শেষ রাত পর্ব-৬

0
1676

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আচ্ছা আপনার প্রাক্তন আসলে কি আপনি তার কাছে ফিরে যাবেন?’

ধ্রুবর প্রশ্ন শুনে আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওনার দিকে চাইলাম। তুলতুলকে বুকের উপর নিয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা করছেন তিনি৷ তুলতুলের পিঠের উপর রাখা ওনার ডান হাত একটু পর পর ওঠানামা করছে। প্রশ্নটা যে তিনিই করেছেন তা ওনার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। আমি তপ্ত শ্বাস ফেললাম৷ ওনার এমন প্রশ্নে মনের ভেতর ক্ষীণ রাগ জন্ম নিলো। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বয়ে কিছু সুক্ষ্ম রাগ আর অভিমান। আমি নিশ্চুপ রইলাম। ওনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুলতুলকে নিজের কাছে নিয়ে নিলাম। রাগ কিংবা অভিমানের উপেক্ষিতেই তুলতুলকে ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার খাটালাম। ওনার ঠিক উল্টো দিকে মুখ ফিরে চুপচাপ তুলতুলকে নিয়ে শুয়ে পরলাম। মিনিট খানেক পেরুতেই তুলতুলের ঘুম জড়ানো চোখ আস্তে আস্তে বুজে এলো। আচমকাই ধ্রুব মৃদুস্বরে হেসে উঠলো। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে আমার কৌতুহলী চোখজোড়া ওনার ঠোঁটের সহজ সরল হাসিতে স্থির করলাম। হঠাৎ এভাবে বিনাকারণে হাসার মানে বুঝলাম না। ধ্রুব খানিক্ষন হেসে শান্ত গলায় বললেন-

‘বউ রাগ করে স্বামীর কাছ থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নিলো। তবে ঝগড়া করল না আর রাগ প্রকাশও করল না। বুদ্ধি খাটিয়ে স্বামীকে শায়েস্তা করার সুক্ষ্ম এবং নিখুঁত পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। যাইহোক তুলতুলকে মাঝে রাখুন। নয়তো ঘুমের মাধ্যে নিচে পরে যাবে।’

আমি কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা কি স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার স্বাভাবিক মনকষাকষি! ঠান্ডা মাথার ঝগড়া নাকি অন্য কিছু!! নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে তুলতুলকে আলতো করে আগলে নিয়ে আমাদের মাঝে শুয়িয়ে দিলাম। ধ্রুব এবার তুলতুলের দিকে ফিরে কাত হয়ে শুলেন। এতে করে মুখোমুখি হলো আমাদের দুজনের। অস্বস্তিতে ফ্যাকাসে বর্ণের হতে লাগলো আমার মুখ। ধ্রুব হয়তো বুঝলো। হয়তো বা লক্ষ্য করলো আমার অস্বস্তিবোধ। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই অন্যদিকে ফিরে গেলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলাম। মানুষটাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হলো না বলেই একটু স্বস্তি বোধ করলাম। না বলতেই তিনি বুঝে গেলেন আমার পরিস্থিতি এতে ওনার প্রতি কিছুটা ভালো লাগা এবং শ্রদ্ধা জন্ম নিলো।

