ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-৩৩

0
1846

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৩৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ঐশী চুপচাপ জুভানের পাশে দূরত্ব রেখে বসে গেলো। জুভান পা দিয়ে দোলনা আলতো করে দুলিয়ে বললো,
— ” আমার সম্পর্কে জানতে চাও? ”

ঐশী সামনে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে সায় দিলো। জুভান এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। ঐশী জুভানের দিকে আগ্রহ চোখে তাকালে জুভান বলতে থাকে,
— ” আমার জীবনটা তোমার মতন সাজানো গুছানো ছিলো না,ঐশী। বরং অনেকটা যান্ত্রিক ছিলো। আর আমি ছিলাম সেই যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রমানব। যার কোনো অনুভূতি, ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য ছিলো না। ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের ঝগড়া দেখেই বড় হয়েছি। আমার কাছে তখন মনে হতো একটা সম্পর্ক মানেই হয়তো প্রতিদিন এই খিটখিটে আচরন, একে অপরকে অভিশাপ দেওয়া, সারাদিন ঝগড়া করে রাতে না খেয়ে ঘুমানো। সেদিন রোজকার মত মায়ের কাছে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু সকালে উঠে এমন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম যেটা আমি কল্পনায় ভাবিনি। বাবা মা দুজন মিলে আমাকে প্রশ্ন করেন, –আমি কার কাছে থাকবো। বাবা নাকি মা? তখন ছোট মনে এই প্রশ্নের বিষাক্ততা বুঝতে পারিনি। তাই সরলমনে বলেছিলাম — দুজনের সাথে। মায়ের মুখ এই কথা শুনে কঠিনরূপ ধারণ করলো। সেই সাথে বাবাও হলেন বিরক্ত। শেষ পর্যন্ত আমার স্থান হয়েছিল মায়ের কাছে ,মায়ের নিজস্ব বাসায়। কদিন ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু তারপর মা নতুন বিয়ে করলেন। তারপর মায়ের কাছেও আমার মূল্য ফিকে হয়ে গেলো। ডাস্টবিনের মতন অযত্নে পড়ে থাকতাম ঘরের এক কোণে। দিন যেতে লাগলো, মায়ের কাছে দূরত্ব বাড়লো। মায়ের মমতার সুতো একসময় ছিঁড়ে যেতেই পা বাড়ালাম ঢাকাতে। একা, নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াতাম সেই শহরে। একসময় নাম- দাম সব হলো আমার। টাকা পয়সা হাতের ময়লায় রূপান্তরিত হলো। কিন্তু কোথাও মনে শান্তি পেলাম না। মেয়ে, মদ আমার রোজকার সঙ্গী হয়ে উঠলো। তারপর একদিন একে মেয়ের সাথে দেখা। যার জন্যে আজকের আমার এই বদল। সে যখন আমার ঘরে গুটিগুটি পা নিয়ে ঘোরাফেরা করে তখন আমার মনে হয় আমার ঘরে দীর্ঘ সময় পর পূর্ণতা এলো। এখন সেই কালো ঘরের আনাচে কানাচে শুধু সুখ আর সুখ। সেই সুখে কোনো স্বার্থ নেই। সেই মেয়েটা কে, চিনেছো নিশ্চই। ”

ঐশী একদলা বিস্ময় নিয়ে জুভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা এত কষ্ট পেয়েছে? ও তো দু মাস ধরে একাকী আছে, আর তার পাশের মানুষটা সারাজীবন ধরে একা একা গুমরে মরেছে। ঐশীর চোখ ভিজে এলো। চোখের গা বেয়ে একফোঁটা জল মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই জুভান সেই জল আঙ্গুল দিয়ে শুষে নিলো। ঐশী অবাক হয়ে তাকালে জুভান বললো,
— ” তোমার চোখের একফোঁটা জল আমার বুকের সবটুকু পানি শুষে নেয়। তাই সেই জলের অপচয় করবে না। ”

ঐশী অবাক হলো কিন্তু এই কথার মানে বুঝলো না।
নিরবতায় কেটে গেলো আরো আধা ঘণ্টা। নিশ্বাসের নিঃশ্বাসের খেলায় ভারী হলো রাতের আকাশ। সেই আকাশে জ্বলজ্বল করে উঠলো অসংখ্য তারা। কিন্তু সেই বিশাল আকাশের একদম পশ্চিম দিকে দুটো উজ্জ্বল তারা বসে আছে। সবার থেকে আলাদা, একদম স্বকীয়। ঐশী সেদিকে চোখ রেখে মনে মনে নানা কল্পনা আঁকছে। অযথাই ওদের নিয়ে নিজের ভাবনার সুতো বুনছে। আচ্ছা, এই দুটো কি ঐশীর বাবা-মা। যারা এই নিষ্টুর পৃথিবীতে ওকে একদম একা করে রেখে গেছেন। শুনেছে , মানুষ মরার পর আকাশের তারা হয়ে যায়। তাহলে ঐশীর বাবা-মাও কি তারা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের ঐ কালো জগতে? ঐশী কোনো উত্তর পেলো না। হবে হয়তো। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে ঐশীকে অন্যমনস্ক দেখে জুভান ঐশীকে ডাক দিলো। কিন্তু ওর মুখে “রা” নেই। জুভান এবার ঐশীর বাহু ধরে ঐশীকে ঝাঁকালো। খানিক জোরগলায় বললো,
— ” ঐশী, এই ঐশী? ”

