অনুভূতিতে তুমি 💖পর্ব-৩২

0
2850

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে)
#পর্ব_৩২

নির্ঝর পেছনে দাঁড়িয়ে মেহেরিন’র ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
“চলো!

মেহেরিন ফাহানের দিকে তাকাল। ফাহান তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। মেহেরিন চোখ সরিয়ে নিয়ে বের হলো। নির্ঝর মেহেরিন’র হাত শক্ত করে ধরল। মেহেরিন নিজেকে একটা ঘোরের মতো লাগতে লাগলো। কি হলো এতোক্ষণ তার সাথে এটা নিয়ে কোন হুশ নেই তার।

অর্ণব দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ করেই মেঝেতে পড়তে নিলো কেউ তার হাত ধরে ফেলল। অর্ণব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। সামনের মানুষ টাকে অনেক ভয় পায় সে। কারণ এটা আর কেউ না ফাহান ছিল। ফাহান কিঞ্চিত হেসে অর্ণবের মাথায় হাত বোলাল। অর্ণব ভয়ে গুটিয়ে দাঁড়াল। ফাহান অর্ণবের গালে হাত রেখে বলল,

“যদি আমি তোমাকে আপন করতে পারতাম তাহলে হয়তো আজ সবকিছু্ই অন্যরকম হতো। আফসোস আমি এটা পারলাম না!

অর্ণব ফাহানের কথা কিছুই বুঝল না। এর মাঝেই নির্ঝরকে দেখতে পেয়ে উচ্চস্বরে “ড্যাডি” বলে ডাক দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। ফাহান মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল। শব্দ করে দম ফেলে প্যান্টের প্যাকেটে হাত দিয়ে সামনে পা বাড়াল। যা হারিয়েছে হয়তো তা আর কখনো ফেরত পাবে না তবে এই আফসোস তার যাবে না। মেহেরিন কে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ছিল সে। সেই ভালোবাসা হয়তো থেকে যাবে, থেকে যাবে ভালোবাসার কিছু স্মৃতি তবে এই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না। ঠিক’ই বলে সবাই সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। এখানে মেহেরিন আর আমার মাঝে কোন ঝামেলা না থাকা সত্ত্বেও নিজের দোষেই আজ তাকে হারিয়ে ফেললাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনের অতীত ছেড়ে আসার পরিকল্পনা তার। তবে অতীতের পিছুটান স্বেচ্ছায় নিতে চায় সে। ইশ আর একবার যদি পেতো সেই সময়টা। ভেঙে দিতো মেহেরিন’র অভিমান। কিন্তু শত আফসোস করেও এখন আর তা ফিরে পাবে না সে।

অদিতি বাহু টেনে নিয়ে গেলো স্টেজের সামনে। আংটিবদল হবে এইবার! ফাহান সেখান থেকে দাঁড়িয়ে চোখ জোড়া মেহেরিন’র দিকে। মেহেরিন’র দেখতে পেয়েও ক্ষনিকের জন্য ব্যাথা লাগল তার বুকের মাঝে। এই ব্যাথা খুব তীব্র। ফাহান তার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। চোখ সরিয়ে নিল দ্রুত। আংটি পড়াল অদিতির অনামিকা আঙ্গুলে। মেহেরিন নিরব দর্শকের মতো চেয়ে রইল শুধু। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করা কষ্টকর হচ্ছে ফাহানের জন্য। তাই অপেক্ষা না করে অদিতি তার অনামিকা আঙ্গুলে আংটি পড়িয়ে দেবার সাথে সাথে চুম্বন খেলো তার কপালে। আরো একবার মেহেরিন’কে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে তার না। অদিতি’র খুশি যেন ধরে না। যেই ভালোবাসার জন্য এতো কিছু সেই ভালোবাসা কি তবে পেয়ে যাচ্ছে সে। তবে এর সত্যতা কতোটুকু? সারাজীবন মনে মেহেরিন কে রেখে অদিতি কে কতোটুকু ভালোবাসা দিতে পারবে সে।

