অনুভূতিতে তুমি 💖পর্ব-৩১

0
2554

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে)
#পর্ব_৩১

নির্ঝর মেহুর কপালে চুমু খেল। অতঃপর তার ঠোঁট জোড়া’র দিকে তাকিয়ে রইল। কেন এমনটা করছে জানা নেই তবুও অগ্রসর হচ্ছে তার ঠোঁটের দিকে। ঠোঁট জোড়া’র অনেক কাছে আসতেই হুট করেই পেছন থেকে অর্ণবের ডাক পেল। দ্রুত মেহু কে ছেড়ে পেছনে চলে এলো। মেহেরিনও দু পা পিছিয়ে গেল। কি হতে যাচ্ছিল এখন এটা ভাবতেই তার শরীর কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে। নির্ঝর গলার টাই ঠিক করে ঠিক করে পিছনে ফিরতেই অর্ণব দাঁত বের করে হেসে বলল,

“ড্যাডি!

অতঃপর উঁকি দিয়ে বলল,
“মাম্মি!

মেহেরিন ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“অর্ণব, সোনা!

অর্ণব দৌড়ে গেল মেহেরিন’র কাছে এলো। মেহেরিন তার চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিল। নির্ঝর নিচ থেকে কার্ড টা হাতে নিয়ে মুচকি হেসে বলল,

“তাহলে যাওয়া যাক!

মেহেরিন হেসে মাথা নাড়ল। অর্ণব নির্ঝরের এক হাত আর মেহেরিন’র এক হাত ধরে নিল। অতঃপর হাঁটতে শুরু করল।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল জন! নির্ঝর প্রথমে বের হয়ে অর্ণব’কে বের করল। অতঃপর মেহেরিন’র হাত ধরে তাকে নামাল। মেহেরিন মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছে। অতঃপর সামনে তাকিয়ে দেখল পুরো বাড়ি আজ আলোর রঙে রঙিন। বাড়ি টা দেখতেও খুব সুন্দর। হয়তো অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া নিয়েছে নাকি তাদের! যদিও এসব ভাবতে ইচ্ছে না করছে তবুও মাথায় এসব কথাই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।মেহেরিন বাড়ি টার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর মেহেরিন’র হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। মেহেরিন তাকিয়ে দেখল অর্ণব নির্ঝরের কোলে। নির্ঝর মেহুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

মেহমানে সবাই উপস্থিত। মেহেরিন বাড়ির এক কোনে দাঁড়িয়ে আশপাশ দেখছে। তার চোখ যাকে খুঁজছে তাকেই দেখার চেষ্টা করছে সে। মনের মাঝে কথাটা বিঁধে গেল। এতো কিছুর পরও তাকে দেখার আশা করাটা বিরাট অন্যায় বলে মনে হচ্ছে। অর্ণব তার হাত ধরে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।‌ নির্ঝর হাতে কোল্ড ড্রিক নিয়ে লক্ষ্য করছে মেহু কে। এই মেয়ে আজও না দুর্বল হয়ে যায়।

ঘাড়ে কারো স্পর্শ শরীর কাঁপিয়ে দিল। মেহেরিন পিছনে ফিরতেই একটা স্টাফ কে দেখল। নির্ঝর দূর থেকে তাদের কথা বলতে দেখে একটু এগিয়ে এলো। মেহেরিন নির্ঝরের কাছে অর্ণব কে রেখে বলল,

“আমি একটু আসছি!

কথার পিঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল নির্ঝর,
“কোথায় যাচ্ছ?

মেহেরিন কে অস্থির লাগছে তার কাছে। তার কথায় হতচকিয়ে গেল সে। সামলে বলে উঠে,
“এত’ই তো একটু কাছে। ঢোক গিলে বলল,

“একজন খুব পুরনো বন্ধু ডেকেছে আমায়!

নির্ঝর কথা বাড়াল না। মেহেরিন অস্থিরতা নিয়েই হেঁটে চলল। নির্ঝরের ভাবনা একটাই ফাহান ডাকে নি তো!

ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল মেহেরিন। আয়নার সামনে সেজে বসে আছে অদিতি। তবে পোশাক পড়ে নি এখনো! অদিতি মেহেরিন কে দেখতে পেয়ে ঘরের বাকি স্টাফ কে বের করে দিল। হাত টেনে ঘরে ঢোকাল মেহেরিন কে। জড়িয়ে ধরল তাকে। মেহেরিন’র গায়ে বোধহয় কাঁটা বেঁধে গেল। এটাই চেয়েছিল সে। হেসে বলল,

“আমি ভাবতেও পারি নি তুমি আসবে।

মেহেরিন শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল,
“ইনভাইট যখন করেছ, তখন তো আসতেই হতো।

অদিতি’র মুখ মলিন হলো। বলে উঠল,
“বিশ্বাস করো আমি চাইনি তুমি আসো!

কপালে ভাঁজ পড়ল মেহেরিন’র। অদিতি হেসে উঠল,
“আসলে তুমি আসবে, ওকে দেখবে আমার সাথে। খারাপ লাগবে না বলো তোমার। আমি মানা করেছিলাম ফাহান কে। বলেছিলাম তো তুমি আসলে কষ্ট পাবে। কিন্তু আমার কোন কথাই শুনলো না সে।

মেহেরিন কিঞ্চিত হেসে বলল,
*এজন্য ডেকেছ আমায়!

“না, দেখো আমি এখনো তৈরি হয় নি। আর একটু পরেই আমার এনগেজমেন্ট।

“তো!

মেহেরিন’র হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে এলো। মেহেরিন তাকিয়ে দেখল পুরো বিছানা জুড়ে জামা ছিটিয়ে আছে। ভ্রু কুন্চিত করে তাকাল অদিতি’র দিকে। অদিতি হেসে বলল,

“অবাক হয়েছ না। আর বলো না, যখন এনগেজমেন্ট’র শপিং করতে গিয়েছিলাম তখন ফাহান এত্ত এত্ত ড্রেস কিনেছে আমার জন্য। বলল এসব ড্রেসে’ই নাকি বানাবে আমাকে। এখন তুমি’ই বলো না এতো ড্রেস কিনার কি দরকার ছিল।

বলেই মেহেরিন’র দিকে তাকাল। মেহেরিন বিনা বাক্যে সব কিছু শুনছে। অদিতি বলে উঠল,

“কিন্তু সমস্যা এখানে না, সমস্যা হচ্ছে আমার কাজিন দের নিয়ে। আসলে এখানে যা দেখছ তেমনি রঙ মিলিয়ে ফাহানের কাছেও পোশাক গেছে। এখন ওদের কথা হচ্ছে আমরা দু’জনেই যেন কোন একটা পছন্দ করে পোশাক পড়ে যাই। ওরা দেখবে আমাদের পছন্দ এক কিনা। এখন বলো যদি পছন্দ ঠিক না হয় তখন কি বিচ্ছিরি কান্ড ঘটবে। তাই তুমি যদি আমাকে একটু হেল্প করতে…

মেহেরিন বিছানা থেকে লাল রঙের গাউন হাতে তুলে নিল। বলে উঠল,

“এই নাও!

“তুমি সিউর!

“ইচ্ছে হলে পড়ো , নাহলে পড়ো না।

“আহ রেগে যাচ্ছ কেন, আচ্ছা আমি পড়ে আসছি। তুমি এখানেই থাকো হুম। ওরা তো চলে গেছে আমাকে একটু তৈরি হতে সাহায্য করো, করবে তো।

মেহেরিন হেসে মাথা নাড়ল। অদিতি পোশাক নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল। মেহেরিন জানে অদিতি এখানে শুধু’ই তাকে জ্বালানোর জন্য ডেকেছে আর কিছুই না। তার পুরোনো ক্ষততে আরেকটু আঘাত করতে চায় সে। তবে হয়তো অদিতি জানে না মেহেরিন কষ্ট সহ্য করতে শিখে গেছে।

মেহেরিন ঘুরে ঘরটা দেখল। দেওয়াল জুড়ে তাদের দুজনের ছবি। একটা ছবিতে তারা খুবই ঘনিষ্ট ভাবে আছে। মেহেরিন’র সে ছবিই হাতে তুলে নিল। দরজা খুলার আওয়াজ পেয়ে সাথে সাথে ছবি টা রেখে দিল। পেছন থেকে অদিতি বলে উঠল,

“মেহেরিন একটু হেল্প করো না। জামার পেছনের পিন টা লাগিয়ে দাও!

