। আমি একটু পর আসছি।
—-মানে? কোথায় যাবে তুমি?
—-আরে ববিতা আন্টি ফোন করেছেন। উনার মেয়ে আবার পাগলামো শুরু করেছে। আমি চকলেট নিয়ে না গেলে নাকি সে পড়তে বসবে না। জানোই তো আমাকে কতোটা ভালোবাসে। বাচ্চা মেয়ে, তার আবদার ফেলতেও পারি না।
—-উনারা মেয়েকে এতো প্রশ্রয় দিচ্ছেন কেন? যা চায় তাই দিতে হবে?
—-আরে বাচ্চা একটা মেয়ে। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে বুঝোই তো। আমি চলে আসবো। বেশি দেরী করবো না।
—-আপু, তুই আসলে না হয় আমরা যাই?
—-না, না। আমার জন্য অপেক্ষা করতে গেলে দেরী হবে। তোরা যা না, আমার আসতে বড়জোর আধ ঘন্টার মতো দেরী হবে। কিন্তু এখন আমার জন্য অপেক্ষা করতে গেলে আজকে যাওয়াই হবে না।
মিশরাত চলে গেলে ইশরাতের সাথে উঠে রিকশায় বসলো সাদমান। ঠিকানা বলে দেওয়ায় রিকশাওয়ালা গন্তব্য বরাবর যেতে লাগলো। ইশরাতের মনে কেমন জানি উথাল-পাথাল লাগছে। শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কিছুই হয়নি, শুধু একটু সাদমানের পাশে বসাতেই। অবশ্য এটাও ঠিক যে আজকে সাদমানের এতোটা কাছে সে প্রথমবারের মতো বসেছে। আজকে সাদমানের সাথে প্রথমবারের মতো কোথাও বের হয়েছে দেখেই এতো সাজগোজ করেছে। তার উপর এখন তো একেবারে এক রিকশায়। খুশিতে গদগদ হয়ে আছে ইশরাত। মনে লাড্ডু ফুটছে ক্রমাগত। কিন্তু বিরক্তি একটা জায়গায় শুধু। যার জন্য এতো সাজলো, সে একটা বার ঠিকমতো তার দিকে তাকালো পর্যন্ত না। ইশরাত এবার আর অপেক্ষা না করে নিজে থেকেই বলে ফেললো
—-সাদমান ভাই, এই শাড়িটা আমাকে কে কিনে দিয়েছে জানেন?
—-তুমি বিবাহিত? কারোর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ?
—-মানে?
—-প্রেমিক বা স্বামী তো নেই। বাপের বাড়িতে থাকো। তাই না?
—-মানে?
—-বান্ধবীর শাড়ি তো ধার করোনি?
—-মানে?
—-কী মানে মানে করছো কখন থেকে? আমার একটা প্রশ্নেরও তো উত্তর দিলে না।
—-আপনার প্রথম আর তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর না, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ।
—-তাহলে তোমার বাবা-মা কিংবা বড়জোর বোন ছাড়া তোমাকে এটা আর কে দেবে? এটা কোনো প্রশ্ন হলো?
—-আপনি কী আমার সাথে একটু স্বাভাবিক স্বরে, স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না? অন্য কারোর সাথে তো আপনাকে এভাবে কথা বলতে দেখি না?
—-বোকার মতো প্রশ্ন করা আমি পছন্দ করি না।
চোখের কোণের হালকা পানি ঝটপট বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছে ফেললো ইশরাত। তবে চোখে যে কাজল দিয়েছে সেটা বোধহয় খেয়াল নেই তার। ডান চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে। এতো সাজ আজকে যার জন্য সাজলো, সে মানুষটা ফিরে তাকানো দূরে থাক, শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করেছে দেখে এভাবে উত্তর দিলো?
হঠাৎ পেছনের আরেকটা রিকশা থেকে একটা ছেলের কন্ঠ শোনা গেল।
—-ওহ মিস, আপনার শাড়ির আঁচল সামলান। রিকশার চাকার কাছাকাছি গিয়ে রয়েছে। বাতাসে উড়ছে। চাকায় লেগে গেলে জীবন নিয়ে টানাটানি লাগবে।
ছেলেটা কথা শেষ করতে পারেনি। তার আগেই একটান দিয়ে বাইরে থেকে আঁচলের অংশটুকু ভেতরে নিয়ে এলো সাদমান। উচ্চস্বরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো
—-এই, যেটা পরে সামলাতে পারো না সেটা পরতে যাও কেন? হ্যাঁ? মরতে চাও? চোখে দেখো না শাড়ির আঁচল যে বাতাসে উড়ছে? নাকি শাড়ি পরে রিকশায় উঠে নিজেকে নায়িকা ভাবা শুরু করেছো?