চারদিক হইচই পড়ে গেল। অদিতি কে সবার সামনে এভাবে কিস করবে উপস্থিত কেউ ভাবতে পারে নি। নির্ঝর তৎক্ষণাৎ অর্ণবের চোখে হাত দিয়ে তাকে ঘুরিয়ে নিল। অর্ণব হাত সরিয়ে নির্ঝরের মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। পরক্ষনেই মনে পড়ল মেহেরিন’র কথা। নির্ঝর তার দিকে তাকাতেই দেখল সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেখানে। দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে সেখানে। তার মন যে কতোটা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে এটা বোঝানো সম্ভব না। একটা মৃত দেহ মরার আগে যেমনটা ছটফট করছে তেমনিই হচ্ছে তার মনের মাঝে। নির্ঝর মুহুর্তে তার হাত টেনে বলল,

“আমাদের যেতে হবে, চলো!

অতঃপর তাকে নিয়ে চলতে লাগল। একহাতে অর্ণব তো অপর হাতে মেহেরিন। পিছন ফিরে চাওয়ার দুঃসাহস করল না কেউই! ফাহান মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল মেহেরিন চলে যাচ্ছে। মনটা শান্ত হলো তার। হুট করেই তার বুকে কেউ জায়গা করে নিল। তাকিয়ে দেখে মেহেরিন! ভ্রু কুঁচকে গেল তার। সে তার গালের কোনে হাত রাখল। চারপাশে করতালির শব্দে সেই ভ্রম ভেঙে গেল। এটা অদিতি ছাড়া আর কেউ না। ফাহান কিঞ্চিত হেসে জড়িয়ে ধরল তাকে।

—-

গাড়িতে মেহেরিন’র কোলে ঘুমিয়ে পড়ল অর্ণব! অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। সামনের সিটে নির্ঝর বসে আয়নার দিকে শুধু চেয়ে রইল মেহেরিন’র হরিণী নজরকাড়া চোখ জোড়ার দিকে। এই চোখে অশ্রু এলে ভালো লাগে না তার।

জন গাড়ি ব্রেক করল খান বাড়ির সামনে। মেহেরিন নিজেই অর্ণব কে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেল। নির্ঝর বের হয়ে নিঃশব্দে তার পিছন পিছন আসতে লাগল। অর্ণবকে ঘরে এনে শুইয়ে দিল বিছানায়। চুমু খেল তার কপালে। নির্ঝরের দিকে ফিরে শীতল গলায় বলল,

“আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন নির্ঝর, আমার অফিসের কিছু কাজ আছে। দেরি হবে!

নির্ঝর ঘোরের মাঝে মেহেরিন’র কথা শুনল। তার ঠোঁটের কোনে হাসিও দেখল সে। তবে এই হাসি প্রাণবন্ত ছিল না। তবে কি শুধুই মেহেরিন কে দেখানোর জন্য।

আকাশে বাজ পড়ল, মুহূর্তে বৃষ্টি নামলো। কখন থেকে বিছানায় বসে আছে নির্ঝর। অপেক্ষা মেহু’র! সে কি আসবে না! বসে থাকবে একা একা! একটু শীত শীত পাচ্ছে। অর্ণব গুটি শুটি মেরে বসল। নির্ঝর তার গায়ে চাদর টেনে কপালে চুমু খেল। ঘড়ির কাঁটায় এখন ১ টা বাজে। রাত তো কম হলো না। মেহেরিন কে করছে এখন?

