নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-৩১

0
863

নানান বরণ মানুষ রে ভাই
বড় পর্ব
৩১ তম পর্ব
নাহিদ ফারজানা সোমা

জীবনটা দূর্বিষহ মনে হচ্ছে। আমার চেনা জানা কারোর জীবন এতো জটিল না। কারোর মা খুনী না, কারোর মায়ের ইতিহাস এতো করুণ না। এতোদিন যাদের আপন ভেবে এসেছি, তাঁরা নাকি আমার সৎ নানী, সৎ মামা,সৎ খালা। যে দাদীকে ফেরেশতা মনে করতাম,এখন শুনি তার অন্য রূপ। যে নানাভাই স্নেহ -ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক ছিলেন, পীরের মতো যাঁকে ভক্তি করেছি,ভালোবেসেছি, তাঁর যৌবনকালের হঠকারিতার জন্য আম্মু পাগল হয়ে গেলেন,খুনী হয়ে গেলেন,আমার আপন নানী আত্মহত্যা করলেন,আপন মামা রাজ্যের কষ্ট ভোগ করে বড় অদ্ভুত ভাবে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। আমার জীবনের কোন কিছুই সুস্থ না,স্বাভাবিক না।কেমন যে লাগছে, তা প্রকাশ করতে পারছি না।

নানী ঘুম থেকে উঠেছেন। ছোট খালা চামচে করে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছেন। নানীর ঠোঁটের কোণা দিয়ে স্যুপ গড়িয়ে পড়ছে। মেজ খালা বললেন,”মুমু, আগে ডায়াপার চেন্জ করা উচিৎ ছিল।তারপরে খাওয়াতিস। খুব দুর্গন্ধ আসছে।”

ছোট মামা এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করলেন।

নানীর সব কাজ নার্স করে দেন, আজ আমাদের গুপ্ত কথাবার্তার জন্য তিনি বাইরের ঘরে আছেন।

আমি নানীর দিকে তাকালাম। হাড়ের সাথে চামড়া লেপ্টে আছে একদম। কুঁচকে যাওয়া চামড়া। কোটরাগত চোখ। খাওয়া,গোসল, টয়লেট, হাঁটা সবকিছু অপরের দয়াতে চলে। এখন থেকে নানীকে কেউ যদি না দেখে, তাহলে ক্ষুধায়,তৃষ্ণায়, মলমূত্র মাখামাখি হয়েই মৃত্যু হবে তাঁর। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে গেলেও এক ফোঁটা পানি নিজে গড়িয়ে নিতে পারবেন না।

এমন দিন যে একদিন আসবে, তা সুন্দরী, বিদূষী, লাস্যময়ী তরুণী রিয়া কখনোই ভাবেন নি। মনে করতেন, এমনই হেসে খেলে, এমনই সুখে-সাচ্ছ্বন্দে, এমনই ভোগ বিলাসিতায় অনন্ত জীবন কাটবে। আমরা সবাই তাই। একসময় জরা-বার্ধক্য আসবে, অন্যের দয়াপ্রার্থী হয়ে থাকতে হবে, তারপর একদিন চিরতরে চলে যাওয়ার ক্ষণ উপস্থিত হবে, এসব কথা আমরা সবাই জানি,কিন্তু মনে রাখিনা।

রিয়া মনে রাখেন নি বলেই একজনের সংসার নষ্ট করতে পেরেছেন, দোজবরেকে বিয়ে করেই ক্ষান্ত হন নি, স্বামীর স্ত্রী -সন্তানদের অমানবিক কষ্ট দিয়েছেন, ধন সম্পদের লোভে শাশুড়িকে মারতে চেয়েছেন। এখন কোথায় গেলো সেই রূপ যৌবন? কাঁড়ি কাঁড়ি গয়না গাটি কোন্ কাজে আসলো তাঁর? তাঁর ভাগ্য যে ছেলেমেয়েরা ভালো। ছোট খালা আর ছোট মামা ছাড়া আর কোনো সন্তান তাঁকে মা বলে ডাকেনি বা তেমন ভালোবাসেনি বটে, কিন্তু তাঁর যত্নে যেন এতোটুকু ত্রুটি না থাকে, সেটা সন্তানেরা দেখছে। সবচেয়ে বেশি দেখছেন সেই সন্তান যিনি রিয়ার গর্ভজাত নন,যার গোটা জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে কয়েকজনের জন্য, তার মধ্যে রিয়া অন্যতম। কি অদ্ভুত!

