পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৭

0
3158

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ সতেরো

একটা নতুন, পানসে,ফিকে ভোরের আগমন। চারদিকে কেমন নিষ্প্রাণতা,বিধ্বস্ততা। একটি পরিবার তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে বসে আছে নিজেদের পুড়ে যাওয়া প্রিয় বাড়িটার কাছে। আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ধনীদের দানবীয়তার নিদারুণ চিত্র। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছে না,ফিরে তাকাচ্ছে না সেই দিকে। যেন ধনীরা এমন ভাবেই তাদের ক্ষমতা দিয়ে পিষে যাবে চিরকাল। এটাই যেন অনিবার্য, রীতিনীতি।

পুরো একটা রাত হন্যে হয়ে খোঁজ চললো দুই রমনীর কিন্তু কোথাও তারা নেই। এ যেন বিরাট বি’স্ফো’র’ণ ঘটলো। এক রাতের মাঝে মেয়ে গুলো কোথায় গেলো সেটা যেন কারো বোধগম্য হচ্ছে না। এমনকি হরপ্রসাদের বাড়ি অব্দি গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় এবং দৃষ্টান্ত হম্বিতম্বি করে এসেছে। তবে এতে বিশেষ লাভ কিছু হয় নি।

প্রতাপ সাহা তার মলিন মুখ নিয়ে সেই কাঁদা মাটিতেই ঠাঁই বসে আছেন। সরলা সারা রাত কেবল আহাজারি করে গেছেন। বাড়ির প্রতিটি মানুষ বর্তমানে ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত। একটা নির্ঘুম রাত কী ভীষণ যন্ত্রণায় তারা কাটিয়েছে সেটা যেন বলে বোঝানো সম্ভব না।

মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত মোটামুটি গ্রামের অধিকাংশ জায়গা খোঁজ করে প্রতাপদের কাছে হাজির হলো। দু’জনই অসম্ভব হাঁপাচ্ছে। শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। সাথে হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে।

দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে প্রতাপ সাহার মুখে হাসি ফুটলো। আশার আলো দেখলো যেন। পাহাড়ের ন্যায় অটল থাকা প্রতাপ সাহা বাচ্চাদের ন্যায় শুধালেন,
“পেলে বাবা,আমার মেয়ে দুটোকে?”

দৃষ্টান্ত আর মৃত্যুঞ্জয় ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ তাদের ব্যর্থতা প্রকাশ করেছে। নিধির বাবা-মা তৃণার শোকে যেন পাথর হয়ে গেলেন। তারা কোনোরকমের কথা বলছেন না। কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভালো কিছুর আশায়।

গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকেই থেকে গেছে প্রতাপ সাহাদের সাথে। যতই হোক,তারা প্রতিবেশী। একজনের বিপদে চলে যাওয়া টা যেন মানানসই মনে হচ্ছে না। আবার হতে পারে হয়তো তারা দর্শিনী আর তৃণার সম্বন্ধে আরও কোনো চাঞ্চল্যকর খবরের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের মন বোঝা আজকাল বড্ড কঠিন হয়ে যে দাঁড়িয়েছে।

সবার বিষন্নতার পাহাড় সরিয়ে একরাশ বিষ্ময় এনে দিয়ে রিনরিনে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠলো,
“বাবা,তোমরা এখানে কেনো বসে আছো? এ কী অবস্থা তোমাদের?”

সবার বিষ্ময় যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। কতক্ষণ তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো তারা মেয়ে দুটোর দিকে। মেয়ে গুলোর মুখ খানা কেমন কোমল,মলিন হয়ে আছে। প্রতাপ সাহা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন। তার সাথে সাথে যেন উপস্থিত সবার ঝিমিয়ে থাকা শক্তিটা জেগে উঠলো। নিধি এসে নিজের বোনটাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রদীপ এসে দর্শিনীর বাহু আগলে ধরলো। সবার মনে চাপা কৌতূহল, বিষ্ময় যেন উপচে পড়ছে।

দর্শিনী তার বাবাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের মায়ের দিকে চোখ যায়। মায়ের সুন্দর, সুশ্রী মুখটুকু কেমন কোমল হয়ে আছে! দর্শিনী অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মা,তোমার কী হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেনো? তোমরা কী মাত্র ফিরলে? বাড়ি না গিয়ে রাম্তায় কী করছো?”

দর্শিনীর মা নিষ্পলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন,
“কোথায় ছিলি তুই সারারাত?”

এবার তৃণা এগিয়ে এলো। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“জানো আন্টি,কালকে রাতে কী হয়েছে?”

সবার বিষ্ময় আকাশচুম্বী। মেয়ে গুলো কোথায় ছিলো সারারাত? তাছাড়া ওদের এত হাসি হাসি মুখই বা কেনো?

মৃত্যুঞ্জয় এবার তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণে যেন তার দেহ স্থির হয়েছে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“কোথায় ছিলেন দু’জন সারারাত?”

