নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-৩০

0
880

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
৩০ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

মেজ আপা প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,”আব্বু এগুলো জানেন?”

“জানেন।”

আমরা দুই বোন একই সাথে চেঁচিয়ে উঠলাম,”আব্বু জানেন?সবকিছু? খুনের ব্যাপার ও? বিয়ের পরে জেনেছেন নিশ্চয়ই? কে বলে দিয়েছিল সব কিছু? আব্বু তারপরও আম্মুর সাথে কিভাবে আছেন?”

“দুলাভাই আপাকে ভালোবেসে এবং সবকিছু জেনে শুনে বিয়ে করেছিলেন। আপার সব ঘটনা আমরা ভাইবোনেরা, তোর নানা-নানী,তোর আব্বা,এখন তোরা দু’জন, এছাড়া আর কেউ জানে না, জানবেও না। আরেকজন জানতেন, আপার সাইকিয়াট্রিস্ট, তিনি মারা গেছেন। আপা নিজেও এগুলো এখন জানেন কি না,তাও জানি না।তোরাও ব্যাপারটাকে কনফিডেনসিয়াল রাখবি।”

“আম্মু জানেন কি না,এ নিয়ে তোমার মনে সন্দেহ, কি বলছো এসব? ”

“আপা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন, দীর্ঘকাল পরে সুস্থ হলেন, কিন্তু এ পর্যন্ত মা বা বড় ভাইয়া সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। তোদের আব্বুর সামনে ও না। যখন একটু একটু করে সুস্থ হতে থাকলেন, তখন বারবার আমরা সামনে যেয়ে বলতাম,আপা দেখো,আমি তোমার ভাই মুকুল, আমি তোমার বোন মিথুন।আপা চুপ করে থাকতেন। ভালো-মন্দ কিছুই বলতেন না। তোদের এই নানী আর নানা দিন নেই, রাত নেই, অক্লান্ত সেবা করেছেন মেয়ের, চিকিৎসায় কোনো কার্পণ্য করেন নি। উনারা সত্যি ই তখন আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, তাতো হয়েই গিয়েছিলো। ”

“আব্বুর বিষয়টা?”

“তোর বাবা-মা ক্লাসমেট ছিলেন ভার্সিটিতে। প্রথম থেকেই আপাকে দুলাভাই এর খুব ভালো লাগতো। দুলাভাই এটা বুঝতে পারতেন যে মেয়েটার কোনো একটা বড় ধরণের সমস্যা আছে। তিনি গোপনে আপার পিছনে পিছনে এসে এই বাসাও চিনে গিয়েছিলেন। আপার অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সংবাদ কেউ একজন দিয়েছিলেন তাঁকে। দুলাভাই হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি তোদের এই নানীকে মনের কথা খুলে বলেছিলেন। প্রতিদিন এসে বসে থাকতেন হাসপাতালে। আপাকে বাসায় আনার পরে নিয়মিত বাসায় আসতে থাকলেন। তখন আপার চেহারার ভয়াবহ অবস্হা। কিন্তু দুলাভাই এর চেহারা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আপাকে তিনি ভালোবাসেন,আপাকে বিয়ে করতে চান। ততোদিনে বিসিএস করে তিনি অ্যাডমিন ক্যাডারে ভালো অবস্থায় আছেন। দুলাভাইকে তোর নানা-নানী একদিন সব ঘটনা জানান।একেবারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। এই ইতিহাস শুনে সরে যাওয়া দূরের কথা, তিনি আপার আরও অনুরক্ত হয়ে পড়েন। আপা একটু সুস্হ হলে তোর দাদার বাড়ির লোকজন দেখতে আসেন। তোর নানা,নানী এবং আব্বু কোন কিছুই তাঁদের কাছে গোপন করেন নি ঐ তিনটা ঘটনা ছাড়া। আপাকে দেখে তোর দাদার বাড়ির কারোরই পছন্দ হয় নি, বিশেষ করে তোর দাদীর। কিন্তু তোর আব্বা সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় বিয়েটা হয়ে যায়। তোর নানা-নানী যখন বুঝতে পারেন তাঁদের হবু জামাইয়ের ভালোবাসা খুবই খাঁটি এবং তাঁর সাহচর্যে থাকলে মেয়েটা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবে,তখন তাঁরা খুশিমনেই বিয়েটা দেন। ”

“রূপকথা মনে হচ্ছে মামা।”

“জীবন অনেক সময় রূপকথার থেকেও চমকপ্রদ। ”

“তারপর? ”

” তোর নানা-নানী,আমরা প্রতিদিন যেতাম আপার বাসায়। দুলাভাই যতোক্ষণ না ফিরতেন, আমরা দুজন-তিনজন আপার কাছে থাকতাম।তোর নানী প্রতিদিন রান্নাবাড়া করে দিয়ে আসতেন বা বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে যেতেন, নানা ব্যবসার কাজ বাদে বাকি সময় পুরোটা আপাকে দিতেন,সবার আদরে,ভালোবাসায়,যত্নে আপা সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিছু টা স্বাভাবিক হন। তবে ভীষণ চুপচাপ হয়ে যান। আরও সুস্থ হওয়ার পরে আমাদের সবার উৎসাহে আপা একটা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে জয়েন করেন।আপার একাডেমিক রেজাল্ট তো ফাটাফাটি ছিলো। ইংরেজিতেও দুর্দান্ত। তাই কোন অসুবিধা হয়নি।”

