# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
অষ্টাদশ পর্ব (১৮ তম)
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
রেখা শিমুলকে সঙ্গ দিতে যেয়ে মেয়েকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন। এই কি সেই ছোট্ট সোনা, পুতুলের মতো শিমুল? মেয়েকে অন্যরা কালিন্দী, থ্যাবড়ামুখী বলতো অনেক বড় পর্যন্ত, কিন্তু তাঁর চোখে শিমুল ছিল ছোট্ট একটা পরী। কি মিষ্টি ছিল তার মুখের বুলি,কি ভদ্র, নম্র ছিল তার আচরণ, কতো লক্ষ্মী, সহিষ্ণু ছিল রেখার শিমুল। এতো অত্যাচারের মধ্যে লেখাপড়া করতো, ছোট ভাই এর যত্ন নিতো, মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিতো,রেখার কাজ কমিয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতো। সেই শিশুকাল হতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো শিমুল। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা করেন নি রেখা।এমন অনেকবার হয়েছে,রান্নাঘরেই নামাজ আদায় করে নিয়েছেন রেখা। মায়ের দেখাদেখি শিমুলও খুব নামাজী হয়ে উঠেছিল। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে ৩০ টা রোজা রাখে শিমুল। সব সন্তানকে যত্ন করে নামাজ শিখিয়েছেন রেখা। পলাশও নামাজ পড়ে চেয়ারে বসে। সূরা,দোয়া-দরুদের বদলে শুধু “আল্লাহ আল্লাহ” করে। ছোট্ট মিতুল অন্য ভাইবোনের নামাজ পড়া দেখে তাদের কপি করে, তার জন্য ও একটা নরম,ছোট্ট, লাল টুকটুকে জায়নামাজ কিনেছেন রেখা, সেখানে নামাজ পড়ে মিতুল, রুকুর সময় প্রায় ব্যালান্স রাখতে পারে না,টলমল করতে থাকে, সিজদায় একদম সটান। তাও পাঁচবার নিয়ম করে পলাশ আর ছোট পাঁচটাকে নামাজে দাঁড় করিয়ে দেন রেখা। অভ্যাস হোক। পলাশ রোজা রাখতে পারে না, তাকে জোরও করেন না রেখা।কিন্তু মৌরি,মুকুল,মিথুনকে রাখতে হয়।
শিমুল যে দেড় বছর ধরে নামাজ পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে,তা জানতেন ই না রেখা। তাঁর হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে শিমুল হাসতে হাসতে বললো,”দেখেছো, মেয়ে দেড় বছর ধরে নামাজ পড়ে না,মা হয়ে তুমি জানোও না।”
রেখা কড়া গলায় বললেন, “তুমি এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা পর্যন্ত করতে না। সেই তুমি যে নামাজ ছেড়ে দিবে,তাতো আমার কল্পনাতেও ছিলো না শিমুল। আমার মনে তো কোনোদিন এই সন্দেহ আসেনি।”
“আমার সাথে নামাজ পড়তে পারতে কিংবা তোমার সাথে নামাজ পড়ার জন্য আমাকে ডাকতে পারতে।”
“সবকিছুতে খুঁত খোঁজো কেন?আমি নামাজ পড়তাম তোমার দাদীর ঘরে।ওখানে ডাকলে যেতে তুমি?”
“আফরোজা বেগমের ঘর বলে কোনো ঘর নেই। এখানে, এই বাড়িতে সব আমার ঘর।”
“তারমানে আমারও নিজের ঘর নেই, তাই না শিমুল?”
“তুমিওতো সমস্ত কথায় খুঁত খোঁজো। তোমার বা পলাশ,মৌরীদের কথা এখানে হচ্ছে না।”
“যা হওয়ার হয়ে গেছে,আজ থেকে আমরা মা-মেয়ে একসাথে নামাজ পড়বো,কেমন মা?”
“আমি পড়বো না। নামাজ পড়ে কি হবে?”
ধর্মপ্রাণ রেখা রাগে নয়,বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান।
“ছোট বেলায় নামাজ পড়তাম,কেঁদে কেঁদে আল্লাহকে বলতাম,আল্লাহ,আমার মায়ের কষ্ট কমিয়ে দাও। আমার বাবাকে ভালো করে দাও।আমার পলাশকে ভালো করে দাও।ঐ খারাপ মানুষগুলোকে শাস্তি দাও।হলো কই?”