ভ্যাপসা গরমে ঘুমের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠলাম আমি। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে পিটপিট করে চোখ মেললাম। চোখ মেলে তাকাতেই সিলিংফ্যানে নজর পরলো। ফ্যান ঘুরছে না তার মানে কি কারেন্ট চলে গেছে! চোখের দৃষ্টি নামিয়ে দেয়াল ঘড়িতে স্থির করলাম৷ ঘড়ির ছোট কাঁটা সাতটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্ক সচল হতেই পেটের উপর ভারি কিছুর উপস্থিতি টের পেলাম৷ আমার ঘুম ঘুম ভাব এবার পুরোপুরিই কেটে গেল। মাথা হাল্কা উঁচু করে আমার পূর্নাঙ্গ দৃষ্টি দিলাম পেটের উপর। সাথে সাথেই বরফের ন্যায় জমে গেল আমার সম্পূর্ণ শরীর। দম আটকে এলো আমার। গরমের মধ্যেও শীতলতায় শিউরে উঠলাম আমি। নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে পেটের ওঠানামা করা বন্ধ করার প্রাণপণে চেষ্টা করলাম। কিন্তু হলো না। আমার নিঃশ্বাসের সাথে সাথেই আমার পেটের উপরে থাকা ধ্রুবর হাতও ওঠানামা করতে লাগলো। আমি থমথমে অবস্থায় ধ্রুবর দিকে তাকাই। তুলতুল ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরে একদম চিপকে শুয়ে আছে। ধ্রুবর ডান হাত তুলতুলের উপর দিয়ে এসে পরেছে আমার পেটের উপর। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। চোখ দুটো বন্ধ দেখেই খুশিতে চিকচিক করে উঠে আমার চোখ। ওনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আমার দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে ভীষণ সচেতনতার সঙ্গে ওনার হাত সরিয়ে আমি উঠে গেলাম। চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলাম। শুকনো ঢোক গিলে ধ্রুবর দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে গেলাম জানালার কাছে। জানালা খুলে দিতেই দমকা হাওয়ায় শীতল হয়ে গেল পুরো রুম। পেছন ফিরে ধ্রুবর ঘুমন্ত মুখ দেখতেই লজ্জা আঁকড়ে ধরলো আমাকে। নাকমুখ দিয়ে যেন গরম আভা বের লাগলো। লজ্জা আর অস্বস্তিতে একা একাই লালনীল হতে লাগলাম। ভাগ্যিস তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। না হলে কতটা আপত্তিকর পরিস্থিতিতেই না পড়তে হতো আমাকে। হঠাৎই উপলব্ধি করলাম আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে আমাকে এতটা গভীর ভাবে ছুঁতে পারেনি৷ সাদাফের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে শুধু একে অপরের হাত ধরা হয়েছে। এর চেয়ে গভীর ভাবে কখনোই সাদাফ আমাকে ছুঁতে চায়নি। দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম আমি।

সময়টা বিকেলের শেষ। চারপাশ ভ্যাপসা গরমে কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। দারুণ গুমোট একটা পরিবেশ। কাক ডাকছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। কর্কশ ডাকেও অদ্ভুত এক উদাসিনতা ছড়িয়ে দিচ্ছে আশেপাশে। উদাসীনতায় হাহাকার করে উঠলো আমার হৃদয়। চোখের পলকেই কেটে গেল দু’দিন। চিরচেনা এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার অন্তিম সময় হলো। এই বিষন্ন বিকেল জানিয়ে দিচ্ছে এবার আমার বিদায় নেওয়ার পালা। বাবা-মা আর ভাইয়াকে ছেড়ে যাওয়ার বিষাদময় অন্তিম প্রহর এসেছে। বিষন্ন সন্ধ্যার মতোই আঁধার নেমে এলো আমার মনে। কান্না চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। তবুও চোখ ভিজে আসলো। আব্বু, আম্মুকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কয়েক ফোটা চোখের জল বিসর্জন দিলাম। সবশেষে ভাইয়ার সামনে আসতেই ভাইয়া দুঃখি দুঃখি গলায় বলল-

‘তুই ধ্রুব ভাইয়ের বাসায় চলে যাচ্ছিস তাই আমার খুব খারাপ লাগছে। আর চিন্তাও হচ্ছে ভীষণ। তোর মতো পেত্নিকে মনি আন্টি আর ধ্রুব ভাই সামলাতে পারবে কি-না কে জানে!! খুব মায়া হচ্ছে ওনাদের জন্য।’

চোখেজল নিয়েই জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ভাইয়ার দিকে। মন খারাপের মাঝেও হেসে ফেলল সবাই। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠবো তখনই বাধ সাধলো তুলতুল। সে কিছুতেই ভাইয়ার গলা ছাড়তে রাজি নয়। ভাইয়ার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একপ্রকার ঝুলে আছে। অল্প কিছুদিনেই মেয়েটা ভাইয়ার সাথে একদম মিশে গেছে। ধ্রুব আর আমি বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তুলতুলকে ছাড়িয়ে নিলাম ভাইয়ার কাছ থেকে। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে।

‘জানালার গ্লাস উপরে তুলে দিন। ধুলাবালি আসছে। আপনার সমস্যা হতে পারে।’

আমি শান্ত চোখে ধ্রুব দিকে তাকালাম। তিনি সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ড্রাইভ করছেন নির্বিকার ভঙ্গিতে। আমি নিম্ন স্বরে বললাম-

‘নাহ, সমস্যা হবে না।’

‘আমার জানামতে আপনার ডাস্ট অ্যালার্জি আছে। তবুও বলছেন ধুলোবালিতে সমস্যা হবে না!!’