ঘর থেকে বের হলো নির্ঝর। হাঁটতে হাঁটতে গেল তার স্টাডি রুমে। টেবিলের উপর বন্ধ ল্যাপটব পড়ে আছে, আর তার পাশে পড়ে আছে বন্ধ ফাইল। তবে মেহেরিন নেই এখানে। তাহলে কোথায় ছাদে। সর্বনাশ করেছে! এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে বৈ কি! নির্ঝর দ্রুত ছাদের দিতে রওনা হতেই থেমে গেল তার ঘরের সামনে। ঘরের দরজা হুট করে খুলে রাখা কেন? তবে কি মেহেরিন এখানে! চোরের মতো উঁকি দিল নিজের ঘরেই! হায় একি হাল আমার ঘরের। আলমারির সমস্ত কাপড় পড়ে আছে মেঝেতে। মেহেরিন হাতে ওয়াইনের বোতল নিয়ে খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। মেহেরিন’র পড়নে এখনো সেই গাউন আর সেই সাজ। চুল গুলো মারাত্মক এলোমেলো। নির্ঝর নিজেই ঢোক গিলে তাকিয়ে রইল। ওয়াইনের বোতল একদিন নিজে এনে রেখেছিল আলমারিতে। মেহু তা জানল কিভাবে বুঝতে পারছে না। ওয়াইনের বোতল খুলতে না পারার কারণে রেগে যাচ্ছে মেহু। এই তো মনে হচ্ছে ওয়াইনের বোতল ছুঁড়ে মারবে। আহ তা হয় কিভাবে। নির্ঝরের অনেক সাধের এটা। অনেক কষ্ট করে বাইরে থেকে আনিয়েছে সে। একবার চেখেও দেখে নি। সে ছুটে গেল মেহুর কাছে। মেহু ছুঁড়ে ফেলতেই ধরে নিল তা। মেহু অবাক আর লজ্জায় থমকে গেল। চেয়ে রইল শুধু। হাতে ওয়াইনের বোতল পেয়ে প্রাণ ফিরে পেল নির্ঝর। শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল,

“মেহু!

মেহু থতমত খেয়ে গেল। কথা বলতে পারছে না, কথা আটকে যাচ্ছে শুধু। দ্রুত এখান থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্তে পা বাড়াতেই নির্ঝর তার হাত খানা ধরে ফেলল। বলে উঠল,

“কোথায় যাচ্ছ, বসো তুমি!

মেহু কিছু বলার আগেই নির্ঝর নিজেই হাত টেনে বসাল বিছানায়। ওয়াইনের বোতল খুলে দু গ্লাসে ঢাল তা। তার ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি। তা কিসের বুঝতে পারছে না। হাতের গ্লাস টা এগিয়ে দিল মেহেরিন’র হাতে। এসে বসল তার পাশে। মেহেরিন কে বোঝাতে লাগলো ধীরে ধীরে খেতে কিন্তু তার আগেই মেহেরিন পুরো গ্লাস খালি করে আবারো তার হাতে দিল তা। নির্ঝর অবাক হলো। মেহু কে দেখে মনেই হচ্ছে না সে প্রথম এসব খাচ্ছে। নির্ঝর কি আর জেনে মেহু আগেও এসব খেয়েছে। এখন শুধু অর্ণবের জন্য সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে সে।

নির্ঝর নিজের গ্লাসও এক ঢোকে খেয়ে ফেলল। ভালোই লাগল তার কাছে।‌ গ্লাসে আবারো ঢেলে এগিয়ে দিল মেহুর হাতে। বিকট শব্দে বাজ পড়ল আকাশে। বৃষ্টির গতি বেড়েছে। মেহু আবারো এক ঢোকে খেয়ে গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিল। নির্ঝর এবার গ্লাসে ঢেলে মেহুর সামনে গ্লাস আর বোতল দুটোই ধরল। বলে উঠল,

