#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আকাশটা সাদা, ফ্যাকাসে। ভোর ছয়টায় যেমন আকাশ কল্পনা করা যায়,তেমনের মতোই আকাশটা। একটা দুটো মেঘ আলপনা আঁকছে আকাশের বুকে। অদ্ভুত সুন্দর সেই সাদা রঙের আলপনা। বাতাসটাও শীতল, নরম তুলোর মতোই আদুরে। ভোরের হিম নামার পর মুহূর্তে বাতাস যেমন হয়,ঠিক তেমন। তবে সেই বাতাসেও আভা ঘামছে। কপালের উপর কয়েক ফোঁটা মুক্ত ঘাম জমেছে। নাকের উপরদিকটায়ও পানির উপস্থিতি। পানিভর্তি মাটির কলসির বাইরে যেমন বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে, তেমনই। আহনাফ এখনো আভার দিকে তাঁকায় নি।তার চোঁখের দৃষ্টি সামনে। রাগ করেছে খুব, মুখে স্পষ্ট। আভা এক ঢোক গিললো। গলা শুকিয়ে আসছিলো এতক্ষণ। আভা আহনাফের নির্লিপ্ততা দেখে আবারও বললো,
— ” সরি। আসলে সবাই আপনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কিভাবে আসতাম সেখানে বলেন? মানুষ ভাববে আমি বর পাগল। বিষয়টা খারাপ দেখাবে না, বলুন?
আহনাফের কপালের রগ ফুলে উঠলো। মুখের অভিব্যক্তি মুহূর্তের মধ্যেই পরিবর্তন হয়ে গেলো। চট করে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত দিলো আহনাফ। কোনো কথা বলবে না এই মেয়ের সাথে। তবে এই মিছে মিছে পণ যে খুব বেশিক্ষণ টিকবে না সেটা ও মানতেই নারাজ। আভা আহনাফকে গাড়ি ইঞ্জিন চালু করতে দেখে খুব বেশি অবাক হলো না। ও সাতপাঁচ চিন্তা না করে আহনাফের দরজা খুলে পাশের সিটটায় ধাম করে বসে গেলো। দরজা খুলার শব্দে আহনাফ পাশ ফিরে তাঁকালো। আভা গাল ফুলিয়ে আহনাফের দিকেই তাঁকিয়ে আছে। আহনাফ আভার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় শোধালো,
— ” দেরি হচ্ছে আমার। নামো গাড়ি থেকে। ”
আভা নাছোড়বান্দার মত বসেই রইলো। আহনাফের শীতল গলায় বলা ছোটখাটো আগ্নেয়গিরির একবিন্দুও পরোয়া করলো না ও। আহনাফ সিটে হেলান দিলো। এক হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে চোঁখ বুজলো। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আভা আহনাফের স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে বাচ্চামো কণ্ঠে বললো,
— ” সরি বললাম তো। এত রাগ কিসের,হু?
আহনাফ এবারও কথা বললো না। চোঁখ’দুটো আগের মতই বুজে রাখা। শুধু চোঁখের পাঁপড়ি খানিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। আহনাফের এমন ব্যবহার দেখে আভার ছোট্ট মন হাসফাঁস করে উঠলো। বুকের ভিতরে অভিমানের পাহাড় একটু একটু করে জমতেই আভা এক তপ্ত নিঃশ্বাস নিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো,
–” থাকুন আপনি আপনার রাগ নিয়ে। আমি কখনোই আপনার রাগ ভাঙাতে আসবো না। এই,বলে দিলাম। সবসময় রাগ ভালো না। বুঝলেন? ”
আভা কথাটা বলেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোঁখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। গাড়ির দরজা খুলতেই হুট করে আহনাফ আভার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে আভাকে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো। দ্রুত ব্যাপারটা ঘটায় আভা থতমত খেয়ে গেলো। পরিস্থিতি বুঝতে তার খানিক সময় তো লাগলো’ই। আভার এক হাত আহনাফের বুকের উপর, অন্য হাত আহনাফের কোমরের টিশার্ট খামচে ধরলো। কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো সব উলোটপালোট হয়ে আহনাফের বুকে ছড়িয়ে পড়লো।