আমি চুপ করে রইলাম। ধ্রুব কিভাবে জানলেন আমার ডাস্ট অ্যালার্জির কথা তা নিয়েই ব্যস্ত হলো আমার মস্তিষ্ক। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব নিজেই জানালার গ্লাস তুলে দিলেন। আমি কিছুই বললাম না। ধ্রুবকে খুব অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে। এক এক সময় এক এক রকমের আচরণ করেন তিনি। আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন কিনা তা-ও বুঝতে পারছি না।

——————

‘মনি মা আমার কাছে দাও আমি নাস্তা বানাচ্ছি।’

মনি মা তরকারি নাড়তে নাড়তে শাসনের সুরে বললেন-

‘তোর এত ব্যস্ত হতে হবে না নাস্তা বানানো নিয়ে। অন্যদিন রান্না করিস। সামনে আরও অনেক দিন পরে আছে।’

আমি ইতস্তত করে বললাম-

‘তাহলে তোমার কাজে হেল্প করি!’

‘আচ্ছা আমার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বল। কোনো হেল্প লাগলে আমি বলবো।’

আমাদের কথার মাঝেই ধ্রুবদের এক রিলেটিভ রান্নাঘরে এসে হাজির হলেন। মনি মা ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

‘উনি আমার ফুফাতো বোন হয়। ধ্রুব খালা। তুইও ওনাকে খালা বলেই ডাকতে পারিস।’

‘নতুন বউ থাকতে আপনি রান্না করছেন কেন আপা?’

ভদ্রমহিলার কথায় মনি মা অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘মেয়েটা কালকেই তো এলো বাসায়। আজকেই কিভাবে রান্নার কাজে লাগিয়ে দেই!’

ভদ্রমহিলা এবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘তা.. রান্নাবান্না ঠিক মতো করতে পারো তো!’

আমি দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বললাম-

‘তেমন ভালো পারি না। টুকটাক রান্না করতে পারিনি।’

আমার জবাবে ভদ্রমহিলা মুখ বিকৃতি করে বলে উঠলেন-

‘বলে কি এই মেয়ে! বিয়ে হয়ে গেছে এখনও ঠিকঠাক রান্না করতে পারো না এটা কেমন কথা!’

আমি মাথা নিচু করে মেঝেতে তাকিয়ে রইলাম। মনি মা চুলা বন্ধ করে আচঁলে হাত মুছে নিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে পুরোপুরি ফিরে তাকায়। হাল্কা হেসে শান্ত গলায় বলে,

‘বিয়ে হয়েছে বলেই যে রান্নাবান্না শিখতে হবে এমন তো কোনো নিয়ম নেই নিপা। বিয়ের জন্য ঘরের সব কাজ জানা থাকতেই হবে এমনটা হলে তো যে কোনো কাজের মেয়ের সাথেই আমার ছেলের বিয়ে দিতাম।’

মনি মা কিছুটা থেমে আবারও বললেন-

‘ছোট থেকে এক মায়ের কাছে পড়াশোনা শিখেছে এখন না হয় ওর মনি মা’র কাছে রান্না করা শিখবে। আমি নিজেই শেখাবো সব কিছু। তবে লেখাপড়া শেষ করুক তারপর ধীরে ধীরে সংসারের কাজ শিখবে এত তাড়াহুড়ো তো নেই।’

ভদ্রমহিলা মুখ কালো করে চলে গেলেন। মনি মা আমার কাধে হাত রেখে বললেন-

‘এমন অনেক আত্মীয়স্বজন আছে যাদের কাজই হলো মানুষের খুত ধরা। মানুষকে ছোট করে কথা বলা। এদেরকে সঠিক সময় সঠিক ভাবে জবাব দিতে হয় না হলে এদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। আর হ্যাঁ এসব কথায় একদমই মন খারাপ করিস না। যাই হোক বাদ দে। ধ্রুবর জন্য চা নিয়ে যা এখন।’

আমি মুচকি হাসলাম। মনি মা’কে যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি ওনার ব্যবহারে। একটা মানুষ এতটা ভালো হয় কি করে!

চলবে…

[সময়ের অভাবে রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here