নানা-নানী-দাদী কাউকে ঘেন্না করতে পারছি না। আমার মা’কে যাঁরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছেন, নিজেদের অজান্তে আমরা তিন বোনই তাঁদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি। এতো ভালোবেসেছি যে সব সত্য সামনে আসার পরও তাঁদের ঘৃণা করতে পারছি না। থাক্,দরকার কি ঘৃণা করার? আমার আপন নানীর চিঠির সূত্র ধরে বলতে হয়, রাগ-ঘৃণা- বিদ্বেষ যদি কোনো উপকারে আসতো,তাহলে একটা কথা ছিল। উপকার যখন করে না,বরং উল্টোটাই করে, তাহলে মনে এসব অনুভূতিকে পুষে রেখে লাভ কি?

আম্মুর জন্য হঠাৎ মনটা কেমন কেমন করা শুরু করলো। কঠিন, কর্কশ আম্মুর মধ্যে যে চরম দুঃখী, অসহায়, অভিমানী, মা-ভাই হারা আম্মু বাস করেন, তাঁকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অনেক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো, সারারাত আম্মু ড্রইংরুমের সোফায় শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন, আব্বু আম্মুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কোনো সামান্য ব্যাপারে আম্মুর রাগ উঠলো, চেঁচামেচি করতে করতে আম্মু একসময় কাঁপতে শুরু করতেন,মুখের কোণে ফেনা জমে যেতো।

আর তখন দাদী আম্মুর কানে না যায় এমন ভাবে আমাদের সামনে বলতেন,”ঢং! কতো যে ঢং করতে পারে তোদের মা! একে মা বলেই ডাকবি না। কোনো মা বাচ্চার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারে? মাছের মা। সারাক্ষণ পাঁয়তারা খুঁজে, কি ভাবে অশান্তি করা যায়।”

দাদীর কথা আমাদের সত্য মনে হতো। আম্মুকে বাজে মহিলা মনে হতো।আব্বুকে মেরুদণ্ডহীন মনে হতো।দাদীকে পরম শুভাকাঙ্ক্ষী মনে হতো।

দাদী আরও বলতেন, “বংশটাই খারাপ। তার বাপ-মায়েরও স্বভাব খুব খারাপ ছিল। তোর বাবাকে বাণ মেরে নিজেদের বশে নিয়ে নিয়েছে। বাণ মারার ব্যাপারটা কিন্তু সত্য, বুবুরা। আমাদের নবীকেও খারাপ লোকজন বাণ মারার চেষ্টা করতো।”

ছোট মামার কাছে আরও শুনলাম,দাদী নিজের ইচ্ছাতেই এই বাড়িতে বেশি থাকতেন। আব্বু-আম্মু যতো উঁচু পোস্টে উঠতে লাগলেন,তাঁদের বেতন যতো বাড়তে লাগলো,দাদীর সামনাসামনি খারাপ ব্যবহার ততো কমতে লাগলো। কিন্তু চাহিদা হতে থাকলো আকাশচুম্বী। আমরা বরাবর দাদীর কাছে শুনে এসেছি, আমরা হওয়ার আগে দাদীকে ধরে আনা হয়েছিল, তারপরে তাকে জালে আটকে ফেলা হয়, আমাদের দেখাশোনা করার জন্য না তাঁকে গ্রামে যেতে দেওয়া হয়েছিল, না অন্য ছেলেমেয়ের বাড়িতে। আমরা নিজেরাও এমনটা দুই একবার দেখেছি।

মামা জিজ্ঞেস করলেন,” মনে করে দেখ্ তো,তোর দাদী যখন অন্য ছেলেমেয়েদের বাসায় দুদিন থাকতে যেতে চাইতো, তার দু’একদিন পরেই আপা ট্যুরে যেতেন কিনা?”