“ভাইয়া, আমরা তো আমাদের ক্যাম্পে ছিলাম কাল রাতে।”

তৃণার উত্তরে হা হয়ে রইলো সবাই। তাদের যেন বলার কোনো ভাষা নেই। যে মানুষ গুলোকে তারা হন্যে হয়ে খুঁজেছে তারা কিনা ক্যাম্পে ছিলো! কারো মুখ থেকে আর কোনো শব্দ যেনো বের হলো না।

এবার মূর্তির ন্যায় প্রতাপ সাহা উঠে দাঁড়ালো। নিজের মেয়ের সামনে গিয়ে কতক্ষণ প্রাণ ভরে দেখলো মেয়েটাকে। মেয়েটাকে কাল রাতে দেখতে না পেয়ে কলিজাটা কেমন হাহাকার করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল এ বিশাল সংসারে কেউ নেই তার। যার মাঝে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতো সে মেয়েটাকেও সে রক্ষা করতে পারলো না। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল বেঁচে থাকাটাই বৃথা হয়ে গেছে। বাবা মানে যেখানে বটবৃক্ষ সেখানে বাবা-ই মেয়ের বিপদের ঢাল হতে পারে নি। এর চেয়ে বেশি অসহায়ত্ব আর কিছুতে নেই। কিন্তু এখন আত্মার শান্তি মিলছে মেয়েকে অক্ষত দেখে। প্রতাপ সাহা আর সময় ব্যয় না করে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরলেন। হিমালয়ের মতন শক্ত,অটল বাবা বাচ্চাদের মতন কেঁদে দিলেন। মেয়েকে যেন বুকের সবটুকু উষ্ণতা ঢেলে দিলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অনবরত বললেন,
“মা,তুমি ঠিক আছো? তোমাকে ঈশ্বর ঠিক রেখেছে। এর চেয়ে খুশির খবর আমার কাছে নেই।”

দর্শিনী থমকালো। বুজ হওয়ার পর থেকে বাবাকে সে কখনো কান্না করতে দেখে নি। তবে আজ বাবা কাঁদছে কেনো?

দর্শিনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাবার চোখের অশ্রু গুলো যত্নে মুছে দিলো। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“বাবা, কাঁদছো কেনো? আমাদের জন্য চিন্তা করছিলে বুঝি? আমার ফোনে চার্জ ছিলো না আর তৃণার ফোনটা জলে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই তো তোমাদের জানাতে পারি নি আমরা যে ক্যাম্পে।”

“এত রাতে ক্যাম্পে গিয়েছিলেন কেনো? সেটা তো পরিষ্কার করুন।”

মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে দর্শিনী তার দিকে ঘুরে তাকালো। শীতল কণ্ঠে বললো,
“কাল বাড়ি ফেরার পথে ক্যাম্প থেকে আমার ফোনে কল আসে। কোনো জরুরী রোগী নাকি এসেছে সেখানে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি আর তৃণা আর কিছু না ভেবেই সেখানে ছুট লাগাই। সেখানে গিয়ে দেখি পাশের গ্রামেরই এক বউয়ের পেইন উঠেছে। বাচ্চা প্রসবের সময় হয়েছে। তৃণা তখন দিক বেদিক ভুলে দৃষ্টান্তদাকে কল লাগায় কিন্তু ফোন বন্ধ ছিলো। আপনার নাম্বার জানা সেই ওর। অতঃপর আমরাই লেগে গেলাম কাজে। সারারাতের চেষ্টার পর ভোর রাতের দিকে তার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। আর শান্তির কথা এটা যে,তারা দু’জনেই সুস্থ আছে।”

দর্শিনীর সাথে সাথে সবাই একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। তন্মধ্যেই সরলা ছুটে এসে চড় লাগালো মেয়ের গালে। একটা চড় দিয়ে ক্ষান্ত হয় নি সে। পর পর আরেকটা চড়ও দিলো। অতঃপর চুলের গোছা ধরে টান দিয়ে রণচণ্ডী রূপে বললো,
“তুই ম’র’লি কেনো মুখপুরী! তুই ম’র’লে আমরা শান্তি পেতাম। কাল সারাটা রাত আমাদের তো বেঁচে থেকেও মে’রে ফেলেছিলি। আর এখন এসে কাহিনী শুনাছ?”

দর্শিনী মায়ের এমন আক্রোশ যেন মেনে নিতো পারলো না। বিষ্ময়ে হা হয়ে রইলো মুখটা। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“মা,আমি করেছি টা কী?”

“দেখ তোর বাবার স্বপ্নে গড়া বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। দেখবি তুই কী করেছিস তার প্রমাণ। একদম শেষ করে দিয়েছিস তুই আমাদের। ম’রে গেলি না কেন তুই?”

দর্শিনী মায়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাড়ির দরজাটার দিকে তাকালো। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই একটা পুঁড়ে যাওয়া বাড়ি চোখে পড়লো তার। যে বাড়িটাতে সে শৈশব,কৈশোর কাটিয়েছে, সে বাড়ির এমন দশা দেখে সে স্তব্ধ। তৃণাও হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। চোখ যে বিশ্বাসই করতে পারছে না সে দৃশ্য।

দর্শিনী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কীভাবে এমন হলো?”

অতঃপর গড়গড় করে সবটা বললো তার বড় ভাই। সারাটা রাতের বিধ্বস্ততার বর্ণনা দিলো সে। কী ভয়ানক কালরাত্রি ছিলো!

দর্শিনী সবটা শুনে পাথর হয়ে গেলো। অতঃপর গুটি গুটি পায়ে মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“মা,তোমার আমার প্রতি অভিযোগ টা ঠিক কী? চড় মারার কারণটা কী? বাড়ি পুড়েছে বলে? নাকি সেই বাড়ির ভিতর আমি ছিলাম না বলে? পুড়ে যাওয়া সন্তানের দেহ দেখার এত ইচ্ছে তোমার মা? আফসোস নেই,হয়তো খুব শীগ্রই দেখবে। যতই হোক,মায়ের অভিশাপ নিয়ে কী আর বেশিদিন বেঁচে থাকা যায়?”

মেয়ের কথায় সরলা থমকে গেলো। মেয়ে কী ভুল কিছু বলেছে!

#চলবে__

[কাল রাতে লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। তাই দিতে পারি নি। দুঃখীত। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here