“নামাজ হিসাব -নিকাশের বিষয় নয় শিমুল। এটা ফরজ, তোমার অবশ্য কর্তব্য। আর তোমার দোওয়া তো আল্লাহ কবুল করেছেন। আমি অনেক ভালো আছি। তোমার মামাদের থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই তো আমি স্বাধীন। কেউ আমাকে কোনো কষ্ট দেয়না।আমার ভাত-কাপড়ের অভাব নেই। সবচেয়ে বড় কথা,আমার মা অন্ত প্রাণ সন্তানেরা আছে।তোমার মতো হীরার টুকরা মেয়ে আছে যার,তার কিসের অভাব?কিসের কষ্ট? ”
এতো কথাতেও লাভ হলো না।শিমুলকে দিয়ে নামাজ পড়ানো গেলো না।রেখার অনুরোধ, আদেশ, রাগারাগি,কান্নাকাটি, অনশন সবই বিফলে গেলো। রোজার সময় সে সারাদিন না খেয়ে থাকে, নিজের ঘরে একা ইফতার খায়।সেহরি খায় না। রেখা জিজ্ঞেস করলেন,”রোজা রাখো কেন?”
“এমনিই।এটা ঠিক রোজা না। আমারতো এমনিতেই খেতে ইচ্ছা করে না।আর ইফতার খাই কারণ আইটেমগুলো মজা লাগে।”
“আল্লাহর উপরে তোর রাগ?তওবা কর্। তিনি তোকে মেধা দিয়েছেন, অস্বাভাবিক ভালো রেজাল্ট করেছিস, ঢাকা শহরে এতো জায়গা নিয়ে এতোবড় বাড়ি একা তোর, আর কি চাই?”
“এগুলোকে পাওয়া বলছো?রেজাল্ট, বাড়ি কোনোটাই কিছু না। অপমান,অবহেলা, লাথি,ঝাঁটা খাওয়ার দুঃসহ স্মৃতির কাছে এগুলো কিছু না।”
রেখা বুঝতে পারেন,মেয়ে তীব্র মানসিক চাপে ভুগছে।তিনি হাসান ভাইয়ের সাথে আলাপ করলেন।হাসান সাহেব সাইকিয়াট্রিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলেন। শিমুল গেলো না,কোনো ভাবেই তাকে নিয়ে যাওয়া গেলো না।
শিমুল ডাক্তারিতে চান্স পেলো, সারা বাংলাদেশে পঞ্চম হয়ে। রেখা আনন্দে অধীর। কিন্তু শিমুল ডাক্তারি পড়বে না। সবাই হতবাক। রেখা কেঁদে ফেললেন,” তুই না বলতি ডাক্তার হবি?”
” এখন বলি না।ডাক্তাররা পলাশক ভালো করতে পারলো কই?”
“পরীক্ষা কেন দিলি?”
“এমনি।কেমন রেজাল্ট করি,তাই দেখার জন্য। ”
“সব কিছু নিজের ইচ্ছা মতো করবি?”
“হাসালে মা। আমার জন্ম ই হয়েছিল অন্যের ইচ্ছামতো চলার জন্য। ”
“এখন তো সেই অবস্থা নেই। ”
“থাকবেও না। আমি আমার ইচ্ছামতো জীবন চালাবো।”
“তাহলে আমি ই বা কি দোষ করলাম?”
“তুমি তোমার মতো জীবন চালাও।কে নিষেধ করেছে?আচ্ছা মা, যখন আমি শিশু ছিলাম,তখনতো আমার করার কিছু ছিলো না। একটু যখন বড় হলাম,তখন থেকে আমার জন্য কারোর কিছু করা লেগেছে? তুমিই বলো।তুমি কিছু করেছো তখন থেকে আমার জন্য? করোনি। আমাকে মারধোর করা হলে কেঁদেছ, কিন্তু কারোর কবজি মুচড়ে দাওনি। আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দাওনি। ”
” তুইতো সব কিছু জানিস। তাহলে এসব কথা তুলিস কেন? আমার করার উপায় থাকলে আমি তোর জন্য করতাম না? হাজার খাটুনির পরও তোকে আমি পড়াই নি? ”
“খুব অল্প সময়ের জন্য। তারপরে আমি নিজেই পড়েছি।”
কি বলবেন রেখা এই অবুঝ মেয়েকে?
“বাড়ির মালিকানা পাওয়ার পরেও তোর দাদীকে আর বাচ্চাগুলিকে রেখে দিয়ে তাদের সময় দেওয়াতে তোর এতো রাগ?”
“আমার নিজের ভাগ্যের উপরে রাগ।”
“আগে তো রাগ করতিস না,শত কষ্টেও অভিযোগ করতিস না,কোনো নালিশ ছিলো না,এখন এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন?”
