# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২১ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
“মা,তোমার দয়ার শরীর। মিঃ অ্যান্ড মিসেস খান মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।এখন কোনও একটা গ্রামে কোনও একটা বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় পেয়েছেন। ওখান থেকে কিছুদিন পরে ঘাড় ধাক্কা খাবেন,কোন সন্দেহ নেই। তারপরে শেষমেষ তোমার দরবারে হাজিরা পেশ করবেন। আশ্রয় প্রার্থনা করবেন। তুমি সম্মতি জ্ঞাপন করবে। বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরটি তাঁদের জন্য বরাদ্দ হবে।তুমি নিজের হাতে ফুলশয্যা…. ”
“শিমুল ! ” রেখাকে এতো জোরে চিৎকার করতে কেউ কখনো শুনেনি।
শিমুল চমকে উঠলো। থতোমতো খেয়ে বললো,”স্যরি। তবে তোমার এমন অভ্যাস আছে বলেই আগের থেকে সাবধান করে দিচ্ছি। ওরা যেন এই বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসে। ”
পর্দার তলা দিয়ে একজোড়া পা দেখা গেলো।মৌরী। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে মা-বোনের কথা শুনছে। রেখার খুব কষ্ট লাগলো মেয়েটার জন্য। ওমর-রিয়া যতোই খারাপ হোক,ওর তো বাপ-মা। আর বাবা-মায়ের সম্বন্ধে কটু কথা কার ভালো লাগে?
শিমুল ডাক দিল,”মৌরী।”
মৌরী ভেতরে এলো। মাথা নীচু। মুখে বেদনার ছাপ।
“শোন মৌরী, আমার কথায় তোর কষ্ট লাগলে মাফ করে দিস। তোর বাবা-মাকে আমার বাড়িতে আমি কোনোভাবে অ্যালাউ করবো না।থাকা দূরের কথা,গেট দিয়েও ঢুকতে দিবো না। তোদের কারো যদি উনাদের সাথে দেখা করার ইচ্ছা হয়,বাইরে কোথাও মিট করবি। আমার বাড়িতে নয়।”
রেখা বললেন, “আমার বাড়ি,আমার বাড়ি করছিস কেন? এই আমার আমার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে না। আমাদের বলা শিখ্।”
“আবারও স্যরি মা।এটা আমার বাড়ি।শুধুই আমার বাড়ি। ”
মৌরী মুখ খুললো,”আপা,বাড়িটা আমাদের দাদাজান বানিয়েছিলেন। ”
“সেজন্য বাড়িটা সবার হয়ে যাবে না। কাগজে কলমে বাড়িটা আমার। মালিক আমি। দাদাজান বাড়িটা বানিয়েছেন, এটা দুনিয়ার সবাই জানে।তোর এই কথা স্বরণ করিয়ে দেওয়ার মরতবা কি? সাতজনের দাদাজান,তাই বাড়িটা সাতজনের?এখনই এই টাইপের চিন্তা?”
“আমি তা বলছি না আপা। বাড়ির মালিক তুমি। কিন্তু তাই বলে আমাদের কোনো গেস্ট এই বাসায় আসতে পারবে না? তোমার পারমিশন নিতে হবে?”
শিমুল রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো।
“অফকোর্স আমার পারমিশন নিতে হবে। তোমরা চোর-ডাকাত-ধান্দাবাজদের গেস্ট বানাবে,সেই সুবাদে তারা আমার বাড়িতে এসে প্রথমে এক গ্লাস পানি খাবে,পরের দিন এসে ভাত খাবে,তারপরদিন বিছানা কাঁথা নিয়ে আসবে,আলটিমেটলি আমার বাড়িতে পারমানেন্টলি জাঁকিয়ে বসবে,এটাতো আমি হতে দিবো না। খুব গায়ে লাগছে মৌরী তোমার বাপ-মা সম্পর্কে বলাতে?তোমার বাপ-মা আমাদের তিনজনকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিলো,চিন্তাও করলো না আমরা কোথায় যাবো,কি খাবো,বাঁচবো কেমন করে?তুমিতো সারাজীবন মহা আরামেই কাটালে,নিজের বাপ-মার রাজত্ব কালে রাজকন্যার মতো রইলে,ভালো খাবার,দামী পোশাক, আবার আমার আমলে আমারই মায়ের আদরে যত্নে
লকলকিয়ে বেড়ে উঠলে। খবরদার মা,আমার কথায় বাধা দিতে আসবে না। মানুষের বাচ্চা মানুষই হয়,সাপের বাচ্চা সাপই হয়। এতোদিন আমার মায়ের রক্ত চুষে তোমরা পাঁচ ভাইবোন খেলে, তোমাদের নাওয়ানো, খাওয়ানো, পড়ানো সব আমরা করলাম, এখন তোমার গুণবান -গুণবতী বাপ-মা যুদ্ধ জয় করে এসেছে, তাদের জন্য তোমার দরদ উথলে উথলে উঠছে। ওরা যদি এ বাড়ির চৌকাঠেও পা রাখে, সবকটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবো আমি।”
রেখার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। শিমুল অনেকদিন ধরেই রুক্ষ ভাবে কথাবার্তা বলে, কিন্তু আজ সীমা পার করে গেলো যে। আব্বা-আম্মা যখন বেঁচেছিলেন, তখন রেখার একটা বাড়ি ছিলো। আব্বা-আম্মা চলে গেলেন, বাড়িটা হয়ে গেলো ভাইদের বাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে বেশির ভাগ সময় দাসী হয়েই জীবন কাটিয়েছেন। আর এখন তিনি মেয়ের বাড়িতে থাকেন। মেয়ে প্রায়ই এটা স্বরণ করিয়ে দেয়। কথা বলার সময় কোনো হুঁশ থাকে না।কি সুন্দর করে বললো,তার কথা অমান্য করলে বাড়ি থেকে সবকটাকে বের করে দিবে।সবকটার মধ্যে যে শিমুলের মাও আছে! এটা শিমুলের একবারও মনে হলো না।
শিমুলের এতো কড়া কথাগুলো মৌরীর হজম হচ্ছিল না। সে তো একবারও বলেনি যে সে তার বাপ-মাকে এখানে নিয়ে আসতে চায়?এতোগুলাো কথা শুনালো কেন আপা? আপার সব ভালো, তারপরও আপার সাথে সবার একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। কারণ আপা বাড়ির সবাইকে তার অধীনস্থ ভাবে। মা,আপা আর ভাইয়া না থাকলে তারা ভেসে যেতো এটা ঠিক,কিন্তু এটাতো বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার জিনিস না।
জীবন যুদ্ধে রেখা এখন বড় ক্লান্ত। ছোট থেকেই তিনি খুব ধর্মপ্রাণ, সব বিষয়ে আল্লাহর উপরে তাঁর পূর্ণ ভরসা। তাই হাজারো দুঃখে-কষ্টে তিনি ভেঙে পড়েন না। হাসানের গোপন কর্মকাণ্ড এবং করুণ পরিণতি তাঁকে প্রচন্ড আঘাত করেছে।তাঁর প্রতি হাসানের নীরব ভালোবাসা তিনি অনুভব করতে পারতেন। সেই ভালোবাসা তাঁর অক্সিজেন হিসাবে কাজ করতো। হাসানের চোখে তিনি ভালোবাসা দেখতে পেতেন,কামনা না।অথচ হাসানের লালসা ছিলোতো বটেই, বিকৃত জঘন্য লালসা।তাঁর ই বাড়িতে একটি শিশু প্রায়ই ভয়ংকর ভাবে নিপীড়িত হতো হাসানের কাছে, ভাবা যায়? ক্লান্ত-শ্রান্ত রেখা যখন রান্না করতেন বা ঘরের অন্য কোনো কাজ করতেন,হাসান তখন একই বাড়িতে তাঁর লালসা চরিতার্থ করতেন রেখারই মেয়ের সাথে, ভালোবাসলে বুঝি এসব করা যায়? হাসান ছিলেন রেখার ভরসার স্হান। সেই ভরসা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। আর কখনো কাউকে বিশ্বাস করতে পারবেন না রেখা,কখনোই না। আগে শিমুলের কাছে থাকলে, শিমুলের মুখের দিকে তাকালে, শিমুলের কথা শুনলে জানটা শীতল হতো,সেই শিমুল কতো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। রুক্ষ কথাবার্তা, কঠিন মুখ। তাঁর কাছে আসে না বললেই চলে। তিনি শিমুলের কাছে গেলেও সে নিস্পৃহ হয়ে থাকে। শিমুলের বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করে না রেখার। তাঁর নিজের গ্রামে নিজের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছা করে পলাশকে নিয়ে। রিয়ার পাঁচ সন্তানের জন্য তাঁর বুক ফেটে যাবে নিশ্চয়, কিন্তু তাদেরতো তিনি ভালো ভালো স্কুল থেকে ছাড়িয়ে গ্রামে নিয়ে যেতে পারেন না। ওরা গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্তও নয়। আবার ওমর-রিয়ার কাছে বাচ্চাগুলোকে দেওয়ার কথা ভাবলেই অসুস্থ লাগে রেখার। একেতো ওমর-রিয়ার চরিত্র -স্বভাব ভালো না, দুজনেই দায়িত্ব জ্ঞানহীন,আর এখনতো চাল চুলা বলে কিছু নেই। ছেলেমেয়েদের মানুষ করবে কি করে?তারা যদি বাচ্চাদের দাবী করে,রেখার কি সাধ্য বা অধিকার না করার? বাচ্চাগুলোও তাঁকে ছাড়া থাকতে পারবে না। এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই রেখা হেসে ফেললেন। নিজের মেয়ে তাঁকে ছাড়া দিব্যি চলতে ফিরতে পারছে। রেখা আপন ভাইদের দেখা পান নি কতটা বছর। একটা সময় ছিলো,যখন আব্বা আম্মাকে একদিন না দেখলে কেঁদে বুক ভাসাতেন রেখা। সেই বাবা-মাকে ছাড়া জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কাটিয়ে দিলেন রেখা। জগতে কারো