“নাও কোনটা নিবে।

লজ্জা বোধ করল মেহেরিন। কি করছে সে? রাগের মাথায় সব কিছুই উল্টাপাল্টা করছে সে। ধীরে ধীরে গ্লাসের দিকে হাত বাড়াল সে। নির্ঝর হেসে নিজের গ্লাসে চুমুক দিল। তাকাল মেহেরিন’র দিকে। রমনী’রা রাগলে সবসময় তাকে সুন্দরী বলে মনে হয়, এই সত্য আজ প্রমাণ পেলো সে। মেহু আজ তার বাইরে নয়। কিছু বলা উচিত কিন্তু বলবে কি? ফাহান কে নিয়ে কিছু? কিন্তু নির্ঝর চায় না মেহু জানুক সে তার অতীত জানে। মেহু খুব লুকিয়ে রাখে নিজেকে। এটা ভালো লাগে নির্ঝরের কাছে। এখন মেহুর অতীত নিয়ে কিছু বলে তার মন খারাপ করার দরকার নেই।

মেহেরিন গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে আর ফাহানের কথা ভাবছে। তার প্রতিটা কথা কানে বাজছে তার। রাগ হচ্ছে খুব। কিভাবে ভাবল সে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসবে সে? এটা তো কখনো সম্ভব না। নির্ঝর কে সে বিয়ে করেছে বটে তবে তাকে তো আর ভালোবাসে না সে। ভালো তো শুধু তাকেই বাসতো। যতটা না ছেড়ে দেওয়াতে কষ্ট পেয়েছে তার বেশি কষ্ট পেয়েছে ফাহান তাকে অন্য কারো হতে বলেছে বলে! মেহেরিন রাগের বসে আবারো গ্লাসে চুমুক দিল।

নির্ঝর শুধু তাকিয়ে আছে মেহু’র দিকে। মেহু কে রাগতে দেখে বেশ ভালো লাগছে তার। বিছানার উপর থাকা অন্য হাত টা ধরতে ইচ্ছে করছে খুব। নির্ঝর হাত বাড়িয়ে তা ছোঁয়ার চেষ্টা করল। মেহু নির্ঝরের ছোঁয়া পেয়ে চমকে সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে গেল। নির্ঝর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেহুর দিকে। মেহু শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে। কয়েক ঘন্টা আগের ঘটনা এখন আবার মনে পড়ছে তার। কিভাবে তার জানা নেই তবুও সেখানে নির্ঝরের সামনে দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু কিভাবে? তবে কি ফাহানের কথা সত্য হবে। না তা হতে দেওয়া যায় না। মেহু আজ পর্যন্ত যাকেই ভালোবেসেছে তাকেই হারিয়েছে। নতুন করে আর শুরু করার প্রশ্নই উঠে না।

নির্ঝর দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে মেহু!

“নননা কিছু না।

নির্ঝর তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। নির্ঝরের পা বাড়ানো দেখে পিছিয়ে যাচ্ছে মেহু। ব্যাপারটা স্পষ্ট না নির্ঝরের কাছেও। মেহু তাকে দেখে এমন ঘাবড়ে যাচ্ছে কেন? তাকে দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছে তাকে অন্য কোন চিন্তা। নির্ঝর ওয়াইনের গ্লাস টা রেখে বলল,

“মেহু..

“হুম!

“কি হয়েছে তোমার? অনেকটা অস্থির লাগছে কেন তোমায়!

মেহু এবারো চমকে উঠলো। তার হরিণী চোখ জোড়া অস্থির হয়ে উঠলো। একবার এদিক আরেকবার ওদিক তাকতে লাগল। নির্ঝর তাকিয়ে দেখল মেহু ঘামছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

মেহু যত’ই পিছে যাচ্ছে ততোই দেওয়ালের দিকে আগাচ্ছে। দেওয়ালের সাথে বাড়ি খেতে যাবে নির্ঝর তৎক্ষণাৎ দৌড়ে তার কাছে গেল। বাহুদোরে হাত রেখে থামিয়ে দিল তাকে। নির্ঝরের ছোঁয়া আবারো কম্পিত করল মেহু কে। শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। সে নিজেও বুঝতে পারছে সবকিছু তার হাতের বাইরে যাচ্ছে।

নির্ঝর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এলোমেলো চুল গুলো কানে গুঁজে দিল সে। মেহু অন্যহাতে তার গাউন খামচে ধরল। নির্ঝরের প্রত্যেকটা ছোঁয়া তার সহ্য হচ্ছে না তবুও তাকে সরাতে পারছে না সে। নির্ঝর ঢোক গিলে তাকিয়ে আছে এই চঞ্চল মুখ খানির দিকে। হরিণী চোখ জোড়া এখনো চঞ্চল। এসব আরো কাছে টানছে নির্ঝর কে!

