প্রেগন্যান্সির কিট টা লুকিয়ে রেখে নির্দ্বিধায় সতীনকে বরণ করে নিচ্ছে দর্শিনী। কী সুন্দর তার সাজ! টকটকে লাল রাঙা শাড়ি পড়ে, কপালে বড় লাল রাঙা টিপ,পায়ে আলতা সাথে মোটা নূপুর। তাদের বাড়িতে আসা মানুষ গুলো এমন দৃশ্যে হতবাক,বিষ্মিত! এমন কি তার স্বামী,যে সদ্য বিয়ে করে এসেছে সেও আশ্চার্যিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দর্শিনীর শাশুড়ী হায় হায় করে উঠলো। ছুটে এসে দর্শিনীর গালে সপাটে ক’টা চড় বসিয়ে দিলেন। বিশাল ক্ষতি হয়েছে এমন মনোভাব করে বললেন,
“হায়,হায় অলক্ষী! তুই বরণ করলি কেনো? শুভ কাজে অশুভের ছায়া পড়লো। কী হবে এবার!”
দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা ষোড়শী নববধূ আৎকে বলে উঠলো,
“শাশুড়ী যে বাড়িতে এমন,সে বাড়িতে আমি থাকবো কীভাবে? আর এই শাড়ি পড়া দিদি টাও বা কে?”
“আমার এক দূর সম্পর্কের চাচাতো বোনের মেয়ে। আমি তো অকারণে রাগ করি নি, মা। বরণ তো আমার করার কথা ছিলো। কিন্তু এ অপয়া মেয়েটা করে ফেললো!”
শাশুড়ির গদোগদো কণ্ঠে ভ্রু কুঁচকালো নববধূ। সে সাথে সাথে ঘরে প্রবেশ করেই জড়িয়ে ধরলো পাথরের ন্যায় লালে রঞ্জিত নারীকে। গালে হাত দিয়ে বললো,
“শাশুড়ি মা বড্ড কড়া। তুমি কষ্ট পেয়ো না। আজ থেকে আমরা সাত জন্মের সই।”
দর্শিনী চুপ রয়। মনে মনে আওরায়,এ জন্মেই আমি তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু না হয়ে যাই-সত্যি জানার পর!
দর্শিনীর শাশুড়ি এগিয়ে এলেন। নববধূকে টেনে দূরে সড়িয়ে নিয়ে গেলেন। তার কর্মকান্ডে নববধূ বিস্মিত! সে বিষ্ময় প্রকাশ করার আগেই শাশুড়ি মিনমিনে স্বরে বললো,
“মা,ওর কাছে যেও না। ও কালনাগিনী। ওর ছায়া মারালেও পাপ।”
ষোড়শী নববধূ কপাল কুঁচকালো। শাশুড়ির চেয়েও দ্বিগুণ ফিসফিসিয়ে বললো,
“ও কালনাগিনী হলে আপনি কী জলহস্তি,মা?”
নববধূর এহেন কথায় বোঁকা বনে গেলো শাশুড়ি, মোহনা। চোখ গুলো বড় বড় করে ফেললো। তার বড় বউ যতটা না চঞ্চল এর চেয়ে দ্বিগুণ না চৌদ্দগুণ চঞ্চল ছোট বউ। মোহনার মাথায় হাত।
তন্মধ্যেই দর্শিনীর ননদ বিহঙ্গিনী এগিয়ে গেলো দর্শিনীর দিকে। হাতটা শক্ত করে ধরে দর্শিনীর ঘরের দিকে নিয়ে গেলো। দর্শিনী কথা বলে না, কেবল হাসে। ওরা ঘরে ঢুকতেই বাহিরে নতুন বউ বরণের আবার তোড়জোড় শুরু হলো। বেজে উঠলো শঙ্খ,উলুধ্বনি। এমন করেই বাড়িটা সেজেছিলো সেদিন। যেদিন বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলো, দর্শিনী৷ তবে,সেদিন শাশুড়ির মুখে হাসি ছিলো না। প্রেমের পরিণতিতে মুখ কালো করে বরণ করেছিলো নতুন বউ। মনে রেখেছিলো বিশাল আফসোস। আজ সেই আফসোসের অবসান হলো। মনের মতন বউ এলো। কেবল কপাল পুঁড়লো দর্শিনীর। এভাবেই তো একজন ভেঙে গিয়ে আরেকজনকে গড়ে দেয়।
“তুই কী পা’গ’ল হলি, বৌদি? কী করছিস এসব! নিজের কপাল নিজে এমন তোড়জোড় করে পোড়াচ্ছিস যে! উন্মাদ হলি?”
