#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৫
“ফাহান হোসেন, ফাহান হোসেন! কোথায় জানি শুনেছি এই নামটা? কোথায় কোথায়…
হাতে এনগেজমেন্ট ‘র কার্ড নিয়ে পায়চারি করছে নির্ঝর। আর বির বির করেই যাচ্ছে। নামটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় একটা শুনেছে সে তবে মনেই করতে পারছে না। পায়চারি শেষে ইজি চেয়ারে বসল সে। চোখ বন্ধ করে চেয়ার দুলাতে দুলাতে ভাবতে লাগল নামের কথা। কিছু কিছু মনে পড়ছে তার। এই নামটা যখন শুনেছিল মেহু তার সাথেই ছিল। কিছুক্ষণ ভাবার পর চেয়ার দুলানো ছেড়ে দিল সে। মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে বলে উঠে,
“ডঃ… ডঃ ফাহান হোসেন! এই তো মনে পড়েছে..
মুখ খুলে শ্বাস নিল সে। কোথায় একটা স্বস্তি অনুভব করল। দাঁড়িয়ে গেল সে। তবে মুহূর্তেই মনে পড়ল এই ডঃ ফাহান হোসেন’ই কে এই ফাহান হোসেন! দু’জনেই কি এক ব্যক্তি কারণ নাম তো সবার’ই এক হতে পারে। নির্ঝর ঠোঁট ভিজিয়ে গায়ের স্যুট টা খুলে বিছানায় রাখল। শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে রুম থেকে বের হলো মেহুর খোঁজে।
ঘরে এসে মেহেরিন কে পেলো না। বসার ঘরে এসে দেখে মিস মারিয়ার কোলে অর্ণব ঘুমাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করেও মেহুর খোঁজ পাওয়া গেল না। ঘুমন্ত অর্ণব কে কোলে করে ঘরে নিয়ে এলো। বিছানায় তাকে শুইয়ে দিতেই বাইরে থেকে মেঘের গর্জন শুনতে পেল। বৃষ্টি হবে বুঝি। নির্ঝর হেঁটে বেলকনির কাছে এলো। আকাশের দিকে তাকাতেই মেহুর মুখ খানা ভেসে উঠলো। হঠাৎ একটা কথা কানের কাজে বার বার বারি খেতে লাগল,
“সবার প্রয়োজন একদিন ফুরিয়ে যায় নির্ঝর..
কথাটা মেহুর ছিল। ডঃ ফাহান হোসেন’র কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা খানা বলেছিল সে। তখন কথাটার অর্থ না বুঝতে পারলেও এখন বেশ বুঝতে পারছে। মেঘের গর্জন শোনা গেল আরো একবার। অর্ণবের কাছে এসে গায়ে চাদর দিয়ে দিল। নির্ঝর ফোন করে মেহুর কাছে কল করতে লাগলো। ঘরেই ফোনের রিং বাজতে লাগলো। এর মানে কি মেহেরিন বাড়িতেই আছে।
দৌড়ে বাগানের কাছে গেল নির্ঝর। পুরো বাগান খুঁজেও তাকে পেলো না সে। হাঁফিয়ে উপরে তাকাতেই দেখল ছাদের গ্রিলের উপর কেউ বসে আছে। নিঃসন্দেহে এই মেহু! নির্ঝর নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
“এই নিশি কন্যা কে খুঁজে যাচ্ছি আর ইনি কি না উপরে বসে আছে!
ছাদের দরজা খোলাই ছিল। রাতের এই অন্ধকারের মাঝেও পুরো ছাদ আলোকিত। নির্ঝর ধীরে ধীরে পা ফেলে মেহেরিন’র কাছে এগিয়ে গেল। মেহেরিন কে বসে থাকতে দেখে ডাক দেবার জন্য প্রস্তুত হলেও মুহূর্তেই কথা ফিরিয়ে নিল সে। কারণ মেহেরিন’র পাশে সেই শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ, তুষার ঘেরা বাড়ি আর সেই আংটির বক্স টা পড়ে আছে। কেন জানি নির্ঝরের গলা ধরে গেল। মন বলল, ডাক না দিতে। থাক না কিছুক্ষণ একা। যদি একা থাকতে ভালো লাগে তবে সেই ভালো লাগার কাছেই ছেড়ে দিক তাকে।
নির্ঝর চোখ নামিয়ে আবারো ঘরের দিকেই হাঁটা ধরল!