মেহেরিন এগিয়ে এসে পিনটা লাগিয়ে দিল। অদিতি আবারো হাত ধরে তাকে নিয়ে ডেসিন টেবিলের কাছে চলে গেল। একটা চেইন হাতে নিয়ে বলল,

“একটু হেল্প করো না।

মেহেরিন হাতে নিয়ে এটা তার গলায় পড়িয়ে দিতে লাগল। অদিতি হেসে বলল,

“ও নিজে পছন্দ করেছে এটা। আচ্ছা মেহেরিন আমাকে সুন্দর লাগছে তো।

মেহেরিন আয়নায় তাকাল। অদিতি কে দেখল! দেখতে খারাপ না মেয়েটা। খুব সুন্দরী সে। বেশি সুন্দরী হওয়াতে মুখে কেমন একটা বিদেশী বিদেশী ভাব চলে এসেছে। সে মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,

“হুম লাগছে!

“লাগতেই হবে, আজকের পার্টিতে সবচেয়ে সুন্দর আমাকেই লাগতে হবে। ফাহানের নজর যাতে শুধু আমার দিকেই থাকে..

বলতে বলতে কানের দুল পড়ল সে। মেহেরিন চেইন লাগিয়ে বলল,

“শেষ!

অতঃপর চলে যেতে নিতেই অদিতি খপ করে তার হাত ধরল। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো। অদিতি দাঁড়িয়ে বলল,
“ফাহানের পছন্দ হবে তো আমায়!

“হুম!

“জানো আমরা এই বাড়িটা কয়েকদিন আগেই কিনেছি, সুন্দর না এটা। ভেবেছি বিয়ের পর দুজন একসাথে’ই থাকবো এই বাড়িতে!

মেহেরিন এবারো বলে উঠল,

“হুম!

“আচ্ছা আমি শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছ, তোমার বর এসেছে সাথে।

“হ্যাঁ!

“পরিচয় করিয়ে দেবে না, জানো আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার বিয়েতে। সব ভুলে নতুন করে শুরু করেছে তুমি তাহলে!

“আমি আসছি!

দরজার কাছে যেতেই কয়েকজন এসে দাঁড়াল। মেহেরিন তাদের ভেদ করে বাইরে চলে এলো। এসেই মুখ খুলে শ্বাস নিতে লাগল। এতোক্ষণ দম বন্ধ হয়েছিল তার!

সব আলো মুহূর্তেই নিভে গেল। সিঁড়ির কাছে আলো জ্বলে উঠলো। মেহেরিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেখানে। আর কেউ না ফাহান দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাকে দেখেই চোয়াল শক্ত করে নিল সে। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল দেওয়াল কে। মেহেরিন’র হার্টবিট দ্রুত বাড়ছে। এতোদিন পর তাকে দেখতে পেয়ে অনেকটা খুশি সে। তাকে একজন তৃষ্ণার্তের মতো লাগছিল। যে কি না অনেকদিন পর পানির স্বাদ পেয়েছে। লাল রঙের কোট পড়েছে সে। তার পাশে এসে অদিতি দাঁড়াল লাল রঙের গাউন পড়ে। দুজনের এরঙের পোশাক দেখে হইচই লেগে গেল। মেহেরিন চোখের পলক ফেলে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করেই কানের কাছে”মেহু” ডাকটা শুনে চমকে উঠলো সে। নির্ঝর তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

“ঠিক আছো!