“তোর ভাই তো আমায় সারাজীবনের উন্মাদনায় ডুবিয়েছে। হাসবো না বল? উন্মাদ হওয়া কী আমার অপরাধ! তবে তো বলা যায়, মোর প্রেম ছিলো সারাজীবনের পাপ।”
বিহঙ্গিনী চুপ করে যায়। সত্যিই তো,প্রেম তো তখন পাপই হয় যখন প্রেমিক হয় নির্জীব। তার ভাইটা তো সেই প্রেমিকের দলেরই। সে ক্ষেত্রে বৌদির প্রেম পাপই হলো।
ননদকে চুপ থাকতে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো দর্শিনী। হঠাৎ হাসি শুনে সামান্য চমকে যায় বিহঙ্গিনী। নিজের বৌদিকে এমন করে হাসতে দেখে অবাক হয়। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আবার হাসছিস যে?”
“তোর ভাই কতটা কথা ভঙ্গ করতে পারে, তা ভেবেই হাসলাম। যখন প্রেম ছিলো তখন বলেছিলো হাত ছাড়বে না। অবশ্য এখনও হাত ছাড়ে নি কিন্তু এটাকে কি ধরে রাখা বলে? জানিস,সেদিন রাতে এসে আমায় কী বলেছিলো? বলে, ‘দর্শিনী আমায় ক্ষমা করো। তুমি বলো, তুমি কী চাও আমি বিয়েটা করি?’ আমি তখন শক্ত কণ্ঠে কী জবাব দিলুম জানিস?”
বিহঙ্গিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। সে জবাব টা জানে। তবুও দর্শিনীকে একটু হালকা করার জন্য কেবল বললো,
“কী?”
“আমি বললাম,’তুমি যদি চাও আমি বেঁচে থাকি, তবে বিয়েটা করো।’ সেদিন তোর ভাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কথা ছড়ালো আমিই নাকি চাই বিয়েটা হোক। সেদিন তোর ভাই আমার মনের কথা জেনেও প্রশ্ন করেছিলো এমন জবাবের জন্যই। কোনো নারী কী সতীন চায় বেঁচে থাকা কালীন? আমি চাইলাম আর তোর ভাই শুদ্ধ পুরুষের মতন মেনে নিলো! কারণ আমি যে বেঁচে নেই।”
বিহঙ্গিনী আৎকে উঠে৷ মুখ চেপে ধরে দর্শিনীর। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“অমন বলিস না। তুই তো জানিস, দাদাই তোকে কত ভালোবেসে।”
“ও আমি ঢেঁড় জানি। নাহলে কী আর পুরাতন বউয়ের মান রাখতে ঘরে সতীন আনে! অত ভালোবাসা আমার কপাল সইবে না যে।”
“তোর বাড়ির মানুষ জানে বিয়ের কথা?”
“নাহ্,কী বলবো? নিজের স্বামীর নামে কেইবা বলতে চায়? নাকি বলবো,মা তোমার মেয়ে তিন বছরও সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে নি, এতটা অলক্ষী সে ৷ হয়তো প্রেমের সংসারে নয়তো ভালোবাসায় ঘুণে ধরেছিলো। তাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। এটা বলবো? আচ্ছা বিহঙ্গিনী, সন্তানই কী সব একটা সংসারে?”
বিহঙ্গিনী থম মেরে বসে থেকে উত্তর দেয়,
“তোর সংসারে তো সবই বলে গণ্য করা হয়েছে। প্রতিবাদ করতে পারলি না?”
“কার জন্য প্রতিবাদ করবো? তোর ভাইয়ের জন্য? সে-ই তো আমার বিপক্ষীয় দলে। তারও যে নতুন রঙ লাগবে। সে কী আমি বুঝি না? বুঝি। আর বুঝি বলেই তাকে রঙের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিলাম নিজে রঙহীন হয়ে।”
“তোর ঘর তুই ই খেলি।”
বিহঙ্গিনী শেষোক্ত বাক্যখানা বলে আর দাঁড়ায় না। বের হয়ে যায় ঘর থেকে। তারও কী ভালো লাগছে নিজের প্রানের চেয়ে প্রিয় বান্ধবীকে এসব বলতে? কখনো কী সে ভেবেছিলো পরিবার,পরিস্থিতি আর প্রেম এমন করে বদলে যায়!