ভেবে দেখলাম,তাইতো! তেমনই তো হতো।

মামা বললেন,” উনি এই বাড়ি ছাড়ার নাম করতেন না, কিন্তু যখনই আপার ট্যুর প্রোগ্রাম হতো কিংবা অফিসের কাজে বিদেশ যাওয়া লাগতো, তখনই তোর দাদীর অন্য ছেলেমেয়েদের বাসায় যাওয়ার বাই উঠতো। জাস্ট আপার মেন্টাল প্রেশার বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আপা তোদেরকে বাড়িতে একা রাখবেন না, এমনকি তোদের বাবার কাছেও রেখে যাবেন না, সমগ্র পুরুষ জাতটাই তাঁর কাছে বিপদজনক, আমাদের কাছেও রাখবেন না,তিনি তখন তোদের দাদীকে “এখন যাওয়া যাবে না” বলে জোর করতেন।সেটাই তোরা দেখতে পেতিস। বাসায় ফিরে আসার পরে আপা তাকে অন্য ছেলেমেয়েদের বাসায় ঘুরতে যেতে বলতেন, তখন তিনি যেতেন না।বলতেন,দরকারের সময়ই যেতে পারিনি,এখন যেয়ে কি করবো।তিনি তোর মা’কে কষ্ট দিতে খুব ভালোবাসতেন। আগে তো নানান আজেবাজে কথা সারাক্ষণ ই সামনাসামনি বলতেন, তোর মায়ের পদবী-অর্থ বাড়ার সাথে সাথে উনার সরাসরি খারাপ ব্যবহার বন্ধ হলো বটে, কিন্তু ইনডিরেক্ট অত্যাচার করে গেছেন সারাজীবন। তোদের মা কিন্তু এতোকিছুর পরেও তাঁর খাওয়া, চিকিৎসা, শখ-আহ্লাদ পূরণ কোনো কিছুতেই অবহেলা করেন নি, নিজে সেধে পড়ে কটু কথা বলেন নি। কোনোদিন বাপের বাড়ি এসে বা স্বামীর কানে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসেন নি। বিয়ের পর থেকে তোর দাদা-দাদীর প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব খরচ বহন করেছেন তোদের বাবা-মা। পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগির সময় নিজেদের ভাগের জমি তোর মায়ের অনুরোধেই দুলাভাই তাঁর বড় ভাইয়ের নামে লিখে দেন। যেহেতু তাঁর আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। তোর ছোট চাচার ব্যবসার মূলধন যুগিয়েছেন আপা, তোদের মেজ ফুপু-ছোট ফুপুর বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ দিয়েছেন তোদের আব্বু-আম্মু। তোরা জানিস সেসব কথা?জানিস না। তারা মানুষের উপকার করে যায় খুব নীরবে,ঢাক ঢোল পিটিয়ে না। এই যে বাড়িটায় আমরা থাকছি, এটাও তোদের মায়ের বাড়ি। কিন্তু ভাব গতিক দেখলে মনে হয় না এ কথা তাঁর মনে আছে। তাঁর স্বপক্ষে আরও সার্টিফিকেট কি তোদের সামনে দিতে হবে?”

” আম্মু নিজে এতো উদার,কই, আমাদের তো উদারতা বা ভালো কাজের শিক্ষা দেন নি কখনো? একটাই বুলি, পড়ো,পড়ো,ফার্স্ট হতে হবে, অনেক উঁচুতে উঠতে হবে, বিরাট চাকরি করতে হবে।”

” আমি তো বললামই রে মা, তোর মা পুরোপুরি সুস্থ না। তাঁর অনেক অ্যাবনরমালিটি আছে। তাঁর মনে হয়, মেয়েদের এক নম্বর কাজই হচ্ছে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজে উপার্জন করা। আপা নিজের মায়ের পরিণতি দেখেছেন। নিজের বেলায় ভালো চাকরি -বেতনের আগে শ্বশুর -শাশুড়ির এক রূপ দেখেছেন, পরে আরেক রূপ। ছোট আপা চাকরি করে না দেখে আপা রাগে তাঁর সাথে ভালো করে কথাও বলেন না।”

সবই বুঝলাম,কিন্তু আমাদের মা খুনী! বুঝে হোক, না বুঝে হোক,আম্মু তিনজন মানুষকে খুন করেছেন। এটা মেনে নেওয়া বড় কঠিন। তবু আম্মুর জন্য বুকের ভেতরটা হু হু করছে। আর আব্বু? খাঁটি প্রেমের উদাহরণ সম্রাট শাহজাহান নন, রোমিও নন, নিখাদ প্রেমের উদাহরণ আমার আব্বু যাঁকে আমাদের অমেরুদণ্ডী প্রাণী মনে হতো, দাদী বলতেন,”বৌ এর ভেড়া।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here