ছোটবেলায় যেমন নানাভাই, নানু,দাদীর কোল ঘেঁষে রূপকথার গল্প শুনতাম,এখনো মনে হচ্ছে রূপকথার গল্প শুনছি।অথচ এটা আমাদের গর্ভধারিনীর জীবন কাহিনী।

“থানা-পুলিশ হয় নি? সাইকিয়াট্রিস্টকে তো সব জানাতে হয়েছিলো। ”

“সাইকিয়াট্রিস্ট আপার কষ্ট ফিল করে প্রায়ই রুমাল দিয়ে নিজের চোখ মুছতেন। তিনি বলেছিলেন, আপা ইনটেনশনালি অপরাধগুলো করেন নি। তারপরও আইনের মারপ্যাঁচ ছিলো,ওগুলো তোদের নানা সামাল দিয়েছিলেন। কিভাবে দিয়েছিলেন, বিস্তারিত জানি না।”

আমি নানীর দিকে তাকালাম। বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি ছোট খালা আর ছোট মামা ছাড়া আর কোনো মামা-খালাকে কিংবা আম্মুকে উনাকে মা ডাকতে শুনিনি।

মেজ আপা বললো,” আম্মুর টার্গেট নানাভাই -নানুও ছিলেন, আমি শিওর। ”

“নিশ্চয়ই ছিলেন। কিন্তু মায়ের আত্মহত্যা আর বড় ভাইয়ার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আপার বুকে শেলের মতো বেঁধে, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর পুরো পটভূমির পরিবর্তন হয়। তোর নানাভাই -নানুকে আপা আর ঘেন্নাও করতে পারেননি, ভালোও বাসতে পারেন নি।তাছাড়া চিকিৎসার পরে তিনি পুরোপুরি না হলেও অনেকটা সুস্থ হয়েছেন, প্রতিশোধের নেশা তাঁর মধ্যে আর নেই, কিন্তু রাগ, জিদ, কটু কথা থেকে গেছে,এটা তাঁর অসুস্থতার পার্ট।”

“আম্মু তোমাদের সাথে এতো চুপচাপ, নিস্পৃহ থাকেন কেন?তোমাদের তো তিনি খুব ভালোবাসতেন? ”

“এখনো খুবই ভালোবাসেন,আগের মতোই। শুধু প্রকাশটা নেই। ”

আমি বললাম,”আম্মু আমাদেরকে ভালোবাসতে পারলেন না কেন?আমাদের তো কোনো দোষ নেই? ”

উত্তর দিলেন মেজ খালা,” এটা তোমাদের ভুল ধারণা মামনি। আম্মু খুব বেশি ভালোবাসে তোমাদের। কিন্তু সে প্রকাশ করতে পারে না। সেই ক্ষমতা ই সে হারিয়ে ফেলেছে। আপা আমার কাছেও তোদের এক রাত থাকতে দেয় নি। কেন, জানিস? তোদের খালু যদি রেপ করে তোদেরকে ! এমনকি একই চিন্তা মুকুল -মিতুলের ক্ষেত্রেও। যে ভাইদের সে এতো ভালোবাসে,তাদের ব্যাপারেও তার সন্দেহ। যদি তোদের ক্ষতি হয়?তোরা না পারবি কইতে, না পারবি সইতে।সেই চিন্তায় আপা অস্থির। তোদের বয়স তিন হতে না হতেই পড়ানো শুরু করা। কারণ , তার মেয়েদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে, অনেক অনেক আয় উপার্জন করতে হবে, কেউ যেন তাদের এতোটুকু অসম্মান করতে না পারে। এলোমেলো অসুস্থ চিন্তা কিন্তু সে মনে করে,যা করছে তোদের ভালোর জন্য ই করছে।”