এই নিয়ে ১০ বার চিঠি টা পড়ল মেহেরিন। ফাহানের হাতের লেখা দরুন সুন্দর। একজন ডাক্তার হবার পরেও এই সুন্দর আর মার্জিত হাতের লেখা দেখে প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে ছিল মেহেরিন। তবে এতো সুক্ষ্ম বিষয় নিয়ে ভাবার সময় তার ছিল না। ফাহান নিজেই একটা কাগজে কিছু কথা বার্তা লিখে মেহেরিন কে দিয়েছিল। যদিও সেই সব লেখা পড়ে মেহেরিন’র তেমন কোন আগ্রহ দেখা গেল না। তখন ফাহান বলে উঠে,
“একটা মজার জিনিস খেয়াল করেছিলে?
মেহেরিন দ্বিতীয় বারের মতো কাগজে চোখ বুলিয়ে বলল,
“কই না তো?
ফাহান মুচকি হেসে বলেছিল,
“আমার হাতের লেখা। একজন ডাক্তার হবার পরেও আমার হাতের লেখা কিন্তু দরুন সুন্দর! তাই না বলো..
ফাহানের এইসব অকারণ কথাবার্তা শুনে হেসে ছিল মেহেরিন। ফাহান কখনোই কাজের কথা বলে না। সবসময় অকাজের কথা বার্তা বলতো সে। তবুও সেই সব কথা শুনে বার বার হেসেছিল মেহেরিন। ফাহানের কাজ’ই ছিল তাকে হাসানো।
মেহেরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে তাকাল। শুকিয়ে যাওয়া গোলাপটা হাতে নিল সে। মনে পড়ে এই গোলাপ দিয়েই তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল সে। গোলাপ টাকে কি যত্নেই না রেখেছে। ইশ এভাবে যদি তাদের ভালোবাসা কে যত্ন করে রাখতো।
চোখের কোনে অশ্রু জমতে শুরু করেছে। মেহেরিন তা দমিয়ে রেখে তুষার ঘেরা বাড়ি টাকে হাতে নিল। মেহেরিন’র তুষার খুব পছন্দ। একদিন ফাহান এই বাড়ি টা মেহেরিন’র সামনে এনে রেখে বলল,
“এই নাও তোমার স্বপ্নের বাড়ি!
মেহেরিন মুচকি হেসে খেলনা বাড়ি টা কে হাতে নিল। ফাহান তার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্বপ্ন দেখেই এতো খুশি যদি তা সত্যি হয় তখন.. তখন তো তুমি পাগল হয়ে যাবে। ( মেহেরিন’র চুল কানে গুঁজে দিয়ে গালে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে বলল…) এই পাগলি কে নিয়ে তখন আমি সংসার করব কিভাবে!
মেহেরিন রেগে মুখ ভেংচি কাটল। বলে উঠে,
“যেমন করে এই পাগলি কে ভালোবাসো!
