নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-২৪

0
878

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
২৪তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ঘরের সবাই থমকে গেলো। মন্জু প্রথমে শিমুলকে দেখতে পায় নি। সে সদর দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসেছিল। বহুদিন হলো,রাত আটটার আগে শিমুল বাসাতে ফিরে না। কাজেই নিশ্চিন্ত মনে এক নাগাড়ে সে রেখা-শিমুলের নামে গীবত গাইছিলো। ওমর একবার কড়া ধমক দিয়েছিলেন, রিয়াও কয়েকবার থামাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মন্জুকে চুপ করানো এখন তাঁদের সাধ্যের বাইরে। মা আর আপার নামে কথা বলায় মুকুল, মিথুন ক্ষিপ্ত। তারা দুই তিনবার বলেছে,”এতো মিথ্যা কথা বলছেন কেন?চুপ করেন।” মন্জু উল্টে খিঁচিয়ে উঠে বলেছে,” চুপ করমু না।আইজ আমার বাপ-মা আইছে, তাদেরকে আমার সব কথা কওন লাগবো। ” রিয়া-ওমর মিথুন আর মুকুলকে কাছে টানতে পারেন নি। তারা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওমর আর রিয়ার আদরে পলাশ একেবারে গলে গেছে। মুমু আর মিতুল চুপচাপ আছে।ওমর-রিয়া কোনো প্রশ্ন করলে সলজ্জে উত্তর দিচ্ছে। মৌরী ঐ যে পালিয়েছে, আর এই মুখো হয়নি।

মন্জু শিমুলকে দেখতে পেলো একটু দেরি করে।প্রথমে থতোমতো খেলেও সে আবার কথা বলতে লাগলো যেন শিমুলকে দেখতেই পায়নি। তার দৃঢ় বিশ্বাস, ওমর-রিয়া বাড়ি ও ক্ষমতা দুইই দখল করবেন এবং রেখাকে তার দুই ছেলেমেয়ে সহ বের করে দিবেন। তবে বের করে দিলে মন্জুর ভালো লাগবে না। তার ইচ্ছা রেখারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যান,বিশেষ করে শিমুল।তারপরে কি করে শোধ তুলতে হয়,তা জানা আছে মন্জুর।

শিমুলকে দেখে ওমর এগিয়ে গেছেন মেয়ের দিকে। জেলে সুদীর্ঘ দিন শাস্তি ও অপমান ভোগ করে, দুঃসময়ে আত্মীয় -বন্ধুদের চরম অবহেলা পেয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই অনেকটা শিক্ষা হয়েছে। নিজেদের ন্যাক্কারজনক কাজগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করার সময় পেয়েছেন প্রচুর। মা যতো খারাপই হন, সন্তান হয়ে তাঁকে দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা, অমানবিক জুলুম করার কষ্টে প্রায়ই কাঁদেন ওমর।মা তো আর ফিরে আসবেন না, জানতে পারবেন না তাঁর প্রতি ভালোবাসা ফিরে এসেছে সন্তানের বুকে।

রেখা। তাঁর প্রথম স্ত্রী। খালাতো বোন হওয়ার সুবাদে রেখাকে জন্মের পর থেকেই চিনেন ওমর। নবজাতক রেখা, হামাগুড়ি দেওয়া রেখা, ফিডার খাওয়া রেখা, টলমল করে হাঁটতে শিখা রেখা, ফ্রক পরে চি-বুড়ি খেলায় ব্যস্ত রেখা, সালোয়ার কামিজ পরা শান্ত স্নিগ্ধ,সদা হাস্যময়ী রেখা সব রেখাকেই ভালো করে চেনা তাঁর। সহজ-সরল -মমতাময়ী রেখার সাথে বছরের পর বছর এতো নির্মম আচরণ কেমন করে তিনি করলেন তা আজও রহস্য স্বয়ং ওমরের কাছে। খালা-খালু কতো ভালোবাসতেন ওমরকে! খুব উঁচু মনের মানুষ ছিলেন তাঁরা। সেই খালা-খালুর বুকের ধনকে কোন্ অপরাধে ভয়াবহ কষ্টে রেখেছিলেন ওমর? আজ রেখার জন্য তাঁর অন্তর ভালোবাসা ও অনুশোচনায় টইটম্বুর। তাতে লাভ কি? রেখার সাথে তাঁর বিশাল দূরত্ব। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে কিভাবে রেখার কাছে যাবেন ওমর? কোথায় যেনো এক অদৃশ্য বাধা।

তাঁর প্রথম সন্তান শিমুল। কতো আদরে-ভালোবাসা আর মমতায়, কতো যত্নে বেড়ে ওঠার অধিকার ছিলো তার, সেই মেয়ে তাঁর কারণেই জন্ম থেকে প্রবল যন্ত্রণা ভোগ করছে। লাথি – ঝাঁটা খেতে খেতে বড় হয়েছে তাঁর
প্রথম দুই সন্তান। রেখা-শিমুল -পলাশের প্রতি প্রবল ভালোবাসায়, তীব্র অপরাধ বোধে ভীষণ ভারাক্রান্ত বোধ করেন ওমর।

“শিমুল, মামনি…. ”

“পলাশ,এদিকে আয়।”

