#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
‘ শোনো মেয়ে, আজ আমার পছন্দের রঙে সাজো তো! হোটেলের বাইরে তোমার জন্যে গাড়ি রাখা। আমিময় হয়ে টুপ করে সে গাড়িতে উঠে পড়বে। অ্যাই অ্যাম ওয়েটিং! ‘
বেডের উপর রাখা এমন চিরকুট দেখে আভা হতবাক। আজ আভার সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ছিলো আহনাফকে। কিন্তু, আহনাফ কি করতে চাইছেন? আভা বুঝতে পারছে না। তবে, আভা আর কালবিলম্ব করলো না। সেদিনের আহনাফের পাঠানো কালো রঙের জামদানি, কালো কাঁচের চুড়ি পড়লো। চুলগুলো একটু স্ট্রেট করে ছেড়ে দিলো। ঠোঁটে দিলো, খয়েরী লিপস্টিক! আভা রেডি হয়ে আয়নার দিকে তাকালো। ইশ! ভালোই লাগছে। আহনাফের চয়েজ আছে, বলতে হবে। আভা রেডি হয়ে নিচে নামলো।
নিচে এক গাড়ি রাখা। সাদা গাড়ি কালো রঙের গোলাপে সাজানো। খুব মোহনীয় লাগছে দেখতে। আভা মুচকি হেসে গাড়িতে উঠলো।
গাড়ি থামলো সমুদ্রের কিছুটা দূরে। আভা চারপাশে তাকালো। এখন রাত! তাই, চতুর্দিকে রাতের কালো রঙে ঢাকা। কি অদ্ভুত! আজ আভাও কালো রঙে সেজেছে। আভা গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। হাঁটা ধরবে সামনে, তার আগেই এক মেয়ে এসে থামালো আভাকে। মেয়েটা অত্যন্ত বিনয়ের সহিত বললো,
— ” ম্যাম, স্যারের অর্ডার অনুযায়ী আপনাকে চোখে কাপড় বেধে দিতে হবে। ক্যান আই? ”
আভা কিছুটা অবাক হলেও দিরুক্তি করলো না। বরং, হেসে সম্মতি দিলো। মেয়েটা এক কালো রঙের কাপড় বেধে দিলো আভার চোখে। অতঃপর, আভার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো সামনে।
— ” আমরা পৌঁছে গেছি, ম্যাম। আর ইউ রেডী টু সি? ”
আভা হেসে মাথা নাড়লো। একটু পর হাতের ছোঁয়া পেল আভার মাথার পিছনে। হাতের ছোঁয়া খুব গভীর, স্নিগ্ধ! আভা জানে এটা কার হাত। আভার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। মানুষটা আভার চোখের কাপড় খুলে দিলো। আভা তাকালো ধীরে ধীরে।
আভা অবাক! যতটা অবাক হলে, দুনিয়া ভুলে যাওয়া যায় ততটাই অবাক আভা। আভার সামনে রাখা অসংখ্য মোমবাতি। সমুদ্রের তীরে যেনো আজ মোমবাতির রাজত্ব! আভার সামনে মোমবাতির দিয়ে লেখা ‘ AVANAF ‘। আভা খুশিতে একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো। চমকে তাকালো পাশের মানুষটার দিকে। আহনাফ হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আভার দিকে। আভা কাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” এসব আমার জন্যে? ”
আহনাফ আভার গাল টেনে দিয়ে হেসে বললো,
— ” উহু, আমাদের জন্যে! ”
আভা হেসে ফেললো। আহনাফ আভার এক হাত নিজের হাতর মুঠোয় পুড়ল। আভা সেদিকে তাকালে আহনাফ বললো,
— ” আরো বাকি, ম্যাডাম। এখনই এত অবাক হলে চলে? চলুন, সামনে যাওয়া যাক! ”
আভা হেসে পা বাড়ালো আহনাফের সাথে।
আভা ও আহনাফ এসে থামলো এক জায়গায়। সে জায়গায় শুধু লাভ শেপের অনেকগুলো বেলুন। আভা অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকালে আহনাফ বললো,
— ” কোথাও যেন শুনেছি, বেলুন ফোটানো তোমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ। সো, হেয়ার ইউ গো! ”
আভা একপলক আহনাফের দিকে তাকালো। চোখে জল জমছে তার। মানুষটা এত ভালো কেনো? আহনাফ আভার চোখে জল দেখে আঙ্গুল দিয়ে খুব যত্নসহকারে জল মুছে দিলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— ” আজ কোনো কান্না না। ওনলি এই মোমেন্টটাকে এনজয় করো। ”
