#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_২১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
বদ্ধ, অন্ধকার রুম। রুমের থাই গ্লাসটায় পর্দা দিয়ে আগলে রাখা। তবুও কোথা থেকে যেনো এক টুকরো আলো উপচে পড়ছে ঐশীর কোলজুড়ে। ঐশী আনমনে তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে। ঝলমল করছে তিনজন মানুষের ছবি। ঐশীর সমগ্র পৃথিবী। ঐশীর বাবা-মা। ঐশী হঠাৎ করে চোখ গেলো নিজের কোলজুড়ে বিস্তৃত আলোর দিকে। সাদা রঙের আলোয় ভরে উঠেছে তার মেয়েলি কোল। ঐশী ফোনটা পাশে রেখে ছুঁয়ে দেখলো সেই আলোর মায়াজাল। সঙ্গেসঙ্গে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা টসটসে জল। ঐশী চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। দাড়ানোর সাথেসাথে কোলে থাকা আলো হারিয়ে গেলো। অতলে, গভীরে। ঐশী ফোন হাতে নিয়ে দাড়ালো জানালার কাছে। রিং বাজছে। আর সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঐশীর বুকের ভিতর থাকা লাল রঙা হার্টের স্পন্দন। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই ঐশী বলে উঠে,
” আমরা কি কাল দেখা করতে পারি , তন্ময়। ”
তন্ময় ঐশীর কথা শুনে অনেক খুশি হলো। তবে তা কণ্ঠে প্রকাশ না করে বললো,
” হ্যাঁ। অবশ্যই। কোথায় দেখা করতে হবে ? ”
ঐশী হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে মৃদু হাসলো। বললো,
” আমি আসবো আপনার ক্যাফেতে। রেডি থাকবেন। ”
” বাহ। ভালো তো। চিন্তা করো না। আমি থাকবো। ”
ঐশী ফোন কেটে দিলো। ফোন বেডের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লো মাটিতে। হাঁটু গেড়ে বসে ঠোঁট চিপে কান্না আটকালো। তবুও কি থামলো সেই অবাধ্য জল ? উহু ! বরং গড়িয়ে পড়ল চিবুক থেকে মাটিতে। ঐশী আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে করে বললো,
” বাবা , তোমার মেয়ের আজ ভয় করছে। বড্ড ভয় করছে , বাবা। মা , কোথায় তুমি ? আমার ভয় লাগছে তো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না ? কোথায় তুমি ,মা ? মাআআ…”
ঐশী চিৎকার করে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো। ঠোঁট ভেঙে কান্না উপচে পড়লো। চোখের নিচে সরু ভাজ পড়লো নোনা পানির আঁচড়ে। একজীবনে কতো দুঃখই না সইতে হলো এই ছোট্ট মেয়েকে ? ইশ!
__________________
ঐশী ধুকধুক মন নিয়ে ক্যাফেতে প্রবেশ করলো। কিন্তু ক্যাফের দরজা খুলতেই ও চমকে গেলো। সম্পূর্ণ ক্যাফে সুসজ্জিত করা নানারকম দামী ফুল আর বেলুন দিয়ে। নিপুণ সাজসজ্জায় কৃত্রিমতায় ঘেরা। ঐশী দেখলো পুরো ক্যাফে ফাঁকা। ঐশী এক ঢোক গিলে এগিয়ে গেলো। সেন্টার টেবিলের যেতেই তন্ময় হুট করেই দাড়িয়ে গেলো ওর সামনে। ঐশী হাসলো। তন্ময় ঐশীর দিকে এক বড় ফুলের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বললো,
” দিস ইজ ফর ইউ, বিউটিফুল লেডি। ”
ঐশী অবাক হওয়ার ভান করে করে ফুলের তোড়া হাতে নিলো। কৃত্রিম খুশি হয়ে বললো,
” থ্যাংক ইউ। এটা খুব সুন্দর। খুব বেশি সুন্দর। ”
তন্ময় মাথা চুলকে লাজুক হাসলো। তন্ময়কে চুপ থাকতে দেখে ঐশী ভ্রু কুচকে বললো,
” কিছু বলবেন ? ”
তন্ময় মাথা নিচু করে পকেট থেকে একটা বক্স বের করলো। বক্সটা ঐশীর দিকে এগিয়ে মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বললো,
” খুলো এটা। ”