বিহঙ্গিনী বের হতেই দর্শিনী দরজায় খিল দিলো। প্রেগন্যান্সির কিট টা বের করলো। যেখানে জ্বল জ্বল করছে পজিটিভি। দর্শিনীর ভিতরে আরও একটা প্রাণও যে আছে,এটা তার প্রমাণ। দর্শিনী ভেঙে ফেলল কিট খানা। ছুঁড়ে ফেললো ভীষণ যত্নে অবহেলার ডাস্টবিনে। এ সত্যি কেউ জানবে না। জানানোর হলে তো সে কবেই জানাতো। যেদিন তার স্বামী নতুন বিয়ের রঙ শরীরে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিলো সেদিন বড্ড বলতে ইচ্ছে হয়ে ছিলো, “ওগো, তুমি তো সন্তান চাও। এর জন্য বিয়ে করছো। এই যে, আমাদের নতুন অতিথি আসছে।” -কিন্তু এই বাক্য গুলো দর্শিনী উচ্চারণ করে নি। তার স্বামী যে তিন বছরেই তিক্ত হয়ে গেছে, তা সে ভালো বুঝতে পেরেছিলো। কেবল মুক্ত হওয়ার জন্য দরকার ছিলো একটা কারণ। যে কারণ সৃষ্টি করে দিয়েছে দর্শিনী নিজেই। মেয়েটা তো আগা গোড়া ভালোবেসে এসেছে। আর,প্রেমিকের মন বুঝবে না -তা কী হয়!
–
সরকার বাড়িতে নতুন বউ এসেই ছাদে ঘুড়ি উড়াতে চলে গেছে। তা দেখার জন্য পাড়া প্রতিবেশীরা নিজ নিজ বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েছে ভীড় জমিয়ে। তারা এ দৃশ্য উপভোগ করছে সাথে হাসি ঠাট্টাও বাদ যাচ্ছে না।
হলরুমে বসে থাকা মোহনার কাছে খবর পৌঁছুতেই তিনি ছুটে এলেন। এটা কী বউ এনেছে না অন্য কিছু! সে ভেবে পাচ্ছে না।
মায়া তখন লাল বেনারসি পরে ছাদে ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত। শাশুড়ি ছুটে এলেন। বউয়ের হাত ধরে আশপাশে তাকালেন। মোহনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে লজ্জায়। নিজে পছন্দ করে এক বাঁদরই শেষমেশ আনলো!
মোহনা নিজের নতুন বউকে একপাশে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“তুমি না নতুন বউ? নতুন বউরা ঘুড়ি উড়ায় না।”
“তাহলে কী পুরাতন বউরা উড়ায়? তাহলে আপনি একটু উড়ান, শাশুড়ি।”
“এই মেয়ে, শাশুড়ি কী? মা বলতে পারছো না?”
“না,পারছি না বলেই তো বলছি না। আমার মা একটাই। তাও সে অনেক ভালো।”
মায়ার সহজসরল বাক্যতে মোহনার মাথায় ছোটখাটো বাজ পড়লো। অন্যদিকে মায়া মিটমিটিয়ে হাসছে আর নানান রকমের ফন্দি আঁটছে।
–
“তুমি এ ঘরে যে? নতুন বউ কই?”
দর্শিনীর ঠাট্টার স্বরে করা প্রশ্নের ইঙ্গিত ঠিকই বুজেছে বিপ্রতীপ। মাথা নত করে মিনমিন কণ্ঠে সে বললো,
“তুমিও আমার সাথে ঠাট্টা করছো,প্রিয়দর্শিনী? আমি তো তোমার ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিলাম।”
“সে তো অনেক আমার ইচ্ছের মূল্য দিলে। এবার যাও নতুন বাসরে। তোমার আজ রঙিন রাত।”
“প্রিয়দর্শিনী?”
“কিসের প্রিয়দর্শিনী? সেদিন রাতে বিয়ে করতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করার সময় আমি দর্শিনী ছিলাম। আজ আবার প্রিয়দর্শিনী! গাছেরও খাবে, তলারও কুড়বে?”
শেষোক্ত কথা গুলো যেনো তীরের মতন বিঁধলো বিপ্রতীপ এর কাছে। সে উত্তর খুঁজে পেলো না আর। তার শব্দের যেনো বড্ড অভাব। দর্শিনী বুজেছে স্বামীর মনোভাব। বিপ্রতীপকে সে ঘরের দরজার বাহিরে পাঠিয়ে দিলো। বিপ্রতীপ কেবল অবাক বনে চেয়ে রইলো। দর্শিনী কৌতুক হেসে গেয়ে উঠলো,
“তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম,কী দোষ দিবি তাতে?
বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই,সকাল দুপুর রাতে।”
আগুন জ্বেলে পুড়লাম আমি,দিলাম তাতে ঝাঁপ,
তোর আমার প্রেমে ছিলো রে বন্ধু, ছিলো পুরোটাই পাপ।”
#চলবে
#সূচনা_পর্ব
#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা