শেষ রাত পর্ব-৮

0
1864

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুব তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় যুগল চেপে ধরলেন আমার গালে। একটু আগেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেভাবে তুলতুলের মুখের সর্বত্র জুড়ে চুমু এঁকে দিয়েছিলেন। ঠিক সেভাবেই বোধহয় অবাঞ্ছিত স্পর্শে কাতর করতে চাইলেন আমাকে৷ আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। থমকে গেল আমার মন মস্তিষ্ক সব। এক হাত দিয়ে শক্ত করে খামচে ধরে রাখলাম ধ্রুবর শার্টের কিছুটা অংশ। কয়েক সেকেন্ড কাটলো এভাবেই। ধ্রুবর তপ্ত ঠোঁট জোড়া এবার অগ্রসর হতে লাগলো আমার বা গালের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে সচল হলো আমার মস্তিষ্ক। তৎক্ষনাৎ মুখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। তার বুকের কাছে হাল্কা ধাক্কা প্রতিবাদ করলাম। আমার প্রতিবাদ কিংবা বাধা ধ্রুব খেয়াল করলো কি-না জানি না। সে নিজের মতোই শব্দ করে চুমু খেলেন আমার বা গালে। আবারও স্তব্ধ হলাম আমি। বলহীন শরীর এবার থরথর করেই কেঁপে উঠলো। ধ্রুব আমাকে মুক্ত করলেন তার উষ্ণ ছোঁয়া থেকে। তুলতুলকে কোলে নিয়ে আনন্দের সাগরে মন ভাসাতে ভাসাতেই ছুটে চললেন রুমের বাহিরে। কানের মধ্যে তীরের মতো এসে বিঁধলো তার উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর।

‘মা!! মা!! দেখো তুলতুল আমাকে পাপা ডেকেছে। এক বার দু’বার না তিন-চার বার বলেছ। বাবা তো আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। তুমি জলদি বাবাকে ডাক দাও। তোমাদের সামনে তুলতুল পাখি আবারও আমাকে পাপা ডাকবে দেখে নিও…’

এই রকম আরও নানান কথা ধ্রুব বেশ উত্তেজনা নিয়ে একের পর এক বলে যাচ্ছেনল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আগের জায়গায়। তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে গালে হাত দিয়ে স্তম্ভিত হলাম আমি। ডান গাল এখনও জ্বালা করছে। ওনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ঘষাতেই গাল জ্বলে উঠেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল কোনো কিছুই মাথায় ডুকছে না। বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত মুহুর্তটা। ধ্রুব কি খেয়াল করেছে সে কি করে গেছে আমার সাথে! হয়তো খেয়াল করেনি তাই তো ড্রয়িং রুমে এত হৈ-হুল্লোড়। মনি মা আর বাবার সাথে খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। এই অযাচিত ঘটনার কথা মনে পরলে কি তিনি লজ্জা পাবেন! অস্বস্তি বোধ আর অনুশোচনায় চুপ করে রইবেন। না-কি বরাবরের মতোই তার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটবে না!

ঘড়িতে সময় বারোটা বেজে একুশ মিনিট। রুম আধো আলো আর আধো আঁধার। ফেরি লাইটের আলোয় সব কিছুই স্পষ্ট। তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে। রুম আলোকিত করে রাখার কারণ আমি আর তুলতুল দু’জনেই। তবে তুলতুলের চেয়ে বেশি প্রয়োজন আমার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘুরে খুবই অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হয় মাথার ভেতর। এই কারণেই সব সময় রুম আলোকিত করে রাখতে হয়। যদিও এতে ধ্রুবর খানিকটা অসুবিধে হয় তবে তিনি কখনই তা মুখ ফুটে প্রকাশ করেননি। কিন্তু উনি না বললেও আমি বুঝতে পারি। তুলতুলের অপর পাশে ধ্রুব পাশ ফিরে শুয়ে আছেন৷ হয়তো ঘুমিয়ে পরেছেন এতক্ষনে। তবে আমার ঘুম আসছে না। ঘন্টা খানেক সময় চুপচাপ শুয়ে থাকার পরেও দুচোখের পাতায় ঘুম এসে ধরা দিলো না। কাল ভার্সিটিতে যেতে হবে ভেবেই ঘুমানোর চেষ্টা করলাম খুব। তবে কোনো লাভ হলো না এত চেষ্টা করেও। মাথাটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে যাওয়া মন আর ধ্রুবর স্পর্শে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমি। সব কিছু মিলিয়ে কেমন গন্ডগোল পাকিয়ে গেছে মাথায়।

‘তুলতুলের আম্মু!’