ঐশী হুড়মুড়িয়ে জুভানের দিকে তাকালো। চোখের দৃষ্টি তার এলোমেলো, ছন্নছাড়া। জুভান সেই দৃষ্টি দেখে কিছুটা অবাক হলো। হঠাৎ করে কি হলো এই মেয়ের? জুভান ঐশীর চোখের কোণ থেকে একফোঁটা জল নিজের আঙ্গুল দিয়ে আনলো। জলের স্বচ্ছ ফোঁটা ঐশীকে দেখিয়ে বললো,
— “আবার কাদঁছো কেনো? ”
ঐশী মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে চোখের জল মুছে নিলো। জুভানের থেকে কষ্ট লুকানোর কি সোচ্চার চেষ্টা তার! জুভান মৃদু হাসলো। সে ঐশীর দু বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরালো। ঐশী বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জুভান যেনো তার অশ্রু দেখে না নেয়। জুভান ঐশীর থুতনি ধরে মুখ উচু করলো। কণ্ঠে আকাশসম আদর ঢেলে বললো,
— ” মা, বাবার কথা মনে পড়ছে? কাদছো কেনো? হুম? ”

ঐশী ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বরাবরের মতন ব্যার্থ হলো সে। নিজের অনুভূতি লুকানোর ক্ষমতা কখনোই ছিল না তার। এবারও হয়নি। মাথা নিচু করে হুহু করে কেঁদে উঠলো ও। আকস্মিক কান্নার শব্দে জুভান হতভম্ব হয়ে গেলো। কি করবে ভেবে না পেয়ে ঐশীর মাথা নিজের বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো। মাথায় বারবার হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,
— ” হুশশ। কাদে না। আরে। এমন করে কান্না করার কি আছে। শান্ত হও ,ঐশী। রিলাক্স।”
ঐশী জুভানের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে নাক ঘষে কান্না করতে করতে বললো,
— ” কি দোষ ছিল আমার। বলতে পারেন। ওরা আমার পুরো পৃথিবীকে কেড়ে নিলো। আমার সম্বল, আমার বেচেঁ থাকার কারণ সব, সব কেড়ে নিল ওরা। কেনো করলো এমন? আমি তো নির্দোষ ছিলাম। ওরা তাহলে আমায় খুন করে ফেললো কেনো? আমার তো দোষ ছিল না। তাহলে? কেনো করলো এমন? কেন..”

ঐশীর কান্নার একেকটা ফোঁটা জুভানের বুকের উপর পড়ছে। সেই ফোঁটা ঐশীর মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই জুভানের বুকে বিষের মতন জ্বালা ধরছে। তার প্রেয়সীকে কান্না করতে দেখে দিল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে নিরুপায়। এখনো তার হাতে এখনো কিছু করার মতন সুযোগ আসে নি। জুভান ঐশীর মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো গলায় বললো,
— ” তোমার কোনো দোষ নেই,ঐশী। তুমি পবিত্র। দুনিয়ায় যত পবিত্রতা আছে সব তোমায় ঘিরে থাকুক, তোমার মনের কুলষিত অংশ সেই পবিত্রতার ধারালো আচড়ে ধুয়ে মুছে যাক। দুনিয়ার সব শুভ সুখ তোমার পায়ের কাছে আত্মসমর্পন করুক। আমার ভাগ্যের সুখটাও আজ থেকে তোমার হোক, ঐশী।”

ঐশী জুভানের বুক থেকে মাথা তোলে তাকালো। এ কি বললো জুভান! ঐশীর চোখে মুখে খেলে গেলো অপার বিস্ময়, রাজ্যের চমক। জুভান ঐশীর অবাক হওয়া মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আবারও বললো,
— ” আমিন, আমিন। পবিত্র এই দোয়ার জন্যে সহস্রবার আমিন। ”
ঐশী কান্নার মধ্যেই হেসে ফেললো। জলে টুইটুম্বর মুখে সেই হাসি খুব বেশি মোহময় ঠেকলো। ঐশী জুভানের দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,
— ” আমিন। ”

আচমকা ঐশী জুভানের কাছ থেকে সরে এলো। মুখে খেলে গেলো লজ্জার আভা। শরীরে আড়ষ্ঠভাব জরিরে ধরতেই ঠোঁট কামড়ে ধরলো ঐশী। দুনো হাত একসাথে কোলের উপর রেখে কচলাতে লাগলো। একটু আগে জুভানের এতটা কাছাকাছি ছিল ও। ইশ! কি লজ্জা! কি লজ্জা! ঐশীর এমন লজ্জা পাওয়া দেখে জুভানের অযথাই হাসি পেলো। দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গলা খাকারি দিয়ে বললো,
— ” অনেক গল্পসল্প হলো। এখন ডিনার করা যাক। অলরেডি অনেক লেট হয়ে গেছে। ”

ঐশী জড়তা ঠেলে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো। দোলনা থেকে উঠে দাঁড়াতেই আচমকা পায়ে পা লেগে হোচট খেলো। সঙ্গেসঙ্গে কোমর ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলে জুভান একহাত দিয়ে ঐশীর কোমড় আকড়ে ধরে। ঐশী চোখ খিচে বন্ধ করে আবারও পিটপিট করে তাকালো। জুভান ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
— ” সাবধানে ম্যাডাম। আপনি হোচট খাচ্ছেন। ”
ঐশী ফ্যালফ্যাল করে জুভানের দিকে তাকালো। কিন্তু এই কঠিন কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরে হতাশ হলো। ঐশী স্বাভাবিক হলে জুভান ঐশীকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঘড়ি দেখে বলে,
— ” ডিনার টেবিলে দেখা হচ্ছে। কুইক এসো। ”
ঐশী মাথা নিচু করে সায় দিলো। জুভান ঐশীর দিকে একঝলক তাকিয়ে মুচকি হেসে সেই জায়গা থেকে চলে গেলো।

#চলবে

শব্দসংখ্যা- ১১০০+

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/201893158521919/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here