মুহূর্তেই নির্ঝর হাত রাখল মেহেরিন’র গালে। মেহু তৎক্ষণাৎ চোখ দু’টো বন্ধ করে নিল।‌ নির্ঝর নেশালো ভাবে তাকিয়ে রইল মেহুর ঠোঁট জোড়া’র দিকে। লাল ঠোঁট জোড়া রীতিমতো কাঁপছে। বাইরে এতো ঝড় বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাস বেলকনির পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। নির্ঝরের এই নেশালো ভাবটা যেন তীব্রতা ছড়িয়ে গেল। সে মেহুর ঠোঁটের দিকে আবারো এগিয়ে গেল। মেহু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল নির্ঝর চোখ বন্ধ করে তার দিকেই আগাচ্ছে। মেহু কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে নিল ভয়েতে। ভেসে উঠলো ফাহানের মুখ খানা। অদিতির কপালে তার চুম্বনের দৃশ্য। রাগ চড়ে বসল মাথায়। হাতে ওয়াইনের গ্লাস টাকে শক্ত করে ধরল সে। মুহূর্তেই বিকট শব্দ! নির্ঝর থেমে গেল। কিসের শব্দ এটা! সরে এসে দাঁড়াতেই মেহু দেওয়ালের সাথে মিলে গেল। নির্ঝর পার্শ্বে চোখ বুলাতেই মেহুর রক্তাক্ত হাত দেখতে পেল। চমকে তাকাল মেহুর মুখের দিকে। মেহু চোখ বন্ধ করে দেওয়ালের সাথে মিশে আছে। নির্ঝর অস্থির হয়ে পড়ল। মেহুর হাত ধরে বলে উঠল,

“মেহু, মেহু তুমি কি করছ এইটা? হাত থেকে রক্ত পড়ছে তো। ওহ শিট কি করবো আমি এখন!

মেহু চোখ মেলে তাকাল। তার হাতের মাঝে এখনো কাচের টুকরা। নির্ঝরের কলার ধরে তাকে ঘুরিয়ে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে কাচটা তার ঘাড়ের কাছে রাখল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। নিভে গেল সব আলো। ভয়ংকর শব্দে বাজ পড়লো আকাশে। বিদ্যুৎ চমকালো! তার আলোতে মেহুর মুখ দেখতে পেল সে। মেহু দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

“আমার কাছে আসবেন না নির্ঝর! ( চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ) বুঝলেন আমার কাছে আসবেন না আপনি!

বলেই ছুরি টা জোরে চেপে ধরল। নির্ঝরের ঘাড়ে লেগে কেঁটে গেল তা। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে “আহ” করে শব্দ করল। হুট করেই আলো সব জ্বলে উঠলো। মেইন সুইচে সমস্যা হয়েছিল হয়তো, সেদিনের মতো! মেহেরিন থতমত হয়ে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। সে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সমানে। মুখ কান সব লাল হয়ে গেছে তার। মেহু তাকিয়ে দেখল ঘাড়ের কাছ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়েছে। মেহেরিন সরে গেল নির্ঝরের কাছ থেকে। নির্ঝর ঘাড়ে হাত রেখে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাকিয়ে দেখল মেহুর পুরো হাত রক্তাক্ত। কাঁচের টুকরো ফেলে দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল মেহেরিন!

