#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৩৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
“k420″ রুম। সম্পূর্ণ রুম কালো রঙের চাদরে ঢাকা। অন্ধকার, ছমছমে পরিবেশ। রুমের একটা কর্নারে একটা মেয়েকে চেয়ারে বেধে রাখা হয়েছে। দু ঠোঁটের মাঝখানে কাপড় বেধে রাখা। হাত, পা বন্ধনযুক্ত। শব্দহীন পরিবেশে শুধুই মেয়েটার গুঙ্গানির আওয়াজই পাওয়া যাচ্ছে। একসময় মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে মাথা বামে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো। মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে একসময় শুকিয়ে এলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর অন্ধকার রুমে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। পায়ের পাতা যেনো মাপে মাপে মাটিতে রাখা হচ্ছে। একটাসময় মেয়েটার মুখের বাঁধন খুলে দিতেই মেয়েটা জেগে উঠে। উন্মাদের মত বিড়বিড় করলো,
— ” পা,পানি। পা,পা,পানি। ”
পাশের মানুষটা হাসলো। হিংস্র সেই হাসি। আচমকা মেয়েটার থুতনি ধরে মাথা উচু করলো। বোতল থেকে উপুড় করে পানি ঢেলে দিলো মুখের ভিতর। পানির কিছু ফোঁটা মেয়েটার গলা ভেজালো বাকি পানি উপচে পড়লো মুখ থেকে। মেয়েটার তৃষ্ণা এখনো মেটেনি। কিন্তু পাশের মানুষটার সময়ের বড্ড অভাব। সে পানির বোতলটা দূরে ছিটকে ফেলে দিলো। আচমকা মেয়েটার গাল আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরলো। এতে তার দু আঙুলের নখ খানিক দেবে গেলো মেয়েটির গালে। মেয়েটা ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। কিন্তু কথা বলার জো নেই তার। চোখ খিচে বন্ধ করে নিল ও। ঐশী সেসব পাত্তা না দিয়ে নিজের কণ্ঠ বদলে ভারী কণ্ঠে মেয়েকে বললো,
— ” সাজ্জাদ হোসেনকে চিনিস? ”
মেয়েটা চুপ করে থেকে চোখ বুজলো। মুখ ভেঙে আসছে তার। ঐশী এতে বিরক্ত হলো। মেয়েটার গাল আরো জোরে শক্ত করে চেপে ধরলো। মেয়েটা ব্যাথায় ” আহ” বলে চিৎকার দিলো। ঐশী দাত কিরমিরিয়ে বললো,
— ” মুখে কথা ফুটে না? দিবো এক থাপ্পর। কথা বল বলছি। সাজ্জাদ হোসেনকে চিনিস? ”
সারা শরীরের অসহ্য ব্যাথা নিয়ে মেয়েটা শুধু মাথা নেড়ে হ্যা বোধক উত্তর দিলো। ঐশী এবার মেয়েটার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলো। সেই মেয়েটা চোখ আদো খুলে ঐশীর মুখ দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু অন্ধকার আর কালো রং ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছে না। মেয়েটা চোখ আবার বুজে ফেলে মাথা কাত করলো। ক্লান্তিতে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না কোনক্রমেই। ঐশী এবার থমথমে গলায় বললো,
— ” বাঁচতে চাস? ”
মেয়েটা শুনলো কি ওর কথা? এখনো চোখ বুজে আছে। ঐশীর রাগ লাগলো। এত তেজ! ঐশী চেয়ার থেকে উঠে ঠাস ঠাস মেয়েটার দুগালে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। মেয়েটা ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো। নাক দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো। ঐশী তেজ নিয়ে বললো,
— ” আমাকে তেজ দেখাস? হ্যাঁ? যা বলবো চুপচাপ তার উত্তর দিবি। নাহলে আজই শেষ চাঁদ দেখা হবে তোর। বাঁচতে চাস কিনা বল। ”
মেয়েটা এবার আর দ্বিতীয় ভুল করলো না। সঙ্গেসঙ্গে মাথা নেড়ে হ্যা বললো। বাঁচতে চায় ও। ঐশী আরামসে চেয়ারে বসলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” এখান থেকে মুক্তি পাবি এক শর্তে। সাজ্জাদ হোসেনকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। ”
মেয়েটা কিছুটা অবাক হলো। চোখ দিয়ে অনবরত খুঁজতে লাগলো এই সাহসী বাক্য বলা কণ্ঠস্বরকে। কিন্তু এবারও ব্যার্থ হলো। ঐশী মুচকি হেসে বললো,
— “চেষ্টা করে লাভ নেই। আমাকে দেখতে পাবি না।এখন শোন, আমরা এই কাজের বদলে তোকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিবো। তুই এই টাকা নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবি। যেখানে কেউ তোকে খুঁজে পাবে না। সারাজীবন এই টাকা দিয়ে আয়েস করে থাকবি। বল,রাজি? ”
মেয়েটা ভাবলো কিছুসময়। কপাল কুঁচকে এই ডিল-টাই যথোপযুক্ত মনে হলো ওর। মাথা হেলিয়ে মুখের লালা দিয়ে গলা ভেজালো। অতঃপর জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে থেমে থেমে বললো,
— ” কো-কোথায় নিয়ে আসতে হবে? ”
ঐশী মুচকি হেসে চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বসলো। হিংস্র হাসি দিয়ে বললো,
— ” মৃত্যুপুরীতে। সেদিন আমি ওর কাল হয়ে আসবো আমি। মহাকাল। ”
ঐশী গর্জে উঠলো। গলায় যত ঝাজ আছে ঢেলে দিলো সেই প্রতিহিংসামূলক শব্দে। চোখে মুখে তৃষ্ণা তার। পাপীদের রক্তের তৃষ্ণা খেলে বেড়াচ্ছে। । খুন করার মতন ভয়ংকর ত্তৃষ্ণা চেপেছে তার শক্ত মন জুড়ে। কি হবে সামনে?