এই পর্যন্ত অনেক বাঁকা কথা শুনলেও ইশরাত এভাবে রাগ করতে কখনো দেখেনি সাদমানকে। ধমক খেয়ে খানিকটা কেঁপে উঠেছে ইশরাত। রিকশাওয়ালার বোধহয় ব্যাপারটা চোখে পড়লো। উনি দরদী কন্ঠে বললেন
—-বাপজান, আম্মারে এতো বইকেন না। বউয়ের রাগ কিন্তু মারাত্মক রাগ। দেখা যাইবো বাপের বাড়িতে গিয়া আর আসে না আপনের কাছে।
—-আপনি রিকশা চালান চাচা।
—-আরে তোমার ভালোর লাইগাই কইলাম। বউ চইলা গেলে যে কী কষ্ট হয়! তোমার চাচি একদিন আমার লগে রাগ কইরা বাপের বাড়িতে গেছিলো। রাগ কী রাগ! ভাঙবারই চায় না। পরে আদর সোহাগ কইরা মান ভাঙানো লাগছে। এর লাইগাই কইলাম বউরে আদর সোহাগ দিয়া রাইখো। বকাঝকা কম কইরো।
বিরক্তিতে মুখের নকশা বদলে গেল সাদমানের। আরে আশ্চর্য! উনি তো দেখি রেডিমেড বিয়ে-শাদি করিয়ে রেডিমেড বউ হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন। রিকশায় ছেলে-মেয়ে একসাথে বসা মানেই কী স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে যাওয়া নাকি!
রিকশাওয়ালা মনে হচ্ছে কথা বলার একটা পুঁজি পেয়েছেন এই একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে। উনি উনার বউয়ের রাগ ভাঙানোর জন্য কী কী করেন, তার চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন সেই মিনিট সতেরো ধরে। সবথেকে বিরক্তিকর যেই ঘটনাটা ঘটেছে, তা হলো রাস্তায় জ্যাম পড়ে গিয়েছে। আজকাল অল্প একটু দূরত্বের মধ্যেও জ্যাম জিনিসটা মারাত্মক ভোগায়! রিকশা থেমে থাকলেও রিকশাওয়ালার কথা থেমে নেই। সাদমান অতিষ্ঠ হয়ে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ফোনে গান শুনতে উদ্যত হলো। ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে সবেমাত্র গান খুঁজতে নিচ্ছিলো, তার মধ্যেই তার কানে এলো বেসুরো কন্ঠে গাওয়া একটি ছেলের গান।
—-চোর আইছে চোর আইছে
খাইছে রে খাইছে খাইছে
তুমি একটা চোর, আমি একটা চোর
দু’জনে করবো চুরি দু’জনকে
আগে তুমি আমাকে, পরে আমি তোমাকে
এটা কোনো গান? এতোটুকু শুনেই সাদমান মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে পাশে তাকালো। তবে তার চেহারায় বিরক্তি নিজের স্থান ত্যাগ করে রাগের জন্ম দিলো। প্রথমত ছেলেটা ইশরাত রিকশার যে পাশে বসেছে, সেই পাশেই বাইক নিয়ে আছে। তার উপর ছেলেটা বাইকে বসে গানটা গাইছে এবং শিস বাজাতে বাজাতে ইশরাতের দিকে তাকাচ্ছে। ইচ্ছে করেই নিজের বাইকটা ইশরাতদের রিকশার সাথে লাগিয়ে রাখলো।
—-আপনি কাকে চুরি করবেন ভাই?
ছেলেটা বোধহয় বুঝতে পারেনি সাদমান তার গান শুনছে। হয়তো ভেবেছিলো কানে যেহেতু ইয়ারফোন লাগানো তাই কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। বোকার মতো সাদমানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে একবার তাকিয়ে সাথে সাথে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে।
—-আপনি তো লাইন ভাঙছেন। সামনে তাকিয়ে দেখুন তো আপনার লাইনের অন্যান্য যানবাহন কোথায় আর আপনি কোথায়? এভাবে রিকশার সাথে লেগে আছেন কেন? আমাদের রিকশাটা আপনার খুব পছন্দ হয়েছে বুঝি?
ছেলেটা তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে নিজের জায়গায় বাইক নিয়ে গেল। তার সাথে সাথেই চাপা কন্ঠে রাগান্বিত স্বরে সাদমান বললো
—-ভবিষ্যতে যদি কখনো আর এভাবে সেজেগুজে বাইরে আসতে দেখেছি তাহলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো। এভাবে রাস্তাঘাটে নিজের রূপ প্রদশর্নের মানে কী? ইচ্ছে তো করছে এক থাপ্পড় দিয়ে রিকশা থেকে নামিয়ে আমি একা একা চলে যাই!