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের আর্ধকে বোতাম খুলল নির্ঝর! রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। নির্ঝর ক্ষত স্থানে হাত রেখে মুচকি হাসল। বলে উঠল,

“তোমার ভালোবাসার ক্ষত এটা মেহু! এতো তাড়াতাড়ি শুকাবে না এই টা!

বলেই মাথায় চুল গুলো এলোমেলো করে হেসে দিল। লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে। নির্ঝর আবারো হাসতে হাসতে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,

“হ্যাঁ আমি পড়ে গেছি তোমার প্রেমে, আর এই পথ সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভালোবাসার যেই উপহার দিলে তুমি আমায়।

হাতে তুলো নিয়ে রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলল,
“তবে কথা দিচ্ছি মেহু, তুমি তো আমার’ই হবে। এখন এটাতে যতটা ক্ষত থাকুক না কেন? সব সহ্য করে নেবো। তবুও তোমাকে চাই আমার!

মাথা সরিয়ে ঘাড় সরিয়ে আবারো দেখল ক্ষতটা। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো তার। কেন জানি বেশ হাসি পাচ্ছে তার। ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,

“মেহু ! তোমার মতোই একজন কে দরকার ছিল আমার। আর আমি তা পেয়ে গেছি!

অতঃপর রক্ত বন্ধ করে ক্ষত স্থানে ঔষধ লাগলো সে। ব্যান্ডেজ করে নিল। ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়ে বের হলো। সে জানে মেহু এখন কোথায় আছে!

ঘরের সামনে এসে দাড়িয়ে গেল নির্ঝর। তার ধারণা সত্যি হয়েছে। অর্ণবের বিছানার কাছে মেঝেতে হেলান দিয়ে বসে আছে সে। তার চোখ জোড়া বন্ধ। নির্ঝরের ধারণা মেহু এতোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহুর এ ব্যাপারটা বেশ লাগে তার।‌ রাগারাগী’র পর এক ঘুম দিয়ে উঠে সে। হাতটা গুটিয়ে পাশে পড়ে আছে।
“ঔষধ লাগানো তো দূর রক্ত অবধি বন্ধ করে নি মেহু। কি কেয়ারলেস মেয়েরে বাবা। এটাও কি এখন আমি করে দেবো নাকি।”

মেহুর হাত টা ধরে বলল,
“এখন ভালো যখন বাসি তখন তো করে দিতেই হবে!

মুচকি হাসল নির্ঝর। হাতের রক্ত পরিষ্কার করে তাতে ঔষধ লাগিয়ে দিল সে। অতঃপর হাত টা ব্যান্ডেজ করে তাকিয়ে রইল মেহেরিন’র দিকে। খুব গভীর ঘুমে আছে,নাকি অন্য কিছু!

মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে মেহেরিন’র। চোখ মেলে তাকানোর শক্তি নেই তার। আশেপাশে কারো ছোঁয়া পেয়েও তাকানোর ইচ্ছা জাগল তবু শরীর মানতে চাইছে না। তবুও মিটিমিটি চোখে তাকালো সে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে কাউকে বসে থাকতে দেখল। সে হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে নিল। মেহেরিন গুটিয়ে নিল। নির্ঝর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কোলে তুলে নিল তাকে। বিছানায় শুইয়ে চাদর টেনে নিল। খুব ইচ্ছে করল কপালে একটা চুমু খেতে। নির্ঝর এগুতেই মেহেরিন ওপাশ হয়ে গেল। সে হেসে তার কপালের পাশেই চুমূ খেল। তাকাল অর্ণবের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াল বেলকনিতে। বাইরের বৃষ্টি কমে নি এখনো। বুঝতে পারছে না আজ এতো বৃষ্টি কেন। প্রকৃতি কেন আজ এতো মাতাল। বেলকনির গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়াল। বৃষ্টির কণা এসে পড়তে লাগল তার মুখে। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে শব্দ করে শ্বাস ফেলল!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here