#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
নৌকো জুড়ে পিনপতন নিরবতা। মাঝেমধ্যে নদীর পানির তীব্র গর্জন কানে আসছে। ঐশী একপাশে বসে আছে। পূর্বের অস্বস্থি এখন অনেকটাই কমে এসেছে। নদীর এই রূপায়ণ দেখে কখনো কি মন খারাপ করে থাকা যায়?
জুভান ফোন হাতে নিয়ে পাশে বসে থাকা তীর্থকে মেসেজ করলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মেসেজ সেন্ড হলো না। বারবার নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখাচ্ছে। জোরে কথা বলাও যাবে না। ঐশী আছে। তাই শেষ পর্যন্ত জুভান হাল ছেড়ে দিয়ে নোটপ্যাড টাইপ করলো,
” কি ব্যাপার ব্রো , ওই মেয়েকে অনেক কেয়ার করছো ? সামথিং ইজ ফিশি, ফিশি । ”
তীর্থ ফোনে গান শুনছিল। জুভান তীর্থর হাতে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। তীর্থ চেতে উঠলো। কান থেকে হেডফোন খুলে জুভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” আরে। মাইয়াদের মতন গুতাস কিয়ের ল্যায়? ”
জুভান শুনে দু ভ্রুয়ের মাঝে ভাজ ফেলে তীর্থর দিকে তাকালো। তীর্থ নিভে এলো। মুখখানা নিষ্পাপ করে বললো,
” ভাই আমার। বল কি বলবি। তোর সব কথা শুনতে এই বান্দা সর্বদা হাজির। ”
জুভান নোটপ্যাডে লেখা তীর্থর চোখের সামনে মেলে ধরলো। তীর্থ লেখাটা পড়ে ভ্রু কুচকে তাকালো। জুভানের চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি। তীর্থ মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস নিল। তারপর জুভানের দিকে তাকিয়ে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
” শি স্টোল মাই হার্ট , ম্যান। ”
জুভান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকালো। সে জানতো এমনই হবে। জুভান আবারও নোটপ্যাডে লিখলো,
” ডাফার ,মেয়েটা মুসলিম। তুই হিন্দু। কিভাবে কি ? ”
তীর্থ লেখা দেখে নিজের ফোনের নোটপ্যাডে লিখলো,
” ইটস লাভ , ব্রো। লাভ। ”
জুভান তীক্ষ্ম চোখে ফোনে লিখলো,
” ইটস বুলশিট , ব্রো। বুলশিট। ”
তীর্থ অসহায় চোখে চেয়ে রইলো জুভানের ফোনের নোটপ্যাডের দিকে।
সাঙ্গু নদীর কিছুটা দূরে এসেছে নৌকা। এবার নদীটা ঢালু হয়ে এসেছে । ঐশী ঢোক গিলে তাকালো ঢালু হয়ে নেমে আসা নদীর স্রোতের দিকে। নৌকা ঢালু বেয়ে উঠতেই ঐশী জোরে বলে উঠলো,
” সাবধানে। ”
ঐশীর চিৎকার শুনে নৌকার বাকি সদস্য ওর দিকে বিরক্তি চোখে তাকালো। মাঝি হেসে বললো,
” ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এই নদী এমনই। জীবনের মত এই নদীরও অনেক চড়াই-উৎরাই আছে। ”
ঐশী তাকালো মাঝির দিকে। মুখে স্মিত হাসি নিয়েই নৌকা চালিয়ে যাচ্ছে। যেনো একজীবনে এই মানুষের মত সুখী দ্বিতীয় কেউ নেই। এত সুখ ! ঐশী চেয়ে রইলো ওই ফোকলা দাঁতের হাসির পানে। এক টুকরো খুশি উপচে পড়া হাসি।
নৌকা ঢালু বেয়ে উঠছে। আর ঐশী নিজের জামা খামচে বসে আছে নিজের জায়গায়। জুভান ব্যাপারটা লক্ষ করলো। ঐশীকে স্বাভাবিক করতে এগিয়ে যেতেই তীর্থ উঠে গিয়ে বসলো ঐশীর পাশে। জুভান থমকালো। তীর্থর এসব যত্ন আত্তি সে আর নিতে পারছে না। কিন্তু , কিন্তু কেনো পারছে না ? খুব স্বাভাবিক ব্যাপারকে সে কেনো অস্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে ? জুভান আপনমনে প্রশ্ন করে উত্তরের ঘটে এক আকাশ শূন্যতা পেলো।
