#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৩৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
বিছানার এক কোণে ঐশী থম মেরে বসে আছে। জুভান রান্নাঘরে দাড়িয়ে লেবু চিপছে। কপালের ভাজ সরু থেকে সরু হতে যাচ্ছে। জুভান কপালে হাত দিয়ে ঘাম-টুকু মুছে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
— ” কত বড় ফাজিল মেয়ে! এক মিনিটের জন্যে একা ছেড়েছিলাম। ভাং খেয়ে আমাকে উদ্ধার করে দিয়েছে। একবার নেশা কাটুক। তারপর দেখছি একে। ”
অন্যমনস্ক ছিল জুভান। লেবু চিপতে গিয়ে হুট করে এক ফোঁটা রস গড়িয়ে পড়লো জুভানের ডান হাতের উল্টোপিঠে। সঙ্গেসঙ্গে জায়গাটা মরিচের মতন জ্বলে উঠলো। জুভান হাতের যন্ত্রণায় চোখ খিচে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। ঐশী খামচে দিয়েছিলো এই জায়গায়। একটু পর হাতের জ্বলা হালকা কমতেই জুভান লেবু পানি বানিয়ে ঐশীর রুমের দিকে পা বাড়ালো।
ঐশী রুমে নেই। জুভান সতর্ক চোখে চারপাশে তাকালো। বারান্দায় চোখ পড়তেই মুচকি হেসে গ্লাস হাতে এগিয়ে গেলো সেখানে। ঐশী আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে কি যেনো গুনছে। কিন্তু কি গুনছে? তারা! জুভান একবার চোখ উঠিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। তারার মেলা বসেছে আকাশে। তাই গুনছে হয়তো। জুভানের হাসি পেলো। তবে মুখ গম্ভীর করেই ডাক দিলো,
— ” এই যে। এদিকে ফিরুন। ”
ঐশী ঠোঁট উল্টে জুভানের দিকে ফিরে তাকালো। বললো,
— ” আকাশে আজ তারা কয়টা উঠেছে জানেন? ”
জুভান গ্লাস হাতে ঐশীর পাশে এসে দাঁড়ালো। ভ্রু কুচকে বললো,
— “কয়টা উঠেছে? ”
ঐশী হাতের আঙুলে গুনে গুনে বললো,
— ” দুইটা বাদে মোট একশো বারোটা। ”
জুভান অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
— ” দুইটা তারা বাদ কেনো? ”
ঐশী বিরক্ত হলো। হাত দিয়ে বাতাস উড়িয়ে দিয়ে ঝাঝালো গলায় বললো,
— ” আরে,আপনি জানেন না। ঐ দুইটা তারা না তো। ওগুলো আমার মা আর আর বাবা। তাই ওই দুইটা বাদ দিয়ে গুনেছি। ”
জুভান কপালে হাত দিয়ে কি যেনো বললো। তারপর ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে ঐশীর দিকে লেবু পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
— ” জ্বি। বুঝেছি। এখন এই লেবু পানি খেয়ে নিন। ঘুমোতে হবে আপনার। ”
ঐশী স্থির চোখে তাকালো গ্লাসের দিকে। চোখ উল্টিয়ে বললো,
— ” চিনি দিয়েছেন? ”
— ” হ্যাঁ। দিয়েছি। ”
— ” আচ্ছা দিন। ”
জুভানের দেওয়ার অপেক্ষা না করে ঐশী একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো গ্লাসটি। তারপর এক ঢোকে সবটুকু পানীয় খেয়ে মুখ তুললো। হাত দিয়ে ঠোঁট মুছে মুখ ডানে বামে ঝাঁকালো। মুখ খিচে বললো,
— ” ইশ! কি টক। চিনি কই? ”
জুভান ঐশীর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে রুমের ভিতর চলে গেলো। এই মেয়ের সাথে কথা বাড়ানো মানেই প্যাচাল। তাই জুভান চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। তবে সে জানে না কতক্ষণ এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবে। জুভানের পিছু পিছু ঐশী রুমে এলো। জুভান ঐশীর বিছানা ঠিক করে বালিশ জায়গামতো রেখে দিলো। তারপর ঐশীর দিকে ফিরে বললো,