__________________________
সময়টা এখন পাঁচটার কাছাকছি। আকাশের রং এই মুহূর্তে রক্তিম হয়ে আছে। সূর্য হেলে আছে পশ্চিম দিকে। যেকোনো মুহূর্তে তার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে যাবে। এক মুঠো বিকেলকে পুঁজি করে ঐশী আর জুভান রথের মেলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বিকেলে জুভান ঐশীকে জোর করে নিয়ে এসেছে এই রথের মেলায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেলায় এলেও এখন এই মেলা দেখে ঐশীর দুচোখে স্থির হয়ে গেছে। এত সুন্দর মেলাও হয়? ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার রথের মেলা আরো বেশি সুন্দর। ঐশী লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে আর চারপাশে দেখছে। জুভান মুখে মাস্ক আর মাথায় ইয়া বড় একটা ক্যাপ পড়ে ঐশীর ডান হাত শক্ত করে ধরে ঐশীর পায়ের সাথে পা মেলাচ্ছে। এই মেয়েটা যা উড়নচণ্ডী। যেকোনো সময় হারিয়ে যেতে পারে। জুভান সেই কথা ভেবে আরো জোরে হাত আকড়ে ধরলো ঐশীর। ঐশীর নাজুক হাত এতে একটু ব্যাথা পেলো। ধ্যান ভঙ্গ হয়ে জুভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আমি হারিয়ে যাচ্ছি যা। আস্তে ধরুন। ”
জুভান সেসব শুনলো না। বরং তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললো,
— ” তোমাকে বিশ্বাস নেই। ”
ঐশী অপমান হয়ে মুখ ফুলিয়ে তাকালো জুভানের দিকে। বললো,
— ” আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন। ”
জুভান একটা দোকানের সামনে দাড়িয়ে একটা চিকন মালা নেড়েচেড়ে বললো,
— ” তুমি যা ভাবো তাই। ”
ঐশী হুতুম পেঁচার মত মুখ বানিয়ে অন্যদিকে ফিরলো। জুভান সেসব পাত্তা দিল না। একটা দোকানে দাড়িয়ে খুব রয়ে সয়ে জুভান এইটা চেইন পছন্দ করলো। চেইনে একটা ছোট্ট অর্থবহ শব্দ “love” ডিজাইন করে লেখা। চেইনটা দেখেই জুভানের মুখ চকচক করে উঠলো। ঐশীকে এতে মানাবে কি-না তা জানতে ঐশীর গলার কাছে চেইন এনে পরখ করলো। অতঃপর মুখ উজ্জ্বল করে বললো,
— ” পারফেক্ট। ”
ঐশী অবাক হয়ে চেইনের দিকে তাকালে জুভান কণ্ঠে উচ্ছাস নিয়ে বললো,
— ” দেখো তো , এটা পছন্দ হয় কিনা? ”
ঐশী হাত দিয়ে চেইন টা ছুঁয়ে দেখলো। অসম্ভব সুন্দর এই চেইন। ঐশী খুশি হয়ে বললো,
— ” খুব সুন্দর। ”
ঐশীর ভালো লেগেছে শুনে জুভানের খুশি আন্দোলিত হলো। ঐশীর হাত ছেড়ে দিয়ে চেইন নিয়ে ঐশীর পিছনে এসে দাঁড়ালো। জুভান ঐশীর ঘাড়ের কাছের চুলগুলোতে হাত দিলো। ঐশীর কেনো যেনো এতে সুড়সুড়ি লাগলো। ও নিজের ঘাড় সংকোচিত করে মাথা নিচু করলো। জুভান সেদিকে খেয়াল না করে ঘাড়ের কাছের চুলগুলো সামনে রেখে খুব আলতো হাতে চেইনটা পড়িয়ে দিলো ওকে। ঐশী এখনো মাথা নিচু করে চেইনের দিকে তাকিয়ে আছে। ” প্রথম উপহার! ” জুভান চেইনটা পড়িয়ে দিয়ে ঐশীর সামনে এসে দাড়ালো। সেটায় একবার চোখ বুলিয়ে বললো,
— ” ভালো লাগছে। এবার অন্য দোকানে চলো। ”
বলেই ঐশীকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জুভান আবারও ঐশীর হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। ঐশীও মুচকি হেসে জুভানের সাথে পা মেলালো।
নাগরদোলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঐশী আর জুভান। ঐশী রীতিমত জেদ ধরে বসে আছে, সে নাগরদোলায় চড়বে। কিন্তু জুভানও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলছে,