মেহেরিন মাথা নেড়ে সায় দিল। নির্ঝর তার হাত ধরে বলল,

“তাহলে এখানে কি করছ? ওখানে চলো!
বলেই সেখানে নিয়ে এলো। শক্ত করে ধরে রাখল হাতখানা। ফাহানের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে অদিতি। মেহেরিন নিজেকে শক্ত করে তাকিয়ে রইল সেখানে। নিচে নেমে মেহেরিন’র মুখটাই সবার প্রথমে দেখল ফাহান। তাকে দেখে এক দৃষ্টিতে সেখানেই তাকিয়ে রইল সে। চোখ গেল কেউ তার হাত ধরে আছে। তার মুখ দেখার চেষ্টা করল ওমনি অর্ণব এসে ডাকল নির্ঝর কে। নির্ঝর নিচু হয়ে অর্ণবের সাথে কথা বলছে তবুও হাত ছাড়ছে না মেহেরিন’র।

ফাহানের পা নড়ছে না দেখে অদিতি নিজেই টেনে স্টেজের কাছে নিয়ে গেল তাকে। গান শুরু হলো এর মাঝে। একেক জন এসে ফাহান আর অদিতি কে কনগ্রেস করছে। গান বাজছে। সব কাপল একসাথে এসে জড়ো হলো সামনে। মেহেরিন’র চোখ এবার সরল ফাহানের থেকে। সে নির্ঝরের হাত শক্ত করে ধরল। নির্ঝর আন্দাজ করতে পেয়ে মেহেরিন’র দিকে তাকাল। মেহেরিন চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো,

“নির্ঝর নাচবেন আমার সাথে!

নির্ঝর ধাক্কা টা নিতে পারল না। পরক্ষনেই উওরের আশা না করে নির্ঝর কে টেনে সামনে নিয়ে গেল। ডিজের কাছে এসে গান বন্ধ করতে বলে মাইক নিজের হাতে নিল। গান বন্ধ হওয়াতে সবাই থেমে গেল। মেহেরিন গান শুরু করল, এসে হাত খানা ধরল নির্ঝরের। ফাহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মেহেরিন’র দিকে। কি করতে চলেছে সে। বক্সে গান বেজে উঠল,

মিলে হো তুম হামকো
বডে নাসিবো সে
চুরায়া হ্যায় ম্যানে
কিসমত কি লেকেরোন সে) x2

মিলে হো তুম হামকো
বডে নাসিবো সে
চুরায়া হ্যায় ম্যানে
কিসমত কি লেকেরোন সে

তেরে মহব্বত সে সাসেই মিলি হৈ
সাদা রেহনা দিল মেং কারিব হোকে….

নির্ঝর হাত ধরে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবেই নাচল মেহেরিন। নাচের মাঝে একবারও চোখ ফেরায় নি ফাহানের দিকে। পুরোটা সময় তাকিয়ে ছিল নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর ও যেন ডুবে গেল সেই চাহনির মাঝে। একে একে আবারো সব কাপলরা এসে উপস্থিত হলো ফ্লোরে।‌ নাচে তাল মিলাতে লাগলো তারা। হুট করেই অর্ণবের ডাক শুনতে পেল। মেহেরিন হেসে অর্ণবের দিকে তাকাল। অর্ণব হাত তালি দিয়ে লাফাচ্ছে। দু’জনেই খানিকটা সরে গিয়ে দাঁড়াল।‌ হাতে হাত ধরে গোল হয়ে গেল। অর্ণব এসে দাঁড়াল তার মাঝে। মেহেরিন’র ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। নকল হাসি ছিল না তা। ফাহান বেশ বুঝতে পারল মেহেরিন ভালো আছে। অর্ণবের কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে তার হাত ধরে লাফাতে লাগলো। সামনে দাঁড়িয়ে নির্ঝর মা ছেলের কাহিনী দেখতে লাগল। তার ঠোঁটের কোনেও হাসি ছিল। মেহেরিন’র চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আবারো অর্ণবের দিকে তাকাল।

নাচ শেষ হলো। অর্ণব হাঁফিয়ে নির্ঝরের কোলে বসে পড়ল। মেহেরিন হাতে ক্লোড ড্রিক নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। নির্ঝর মুগ্ধ চোখে দেখছে সেই হাসি। হঠাৎ করেই অদিতির আবির্ভাব ঘটল। অর্ণবের থিতুনি তে হাত রেখে বলল,

“তোমার ছেলে এ!