ঐশী ফুলের তোড়া একপাশে রেখে বক্সটা হাতে নিলো। বক্স খুলতেই জ্বলজ্বল করে উঠলো একটা হীরার আংটি। ঐশী উত্তেজিত হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
” ওয়াও। এটা আমার জন্যে ? ”
তন্ময় মাথা এদিক ওদিকে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
” হুম। ”
ঐশী ভিতর ভিতর আগুন হলো। তন্ময়কে দেখে ভেংচি দিলো। ন্যাকা ! যেনো লজ্জাবতী লতিকা ! যত্তসব ! ঐশী হেসে বললো,
” দাড়ান। ”
তন্ময় বিনাবাক্যে দাড়িয়ে গেলো। ঐশী বক্সটা ব্যাগে পুড়ে বললো,
” আপনি তো আমায় সারপ্রাইজ দিলেন। এবার আমার পালা। ”
তন্ময় এবার যেনো নেচে উঠলো। এতটা আশা করেনি সে। তন্ময় উত্তেজিত হয়ে বললো,
” তুমি আমায় সারপ্রাইজ দিবে , ভূমি ? ”
ঐশী মাথা নাড়ালো,
” হুম। ”
” তাহলে , চলো। দাড়িয়ে আছে কেনো ? চলো ,চলো। ”
ঐশী তন্ময়কে আটকে দিলো।
” উহু ! এভাবে না। আগে আমি আপনার চোখে কাপড় বেধে দিবো। তারপর যাবো। ”
তন্ময় একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। ঐশী একটা কালো টকটকে কাপড় বেধে দিল তন্ময়ের চোখে। অতঃপর তন্ময়ের হাতের কনুই ধরে এগিয়ে গেলো ক্যাফের বাইরে।
________________
লাল রাজকীয় রিকশা গিয়ে থামলো একটা নিস্তব্ধ গলির কাছে। ঐশী তন্ময়কে নিয়ে নেমে দাড়ালো। তন্ময় ঐশীর হাত ধরে বললো,
” কোথায় নিয়ে এলে , ভূমি ? কাপড় খুলে দেই আমি। ”
ঐশী আতকে উঠলো। সঙ্গেসঙ্গে বললো,
” না, না। এখন না। আমি যখন বলবো তখন খুলবেন। ”
তন্ময় লাজুক হাসলো। ঐশী তন্ময়কে নিয়ে গেলো একটা কালো , অন্ধকার গ্যারেজের ভিতরে। ভিতরে ঢুকেই শাটার আটকে দিলো ঐশী। এবার তন্ময় কিছুটা সন্দেহ হলো। শাটার আটকানোর শব্দ ওর কানে গেলো। তন্ময় জলদি চোখের কাপড় সরিয়ে ফেললো। কিন্তু ! একি ! সব অন্ধকার কেনো ? কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার , নিস্তব্ধ। এমনকি তন্ময় নিজের অঙ্গপ্রতঙ্গও দেখতে পেলো না। তন্ময় ডাক দিলো,
” ভূমি , ভুমি। এই ভূমি ? ”
কোনো উত্তর এলো না। তন্ময়ের ভ্রু কুচকে আবারও কিছু দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু হায় ! সব অন্ধকার। তন্ময় ” ভূমি ” বলে ডাক দিলো। একবার , দুইবার। অতঃপর অসংখ্যবার। কিন্তু কেউ জবাব দিলো না। এবার তন্ময় রেগে বললো,
” ভূমি, এবার তুমি আমার সামনে না এলে আমি কিন্তু গুলি করবো। মাইন্ড ইট। আসো বলছি। কি খেলা খেলছো তুমি ? ভূমি, লাস্ট বার বলছি। আমার সামনে এসে দাড়াও। ভূমি। ”
পাশ থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে উঠলো । কেউ বললো,
” এতুটুকুতেই ভয় পেয়ে গেলে , মিস্টার কিলার ? ”
” কিলার ” শব্দটা শুনে তন্ময় ভরকে গেলো। কণ্ঠ চেনা তার। ভূমির কণ্ঠ। তন্ময় ঘাম মুছে বললো,
” আমি কোনো খুনি নই। তোমার কোনো ভুল হচ্ছে ,ভূমি। ”
পাশ থেকে নিরবতা ভেসে আসলো। তন্ময় আবারও বললো,
” দেখো , ভূমি। ভালো হবে না কিন্তু। আমার সামনে আসো। নাহলে আমি যা দেখাতে চাইছিনা , তাই দেখবে তুমি। ”
হেসে উঠলো কেউ। হৃদয়বিদারক শব্দে প্রতিধ্বনিত হলো সেই হাসি। হঠাৎ একটা দেয়াল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মাল্টিমিডিয়ার আলো এসে সোজা পড়লো তন্ময়ের চোখে। তন্ময় হাত সামনে এনে চোখ ঢাকলো। কিন্তু কারো আওয়াজ শুনে হাত নামিয়ে স্ক্রিনে তাকালো,