তীর্থ ঐশীর পাশে বসলো। ঐশী তীর্থর দিকে তাকিয়ে বললো,
” খুব ঢালু , তাইনা ? ”
তীর্থ দুপাশের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
” একদমই না। বরং খুব মোহময়। ”
ঐশী প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো। তীর্থ পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
” সব ভয় কাটিয়ে দাও। মন খুলে শুধু এই জায়গাটাতে মত্ত হও। দেখবে সব ভুলে গেছো। কোথায় আছো, কেমন আছো , কি করছো সব ভুলে যাবে এক পলকে। একবার শুধু দুর দৃষ্টি দাও। খুব দূরে তাকাও। দৃষ্টি সীমার বাইরে। ”
ঐশী কোনো প্রত্যুত্তর না করে সামনে তাকালো। সঙ্গেসঙ্গে মুগ্ধতা ওর দুচোখে ভর করলো। নদীর পাশে জুড়ে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। যেনো এক গুচ্ছ সবুজ রঙ শিল্পী ক্যানভাসে আকা। ঐশী হাত বাড়িয়ে ছুতে চাইলো। তবে ছুতে পারলো না। কিন্তু অনুভব করলো অসম্ভব প্রাণ জড়ানো মুগ্ধতা। তীর্থ পাশ থেকে বললো,
” ভালো লাগছে ? ”
মুগ্ধ ঐশী জবাব দিল,
” উফ ! এত সুন্দর ! আমি এসব দেখে ভালো লাগায় মারা যাচ্ছি। ”
তীর্থ হাসলো। ঐশী আবারও বললো,
” মনে হচ্ছে , মনে হচ্ছে এগুলো পাহাড় না। মেঘে ভাসমান সবুজ তুলো। দেখুন, দেখুন পাহাড় গুলো মেঘ ছুঁয়েছে। দেখতে পারছেন ? ”
” পাহাড়গুলো মেঘ ছুঁয়নি। বরং মেঘের নিচে থাকায় দুর থেকে মনে হচ্ছে এগুলো মেঘের সাথে মিশে গেছে। ”
ঐশী চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। পলক ফেলতে ভুলে গেছে ও। মনে হচ্ছে একটা পলক ফেললে এক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য এই অপরূপ সৌন্দর্য মিস করবে। কিন্তু ঐশী দেখতে চায়। প্রাণ ভরে মিশতে চায় প্রকৃতির এই রূপের ছন্দে। তীর্থ বললো,
” দু চোখ বুজে নাও ঐশী। আরো ভালো লাগবে। ”
সঙ্গেসঙ্গে ঐশী চোখ বুজে নিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিল। ইস! বাতাসটা ওর নাকে ঢুকে গলার কাছে ঠান্ডা পরশ দিতে লাগলো। পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছে। এত ভালো লাগছে কেনো ওর ?
জুভান ঐশীর কাজকর্ম দেখে ওঠে এলো। ঐশীর পাশে বসে বললো,
” এখন যদি একটা জ্যাক থাকতো তোমার পাশে , তাহলে , দা গ্রেট টাইটানিক সিন হয়ে যেত। ব্যাপারটা দারুন না ? ”
জুভান যে ঐশীকে ব্যঙ্গাত্মক গলায় বললো তা দিশেহারা ঐশী বুঝতে না পারলেও তীর্থ বুঝলো। ঐশী মাঝপিঠে বলে উঠলো,
” দরকার নেই কোনো জ্যাক মানবের । আমি একাই দুশো ।”
জুভান শুধু ঐশীর প্রাণ খোলা হাসি দেখলো। এই মেয়েটাকে এত সুখী কখনোই দেখেনি ও। এই জায়গায় এত সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখে সে আর নিজের মাঝে নেই। যদি তীর্থর সামান্য মেহনতের ফলে মেয়েটার মুখে হাসি ফুটে তবে তাই ভালো। তাহলে জুভান কেনো ভিতরে ভিতরে পুড়ছে?
জুভানের ঐশীকে হাসতে দেখে মনের ভিতরে সুখ সুখ লাগে। মনে হয় মেয়েটার মুখে হাসিটা কি অমায়িক ! একদম কৃত্রিমতা নেই ওতে। কিন্তু কেনো মনে হলো এমন ? উত্তর কই?