ছোট মামা বললেন,” দাদীর বিষয়ে মা-বাবার উপরে কঠিন রাগ আছে তোদের,অভক্তি ও। কিন্তু আম্মুরা, তোরা তোদের দাদীকে দেখেছিস শৈশবের সরল দুটি চোখ দিয়ে। দাদীর স্নেহ -মমতা-ভালোবাসায় তোরা বিভোর ছিলি, তোরা নাতনি,তোদের তো ভালোবাসবেন ই, কিন্তু তোদের দাদী কিন্তু মোটেই সহজ মানুষ ছিলেন না। তোদের কাছে দাদী আম্মুর নামে বদনাম করতেন না? মাথা নিচু করে ফেলবি না, উত্তর দে। সারাক্ষণই তিনি আপার নামে বদনাম করতেন। আপা তখন কিছুটা সুস্থ, কিন্তু উনার মানসিক অত্যাচারে আপা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। আর তার অসুস্থতা
মানে ভায়োলেন্স। আপা তো তাঁর ছেলেকে সেধে বিয়ে করেন নি। ছেলে পাগল হয়ে আমার বোনকে বিয়ে করেছে। এই সত্যটা জেনেও তিনি আপাকে খোঁটার উপরে রাখতেন। কেমন খোঁটা দিতেন জানিস? আমার রাজপুত্র ছেলেটাকে এই কালো ডাইনি বশ করেছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে বাপ মা কুৎসিত মেয়েটাকে আমার হীরার টুকরা ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। মাথা নাড়াচ্ছিস কেন?একটা বর্ণও মিথ্যা না।তোদের আব্বু তাঁর মা’কে অনেক বুঝাতেন। এতে তোর দাদী আরও খেপে যেতেন। ছেলে কি দেখে বিয়ে করলো? একেতো পেত্নীর মতো চেহারা, তার উপরে মাথা খারাপ। তখন কিন্তু তিনি গ্রামে থাকতে চাইতেন না। এই ছেলের কাছেই থাকবেন আর বৌকে সমানে কথা শোনাবেন। তোর দাদাও এই মানসিকতার ছিলেন।দেখে শুনে তোর নানা-নানী আপাকে বাসায় নিয়ে আসতে চাইলেন। আপা সেটাও আসবেন না। আমরা পালা করে সারাদিন আপার কাছে থাকতাম যেন শাশুড়ি কথা শোনাতে না পারেন, আপা নিজেকে ইনসিকিউরড না ভাবেন।এতে তোর দাদীর রাগ আরও বেড়ে গেলো। একেতো এই কুরূপা বউ কালো যাদু করে তাঁর ছেলেকে বশ করেছে, তার উপরে বৌএর বাপের বাড়ির লোক এসে জামাইএর অন্ন ধ্বংস করছে। ব্যাপারটা ছিল উল্টো। এই বাসা থেকে প্রতিদিন আমরা নানারকম খাবার নিয়ে যেতাম। আপার তখন প্রচুর পুষ্টিকর খাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু তোর দাদীর কথার জ্বালায় খেতে পারতো না। একদিন তোর নানা -নানী এসে আপার শ্বশুর -শাশুড়িকে আলাদা ঘরে ডেকে নিলেন। তারপর থেকেই তোদের দাদা-দাদীর ভোল পাল্টে গেলো। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কি হয়েছিল বলতো?”

আমি সভয়ে বললাম,”নানাভাই বন্দুক দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন? ”

মামা হেসে বললেন,” না। তোদের নানা-নানী নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন আপার শ্বশুর -শাশুড়িকে। তখন তোদের মেজ ফুপুর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তার নাম করে একসেট গয়নাও দিয়েছিলেন তোর নানা-নানী। ”

আমার মামা-খালারা কেউ মিথ্যা কথা বলে না। সুতরাং ছোট মামা যা বলছেন,তা সত্যি। হায়! দাদীকে ফেরেশতা মনে করতাম, আমার বুকের ভিতরে দাদীর জন্য যে রাজসিংহাসন ছিল, তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।

” তোর দাদা-দাদী ভীষণ লোভী ছিলেন রে। দুলাভাইয়ের বাবা-মা, তোদের দাদা-দাদী, তাঁদের সম্পর্কে এসব বলতে আমারও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু সত্যটা তোদের জানতে হবে। একবার তোর মেজ ফুপু-ফুপা বেড়াতে এসেছেন, আমরাও কয়েকজন গিয়েছি। নতুন বিয়ে হয়েছে দেখে তোর ফুপু অনেক গয়না পরে এসেছিলেন। সেজ আপা আর ছোট আপা আবিষ্কার করে, একটা পুরো গয়নার সেট তোদের মায়ের। বানু নানী তোর মা’কে ভীষণ ভালোবাসতেন,তিনি দিয়েছিলেন আপাকে এই সেট টা। ভারি হার, ঝুমকো, দুটা চূড়, একটা আংটি। পরে নিরিবিলিতে আপাকে মেজ আপা এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলো। আপা বললেন,শাশুড়ি তাঁর কাছে এই সেটটা নিজের মুখে চেয়েছেন, তিনি না দিয়ে পারেন নি। কি হবে গয়না দিয়ে?

সুস্থ হয়ে আপা চাকরিতে ঢুকলেন অনেক বড় পোস্টে। আপার বেতন দুলাভাইয়ের থেকেও অনেক বেশি ছিলো। তোর দাদী আপাকে চুষে ছিবড়া বানাতে লাগলেন। গয়না বা টাকার প্রতি আপার কোনো আকর্ষণ ছিলো না। তোর দাদা গরু কিনবেন, শিমুল টাকা দাও, তোর ছোট চাচার পরীক্ষার ফিজ লাগবে,শিমুল টাকা দাও, তোর বড়ফুপুর অপারেশন হবে, শিমুল টাকা দাও। তোর বাপের কাছ থেকে তো মাসে একটা বড় অ্যামাউন্ট পেতেনই, আবার এদিকে ছেলেকে না জানিয়ে বৌএর কাছ থেকে কথায় কথায় টাকা নেওয়া।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here