বোনের আদেশ বুঝতে পেরে পলাশ কোনোমতে উঠে দাঁড়ায় টলমল পায়ে,শিমুল যেয়ে তার হাত ধরে।

নিজের মেয়ে। কিন্তু জোর খাটানোর মুখ নেই ওমরের। রিয়া শিমুলের হাত ধরেন। শিমুল শান্ত ভাবে হাত সরিয়ে নেয়। রিয়া জড়িয়ে ধরেন শিমুলকে,”আমাদের ক্ষমা করে দাও মামনি।”

“আয় পলাশ।”
মুকুল-মিথুন বলে,”আমরাও যাবো আপা।”

“আয়।”
বোন ঘরে ঢোকার পর থেকেই তার ওড়না ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো মিতুল। এক হাতে পলাশ,আরেক হাতে মিতুলকে নিয়ে এগিয়ে যায় শিমুল। তির তির করে কাঁপছে সে। প্রচন্ড রাগে,তীব্র যন্ত্রণায়। রিয়া আবার তাকে আটকান,”আমার কয়েকটা কথা শোনো মামনি।”

মুমু পাকা বুড়ির মতো বললো,”যাই, মায়ের কাছে যাই। মা ঘুম থেকে উঠলেই আমাকে খুঁজে বেড়াবে।”

মন্জু মুখ বাঁকিয়ে বললো,” আর মা,মা করন লাগবো না। তুমার আসল মা চইলা আইছে। তুমাদের পাঁচ ভাই-বইনের কষ্টের দিন শ্যাষ।”

ওমর এবারে প্রচন্ড ধমক লাগালেন,” যাও এখান থেকে। বখাটে মহিলা,তখন থেকে বকবক করছে।”

ধমকের শব্দে সবাই কেঁপে উঠেছে শিমুল আর রিয়া ছাড়া। মন্জু ভয় পেলো,কিন্তু গেলো না।

ওমর আবার চিৎকার করলেন,”কানে কথা যায় নি?এখনো দাঁড়িয়ে আছো?”

শিমুল ঠান্ডা গলায় বললো,” চেঁচাবেন না। এটা আমার বাড়ি। আমার দাসী। আমার চাকরকে আমি ধমকাতে পারি, বাইরের কেউ না। আমরা সবাই এখন উপরে যাচ্ছি। মন্জু, মেহমানরা এখন বের হয়ে যাবেন।তাঁরা গেলে দরজা আটকে দিও।”

দলটা ভিতরে চলে গেলো। ওমর-রিয়া অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। কি করবেন,বুঝে উঠতে পারছেন না। মন্জু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ওমর-রিয়ার কি বাড়ি দখলের ইচ্ছা সত্যি ই নেই? নাকি এটাও একটা চাল?

উপরে উঠে শিমুল গেলো মায়ের ঘরে। মা খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন চুপচাপ। মৌরী মায়ের কোলে মাথা রেখে উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

রেখা শিমুলকে দেখলেন।কিন্তু কিছু বললেন না। আবার আগের ভঙ্গিতে বসে রইলেন।

“মৌরী, সামনে পরীক্ষা। এখানে বসে থাকলে চলবে না। যা,পড়তে বস্। কি হলো?”

মৌরী চলে গেলো। ফিরে এলো একটা বই নিয়ে। সে মায়ের কাছে বসে পড়বে। বেশির ভাগ সময় মৌরী মায়ের ঘরেই পড়ে।এতে তার নাকি খুব শান্তি লাগে। পরীক্ষার টেনশন কমে যায়।

পরদিন সকালে মতির মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো সবার। মন্জু মৃত অবস্থায় পড়ে আছে তার চৌকিতে।

কিভাবে হঠাৎ এই মৃত্যু? শিমুল জিজ্ঞেস করলো মতির মা,নাজু,পখিকে,”একটা মানুষ মরে গেলো,তোমরা কিছুই টের পেলে না?”

তাদের সম্মিলিত বক্তব্য হলো,মন্জু তাদের সাথে সারভেন্ট কোয়ার্টারে কখনো ঘুমাতো না। সে ঘুমাতো মূল বাড়ির নিচের তলায় একটা ছোট ঘরে।কালকে রাতে দিব্যি খাওয়া দাওয়া করেছে। গল্পগাছা করেছে স্বাভাবিক ভাবে। নাজুর সাথে রাতে কি নিয়ে যেন প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছিল। নাজুকে গালি দিতে দিতেই নিজের ঘরে যায় মন্জু। দরজা আটকানোর অভ্যাস ছিলো না, দরজা আটকে দিলে দমবন্ধ লাগতো মন্জুর।

শিমুল নাজুকে জিজ্ঞেস করলো,”তুই কিছু করিস নি তো? ”

নাজু আঁতকে উঠলো ভয়ে।

“পুলিশে খবর দেওয়া দরকার।”

রেখা শীতল গলায় বললেন,” মন্জুর হার্টের সমস্যা ছিলো। ওষুধ ঠিক মতো খেতো না। হার্ট এট্যাকে মারা গেছে সম্ভবত। পুলিশের দরকার নেই। ”

মতির মাও সায় দিলো। হার্টের ব্যারাম ছিলো মন্জুর।

সাত কূলে কেউ নেই। রেখার উদ্যোগে দাফন-কাফন হয়ে গেল মন্জুর।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here