— ” নিন। শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে। ”
ঐশী হাসলো। মাদক হাসি। লাফিয়ে লাফিয়ে বিছানার কাছে গিয়ে ঠাস করে বসে পড়লো ওতে। কিছুসময় কেটে যাওয়ার পরও ঐশীর মধ্যে ঘুমানোর কোনো লক্ষণ পাওয়া গেলো না। শেষ পর্যন্ত জুভান প্রায় বিরক্ত হয়ে বললো,
— ” ঘুমাচ্ছো না কেনো? ”
ঐশী জুভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” ঘুম আসছে না। তবে আমার না খুব গল্প গল্প পাচ্ছে। আসুন গল্প করি। ”
ঐশী মিটমিটিয়ে হাসলো। জুভান ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে পাশের সোফায় ধাম করে বসে পড়লো। বললো,
— ” শুরু করো। শুনছি। ”
সোফায় বসলেন কেনো? ঐশী চোখ ছোটছোট করে ফেললো। বিছানার পাশের জায়গাটায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,
— ” এখানে এসে বসুন। আমার গায়ে ময়লা নেই। রোজ গোসল করি আমি। ”
জুভানের হাসি পেলো। মুচকি হেসে সোফা থেকে ঐশীর পাশে বসে বললো,
— ” কাছ ঘেঁষলে তো ডিলের কথা মনে পড়ে যায় তোমার। তাই দূরে বসেছিলাম। ”
ঐশী আচমকা জুভানের ডান হাতের বাহু জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা রাখলো। জুভান হতবাক হয়ে ঐশীর দিকে তাকালো। কি করছে এই মেয়ে? পাগল হলো? জুভান চোখে বিস্ময় নিয়ে বললো,
— ” কি হলো?”
— ” কি আবার হবে? ”
— ” এত কাছে এসে বসলে? পরে তো নিজেই চেচামিচি করবে। ”
— ” না। করবো না। ”
ঐশী মাথা তুলে জুভানের চোখে চোখ রাখলো। ব্যাকুল কণ্ঠে বললো,
— ” থাকুন না এভাবে। ভালো লাগছে। ”
জুভানের খা খা করা বুকটায় মিঠা পানির ঝাপটা পড়লো। শূন্য মনটা হঠাৎ করেই পূর্ণতার রঙে রাঙিয় উঠলো। ঐশীর অস্থির চোখের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললো,
— ” ঠিক আছে। ”
ঐশী স্থির ভাবে আবারও জুভানের কাধে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজলো। অতঃপর নিরবতা। ঐশী জুভানের নিঃশ্বাসের শব্দ গুনছে। একটা, দুটো, তিনটি তারপর অসংখ্য। ঐশী হাল ছেড়ে জুভানের এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরলো। জুভান তার হাতের দিকে তাকালো অবাক হয়ে। ঐশী ভুল করছে না-তো? জুভান চায়না ঐশী কোনো ভুল করে পরে পস্তাক। জুভান তাড়াহুড়ো করে ঐশীর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ঐশী বাধা না মেনে আরো জোড়ে তার হাত আকড়ে ধরে। আবারও জুভানের চোখে চোখ রাখে। জুভানের দৃষ্টি এলোমেলো, অগোছালো। ঐশী সেই দৃষ্টির নেশায় ডুবে গিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
— ” আপনি অনেক সুন্দর, গায়ক সাহেব। যাকে বলে মারাত্মক সুন্দর। ছেলেদের এত সুন্দর হওয়া উচিত না। পাপ লাগে। আপনাকে এই মারাত্মক পাপের জন্যে ১০২ ধারা মোতাবেক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।”
জুভান ঐশীর কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেললো। ঐশীর দিকে খানিক ঝুঁকে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
— ” এই ভয়ানক প্রেমিকার তরে এই অতীব সুন্দর তরুণ হাজারবার কুরবান হোক, মিসেস মির্জা। ”