আভা আহনাফের চোখের দিকে খানিক তাকালো। কিন্তু, সবসময়ের মত এবারও আহনাফের ওমন নেশালো চোখে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরালো। এগিয়ে গেলো সামনে।
ঠুস, ঠুস, ঠুস। বেলুন ফুটানোর আওয়াজে মুখরিত সমুদ্রের তীর। আহনাফ দুর থেকে আভার একেকটা উচ্ছল কাজ দেখছে। আজ ও নিজেও অনেক খুশি। একসময় আভা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো মাটিতে। আহনাফ এগিয়ে গেলো। নিজেও আভার মাটিতে বসলো না। সোজা শুয়ে পড়লো। সমুদ্রের তীরের মাটি একদম ঠান্ডা। আর রাতের বেলায় তো হিম জমে। আহনাফকে শুইয়ে থাকতে দেখে আভা নিজেও শুয়ে পড়লো আহনাফের পাশে। আহনাফ আকাশের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
— ” আজ আমাবস্যার রাত, জানো? ”
আভা মাথা নাড়লো। যার অর্থ, জানে সে। আহনাফ ঘাড় হালকা কাত করে আভার দিকে তাকালো। আভার দিকে মোহময় চোখে চেয়ে বলল,
— ” আজ আকাশের রংও কালো, রাতের রঙও কালো।আর আমার পাশে আমার কালো হুরপরী। এর চেয়ে বেস্ট ফিলিংস আর হতেই পারে না। ”
আভা লজ্জা পেলো। আহনাফ আবারও আকাশের দিকে তাকালো। আভা কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারে না। বারবার, সংকোচরা তাকে আটকে নেয়। কিন্তু না। এবার ও বলবেই। মনের কথা বলতে লজ্জা কিসের? আভা আকাশের দিকে তাকালো। সমস্ত সংকোচ, জড়তার সুতো ছিন্নভিন্ন করে নরম কণ্ঠে বলল,
— ” একটা কথা বলি।
— ” হুম, বলো। ”
আভা এক ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। আহনাফের দিকে ফিরে তাকালো। আহনাফ নিজেও আভার দিকে তাকালে আভা বলে উঠলো,
— ” ভা.ভা.ভালোবাসি আপনাকে। ”
আহনাফের কানে আভার বলা কথাটা প্রবেশ করতেই সে যেন হাজার ভোল্টেজে কেপে উঠলো। তার কান ঠিক শুনলো তো? আহনাফ চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। নিস্পলক চোখে চেয়ে আছে আভার দিকে। আভা আহনাফের ওমন তাকানো দেখে চোখ নামালো। আহনাফের বিস্ময়ভরা চাওনি তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আহনাফ একলাফে উঠে বসলো। কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আরেকবার বলো ত? ”
আভা আরো একবার বলল,
— ” ভা.ভালোবাসি! ”
— ” ওয়ান্স মোর, প্লিজ! ”
— ” অ্যাই লাভ ইউ, মিস্টার রাগিনাফ! ”
আভার কণ্ঠ এবার আর কাঁপলো না। ভালোবাসার মানুষকে নিজের অনুভূতি জানাতে এত সংকোচ কিসের? নাহ! কোনো সংকোচ থাকতে নেই। আহনাফের চোখ থেকে এখনো অবাকের রেশ দুর হয়নি। আজ সে স্বার্থক! তার বউফ্রেন্ড তাকে ভালবাসি বলেছে, আর কি চাই তার? আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। আহনাফকে দাঁড়াতে দেখে আভা নিজেও দাঁড়ালো।
আহনাফ সমুদ্রে নামলো। হাঁটু অব্দি পা ভিজিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আভা এখনো আহনাফের এমন অদ্ভুত কাজের কারন বুঝতে পারছে না। বোকার মত তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। আহনাফ আকাশের দিকে চেয়ে আভার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” থ্যাংক ইউ, বউফ্রেন্ড! আমার জীবনে আসার জন্যে। থ্যাঙ্ক ইউ, ফর লাভিং মি। অ্যান্ড থ্যাংক ইউ ফরেভার, ফর বিং উইথ মি হামেশা, হামেশা! ”
আভা হাসলো। পাগল একটা!