জন্য কোনো কিছু আটকে থাকেনা।
মৌরী সারাদিন খায় নি। রেখা অনেক সাধাসাধি করেছেন, মুখে তুলে খাইয়ে দিতে গেছেন,লাভ হয়নি। মৌরীর কষ্ট অনুভব করতে পারেন রেখা।বাপ-মায়ের কৃতকর্মের ফল ছেলেমেয়েদের পোহাতে হয়। আগাগোড়া রেখা চেষ্টা করেছেন, বাচ্চাগুলোকে কেউ যেন তাদের বাপ-মা নিয়ে লজ্জা না দেয়। ওদের স্কুলের বন্ধু বান্ধবরা কতো বেড়াতে এসেছে,ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায় নি,ওরা একটি ভাঙা, কলঙ্কিত পরিবারের সন্তান,রেখা ওদের বিমাতা। আর আজ রেখার নিজের মেয়েই মৌরীকে বাপ-মা তুলে কথা শোনালো।আগে শিমুলের মধ্যে আম্মার ছায়া দেখতে পেতেন রেখা,শান্তি পেতেন, এখন পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বাচ্চার বাপইতো দুইটা-তিনটা বিয়ে করে, শত শত বাচ্চা বাপ আর সৎ মায়ের নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়, শিকার হয়ে নানার বাড়িতে আশ্রয় নেয়,সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে শুধু উপেক্ষা আর অত্যাচার। তারা তো এতো ঘৃণা, রাগ বুকে পুষে রাখে না। তিনি বর্তমানে শিমুলের একটা গুণই দেখতে পান। লেখাপড়ায় দূর্দান্ত। এটুকুই। শিমুল এখন খুবই অন্তর্মুখী। অল্পেই রেগে যাওয়া,বিরক্ত হওয়া, রূঢ় ভাবে কথা বলা এক তরুণী। স্পষ্ট কথা সুন্দর করেও বলা যায়। শিমুল পলাশের প্রতিও এখন আগের মতো আবেগী,যত্নশীল নয়। নিজের ইচ্ছা মতো বাইরে যায়,ইচ্ছা মতো ঘরে ফিরে।
রাতে বাচ্চাদের খাওয়ার জন্য ডাকতে যেয়ে বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলেন রেখা। মৌরীরা পাঁচ ভাই বোন এক ঘরে বসে আছে, ছোট্ট মিতুল ঘর থেকে বের হতে গেলে বাকি ভাইবোনেরা আটকে দিচ্ছে, পলাশ বসে আছে একা,অন্য ঘরে। মৌরীর মুখ গম্ভীর। স্পষ্ট বিভাজন। তারা পাঁচ জন সহোদর,সহোদরা। পলাশ বৈমাত্রেয়।
রেখা না বুঝার ভান করে মৌরীর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,”কি রে? লেখাপড়া বাদ দিয়ে কি গল্প হচ্ছে? আমিও একটু শুনি। আর পলাশটা একা বসে আছে কেন? সে তো একা থাকার বান্দা না।”
চারজন উত্তর দিলো না,গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। শুধু ছোট্ট মিতুল রেখার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো,” মেজ আপা বড় ভাইয়াকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। বড় ভাইয়া কান্না করেছে।”
রেখা মৌরীকে একটু শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”এমন করলে কেন,মৌরী?”
মৌরী ইন্টারমিডিয়েট দিবে। ঘাড় বাঁকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিলো,” তোমরা মালিক পক্ষ। আমি আর আমার ভাইবোনেরা তোমাদের দয়ায় বেঁচে আছি। মালিকদের সাথে বেশি মেলামেশা না করাই ভালো।”
রেখার মাথাটা ঘুরে উঠলো। তিনি কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলেন। পারলেন না।
চোখ খুলে রেখা দেখলেন অনেকগুলো কান্নাভেজা মুখ। রেখাকে চোখ খুলতে দেখে মৌরী রেখার উপরে হুমড়ি খেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,”মা। আর কক্ষনো এমন বেয়াদবি করবো না,তোমাকে আর দুঃখ দিবো না।এবারের মতো মাফ করে দাও।”
চলবে।