ঐশী খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। সে হাসিতে ঝিলিক দিলো তার গজদন্ত। জুভান মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো সে ঝড় তোলা হাসির দিকে। ঐশী হাসি থামালে জুভান মিহি সুরে বললো,
— ” এই শহরে আজ থেকে সকল প্রেমিকার হাসি নিষিদ্ধ করা হোক। নাহলে সেই হাসিতে সেই শহরের সকল প্রেমিকের ধ্বংস নিশ্চিত। ”
ঐশী বুঝলো না। মুখ ফুলিয়ে বললো,
— ” আপনি কঠিন করে কথা বলছেন। ”
জুভান হাসলো। তবে প্রত্যুত্তর করলো না। আবারো নিরবতা। ঐশী জুভানের ডান হাত নিয়ে খেলছে। নেড়েচেড়ে দেখছে। নিজের কোলের উপর রেখে তাতে ধ্যান দিয়ে তাকিয়ে থাকছে। ওর কাছে আপাতত এই পুরুষালি হাতের থেকে আশ্চর্য দ্বিতীয় আর কিছু নেই। একসময় ঐশীর কপাল কুঁচকে এলো। ভ্রুতে ভাজ ফেলে সেই হাতের দাগ জুভানকে দেখিয়ে বললো,
–” এই জখম? ”
জুভান তার হাতের দিকে তাকালো। ঐশীর খামচে ধরা হাত কালচে হয়ে আছে। জুভান শান্তনা দিয়ে বললো,
— ” ও কিছু না। ”
ঐশীও নাছোড়বান্দা। জুভানকে হাতের ব্যাপারে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। একসময় জুভান বিরক্ত হয়ে বললো,
— ” জেদ নিয়ে নাগরদোলায় চড়তে গিয়েছিলে। ভয় পেয়ে আমার হাত খামচে ধরেছিলে। তাই দাগ হয়ে গেছে। ”
ঐশী কিছুক্ষণ জুভানের দিকে তাকিয়ে আচমকা ভ্যা করে কেঁদে ফেললো। যাকে বলে হাত পা ছড়াছড়ি কান্না। জুভান হতবিহ্বল হয়ে ঐশীর কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু ঐশী ত ঐশীই। নিজের হাত নিজেই খামচে ধরলো। কিন্তু যেই ব্যাথা পেলো অমনি হাত ছেড়ে দিয়ে আবারও জোর গলায় কান্না করতে লাগলো। ভেজা কণ্ঠে বললো,
— ” আমি আপনাকে ব্যাথা দিয়েছি। খুব খারাপ আমি। খুব খারাপ। ”
জুভান একসময় ঐশীর পাশে বসলো। ঐশীর মাথা জোরপূর্বক নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে লাগলো। একসময় ঐশী শান্ত হলো। ফুস ফুস করে নিঃশ্বাস নিয়ে জুভানের বুকের সাথে মিশে গেলো। জুভান ঐশীকে আলতো করে বালিশে শুইয়ে দিয়ে ওর পাশে বসলো। ঐশীর চোখের পাতা হাত দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে শাসনের সুরে বললো,
— ” নো মোর ওয়ার্ডস। এখন ঘুমাও। ”
ঐশী চোখ খুলতে গেলে জুভান ধমক দিয়ে বললো,
— ” আমি ঘুমাতে বলেছি। ”
ঐশী আবার চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। জুভান মৃদু হাসলো। ঐশীর চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
একসময় ঐশীর নিশ্বাস ভারী হলো। তার মানে ও ঘুমিয়ে গেছে। জুভান হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলো নেভালো। কিছু একটা ভেবে ঐশীর দিকে ঝুঁকে এলো। কানের কাছে বিড়বিড় করে বললো,
— ” তোমার দেওয়া প্রেমাঘাতে আমার মৃত্যুও মঞ্জুর, ঐশী। ভালোবাসি। ”
ঐশী ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরলো। ধীর কণ্ঠে বিড়বিড় করলো,
— ” আ-আপনি আ-বার কঠিন করে কথা ব-বলছেন। ”
জুভানের ঠোঁট দুদিকে প্রশস্থ হলো। ঐশীর কপালে নানা দ্বিধা আর জড়তা নিয়ে নিজের ঠোট ছোঁয়ালো। মনে মনে ভাবলো, এই সময়টা যেনো বারবার আসুক। তার মেঘবালিকা যেনো বারবার বাচ্চামিতে মত্ত হোক। আর সে তাতে মুগ্ধ হোক আজীবন।
#চলবে
শব্দসংখ্যা- ১১০০+
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/203003148410920/?app=fbl