ফাহান হেসে তাকে এক হাত দিয়ে জরিয়ে নিল তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই স্মৃতি’র অবশান ঘটল। তৃতীয় বারের মতো মেঘের গর্জনে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। মেহেরিন আংটির বাক্স খানা হাতে নিল। তার হাত কাঁপতে শুরু করল। আংটির বাক্স খুলতেই একপাতা অতীত সামনে এসে হাজির হলো…
গিটার হাতে চেয়ারে বসে এক গাদা লোকের সামনে বসে গান গাইছে মেহেরিন। এই এতো লোকের মাঝে তার চোখ ছিল শুধুই সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে। ড্রিংক হাতে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফাহান মেহেরিন’র দিকে। মেহেরিন তার লজ্জা মাখা মুখে গান গেয়ে চলছে তার জন্য। তাদের প্রিয় “মিলে হো তুম হামকো” যা দিয়ে তাদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল সেই গান দিয়েই সম্পর্কের পরবর্তি ধাপ পেরুতে যাচ্ছিল মেহেরিন। হুম গান শেষেই আংটির বাক্স হাতে ফাহানের সামনে হাঁটু গেড়ে বিয়ের প্রপোজাল রেখেছিল সে। ফাহান মুচকি হেসে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মেহেরিন নিজ হাতে তার অনামিকা আঙ্গুলে সেই আংটি পড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল এই বুঝি নতুন করে আবার পথচলা শুরু হবে তবে কে জেনেছিল এই ধাপ তার সম্পর্কের ইতি টানবে।
চোখ ভিজে উঠছিল অশ্রু ভরে। বৃষ্টির পানির সাথে সাথে সেই অশ্রু গড়িয়ে কখন পড়ল টের পেল না। মেহেরিন আংটি হাতে নিল। আংটির পেছনের দিকে M 🖤 F লেখা। মেহেরিন হাত মুঠে করে নিল। চোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছে। কেন ঝরছে তার জানা নেই।
বৃষ্টির গতি বেড়ে গেল। দমকা হাওয়া বইতে লাগলো। রাতও বেশ হয়েছে। নির্ঝরের মেহেরিন’র চিন্তা হতে লাগল। সে এবার ছাদের দিকে পা বাড়াতেই দেখল মেহেরিন দৌড়ে নামছে। তাকে দেখে অবাক হলো সে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই মেহেরিন তার পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল।
নির্ঝর বেলকনির কাছে এসে দেখল মেহেরিন বাগানের নিচে বসে হাত দিয়ে কিছু খুঁজে চলছে। ভ্রু কুন্চিত হলো তার। মেহেরিন’র হাতের আংটি টা নিচে পড়ে গেছে। বিধায় তাই পাগলের মতো খুঁজে চলছে সে। নির্ঝর একটা ছাতা হাতে বেয়ে হয়ে এলো। মেহেরিন’র একটু কাছে থেমে দেখল নিচে বসে পাগলের মতো কিছু খুঁজে জ্বলছে। চারদিকে আলো তবুও মনে হচ্ছে আঁধারের মাঝেই কিছু খুঁজছে সে। নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা আগাতে যাবে ওমনি পায়ের কাছে সূক্ষ্ম কিছু চোখে পড়ল তার। নির্ঝর নিচ থেকে তা হাতে তুলে দেখল একটা আংটি। মেহেরিন’র দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এই আংটি কি তবে খুঁজছে এই মেয়ে।
মেহেরিন এই বৃষ্টির মাঝে কাকভেজা হয়ে আংটি খুঁজেই চলেছে। বৃষ্টির আর কান্না এক হয়ে গেছে তবুও হাত দিয়ে সেই কান্না মুছছে সে। হুট করেই তার সামনে এক জোড়া পা দেখল সে। মাথা তুলে তাকাতেই দেখল নির্ঝর তার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে আর নিজে ভিজছে। নির্ঝর তার হাত খানা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“উঠে এসো, যা নিজ থেকে হারিয়ে যায় তা খুঁজে কখনো পাওয়া যায় না।
মেহেরিন’র চোখের পানি স্তব্ধ হয়ে গেল। ঢোক গিলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নির্ঝর দ্বিতীয় বারের মতো কঠিন গলায় বলল,
“মেহু, উঠে এসো!