সমুদ্রের পানি দুজনের হাঁটু অব্দি ভাসমান। হঠাৎ আহনাফ আভার দিকে তাকালো। তার চোখে যেনো আকাশ সমান আদর! আভা ডুবে যাচ্ছে আহনাফের ওমন চাওনিতে। তবুও, অন্যদিনের মত চোখ সরালো না। তাকিয়েই রইলো! আহনাফ আভাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আভা কেঁপে উঠলো খানিক। আহনাফ বললো,
— ” আকাশের দিকে তাকাও আর আমার কথা শুনো।মন দিয়ে শুনবে। ”
আভা মাথা নেড়ে সায় দিলো। আহনার বলতে শুরু করলো,
— ” জানো, আমি সবসময় ভালোবাসা মানে বুঝতাম, শুধুমাত্র মা-বাবার ভালোবাসা। আর সব ভালোবাসা আমার কাছে মিথ্যে, স্বার্থের ছিলো। কিন্তু, তোমাকে দেখার পর আমার সেসব চিন্তা নির্মূল হয়ে গেলো। বারবার মনে হচ্ছিল, এই মেয়েকে নিজের সাথেই না বাঁধতে পারলে আমি নিঃশেষ! আমার ধংস নিশ্চিত। আজ দেখো, তুমি আমার সামনে। আমার একান্ত নারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছো। বিয়ের জন্যে অবশ্য আরো তিন বছর বাকি আছে। তবুও আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, উইল ইউ ম্যারি মি, মিস বউফ্রেন্ড?”
আভা বিয়ের কথা শুনে হেসে উঠলো। খিলখিলিয়ে হাসি। আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
— ” আপনি আমার আসক্তি, মিস্টার রাগিনাফ। আর আসক্তিকে কখনোই দূরে রাখতে নেই। ভয় হয় যে। তাই কাছে রাখার জন্যে বিয়ে ত করতেই হবে। তাইনা? ”
আভার উত্তর শুনে আহনাফের মনটা খুশিতে যেনো নেচে উঠলো।
— ” সরি ফর ডিস্ট্রাবিং, গাইস! ”
পিছন থেকে নুহাশের কথা শুনে আভা এক ছিটকে আহনাফের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। আহনাফ নিজেও এতে বিরক্ত হলো। নুহাশ এগিয়ে এলো ওদের দিকে।
আহনাফ রাগ নিয়ে বললো,
— ” তুই এখানে? ”
নুহাশ উত্তর করলো,
— ” তোর একবারও মনে হয়নি যে সবকিছু এত সহজ কি করে হয়ে যাচ্ছে? মানে তুই কি করে এত সহজে আভাকে পেয়ে গেলি, হাও ইজ ইট পসিবল? ”
আহনাফ আভার দিকে তাকালো। আভা প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে নুহাশের দিকে। আহনাফ বললো,
— ” আভা সবসময় আমারই ছিলো। তাই ভয় পাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। গেট ইট? ”
— ” আভা তোরই ছিল, সেটাই তোর জন্যে প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু এসবের মাঝখানে একটা টুইস্ট আছে, বস। ”
— ” মানে? ”
— ” আমি এত সহজে হার মানার ছেলে নই সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। কিন্তু, আমি নিজে থেকেই তোদের থেকে দূরে সরে গেছি, আহনাফ। ”