সহ্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এই মানুষটা একটা দিনও তার সাথে একটু ভালো করে কথা বলে না। ভালো কথা বললেও তার উল্টো অর্থ ধারণ করে তাকে প্রতুত্ত্যর করে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ইশরাত।
—-এই, একদম কান্না বন্ধ। এতোক্ষণ রাস্তাঘাটে সব ছেলেদের রূপ দেখিয়ে সাধ মেটেনি? এখন কান্না করে সিমপ্যাথি আদায় করতে চাইছো?
কান্না গিলে ইশরাত বললো
—-আমাকে নামিয়ে দিন রিকশা থেকে। আপনার মতো মানুষের সাথে আমি আর যাবো না কোথাও। খুব শিক্ষা হয়েছে আমার।
—-ওহ, ওই বাইকে উঠার শখ হয়েছে বুঝি? ওই ছেলের পাশে গিয়ে বসার শখ হয়েছে?
না, এবার আর কান্না আসছে না ইশরাতের। বরং রাগ হচ্ছে। শুধু কী এই লোকটাই ত্যাড়া কথা বলতে পারে? সে পারে না? তারও তো মুখ আছে। পরিণাম বিবেচনায় না রেখে ইশরাত বলে ফেললো
—-হ্যাঁ বসবো ওই বাইকে গিয়ে ছেলের পাশে। দরকার পড়লে এখানে যতগুলো বাইক, রিকশা, সিএনজি আছে আর তাতে যতোগুলো ছেলে আছে তাদের সকলের পাশে বসবো। আপনার কোনো সমস্যা?
(৮)
—-এই, আমাকে এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমি পার্কে যাবো। অদ্ভুত তো! গাড়ি থামান।
মিশরাতের কথাগুলো কর্ণগোচর হয়েছে বলে মনে হলো না আরিয়ানের। বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে সে তার মতো গাড়ি চালাতে লাগলো।
—-এই, এলোমেলো ভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন? আর এটা কোন রাস্তায় যাচ্ছেন? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি?
—-আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার কথার উত্তর দেবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আপনি সম্বোধন পরিবর্তন করো।
—-মানে কী এসবের?
—-মানে কিছুই না। আমাকে আগে যেভাবে, যা বলে সম্বোধন করতে, এখন ঠিক সেভাবেই করবে।
—-আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন যে এখন আমরা সেদিনের বর্ষণের রাতে নেই। তখন আমি চিৎকার করতে পারিনি বা করিনি কারণ সেসময় আমার চিৎকার শোনার মতো মানুষ ছিলো না। আর আজকে অভাব নেই। আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন, এক চিৎকারে কিন্তু রাস্তার মানুষজন ছুটে আসবে! গণপিটুনি না খেতে চাইলে গাড়ি থামান।
—-গাড়ির গ্লাস সাউন্ড প্রুফ। তুমি চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। আর রিমোট আমার কাছে। তুমি চাইলেও পারবে না গ্লাস নামাতে৷ তাই চিৎকার দেওয়ার আশা ছেড়ে দাও।
—-আপনি কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছেন! বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে এসব!
—-এখনো কোনো বাড়াবাড়ি শুরুই করিনি। ইনফ্যাক্ট, কিছুই করিনি। আমার ঠিক কতোটা ডেস্পারেট হতে পারি সেটা তুমি ভাবতেও পারবে না।
রাগে পুরো শরীর ফেটে পড়ছে মিশরাতের। ববিতা আন্টির বাসায় গিয়ে উনার মেয়ের হাতে চকলেট ধরিয়ে একটু আদর করে এসে রিকশার জন্য কেবল রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলো মিশরাত। তার মধ্যেই আরিয়ান এসে মুহূর্তের মধ্যেই তাকে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলো। এরপর স্পিড বাড়িয়ে অনেকটা পথ সামনে এগিয়ে এখন যে কোথায় যাচ্ছে তা বলা মুশকিল হয়ে পড়ছে।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামালো আরিয়ান। রাস্তার দু’পাশে সবুজ গাছপালা আর বিস্তৃত মাঠ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নিজে গাড়ি থেকে নেমে মিশরাতকে বললো
—-নামো গাড়ি থেকে।
মিশরাত আগের মতো শক্ত হয়ে বসে রইলো।
—-তুমি আমার কোলে উঠতে চাও এটা আগে বলবে না সোনাপাখি?
হাবাগোবা হয়ে মিশরাত তাকিয়ে রইলো আরিয়ানের দিকে। ছেলেটা কী একেবারেই পাগল হয়ে গিয়েছে? আসলেই মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গিয়েছে? কোথায় সেই প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আরিয়ান যে সবসময় নিজেকে সবরকমের আবেগ থেকে দূরে রাখতো? যার মধ্যে মিশরাতকে নিয়ে আবেগের ছিটেফোঁটাও ছিলো না, সেই আরিয়ান আজকে এগুলো কোন ধরনের ব্যবহার করছে?