আহনাফ আভার দিকে তাঁকিয়ে আস্তে করে একহাত দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। আভা মাথা তুলে আহনাফের দিকে তাঁকালো। দু’চোখে তার এখনো অভিমানেরা খেলা করছে। আহনাফ মুঁচকি হেসে আভার চুল কানের পিছনে গুজে দিলো। একজন দায়িত্বশীল প্রেমিকের মত আঙুল দিয়ে আভার চোঁখের জল মুছে দিলো। নিজ চোখে আস্ত এক মায়ার সাগর পুষে নিয়ে বললো,
— ” এই সামান্য কারণে চোঁখের জল ফেলতে হয়? কিছু জল স্টকে রেখে দেওয়া ভালো, সুখের সময় কাজে লাগবে।”
আহনাফের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। তবে,কি ছিলো? যার কারণে আভার শক্ত রাগ, আদুরে অভিমান এক নিমিষেই দ্রবীভূত হয়ে গেলো? আভা থুতনি নামিয়ে ফেললো। আস্তে করে বললো,
— ” আপনিই দায়ী এই কান্নার জন্যে। এত রাগ! বাপরে! আর একটু হলেই কেঁদে কেটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলতাম আমি। ”
আহনাফ আরো দু একটা কথা বলতে যাবে তার আগেই ওর মুঠোফোন বেজে উঠলো। মুঠোফোনের শব্দ কানে প্রবেশ করতেই আভা তড়িৎ গতিতে সরে এলো আহনাফের কাছ থেকে। অস্থির হয়ে গেলো চাহনি। এই প্রথম,এই প্রথম আহনাফের এত কাছে ছিলো ও। ভাবতেই পেটের ভিতরে গুড়ুম গুড়ুম করছে। সর্বাঙ্গে আড়ষ্ট ভাব ঘিরে ধরেছে। মুখখানা কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ ধারণ করেছে। উফ! আহনাফের সামনে আর বসে থাকা যাচ্ছে না।
আভা যখন লজ্জার সাগরে হাবুডুবু খেতে মগ্ন তখন আহনাফ ফোন হাতে নিতে নিতে আরো একবার লজ্জা দিলো তাকে,
— “থাক। গাল আর লাল করতে হবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। সে সম্পর্কে এত গভীরে যাওয়ার কিছু নেই। বি নরমাল। ”
আহনাফ ফোন রিসিভ করলো। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। আহনাফ ফোন কানে ধরে অপরপাশের মানুষের কথা শুনলো। তারপর গম্ভীর সুরে বললো,
— ” উনাকে বিকেলের দিকে আসতে বলো। আমি এসেই প্রথমে উনাকে দেখে নিবো। এখন গাড়িতে আছি আমি। ”
আহনাফ ফোন কেটে সামনে রাখলো। আভাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আভা বলে উঠলো,
— ” সাবধানে যাবেন। আর হ্যাঁ, গাড়িতে ঘুম পেলে রাস্তায় কোনো রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেয়ে নিবেন। ঘুম ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। ঘুম চোঁখ নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। ওকে?”
আহনাফ কিছুক্ষণ আভার দিকে তাঁকিয়ে থাকলো। এই মুহূর্তে আভার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, কোনো বুঝদার মেয়ে তাকে উপদেশ দিচ্ছে। আচানক আহনাফ আভার গাল টেনে দিলো। আভা গালে হাত দিয়ে অবাক চোঁখে আহনাফের দিকে তাঁকালে আহনাফ হেসে বললো,
— ” হুয়াই সো কিউট? ”
আভা হেসে ফেললো। যে হাসিতে আহনাফ মুগ্ধ হয়, বারংবার, বারংবার, বারংবার।
_______________________
খাবার টেবিলে বসে আছে আভাদের পুরো পরিবার। আভার মা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে মাত্রই চেয়ারে বসলেন। দাদুমনি পালং শাক দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুললেন ভাতের লোকমা। মিনহাজ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। আভার বাবা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও খাওয়ায় মন দিলেন।
এসবের মধ্যে হুট করে দাদুমনি বলে উঠলেন,
— ” এ জুনায়েদ, আভার তো বাগদান হইয়া গেলো। এখন ওরে বিয়ে দিবি কবে? কিছু ভাবসস ? ”
আভার বাবা মোহাম্মদ.জুনায়েদ ইসলাম ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই যাচ্ছিলেন। মায়ের কথা শুনে তার হাত থেমে গেলো। গম্ভীর সুরে তিনি বলেন,
