ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-১৭

0
2701

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

হোটেলের রিসিপশনের দাঁড়িয়ে আছে জুভান আর ওর বন্ধু তীর্থ। তীর্থ বান্দরবানের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় ওদের গাইড করতে পারবে। জুভান তাই ওকে ওদের সাথে নিয়েছে। ওরা দুজন নিচে অপেক্ষা করছে ঐশীর জন্যে।

একটু পর ঐশী তাড়া নিয়ে নিচে নামলো। পরনে একটা বাদামী স্কার্ট আর কালো টপস। ঐশী বরাবরের মতন সাইড ব্যাগ আকড়ে ধরে জুভানদের কাছে এসে দাঁড়ালো। জুভান একটু দূরে ফোনে কথা বলছিল। ঐশীকে আসতে দেখে ফোন কেটে ঐশীর পাশে এসে দাড়ালো। ভ্রু কুঁচকে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবারও ঐশীর দিকে তাকালো। ভ্রু আড়াআড়ি বাঁকিয়ে বললো

” পাক্কা আধ ঘণ্টা লেট। নাও , টেল মি দা রিজন। ”

ঐশী কিছুটা মিহি সুরে বলল,

” শাওয়ার নিয়েছিলাম , না ? চুল ভিজে ছিল। তাই হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে রেডি হয়ে এসেছি। তাই বোধহয়…”

” লেটস গো। ”

ঐশীকে মাঝপথে থামিয়ে বললো জুভান। তীর্থ ঐশীকে দেখে যাচ্ছে সেই কতক্ষণ ধরে। এত সুন্দর মেয়ে হয় ? সাক্ষাৎ প্রতিমার মত। তীর্থ মুগ্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে রইলো ঐশীর দিকে। জুভান ওদেরকে আসতে বলে আগে আগে হাঁটা ধরলো সামনে। একটু পর তীর্থ আর ঐশী জুভানের সাথেসাথে হাঁটা শুরু করলো।

_____________________

জীপ চলছে আপন গতিতে। বান্দরবানে বাতাসটা যেনো সজীবতায় ঘেরা। জুভান ফোন উচু করে ভিডিও করতে মগ্ন। তীর্থ ড্রাইভ করছে। আর ঐশী আঁকাবাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসের ঝাপটায় তার চুল উড়ছে এলোমেলো , অগোছালোভাবে। জুভান ভিডিও করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,

” তীর্থ , এখান থেকে থানচি যেতে কতক্ষণ লাগবে ? ”

তীর্থ গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,

” নরমালি তো বান্দরবান থেকে থানচি যেতে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগে। কিন্তু তোদের হোটেল তো কাছে ছিল । তাই আনুমানিক দুই ঘণ্টা লাগবে। ”

জুভান মাথা হেলালো। ফোনের ভিডিও অফ করে পকেটে পুড়ে নিল। সিটে মাথা হেলিয়ে ডান পাশের রাস্তায় তাকালো। ধু ধু বাতাসে জুভানের সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর লেপ্টে যাচ্ছে। জুভান একসময় হাত দিয়ে চুলগুলো পিছন দিকে ঠেলে দিল।

হঠাৎ এই বাতাসের ঝাপটায় ঐশীর চুল তার অজান্তেই জুভানের মুখে ছিটকে পড়লো।আবার সেই মোহনীয় ঘ্রাণ ! সেই মাতাল করা সুগন্ধ। জুভান চোখ বুজে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চুলের কারণে নাকে সুরুসুরি লাগলো। সঙ্গেসঙ্গে জুভান টানা দু একটা হাঁচি দিল।

জুভানের হাঁচির শব্দে ঐশী স্তম্ভিত ফিরে পেলো। চুল সামলে জুভানের দিকে ফিরে তাকালো। জুভান আরো গুটিকয়েক হাচি দিয়ে নাক মুছে ঐশীর দিকে তাকালো। কিছুটা কড়া গলায় বললো,

” চুল সাবধানে রাখো। মানুষকে জ্বালাচ্ছে তোমার এই বাঁশের মত চুল। ডিসগাস্টিং। ”

কথাটা বলে জুভান আরো একবার হাঁচি দিল। জুভানের হাঁচির শব্দে ঐশীর কেনো যেনো হাঁসি পেলো। ফিক করে হেঁসে দিতেই জুভান ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। সঙ্গেসঙ্গে ঐশী চুপ। লম্বা চুলগুলো সামলে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে আবারও রাস্তার দিকে তাকালো।