অর্ণব মেহেরিনকে আকঁড়ে ধরে বলল,
“মাম্মি!

অদিতি হেসে নির্ঝরের দিকে তাকাল। মেহেরিন কে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তোমার হাসবেন্ড!

মেহেরিন বলার জন্য মুখ খুলতেই পাশে ফাহান কে দেখল। সে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে কিঞ্চিত হেসে বলল,
“আমার হাসবেন্ড মিঃ নির্ঝর চৌধুরী মেঘ আর আমার ছেলে অর্ণব!

নির্ঝর অদিতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। অদিতি হেসে মাথা নেড়ে বলল,

“আহ, হ্যাপি ফ্যামিলি! এমন ফ্যামিলি আমাদের কবে হবে ফাহান।

ফাহান হেসে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল অদিতি কে। অতঃপর মেহেরিন’র দিকে তাকিয়ে বলল,

“খুব জলদি!

মেহেরিন ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠল। অদিতি ফাহানের হাত ধরে বিদায় নিল। গান আবারো বেজে উঠলো। এবার স্টেজে ফাহান আর অদিতি। অর্ণব নির্ঝরের কোল থেকে নামল। নির্ঝরের হাত ধরে এগিয়ে গেল নাচ দেখার জন্য। নির্ঝরের দৃষ্টি ছিল মেহেরিন’র উপর। মেহেরিন সেই স্থান দ্রুত’ই প্রস্থান করল!

খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে বাড়ির বেলকনির কাছে দাঁড়াল এসে দাঁড়াল। বাড়ির দোতলায় পেছনের দিকে ভালোই একটা বেলকনির ব্যবস্থা আছে। হাতের ফোনটা কেঁপে উঠলো মুহুর্তে। মেহেরিন তাকিয়ে দেখল নির্ঝরের মেসেজ,

“কোথায় তুমি? অর্ণব খুঁজছে তোমায়?

মেহেরিন টাইপিং করল,

“এখানেই আছি, আসছি খানিকক্ষণ পর!

মেসেজ সেনড করার পর’ই কেউ নরম স্বরে বলে উঠল,

“হাসবেন্ড কে মেসেজ করছো বুঝি!

মেহেরিন’র বুক টা ধুক করে কেঁপে উঠল। তার শরীর কেমন অদ্ভুত রকমের অস্থিরতা দেখা দিল। হতচকিয়ে উঠলো সে। ফাহানের গলা চিনতে কখনো ভুল করবে না সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে এর মাঝেই। শুকনো ঢোক গিলে পিছনে তাকাল সে। প্যান্টের প্যাকেটে হাত রেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফাহান। মেহেরিন বিস্ফোরিত চোখে দেখতে লাগল তাকে। ফাহান ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে বলে উঠল,

“দেখে এলাম, তোমাকেই খুঁজছে সে!

মেহেরিন কিছু বলতে গিয়েও বলল না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিল সে। ফাহান তাকে আটকাবে এটা ধারণা ছিল না তার। একটানে নিজের খুব কাছে টেনে নিয়ে এলো তাকে। মেহেরিন’র পুরো শরীর কাঁপছে এবার। আর কারো কাছে না ফাহানের কাছে খুব দুর্বল সে।ফাহান হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে গেলেই মেহেরিন ফাহানের হাত ছাড়িয়ে নিল। বলে উঠল,

“আমার স্বামী খুঁজছে আমাকে!

ফাহান শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ তাই তো, যাও!