“আগে ভুল করেছি।”
রেখা প্রবল দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। হাসান সান্ত্বনা দেন,”এতো চিন্তা করছো কেন,রেখা? মেয়েটা জন্ম থেকে নিজে কষ্ট ভোগ করেছে, মা-ভাইকে খুব নিষ্ঠুর ভাবে অত্যাচারিত হতে দেখেছে। ও আশা করেছিল, সুযোগ পেয়ে তুমি তোমার স্বামী,তার দ্বিতীয় স্ত্রী, শাশুড়ি, তোমার ভাই, ভাইবৌদের প্রতি কঠিন প্রতিশোধ নিবে। নিজের জন্য না নাও,সন্তানদের কষ্টের প্রতিশোধ নিবে। সেটা যখন নিলে না উল্টে ওদের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দিলে,তখন ও মনে জোর আঘাত পায়। তোমার আসলে শিমুল-পলাশকে অনেকটা সময় দেওয়া উচিৎ ছিলো।”
“শাশুড়ি যে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন।”
“এখানেই তো ভুল করেছো। শিমুলের সবচেয়ে অপ্রিয় মানুষটার জন্য দিনের সবটুকু সময় ব্যয় করেছো। বছরের পর বছর।ঐ সময়টা শিমুল-পলাশের প্রাপ্য ছিলো। সে কথা মেয়েটা বারবার বলেছেও।প্রতিশোধ না নাও, তোমার শাশুড়িকে ওল্ড হোমে রেখে আসতে পারতে।আমিও তোমাকে এই কথা বলেছিলাম কয়েকবার।”
“ওল্ড হোমে ঐ অবস্থায় রাখলে তিনি বাঁচতেন না হাসান ভাই। ”
“উনার মতো মানুষের বেঁচে থাকার চাইতে তোমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটোর বেঁচে থাকার বেশি দরকার ছিল। ”
“আপনিও আমাকে দোষ দিচ্ছেন? পৃথিবীতে তাহলে ক্ষমা, সেবা এসব শব্দ থাকবে না? শুধু প্রতিশোধ, রাগ এসব শব্দেরই জয় হবে? সময় দেওয়া মানে কি সারাক্ষণ কাছে বসে থাকা?আমি শিমুলের পাশে বসে থাকিনি, কিন্তু ওর প্রতি আমার মমতা,ভালোবাসা অনুভব করার বয়স-বুদ্ধি কি ওর হয় নি?”
“বুঝছো না কেন, ওর শিশুকাল,বাল্যকাল আর দশজনের মতো না। পলাশ -শিমুলের মতো মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত মানুষ পাওয়া কঠিন। এই ক্ষতের উপরে প্রলেপ পড়ার দরকার ছিলো। দুর্ভাগ্যবশত প্রলেপ পড়ে নি।যাহোক,অতো চিন্তার কিছু নেই। এই বয়সটা একটু এরকমই। টেনশন কোরো না। ওর উপরে চাপ দিও না। ওকে সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।শিমুল খুবই ভালো মেয়ে। সৎ ভাই বোনদের নিয়ে তার কোনো অনুযোগ নেই। ওদের সে আপন ভাইবোনের মতোই ভালোবাসে। এটা কিন্তু সহজ ব্যাপার না। মৌরীদের তুমি এতো ভালোবাসো,এটা তাকে দুঃখ দেয়না।কিন্তু তোমার দিন রাত ভুলে শাশুড়ি সেবা, রিয়ার বাপ-মা এলে যত্ন আত্তি করা ওর মনে খুব লেগেছে। ”
শিমুল ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে। রেখা খুব খুশি হলেন। মেয়ে যেখানে হাত দেয়,সেখানেই সোনা ফলে। মৌরী ক্লাস টেনে উঠলো।মুকুল এইটে,মিথুন সিক্সে,মুমু থ্রি তে।মিতুলকে ওয়ানে ভর্তি করা হলো এবারে। সব ক’জন লেখাপড়ায় ভালো। পড়াশোনার বিষয়ে মা ও বড় আপা বড়ই কঠিন। ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া বাচ্চাগুলোর আদবকায়দার প্রশংসা চারদিকে। তথ্যগুলো ওমর-রিয়ার কাছেও যায়।খুশি হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের দৈন্যতাও তখন প্রকট হয়ে নিজের কাছে ধরা পড়ে।
রিয়ার মা মারা গেছেন বেশ আগে। স্বামী মারা যাবার ছয় মাসের মধ্যে। পড়শীদের ভাষায়,”পিঠের মাংস খসে খসে পড়তো।” রিয়াকে তার এক দূর সম্পর্কের খালা বলেছিলেন, একদিন রিয়ার মা’কে দেখতে এসেছিলেন তিনি, রোগীর মাথা লাল পিঁপড়া দিয়ে এমন ভাবে ছেয়ে ছিলো যে চুল বলে কোন বস্তু যে আছে সেটা বোঝার কোনো উপায় ছিলো না। রিয়া পাথর হয়ে বসেছিলেন। শুভ বোধোদয় আগেই হয়েছিল তাঁর ধাক্কা খেতে খেতে, মৃত মায়ের পাশে বসে থেকে আর নানা কাহিনী শুনে তাঁর মনে হলো, এই ছোট্ট অনিত্য জীবনে একটা মানুষের কতো জিনিসের দরকার হয় যার জন্য মানুষ মারামারি, কাটাকাটি, খুনোখুনি করে?লোভ-রাগ-হিংসা-কুটিলতায় জর্জরিত হয়? ইস্,কি ক্লেদাক্ত জীবন রিয়ার, তার মায়ের,ভাইদের ! জীবনটাকে যদি আবার একদম গোড়া থেকে শুরু করা যেতো!
চলবে