থানচি পৌঁছে গেছে ওরা। এখন আর জীপ কাজে লাগবে না। এখন নৌকা দিয়ে এখানকার সাঙ্গু নদী পাড় হতে হবে। এখানকার একজন গাইডকে বলে ওরা একটা নৌকা ভাড়া করলো।
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ঐশীর বেলায়। নৌকার কথা শুনে ঐশী ভয়ে ক্ষয়। যাই হয়ে যাক সে নৌকাতে উঠবে না। কোনো ক্রমেই না। জুভানের বিরক্ত লাগলো। ঐশীর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বললো,

” ওকে। ফাইন। তুমি এখানে একা একা বসে থাকো। আমরা সব ঘুড়ে সন্ধ্যার দিকে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো। ট্রাস্ট মি, ইউ আর জাস্ট আনবিলিভেবল। ”

ঐশীর রাগ লাগছে। নিজেকে অসহায় থেকে অসহায় মনে হচ্ছে। একা একা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে বসে থাকবে। ইমপসিবল। জুভান ঐশীর দিকে তাকিয়ে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ঐশীকে একা রেখেই নৌকাতে চরে বসলো। তীর্থ জুভানের এই ভয়ঙ্কর রাগ সম্বন্ধে খুব ভালোই অবগত। তাই সে মুচকি হেসে ঐশীর পাশে এসে দাড়ালো। আশ্বস্তের সুরে বললো,

” দেখো ঐশী , একটা নৌকাই তো। এতো ভয় পাবার কি আছে ? আমাদের সাথে চলো। খুব ভালো লাগবে। ”

ঐশী পানির দিকে একঝলক তাকিয়ে করুন সুরে বললো,

” আমার তো নৌকা নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা ওই পানি নিয়ে। এত পানি। তার উপর আবার এত স্রোত। আমি সাঁতার পারিনা। মরে-টরে গেলে ? ”

তীর্থ হাসলো। ঐশীকে অপেক্ষা করতে বলে এক দৌড়ে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। ঐশী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তীর্থর যাওয়ার পানে।
আর এদিকে জুভান একটু আগের ফোনে তোলা ছবিগুলো দেখছিল। ঐশী আর তীর্থকে একসাথে ফুসুরফুসুর করতে দেখে ভ্রু কুটি করে ওদের দিকে তাকালো। কি এমন কথা বলছে ওরা?

একটু পর তীর্থ হাতে করে তিনটে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে আসলো। ঐশীর দিকে একটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

” নাও ধরো। এই জ্যাকেট সবাইকেই দেওয়া হয় সাঙ্গু নদী পাড় হওয়ার সময়। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিলে। এখন এটা পড়ে নাও। জলদি করো। ”

ঐশী যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তীর্থের কাছ থেকে জ্যাকেট নিয়ে জামার উপরে পড়ে নিল। তীর্থ নিজেও একটা জ্যাকেট পড়ে আরেকটা জ্যাকেট জুভানের দিকে ছুঁড়ে দিলো। জুভান সঙ্গেসঙ্গে ক্যাচ করে নিল। তীর্থ খানিকটা চিৎকার করে বললো,

” ভাইইই , পড়ে নে। ”

জুভান জ্যাকেট টা গায়ে দিতে দিতে আরো একবার ঐশীর দিকে তাকালো। লাইফ জ্যাকেট গায়ে দেওয়ায় হালকা পাতলা ঐশীকে অনেক মোটা লাগছে। জুভান ঐশীর দিকে তাকিয়ে অজান্তেই হেসে দিল। যেনো মনে হচ্ছে সবুজ বাঁশের উপর হলুদের ছন দিয়ে মোড়ানো। ঐশী জুভানকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো। মাস্ক পড়া ছিল বিধায় জুভান হাসছে কিনা সেটা বাইরে থেকে বুঝা যাচ্ছে না। তাই ঐশীও বুঝতে পারলো না।

তীর্থ প্রথমে নৌকাতে উঠলো। ঐশী এগিয়ে গিয়ে নৌকাতে উঠতে গেলে জুভান হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু তার আগেই তীর্থ নিজের হাত বাড়িয়ে ঐশীর হাত স্পর্শ করলো। জুভান হাত গুটিয়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে ওদের দিকে তাকালো। কেনো তাকালো সে নিজেও জানেনা । ঐশী এসব ভ্রুক্ষেপ না করে তীর্থর হাত ধরে নৌকাতে উঠে বসলো।