_____________________
জায়গাটা রেমাক্রী। নৌকা এসে ঠেকেছে তীরে। ঐশী’রা নেমে দাড়িয়েছে।
জুভান আগে আগে হাঁটছে। পিছন পিছন ঐশী আর তীর্থ আসছে। ঐশী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
” ওই যে ঘর দেখা যাচ্ছে , ওগুলো কি ? ”
তীর্থ হাঁটতে হাঁটতে বললো,
” ওগুলো কে মারমা ভাষায় ‘ খুম ‘ বলে। উপজাতিরা থাকে ওখানে। ”
” ‘ খুম ‘ মানে কি ? ”
” জলপ্রপাত। ”
” ওহ। ভালো লাগছে দেখতে। ”
” তুমি জানো আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ? ”
ঐশী নিরুত্তর তাকালো তীর্থর দিকে। তীর্থ জিন্সের পকেটে হাত গুজে বললো,
” নাও , আমরা ” নাফাখুম ” জলপ্রপাত দেখতে যাচ্ছি। ”
” ওয়াও। জলপ্রপাত ? নায়াগ্রার মত ? ”
” না। নায়াগ্রার মতন না। নায়াগ্রা ত খুব বড়। নাফাখুম একটু ছোট সেটা থেকে। ”
” খুব মজা হবে। তাইনা ? ”
” হুম। তাতো অবশ্যই। ”
ঐশী খুশির চোটে আগে আগে হাঁটছে। মনে তর সইছে না। হাঁটতে হবে অনেকখানি। ইশ ! যদি আরো একটু আগে পৌঁছানো যেতো?
ঐশী জুভানের পাশে পাশে পা চালাচ্ছে। জুভান ভিডিও করতে করতে বললো,
” তাহ। তীর্থর সাথে থাকতে খুব ভালোই লাগছে, মিস ঐশী ? ”
জুভানের কথা শুনে ঐশীর উত্তেজনায় ভাটা পড়লো। ভ্রু কুঁচকে জুভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” মানে ? ”
” আমি তো বাংলায় বললাম। বোঝোনি কেনো ? ”
” তীর্থ একজন ভালো মানুষ। অচেনা জায়গা এত সুন্দর করে বিশ্লেষন করছিলেন। তাই আমিও উনার সাথে কথা বলেছি। বাট , আপনি এই কথা বললেন কেনো ? বুঝলাম না আমি। ”
জুভান মাথা নেড়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। ঐশী শুধু চেয়ে রইলো জুভানের দিকে। তবে লোকটার কথার রহস্য ভেদ করতে পারলো না।
তীর্থ এগিয়ে আসলো জুভানের কাছে। একটু হয়রান হয়ে বললো,
” কিছু খাবি না ? সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। এখানে অনেক হোটেল আছে। যাবি ? ”
জুভান মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা পা বাড়ালো ” নাফাখুম ” জলপ্রপাতের পথে। তিন ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছতে হবে সেখানে।
যেতে যেতে ঐশী মাঝপথে থমকে গেলো। ঐশীকে থামতে দেখে ওরা দুজনও থেমে গেলো। ঐশীর কাছে এসে জুভান বললো,
” হোয়াট ? থেমে গেলো কেনো ? দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
ঐশী পা ধরে নাক মুখ কুচকে বললো,
” পায়ে ব্যাথা করছে খুব। ”
জুভান থমথমে গলায় বললো,
” হাঁটলে তো ব্যাথা করবেই। এখন সহ্য করে উঠে দাড়াও। আর আধা ঘণ্টার পথ। ”
ঐশী এবার কান্না পাচ্ছে। কান্না আটকে বললো,
” আমি সত্যি বলছি। খুব ব্যাথা করছে পায়ে। ”
এমনিতেই তীর্থর ঐশীর প্রতি এসব আদিক্ষেতা দেখে জুভান বিরক্ত। তাই ঐশীর উপর সব ঝাঝ ঢালতে জুভান আরো দু এক কথা শুনাতে যাবে তখনই ঐশীর মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেলো। ঐশীর পায়ের কাছে হাঁটু গেরে বসে বললো,
” কোথায় ব্যাথা করছে। দেখাও তো। ”
ঐশী পায়ের এক অংশ দেখিয়ে দিলো। জুভান পায়ে হাত দিতে গেলে ঐশী ঝটকে পা সরিয়ে নিলো। ব্যস্থতা দেখিয়ে বললো,
” পায়ে হাত দিবেন না। ”
জুভান উত্তর করলো না। বরং জোরপূর্বক ঐশীর পা নিজের কাছে টেনে দিল এক মোচড়। ঐশী ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো। পায়ে হাত দিয়ে নাক মুখ কুচকে বললো,
” আপনি খুব খারাপ। খুব খারাপ আপনি। ”
জুভান উঠে দাড়ালো। বাঁকা হেসে বললো,
” আমি জানি আমি মানুষটা ভালো নই। এত ঘটা করে বলতে হবে না। ”
ঐশী হঠাৎ উজ্জ্বল চোখে তাকালো জুভানের দিকে। একটু আগে ব্যাথায় টনটন করা পা এখন ঝরঝরে। একটুও ব্যাথা নেই। ঐশী অবাক হলো। ব্যাথা ভ্যানিশ হলো কি করে ?
#চলবে…
শব্দসংখ্যা – ১২০০+