আচমকাই ধ্রুবর ডাকে আমি আনমনেই ‘জ্বি!’ বলে সাড়া দিলাম। পরক্ষণেই নিজের মুখ চেপে ধরলাম। ধ্রুব এখনও ঘুমান নি! এক দেড় ঘন্টা শুয়ে থেকেও ঘুমায়নি তিনি! কি আশ্চর্য! আর উনি জানলেই বা কিভাবে আমি জেগে আছি। আমি তো একটুও নাড়াচাড়া করিনি।

‘আমার মনে হচ্ছিলো আপনি এখনও ঘুমান নি ঠিক তা-ই হলো। আমার ধারনাই সত্যি।’

ধ্রুব নিম্নস্বরে কথাটা বললেন। তার কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো আমাকে সজাগ পেয়ে তিনি কিঞ্চিৎ খুশি বোধ করছেন। আমি আগের মতোই চুপ করে রইলাম। ধ্রুব এবার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমার দিকে ফিরলেন। আমার মুখোমুখি হয়ে নরম গলায় বললেন-

‘তখনকার ঘটনার জন্য আমি সরি। আমি আপনাকে ওভাবে চুমু… মানে টাচ করতে চাইনি। আসলে তুলতুলের মুখে প্রথম পাপা ডাক শুনে অতিমাত্রায় খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কি করেছি না করেছি কিছুই খেয়াল করিনি।’

আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘হুম বুঝতে পেরেছি।’

‘আপনার এতো অস্বস্তিবোধ করতে হবে না। আর লজ্জাও পেতে হবে না। আমরা আমরাই তো। জাস্ট একটু চুমুই তো খেয়েছি তা-ও আবার গালে। তুলতুলকেও দিয়েছি ও লজ্জা পায়নি তাহলে আপনি কেন এত লজ্জা পাচ্ছেন!’

আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। ধ্রুব তার নিজের কথাতেই থতমত খেয়ে গেলেন। লোকটা কখন কি বলেন তা সে নিজেও জানে না। যখন যা মুখে আসে তা-ই বলে ফেলে। পরে আবার নিজেই হকচকিয়ে যায়। কি অদ্ভুত মানুষ উনি। ধ্রুব গলা পরিষ্কার করে কথা পালটানোর চেষ্টা করলেন।

‘আমাকে পাপা ডাকতে হবে এটা তুলতুলকে কিভাবে শিখিয়েছন?’

‘আপনার ছবি দেখিয়ে শিখিয়েছি।’

ধ্রুব ছোট্ট করে ‘ওহহ’ বলে চুপ করে গেলেন। আবারও নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হলো সাড়া ঘর। আমরা কেউই আর কোনো কথা বললাম না। হয়তো সেই ঘটনার জন্যই অস্বস্তি বোধ করছি দুজনে। দুজনের মনেই হয়তো চলছে লজ্জা আর অস্বস্তির মিশ্রণে অদ্ভুত অনুভূতি।

‘মনি মা! তুলতুলের দুধের ফিটার আমি রেডি করে দিয়েছি। ঘুম থেকে উঠলে ওকে খাইয়ে দিও। আর হ্যাঁ গোসল করানোর সময় পানি হাল্কা গরম করে নিও। পানি যেন বেশি গরম না হয় খেয়াল রেখো।’

মনি মা কপাল কুচকে বিরক্তিভাব নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ভারি কন্ঠে বললেন-

‘এখনই এমন অস্থির হয়ে পরেছিস তাহলে ক্লাসে মন বসাবি কিভাবে? এত চিন্তা না করে চুপচাপ যা৷ দেরি হচ্ছে তোর। আর হ্যাঁ ক্লাসে বসে বসে আবার তুলতুলকে নিয়ে অস্থির হোস না। ওর জন্য আমি আছি।’

আমি মাথা নিচু করে মলিন মুখে ধ্রুব কাছে গেলাম। ধ্রুবর অদ্ভুত চাহনি আমার দিকেই স্থির। আমি ধ্রুবর সাথে বেরিয়ে যেতে লাগলাম। দরজার কাছে এসে আবারও দাঁড়ালাম। মনি মা’র দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললাম-

‘তুলতুল বেশি কান্নাকাটি করলে আমাকে কল দিও মনি মা।’

মনি মা ক্ষেপে গিয়ে রাগান্বিত গলায় বললেন-

‘তুই এখন যাবি নাকি দিবো এক চড়! কি শুরু করেছিস কতক্ষন ধরে? আমি বলেছি তো আমি তুলতুলের খেয়াল রাখবো। তুই নিজের পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা কর। তুলতুলের জন্য তোর রেজাল্ট খারাপ হলে একদম তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসবো তোকে মনে থাকে যেন। এখন যা। আরেকটা কথা বললে খবর আছে।’