নৌকা চলছে নদীর অঙ্গজুড়ে। নৌকায় ওরা সহ আরো একজন কাপল আছে। একে অপরের সাথে ফিসফিস করছে আর আশপাশে বারবার তাকাচ্ছে। এদিকে ঐশী একপাশে বসে আছে হাঁটু গেরে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে পানিতে হাত দিতে। কিন্তু ভয়ের চোটে হাত দেওয়া তো দূরে থাক নৌকার পাশ গেসেও বসছে না। যদি পড়ে যায় !

তীর্থ নৌকায় গা এলিয়ে হেডফোন দিয়ে ফোনে গান শুনছে। এসব ভ্রমন-ট্রমন খুব স্বাভাবিক ওর জন্যে। প্রায় অনেকবার এসেছে এইজায়গায়। চুষে খেয়েছে বান্দরবানের প্রতিটা এলাকা। তাই এসব দেখে খুব বেশি মোহিত হলো না সে। তবে জুভান নৌকায় বসে ভিডিও করছে।

একসময় তীর্থ চোখ খুলে ঐশীর দিকে তাকালো। কেনো জানেনা ঐশীর হাবভাব সে খুব সহজেই বুঝে গেলো। নিজের জায়গা ছেড়ে ঐশীর পাশে এসে বসলো। ঐশী পানির দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। হঠাৎ তীর্থ বললো,

” পানিতে হাত ভেজাবে ? ”

ঐশী মন খারাপ করে বললো,

” যদি নৌকা ডুবে যায় ? ”

তীর্থ হেসে বলল,

” সে চিন্তা তোমায় করতে হবে না। চলো। হাত দাও। ”

ঐশী বসে রইলো। ভয় কাটে নি তার। তাই হাত দিল না ঠান্ডা পানির স্রোতে। তীর্থ আবার বললো,

” আমি আছি না। হাত দাও। ডুববে না নৌকা। দাও। ”

ঐশী মাথা হেলিয়ে খুব সন্তর্পনে পানিতে হাত দিল। সাথেসাথেই শিউরে উঠলো ও। এত ভালো লাগছে ! বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐশী পানিতে হাত দিয়ে থমকে বসে রইলো। পানির ফোঁটা ছিটকে পড়ছে ওর শরীরে। ঐশী আলতো হাতে পানির মাঝে হাত ডুবিয়ে রেখেছে। ঠাণ্ডা পানির জন্যে হাত যেনো কাটা যাচ্ছে। তবুও ভালো লাগছে। খুব , খুব ভালো লাগছে ওর। তীর্থ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো ঐশীর দিকে। একটু পর জিজ্ঞেস করলো,

” ভালো লাগছে ? ”

সঙ্গেসঙ্গে ঐশী উত্তর দিলো,

” খুব ভালো লাগছে। অসম্ভব ভালো লাগছে। কিন্তু পানি ঠান্ডা অনেক। হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। ”

” এই নদীর পানি ঠান্ডাই। গরম কালেও খুব ঠাণ্ডা থাকে। একটুসময় হাত দিয়ে রাখো। সয়ে যাবে। ”

ঐশী সব শুনে পানিতে আরো বেশি করে ডুবিয়ে দিলো নিজের হাত।

ওদের এই কথাবার্তা দেখে মাঝি হুট করেই বলে উঠলো,

” আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী ? ”

ঐশী থমকে গেলো। সাথে চমকালো আরো দুটো চোখ। জুভান ফোন থেকে চোখ তুলে ভ্রু কুচকে তাকালো ওদের দিকে। ঐশী তীব্র অস্বস্তিতে পানি থেকে হাত উঠিয়ে নিল। তীর্থ পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে গলা কেশে বললো,

” না চাচা। আমরা শুধু ফ্রেন্ড। তাছাড়া কিছু নই। ”

#চলবে

শব্দসংখ্যা – ১১০০+

জীবনে কখনোই বান্দরবান বেড়াতে যাইনি। গল্পের সুবাদে লিখতে হচ্ছে। কোনো কিছু ভুল লিখে থাকলে আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here