ফাহানের কথা শেষ হতে না হতেই মেহেরিন সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। ফাহান এটা থেকে অবাক হলো। মেহেরিন পা বাড়িয়ে ওপাশে যেতে নিবে তার আগেই ফাহান তার হাত ধরে টেনে এপাশে নিয়ে এলো। মেহেরিন হতবাক হয়ে গেল। তবুও কি হচ্ছে তা ভেবে তা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল।

“ফাহান হাত ছাড়, আমি কিন্তু চিৎকার করব।

“করো গানের আওয়াজে তোমার চিৎকার কেউ শুনবে না।

“ফাহান, ছাড়ো বলছি!

ফাহানের কানে কোন কথাই ঢুকল না। ঘরের ভেতর তাকে নিয়ে চলে গেল সে। হাত ছেড়ে দিল তার। মেহেরিন রেগে খুব জোরে চড় মার/ল ফাহানের গালে। ফাহান চোয়াল শক্ত করে তাকাল মেহেরিন’র দিকে। মেহেরিন দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে ফাহানের দিকে। বলে উঠল,

“সমস্যা কি তোমার, এমন করছ কেন?

ফাহান নিজের ক্রোধ রোধ করল। শান্ত গলায় বলে উঠল,
“কেমন আছো?

মেহেরিন বেশ বিরক্ত ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,
“একথা জিজ্ঞেস করতে এভাবে টেনে আনার কি দরকার ছিল!

“খুব ভালোবাসে নাহ, ও তোমাকে!

“ফাহান চুপ কর!

“আমি দেখেছি কিভাবে তোমার খেয়াল রাখে, খুব সুখে আছো তাহলে।

“ফাহান তোমার থেকে বিন্দু মাত্র কথা শোনার ইচ্ছা নেই আমার।

“সেদিন’ই কেন বিয়ে টা করলে তুমি মেহেরিন! অন্যদিনও তো করতে পারতে তাই না!

মেহেরিন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ফাহান অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে…

ফাহান কে খুঁজতে খুঁজতে ঘরের কাছে চলে এলো অদিতি। ঘরের ভেতর থাকা মেহেরিন আর ফাহান কে আড়াল করল না তার চোখ। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলে সেখানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,

“এই লায়লা আর মাজনু এখানে একসাথে কি করছে? পুরনো প্রেম জেগে তুলছে না তো। এজন্য! শুধু এজন্য’ই , বার বার বারণ করেছিলাম ডেকো না মেহেরিন কে ডেকো না। কিন্তু তা না। তবুও ডেকে এনে তুলল। কি এই প্রেম লীলা করার জন্য। আমার এতো দিনের পরিশ্রমে জল ঢেলে দিবে এভাবে।

অদিতি রেগে চলে এলো সেখান থেকে। রাগে ফেটে যাচ্ছে তার মাথা। হাতে কামড়ে ধরে রাগ নিবারণ করল। শান্ত গলায় বলে উঠে,

“মেহেরিন, মেহেরিন আর মেহেরিন। কি যাদু করেছে এই মেহেরিন। সবসময় সুযোগে ছিলাম কবে এদের ভালোবাসার মাঝে এক ফোঁটা অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে, একটু ফাটল ধরে। তাহলে এটা ভেঙে ফেলা সম্ভব হতো আমার পক্ষে। আর সেদিন তাই হয়েছিল। ফাহান রেগে গাড়ি চালিয়ে আসছিল রাস্তা দিয়ে। এক্সিডেন্ট করল। তার কিছু না হলেও তার প্রতি পক্ষ ভ্যান চালক খুব খারাপ ভাবেই আহত ছিল। তাকে দেখেই বুঝলাম মারাত্মক ঝগড়া করেছে মেহেরিন’র সাথে। ভেবেছিলাম ভাগ্য হয়ত আবারো সুযোগ দিচ্ছে আমায়,দিচ্ছে আমার ভালোবাসা কে। ছাড়লাম না তা। লুটে নিলাম। অবিশ্বাসের বীজ তিব্র ভাবে বুনে দিলাম দুজনের মাঝে তা কি আজকের এই দিনটার জন্য। ভাগ্যিস মেহেরিন রেগে বিয়ের মত একটা মস্ত বড় সিদ্ধান্ত নিল নাহলে আমি তো ভেবেছিলাম কিছুই হবে না হয়তো। বার বার ফাহান কে আটকানো সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। তবে কে জানতো শেষমেষ এরা নিজেরাই সরে যাবে। কিন্তু আজ কি করছে এসব? কেন করছে! আহ! সহ্য হচ্ছে না আমার। রাগে ফেটে যাচ্ছে মাথা টা।