—-আমার কথা বুঝতে পারলে না মিশু? বলতে চাইলাম যে, গাড়িতে উঠার সময় তো তোমাকে কোলে করেই তুলেছি। কারণ তুমি উঠতে চাইবে না আমি জানতাম। তো তখন কোলে নিয়েছি বলে কী এখনো কোলে উঠার জন্য এরকম কপট জেদ দেখাচ্ছো?
আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মিশরাত গাড়ি থেকে নেমে গেল। এই লোকের সাথে কথা বলে লাভ নেই। কেমন যেন পাগলাটে ব্যবহার করছেন!
—-নেমেছি গাড়ি থেকে। এখন কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন। আমার এক জায়গায় যাওয়ার আছে। দেরী হয়ে যাচ্ছে।
কথাটা শেষ করে আরিয়ানের দিকে তাকালো মিশরাত। আরিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো তার। তার চোখদুটো এমন ছলছল করছে কেন? মিশরাতকে আর কিছু ভাববার সময় দিলো না আরিয়ান। দু’হাতে জাপটে ধরলো তাকে। মিশরাত যেন কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা ভুলে গিয়েছে।
—-পাঁচটা বছর মিশু। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আমি এই সময়টার অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরার প্রহর গুনছিলাম। মনটা শুষ্ক মরুভূমি স্বরূপ হয়ে আছে। পানির জন্য ছটফট করছিলো। বড্ড ছটফট করছিলো। অবশেষে সেই পানি পেয়ে গেলাম। এটাকে পানি না বলে বোধহয় অমৃত বলা উচিত তাই না মিশু?
এক ধাক্কায় আরিয়ানকে নিজে থেকে ছাড়িয়ে নিলো মিশরাত। চোখে তার আগুনসম রাগ।
—-আপনার সাহস হয় কী করে আমাকে ছোঁয়ার? ওহ আচ্ছা, নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে এই কারণে নিয়ে এসেছিলেন বুঝি? আপনার অসৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে?
—-মিশু!
—-একদম চুপ। পেয়েছেন টা কী আপনি? আমি কী আপনার কাছে স্রেফ একটা পুতুল নাকি আসবাবপত্র টাইপ কিছু? আমাকে মানুষ মনে হয় না? জীবনে সবথেকে জঘন্যতম ব্যবহার আমি যদি কারোর থেকে পেয়ে থাকি সেটা আপনি। আর এখন এসেছেন দরদ দেখাতে?
—-একপাক্ষিক বিচার করতে যেও না মিশু।
—-পুরো ঘটনাটা যেহেতু একপাক্ষিক, তাহলে বিচার কী উভয় পাক্ষিক হয়?
—-আমার তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে মিশু।
—-কিন্তু আমার শোনার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই।
—-কেন? এতো সময় কার জন্য রাখো তুমি? ওই ছেলের জন্য? যার সাথে তুমি রাতে পার্টিতে যাও?
—-আপনার মন-মানসিকতা একটুও পরিবর্তন হয়নি আমার প্রতি, তাই না? কী সহজে বলে ফেললেন, আমি পার্টিতে যাই রাত-বিরেতে ছেলের সাথে!
—-আমি নিজের কানে শুনেছি।
—-খুব ভালো করেছেন শুনে। আপনি যা শুনেছেন তা-ই সঠিক ধরে নিন? রাত-বিরেতে পার্টিতে যাওয়া মেয়েগুলো খুব খারাপ হয় তো। তাহলে সেরকম মেয়ের পেছনে কেন এসেছেন আপনি?
আরিয়ানের উত্তরের অপেক্ষা না করে মিশরাত হেঁটে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো।
—-আপনি যদি এখন আমাকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছেন সেখানে না নামিয়ে দেন, তাহলে আমি কিন্তু সোজা হাঁটা শুরু করবো বলে দিচ্ছি!
মিশরাতের কথা শুনে আরিয়ান গাড়িতে বসে গাড়ি ছাড়তে নিলো এরমধ্যেই মিশরাতের ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে স্পষ্ট করে ভেসে উঠেছে “সাদমান কলিং”।
গাড়ির স্টিয়ারিং এ জোরে একটা বাড়ি দিলো আরিয়ান। মিশরাতের ফোন হাতে নিয়ে সরাসরি অফ করে দিলো। মুখ হা করে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে মিশরাত।
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)
[আগামীকাল ধূসর অনুরক্তি গল্পের অন্তিম পর্ব আসতে চলেছে।]