— ” না। মাথা ঘুরাবে। অন্য কিছুতে চড়বো আমরা। তবে এটাতে না। ”
কিন্তু নারীর মনের কাছে একসময় হার মানলো জুভান। বিরক্ত হয়ে ঐশীকে সাথে নিয়ে নাগরদোলায় চড়ে বসলো। একটু পর নাগরদোলা চলতে আরম্ভ করলো। কিন্তু ঐশী তার দুই সেকেন্ড পরই ভয় পেতে লাগলো। যতই সাহসী হোক না কেনো, এই নাগরদোলা ঐশীর সব সাহসকে তুচ্ছ করে দেয়। ঐশী নিচে একবার তাকালো। এত উচুঁ দেখে সঙ্গেসঙ্গে চোখ বন্ধ করে মাথা সোজা করলো। জুভান ঐশীর পাশে হেলান দিয়ে বসে আরামসে এসব দেখছে। এত জেদ নিয়ে উঠেছে এবার মজা বুঝো। ঐশী ভয়ে একসময় জুভানের হাত খামচে ধরে। জুভান ব্যাথায় চোখ খিচে নেয়। তবে কোনো শব্দ করে না। পুরোটা সময় ঐশী জুভানের হাতের এক জায়গা খামচে ধরে বসেছিলো।আর জুভান এসব মুখ বুজে হাসিমুখে সহ্য করছিলো। থাকুক না প্রিয়তমার দেওয়া একটা দুটো সুখকর আঘাত! ভালোবাসাময় দাগ! ক্ষতি কি?
জুভান ঐশীকে এক হাতে আগলে হাঁটছে। আর ঐশী নিজেকে সামলে হেলেদুলে জুভানের সাথে পা মেলাচ্ছে। ঐশীর মাথা ঘুরছে। তার একটু পরই ও উপলব্ধি করলো, ওর আশপাশের দুনিয়া ঘুরছে। আচ্ছা, মেলায় এতগুলো মানুষ এই ভূমিকম্প টের পাচ্ছে না। সব মানুষ কি নেশা করলো। ঐশী একসময় মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে জুভানের কাধের টিশার্ট খামচে ধরে। জুভান সঙ্গেসঙ্গে সচেতন হয়ে ঐশীর কোমর জড়িয়ে ধরে। ঐশী চোখ বুজে নিয়ে আবার খুলে ফেললো। এক হাতে জুভানের গলা আগলে মৃদ আওয়াজে বলে উঠলো,
— ” পৃথিবী ঘুরছে। আপনি কি টের পাচ্ছেন? না-কি আপনিও নেশা করে বসে আছেন? ওদের মতন? ”
জুভান হতভম্ভ হয়ে তাকালো ঐশীর দিকে। একঝটকা দিয়ে ঐশীকে সোজা করে দাড় করালো। চোখ ছোটছোট করে বললো,
— ” আর ইউ ওকে? এমন ওইয়ার্ড বিহেভ করছো কেনো? ”
ঐশী জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। তারপর নেশালো গলায় বললো,
— ” আমি ঠিক নেই। ঘুরছি আমি। আব না মানে দুনিয়া ঘুরছে। আরে , আপনিও তো ঘুরছেন। সব্বাই ঘুরছে। এখানের সব্বাই না ঘুরন্ত মানব হয়ে গেছে। সব্বাই শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে। ঘুরছে আর ঘুরছে। ”
জুভান ভ্রু কুটি করে তাকালো ঐশীর দিকে। এই মেয়েটা পাগল হলো না-কি? এমন করে কথা বলছে কেনো? জুভান ঐশীর ঠোঁটের কাছে নাক এনে কিছু একটার ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করলো। সঙ্গেসঙ্গে ঐশীর থেকে সরে এসে অবাক হয়ে বললো,
— ” তুমি ভাং খেয়েছো? সিরিয়াসলি ঐশী? ”
ঐশী হাসলো। একবার আস্তে হাসলো। পরক্ষণে শব্দ করে হেসে দিলো। হাসি থামানোর বৃথা চেস্টা করে বললো,
— ” আপনি কি করে জানলেন? আপনি কি সবজান্তা? ”
জুভান ঐশীর অবস্থা দেখে কপালে হাত দিলো। বিড়বিড় করে বললো,
— ” এই মেয়ে গেছে। ”
#চলবে
গল্পটা আমি টেনে-হিচড়ে বড় করছি না। একটা গল্পে হুট করে ভালোবাসা তৈরি করা যায়না। উভয়ের সময়ের দরকার হয়। ভালোবাসাটা গভীর করে ফুটিয়ে তুলতে মাঝখানে কিছু মুহূর্তের প্রয়োজন হয়। আমি সেটাই করছি। আশা করি এতে বিরক্ত হচ্ছেন না আপনারা। হ্যাপি রিডিং
শব্দসংখ্যা- ১৩০০+
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/202373945140507/?app=fbl