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। এই কয়দিন তুলতুলকে ছাড়া এক মুহুর্তের জন্যেও কোথাও যাইনি৷ আজ তুলতুলকে রেখে বাহিরে যাচ্ছি ভেবেই মনটা খুতখুত করছে। তুলতুল কিভাবে থাকবে তা ভেবেই চিন্তায় সব গুলিয়ে ফেলছি। ধ্রুব বিরক্ত হয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন-

‘উফফ তুলতুলের আম্মু আসো তো। তোমাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে।’

আমি থমথমে পায়ে ধ্রুব সাথে হাঁটতে লাগলাম। ধ্রুব গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বসিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘আর কিছুদিন পর হয়তো আপনার এক্সাম। ঠিক মতো পড়াশোনায় মন দিন। না হলে আম্মু ভীষণ রাগ করবে। আর তুলতুলকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আম্মু আগেও ওর খেয়াল রেখেছে আর ভবিষ্যতেও রাখতে পারবে।’

আমি মাথা নিচু করে রাখলাম। মেয়েটাকে ছাড়া একমুহূর্তও মন টিকছে না। এতক্ষন কিভাবে থাকব তা-ই বুঝতে পারছি না। তুলতুল ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখলেই হয়তো মাম্মা মাম্মা বলে কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন কি মনি মা ওকে সামলাতে পারবে! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ভার্সিটিতে এসে পরলাম৷ ধ্রুব গাড়ি থামিয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘আচ্ছা সাবধানে থাকবেন আর কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে কল দিয়েন।’

আমি ইতস্তত করে মিনমিনিয়ে বললাম-

‘আপনার নাম্বার আমার কাছে নেই।’

ধ্রুব অবিশ্বাসের চোখে আমাকে তাকালেন। মাথা নাড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলেন,

‘আমার নাম্বার মানে আপনার হাসবেন্ডের নাম্বার আপনার কাছে নেই?’

আমি তার দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। ধ্রুব বোধহয় হতাশ হলেন। ছোট করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে আমার দিকে হাত বাড়ালেন। আমি না বুঝে ওনার হাতের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব এবার বিরক্ত প্রকাশ করলেন। হাত নাড়িয়ে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললেন-

‘ফোন দিন। আপনার ফোন।’

আমি কিছুক্ষন স্থির বসে থেকে ফোন বের করে ওনার হাতে দিলাম। তিনি আমার ফোনে কিছু একটা করলেন। খানিকক্ষণ পর আমার ফোন দিয়েই নিজের একটা সেলফি তুললেন। তারপর আবারও ফোনে কিছু একটা করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি ফোন হাতে নিয়ে ভীষণ আগ্রহের সাথে ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। ধ্রুব তার নাম্বার সেভ কিরে দিয়েছে আমার ফোনে। খুব সুন্দর করে ‘তুলতুলের আব্বু’ লিখে নিজের ছবি দিয়ে সেভ করেছেন নাম্বার। আমি ফোন থেকে চোখ তুলে বিস্ময় নিয়ে তাকাই ধ্রুবর দিকে। নির্লিপ্ত তার চাহনি। তিনি কি আমার উপর অধিকার খাটাচ্ছেন? আদর্শ স্বামী হওয়ার চেষ্টা করছেন নাকি এমনিতেই বিনাকারণে এমন করছেন!

‘কি হলো যান। দেরি হচ্ছে তো আপনার আমার দুজনের। আমাকে পরেও দেখতে পারবেন। অনেক সুযোগ আছে দেখার।’

আমার তীক্ষ্ণ চাহনি ওনার দিকে নিক্ষেপ করে বিনাবাক্য ব্যয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। ধ্রুব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন-

‘ক্লাস শেষে অপেক্ষা করবেন। আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবো।’

আমি হাল্কা করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই তিনি চলে গেলেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অলস ভঙ্গিতে ভার্সিটির ভেতরে আসলাম। অডিটোরিয়ামের দিকে আসতেই কারও আকর্ষণ কাড়া ডাকে আমি থমে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধক করেই কেঁপে উঠলো বুক। ভার্সিটিতে আসতেই পুরনো স্মৃতি চারপাশ থেকে আকড়ে ধরতে লাগল।

চলবে…

[গল্প ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন আর আপনাদের মন্তব্য জানেবন। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here