— ” আম্মা, আভার আটারো বছর হয়নি এখনো। আগে ভার্সিটি উঠুক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। ”
বিয়ের কথা শুনে আভার হাত থেমে গেলো। বুকের ভিতর এক সর্বগ্রাসী তুফান শুরু হয়ে গেলো। কেনো জানেনা, যখনই তার বিয়ের কথা উঠে তখনই আভা খুব বেশি নার্ভাস হয়ে যায়। এই সমস্যার যথাযথ কারন আভার জানা নেই। হতে পারে, এই সমস্যা সকল হবু বউদের জন্যেই কার্যকর। দাদুমনি একটু থেমে শ্বাস নিয়ে বলেন,
— ” তয়, মেয়েরে এত জলদি বাগদান করে দিলি কেন? বিয়ের কদিন আগেই নাহয় বাগদান করতি। এত তাড়ার কি আছিল? ”
জুনায়েদ একবার স্ত্রীর দিকে তাঁকালেন। আভার মা নির্দ্বিধায় ভাত খাচ্ছেন। যেন এই ব্যাপারে তার মত প্রকাশের কোনো ইচ্ছাই নেই। এই বাগদান নিয়ে মেয়ের বাবারই তো যত তাড়াহুড়ো ছিলো। সময় থাকতেই মেয়ে পর হয়ে যাচ্ছে, আভার মা এসব ভেবেই নিজের স্বামীর উপর রেগে যেতে লাগলেন। জুনায়েদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
— ” আহনাফের পরিবার খুব তাগাদা দিচ্ছিলো। তাই বাগদান করিয়ে রেখেছি। সময় আসলে বিয়ের কথাটাও পাঁকা হবে। মেয়ে আমার এখনো ছোট, আম্মা। ”
দাদুমনির নজর এবার মিনহাজের উপর পড়লো। মিনহাজকে শান্ত থাকতে দেখে দাদুমনি এবার কথা তুললেন,
— ” মেয়ের নাহয় বিয়ের বয়স হয়নি। তা ছেলেরও কি বয়স হয়নি? মিনহাজের তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে। ওরে বিয়ে দিবি কবে? ”
দাদুমনির কথা শুনে মিনহাজের হেঁচকি উঠে গেলো। নাকে মুখে পানি উঠে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেলো তার। আভা তাড়াহুড়ো করে মিনহাজের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। মিনহাজ চকিতে ছুঁ মেরে আভার থেকে পানি নিয়ে এক ঢোকে সমস্ত পানি খেয়ে নিলো। মিনহাজের ওমন অদ্ভুত আচরনে টেবিলে বসে থাকা সবাই হতবম্ব। তবে,জুনায়েদ ছেলের এহেন আচরনেও স্বাভাবিক হয়ে বসে রইলেন। মিনহাজার বিয়ের কথা মায়ের আগে তার মাথায় এসেছিলো। ছেলের সামনে বিয়ের কথা তুলেছেন বটে। তবে ছেলে তার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
‘ বিয়ে ‘ বিষয়টা মনঘটিত ব্যাপার। তাই এই বিষয়টি জুনায়েদ ছেলে-মেয়ে কারো উপরই চাপিয়ে দেননি। বাবা হিসেবে তারও সন্তানের খুশির দিকটা খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়।
দাদুমনি মিনহাজের এমন আচরণে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন না। বরং ধীরে সুস্থে জিজ্ঞেস করলেন,
— ” দাদু, তোমার কোনো মেয়ে পছন্দ আছে? থাকলে আমারে বলতে পারো। আমাদের তোমার পছন্দের উপর পুরা সমর্থন আছে। ”
মিনহাজ মাথা নিচু করে আরো এক ঢোক পানি খেলো। মা-বাবার, বোন, দাদুর সামনে নিজের বিয়ের কথা বলতে আড়ষ্টভাব কাজ করছে তার। তবুও বলতে হবে। কারণ, সে একজন প্রেমিক। প্রেমিকার খুশির দিকটাও তাকে বিবেচনা করতে হয়। আর তার প্রেমিকা যে তার সান্নিধ্যেই নিজেকে সবচেয়ে বেশি সুখী মনে করে,সেটা সে হলপ করে বলতে পারে।
— ” দাদু, আছে কোনো পছন্দের মেয়ে? বলো? ”
দাদুমনির কথায় মিনহাজ একটু থেমে নিজেকে ধাতস্থ করলো। ভারী নিঃশ্বাসের বহর ত্যাগ করে বললো,
— ” পছন্দের কিনা সেটা বলতে পারিনা। তবে একজনকে ভীষন ভালোবাসি। বিয়ে করলে তাকেই করবো।”
#চলবে
খুব বড় করে দিয়েছি আজ। ১২০০+ শব্দ। ভাবা যায়!
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/231119505599284/?app=fbl