— ” যা বলবি সোজাসুজি বল। টাইম ওয়েস্ট করিস না আমার। ”
নুহাশ এক নিঃশ্বাস ফেললো। ভারী নিঃশ্বাস! অতঃপর আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
— ” ওয়ান্স অপন অ্যা টাইম, আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। কিন্তু আমার হিংসা, আর জেদ আমাদের দুজনকে শত্রু বামনিয়ে ফেললো। তুই আমার সাথে শত্রুর মত ব্যাবহার করলেও আমি সেদিন জানলাম আমি তোর জন্যে কি ছিলাম। মনে আছে সেই রাতের পার্টির কথা। নিউ ইয়ারের পার্টি? সেদিন তোর সামনে আমার নামে কজন খারাপ কথা বলেছিল। আমি তখন ছিলাম না ঠিকই। কিন্তু তুই? তুই ওদের কি বলেছিলি, ‘ ও আমার শত্রু ঠিকই, কিন্তু আমি আগে যেমন আছে ওর নামে কোনো বাজে কথা সহ্য করিনি, এবারও করবো না। বেস্ট ফ্রেন্ড হয় ও আমার। ফারদার, ওকে অপমান করে কথা বললে তোদের জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। ‘ বিশ্বাস কর দোস্ত! আমি নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারিনি। আমারই দোষ ছিল। তোকে চিনতে পারি নি। তাই প্রতিদান স্বরূপ, আভার পিছু আমি ছেড়ে দিয়েছি। যা, আভাকে নিয়ে জমিয়ে প্রেম কর। বেস্ট অফ লাক, বোথ অফ ইউ! ”
এতক্ষণ এত সব কথা শুনে আভা হতবাক। ওর পিছন পিছন এত কিছু হয়ে গেছে, আর সেটা ও জানেই না। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নুহাশের দিকে। নুহাশ চোখের জল আঙ্গুল দিয়ে মুছে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” ওকে, বাই দেন। এনজয়! ”
নুহাশ পা বাড়ালো সামনে।
— ” নুহাশ? ”
হঠাৎ পিছন থেকে আহনাফের কণ্ঠ শুনে নুহাশ থেমে গেলো। আহনাফ দৌঁড়ে গেলো নুহাশের দিকে। নুহাশ ভ্রু কুচকে আহনাফের দিকে তাকালে আহনাফ আচমকা জড়িয়ে ধরলো নুহাশকে। নুহাশ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। একসময় আহনাফ বললো,
— ” সরি রে! ”
এক শব্দ শুনে নুহাশের কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল। মুচকি হেসে নিজেও জড়িয়ে ধরলো আহনাফকে। বললো,
— ” আমিও ডাবল, ট্রিপল সরি। ”
দূর থেকে দুজন বন্ধুর এমন মিলন দেখে নিজের অজান্তেই আভার চোখ ভিজে এলো। তবে, সে আঙ্গুল দিয়ে জলটুকু মুছে নিয়ে ঝাপসা চোখে তাকালো ওদের দিকে। সব বন্ধুত্ব চির অম্লান থাকুক, আজীবন সজীব থাকুক। আমিন!
#চলবে
এক ধামাকা পর্ব চান? এই পর্বে যদি বিশাল বিশাল কমেন্ট আসে, তাহলে আজকে একটা ধামাকা পর্ব দিব, ইন শা আল্লাহ!
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/247688327275735/?app=fbl