” মা , আমি তোমার বাবা বলছি। যখন তুমি এই ভিডিও দেখবে তখন হয়তো আমি এই পৃথিবীতে থাকবো না। কিন্তু তুমি থাকবে। আমি তোমার উপর একটা আঁচও পড়তে দিবো না। একটা আঁচড় না। তোমার মার কাছে আমি প্রমিজ করেছি। জানো , আমাদের প্রেমের বিয়ে ছিলো। তোমার মা সবসময় আমার পেশা নিয়ে চিন্তা করতো। বারবার বলতো আমি যেনো এই পুলিশ পেশা ছেড়ে দেই। কিন্তু আমি ছেড়ে দেইনি। দেশের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে না ? বলো ? একদিন তোমার মা, আমাকে ওয়াদা করতে বলে। আমার পেশা দ্বারা কখনোই তোমার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়। আমিও ওয়াদা করেছি। তাই আজ তুমি জীবিত আছো। আমি এখন চারজন মানুষরুপি কাপুরুষের ছবি দেখাবো। তারা আজ তোমার এই অবস্থার জন্যে দায়ী। মা শুনো , তাদের ছবিগুলো তুমি কখনোই ভুলবে না। কখনোই না। ”
অতঃপর স্ক্রিনে দেখালো তন্ময়ের এক হাস্যোজ্বল ছবি। তন্ময় ঘামতে লাগলো। এই সেই পুলিশ। যাকে ওরা সবাই মিলে আগুন পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে। তার মানে ভূমি সেই পুলিশের মেয়ে ? কিন্তু পুলিশের মেয়ের নাম টি ঐশী ছিল ? তাহলে এ কে ? স্ক্রিনের আলোতে তন্ময় বুদ্ধি করে ঐশীকে খুঁজতে যেতেই স্ক্রিন বন্ধ হয়ে গেলো।আবার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো। তন্ময় হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যেতে লাগলো ঐশীর দিকে। কিন্তু তার আগেই ঐশী জলদি তন্ময়ের হাতে পুষ করে দিলো একটা ইনজেকশন। তন্ময় ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে জ্ঞান হারালো। ঐশী এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। গ্যারাজের চারপাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হতে লাগলো। এক ছটাক আলো এসে পড়ল ঐশীর মুখে। ঐশী চোখ কুচকে নিলো। তন্ময়ের ভারী শরীর টানতে টানতে নিয়ে চেয়ারে বেধে ফেললো।
_________________________
চোখের উপর আলো পড়তেই চোখ আদো আদো করে খোলার চেষ্টা করলো তন্ময়। চোখের রেটিনা পরিষ্কার হতেই সামনে দেখতে পেলো ঐশীকে। ঐশী খুব আরমসে মাটিতে বসে নানা ধরনের ইলেকট্রিক তার নিয়ে সেট করছে। তন্ময় স্তম্ভিত ফিরে পেতেই রাগে চেয়ার থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। তবুও তার ছটফটানি কমলো না। ঐশী এসবে ভ্রুক্ষেপ করলো না। ও ভাবলেশহীনভাবে তার নিয়ে কিছু একটা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর তন্ময় গর্জে উঠে বললো,
” এসব কি, ভূমি ? ছাড়ো আমায়। বেধে রেখেছো কেনো আমায় ? দেখো , আমাকে আটকে রাখার দুঃসাহস করবে না। ছাড়ো বলছি আমায়। ”
ঐশীর তার সেট করা শেষ। মাটি থেকে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো। তন্ময়ের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে বললো,
” ওকে। আমার পরিচয় এবার দেওয়া যাক। আমার নাম ঐশী। ( তন্ময়ের চোখের দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে ) নট ভূমি। ডটার অফ আশরাফুল হাবিব। এ পুলিশ অফিসার। কি ? চিনতে পেরেছো ? ”
তন্ময় চমকে উঠলো। ভ্রু উচু করে বললো,
” তুমি ঐ..ঐশী ? ”
ঐশী মুচকি হেসে চেয়ারে হেলান দিলো। জোরে এক হাফ ছেড়ে বললো,
” আরে। একবারের কথা একশোবার কেনো বলা লাগে আপনাকে । কালা, নাকি ? ”
#চলবে
শব্দসংখ্যা -১২০০+
আগামী কয়েকদিন রেগুলার পর্ব দেওয়া হবে। আমি ফ্রি আছি তাই। আর বোনাস পার্ট চাইবেন না প্লিজ।