অদিতি রেগে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে নির্ঝরের দিকে তাকাল। বলে উঠল,

“এই হাসবেন্ড নির্ঝর, কোন চিন্তা নেই কি তার। কোথায় তার বউ, কার সাথে কি করছে খোঁজ খবর নেবার কি প্রয়োজন বোধ করছে না।

অদিতি এবার শান্ত হলো। নিচে নেমে এলো নির্ঝরের কাছে। হাসি মুখে বলে উঠল,

“মিঃ নির্ঝর যে, কাউকে খুঁজছেন?

“হ্যাঁ মেহেরিন কে খুঁজছি আমি..

“ওহ, মেহেরিন। তাকে তো উপরে যেতে দেখলাম।

“ওহ আচ্ছা!

“আপনি এক কাজ করুন, অর্ণব কে আমার কাছে দিয়ে উপরে যান।

নির্ঝর প্রথমে না বলবে ভেবে কি মনে করে বলল,
“আচ্ছা!

অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আন্টি কে জ্বালাবে না, এখানে থাকো। আমি মাম্মি কে নিয়ে আসছি!

অতঃপর সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল নিজের!

মেহেরিন হেসে বলে উঠল,
“নতুন ভাবে শুরু করলাম আর কি!

ফাহান মাথা নিচু করে ফেলল। সে এখন শান্ত,‌নিবিড়। মেহেরিন’র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি একজন সাইক্রেটিস মেহেরিন, মানুষ কে বুঝতে পারি খুব। তবে কেন আজ তোমায় বুঝতে পারি না।

মেহেরিন হেসে উওর দিল,
“কারণ সেই মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছো তুমি!

ফাহান নিশ্চুপ দেওয়ালের মতো হয়ে গেল।অনেকটা আবেগ নিয়েই বলে উঠল,

“অনেক খেয়াল রাখে না অর্ণবের!

মেহেরিন’র কপালে ভাঁজ পড়ল। ফাহান হেসে বলল,
“না, আসলে আমি তো পারি নি। বোধহয় সে পেড়েছে!

বলছি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার এই এমন কথাবার্তা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল‌ মেহেরিন’র মন কে। তার চোখের অশ্রু যেন বাঁধ মানবে না বলেই দিয়েছে। ফাহান মেহেরিন’র একটু কাছে এসেই দাঁড়াল। মেহেরিন নড়ল না। মেহেরিন হাত খানা ধরে বলল,

“সরি!

মেহেরিন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফাহানের দিকে। উষ্ণ গলায় বলে উঠল,

“হয়তো কথাটা আগে বললে আজ এতো গুলো জীবন নষ্ট হতো না ফাহান!

ফাহানের চোখের কোনে অশ্রু জমতে শুরু করল। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেহেরিন’র দিকে।মেহেরিন’র চোখ বেয়ে অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ল। ফাহান হাত দিয়ে তা মুছে দিয়ে হুট করেই মেহেরিন কে তার বুকে টেনে ধরল। ফাহানের গরম নিঃশ্বাস মেহেরিন’র ঘাড়ে পড়তে লাগলো।

নির্ঝর বাকরুদ্ধ হয়ে সেখানেই তাকিয়ে রইল। রাগ হচ্ছে খুব! মেহেরিন’র চোখের জল মুছে দেওয়ার আর জরিয়ে ধরার অধিকার তো শুধু তার। ইচ্ছে করছে এখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু তা না করে দাঁড়িয়ে রইল। দেখার অপেক্ষা মেহেরিন কি জড়িয়ে ধরবে তাকে। মেহেরিন হাত উঠাল জরিয়ে ধরতে। নির্ঝর তা দেখে দাঁতে দাঁত চেপে চলে এলো সেখান থেকে। কিন্তু মেহেরিন জরিয়ে ধরল না ‌ হাত টা আবারো নামিয়ে নিল। তবে নির্ঝরের চোখে তা পড়ল না। মেহেরিন নিজেকে সামলে নিল। শীতল গলায় বলে উঠল,
“ফাহান ছাড়ো আমায়!