মেহেরিন এবার হাত বাড়াল তার দিকে। নির্ঝর সেই হাত খানা ধরে উঠাল তাকে। তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেহেরিন চোখ নামিয়ে রেখেছে। নির্ঝর তার ভেজা চুল গুলো কানে গুঁজে দিল। মেহেরিন এবার মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। নির্ঝরের মনে হলো এই কোন নতুন এক মেহু কে দেখছে সে। ভালোবাসার কাঙাল সে! কোন এক নিরীহ রমনী যার আছে এক নজরকাড়া চোখ আর স্নিগ্ধ দু খানা ঠোট। ঠোট জোড়া অবশ্য কাঁপছে তার।
নিজ হাত বাড়াতেই মেহেরিন জড়িয়ে ধরল তাকে। এই বুঝি এমন কারো কাঁধে মাথা রাখার জন্য মত্ত ছিল সে।
—-
পোশাক চেঞ্জ করে গুটিগুটি মেরে সোফার কোনো ঘুমিয়ে আছে মেহেরিন। নির্ঝর পা বাড়িয়ে কাছে এলো তার। ঘুমের মাঝে তার নিশি কন্যা কে একটু বেশিই মুখর লাগে বলে মনে হচ্ছে। নির্ঝর খেয়াল করল মেহেরিন শীতে কুঁকড়াছে। কুঁকড়ানোর’ই কথা! অনেকক্ষণ ভিজেছে বৃষ্টিতে। নির্ঝর বিড় বিড় করে বলে উঠলো,
“কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে গেছে তাই এখন ঘুমে মগ্ন আমার নিশি কন্যা। আচ্ছা নিশি কন্যা তোমাকে কেউ বলেছে কাঁদলে তোমাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। সব মেয়েদের কিন্তু লাগে না। অনেক মেয়ের কান্না দেখেছি আমি তবে নিশিকন্যার কান্না এই প্রথম পাগল করল আমায়।
নির্ঝর মেহেরিন’র মাথায় হাত রাখতেই দেখল চুল ভেজা। এই মেয়ে তো দেখছি সর্দি লাগাবে। একটা বালিশ আর চাদর আনল। মাথার তলে বালিশ দিয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিল। গায়ে চাদর টেনে মেহেরিন’র মুখের সামনে এসে বসল। তার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। নির্ঝর স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মেহেরিন’র দিকে। তার উষ্ণ ঠোট খানার প্রেমে পড়ছে যেন বার বার। কি ভেবে নির্ঝর মেহেরিন’র ঠোঁটের খুব কাছে এসে গেল। তার নিঃশ্বাস পড়ছে তার মুখের উপর। চোখের পাতা নড়ছে। নির্ঝর ফিক করে হেসে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে উঠে গেল সেখান থেকে। পেছনে ফিরে একবার দেখল এই নিশি কন্যা কে। সকাল হলেই এই নিশি কন্যা আর নিশি কন্যা থাকবে না। রাতের এই কান্না, এই দুঃখ, এই ক্ষত কিছুই মনে রাখবে না সে। ততোদিন তো রাখবে না যতদিন না এই ফাহান আবারো তার পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তুলে। আবারো নতুন একটা সকালের মাঝে নতুন একজন মেহেরিন কে দেখা যাবে। নির্ঝর জানে এমনটাই হবে। মেহেরিন জানে কিভাবে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়। তবুও একসময় সময়ের কাছে হার মানতে হয় তাকে। সুখ বিলিয়ে দিতে হয় তার কাছে।
নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণবের কাছে আসে। গায়ের চাদর টা ইতিমধ্যে ফেলে দিয়েছে সে। নির্ঝর আবারো তার গায়ে চাদর টেনে তার পাশে বসে পড়ে। অতঃপর সোশ্যাল সাইটে ডঃ ফাহান হোসেন’র সম্পর্কে খোঁজ নেয়। ডঃ ফাহান হোসেন দেশের একজন ইয়ানগেস্ট সাইক্রেটিস। লন্ডন থেকে পড়াশোনা শেষে নিজ দেশে এসেই থাকছেন গত বছর যাবত। নির্ঝর তার সম্পর্কে আরো খোঁজ নিয়ে জানতে পারে মেহেরিন বর্ষা খান’র সাথে তার বিয়ের গুঞ্জন উঠেছিল। তবে তা ভেঙ্গেও গেল। কিন্তু এরপর ফাহান হোসেন’র বিয়ের কোন কথাই বলা নেই।
নির্ঝরের মাথায় কেমন একটা চক্কর দিল। মাথায় চুল টেনে বসে রইল সে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। হঠাৎ করেই কানে অর্ণবের স্বর এলো। ঘুমের ঘোরেই “ড্যাডি” বলে ডাকছে সে। নির্ঝরের অস্থির শরীর মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল। অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল সে। মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়ল নির্ঝর, তবে স্বপ্নের মাঝে উঁকি দিল নিশি কন্যা!
#চলবে….