ফাহান মেহেরিন’র কানের কাছে বলল,

“কি বলো তো মেহেরিন, পৃথিবীতে আমরা এমন একজন কে ভালোবেসে ফেলি যাকে আমরা হয়তো পাবো না। তবুও ভালোবাসি। মনে করি এতো ভালোবাসা কখনো কেউ দিবে না আমায় ‌ কিন্তু এটা কখনো ভেবে দেখি না, যে মানুষটা নিয়ে আমার সারাজীবন থাকতে হবে সে হয়তো তার চেয়েও বেশি ভালোবাসা দিবে আমায়! নাহলে আমার ভাগ্য তার সাথে জুড়ল কেন?

ফাহানের কথায় মেহেরিন অবাক হলো। ফাহান তার অশ্রু গড়িয়ে পড়া থেকে রোধ করল। নির্ঝর সিঁড়ির কাছে গিয়েও আবারো ফেরত এলো। মেহেরিন’কে ফাহানের কাছে একা রেখে যাবে না সে। এদিকে ফাহান মেহেরিন কে ছেড়ে দিল। মেহেরিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ফাহান মেহেরিন’র দুই বাহুতে হাত রেখে বলল,

“আমি নির্ঝরের কথা বলছি তোমায়, আমার মনে হচ্ছে দেখো অনেক ভালোবাসবেও তোমায়। সে সব কিছু দেবে‌ যা আমি দিতে অস্বীকার করেছিলাম। মেহেরিন! তোমার জীবনে আমি এক বসন্তের দিনের মতো। আর যেই দিন চলে যায় তা কখনো কিন্তু ফিরে আসে না। নতুন নতুন দিনের আগমণ টা ভিন্ন হয়। সেই ভিন্নতা তোমাকে নির্ঝর দিবে। নির্ঝরের চোখে তোমারে জন্য আমি যে ভালোবাসা দেখেছি তা আসলেই অন্যরকম। এক অন্যরকম অনুভুতি তা! তুমি মিলিয়ে নিও আমার কথা!

মেহেরিন চোখের পাতা ফেলে তাকিয়ে আছে ফাহানের দিকে। ফাহান এক গাল মেহেরিন’র হাতে রেখে বলল,

“ক্ষমা করে দিও আমি কথা রাখতে পারে নি।

মুহূর্তেই গড়িয়ে জল পড়লো আবারো। ফাহান হাত বাড়িয়ে তা মুছে দিতে চেয়েও হাত সরিয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
“না! এই অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি!

হুট করেই দরজা খোলার শব্দ এলো। দু’জনেই তাকাল দরজার দিকে। সামনে নির্ঝর কে দেখে অবাক দুজন। ফাহান এক পা পিছিয়ে গেল। নির্ঝর রেগে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল। ফাহান কে উপেক্ষা করে মেহেরিন কে বলল,

“কখন থেকে খুঁজছি তোমায়, কোথায় ছিলে? জানো অর্ণব.. বলেই থেমে গেল। মেহেরিন’র চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“কাঁদছো কেন তুমি!

মেহেরিন হতচকিয়ে গেল। বলে উঠল,
“না কাঁদছি না।

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে ফাহানের দিকে তাকাল। ফাহান হেসে বলল,

“মেহেরিন! তোমার জন্য অনেক ভাবে কিন্তু নির্ঝর!

নির্ঝর সেই কথা উপেক্ষা করল। মেহেরিন’র পিছনে দাঁড়িয়ে তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

“চলো!

মেহেরিন শেষবারের মতো তাকাল ফাহানের দিকে। ফাহান এক মিষ্টি হাসি দিয়ে বিদায় দিল! অতঃপর….

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here