#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘বউয়ের সাথে প্রেম করতে এসেছি৷ এখানে আমার বোকাসোকা শ্বাশুড়ি ভিলেনের রূপ নিবে বলে তো মনে হচ্ছে না। উনি আমাকে আপনার চেয়েও বেশি ভালোবাসে যেমনটা আমার মা আপনাকে ভালোবাসে। তাই ভালোবাসায় ভালোবাসায় কাটাকাটি।’
ধ্রুবর মুখে অমায়িক হাসি। কত সহজ সরল ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছেন। রাত নয়টা বাজে কাউকে কিছু না বলেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমাকে বাসায় না পেয়ে সবাই অস্থির হবেন কি-না এতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে ম্লান কন্ঠে বললাম-
‘বাসার ভেতরে যাননি কেন?’
ধ্রুব ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। গলার স্বর নামিয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-
‘আসলে আমার লজ্জা লাগছিল। বউয়ের সাথে দেখা করতে প্রতিদিন শ্বশুর বাসায় যাওয়া ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক মনে হচ্ছে। তা ছাড়া এসব দেখলে সবাই তো আমাকে বউ পাগল বলবে যা মোটেও আমার ক্যারেক্টারের সাথে যায় না।’
ওনার কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পেল। আমি মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলাম। কোনো রকম নিজের হাসি লুকিয়ে চাপা কন্ঠে বললাম-
‘অহহ আচ্ছা! শ্বশুর বাসায় বউয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়া লজ্জাজনক ব্যাপার!! আর এখন যে কাউকে না জানিয়ে বউকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছেন তার বেলায় কি? এটা তো আরও ভয়াবহ ব্যাপার। এটা কি বুঝতে পারছেন?’
ধ্রুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষনেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললেন-
‘বিয়ের আগে প্রেম করার শখ বিয়ের পর মেটাচ্ছি এর জন্য একটু আধটু ভয়াবহ কাজ তো করতেই হবে। আমার আবার বীরপুরুষ টাইপ প্রেমিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। এখন না হয় প্রেমিকের জায়গায় বীর স্বামী হলাম তাতে ক্ষতি কি!’
আমি অবাক হলাম। বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। কি বলছেন এসব? মানুষটা কি পাগল হয়ে গেছে না-কি! একবার লজ্জায় লাল হচ্ছে আবার কি সব সাংঘাতিক প্রেম প্রেম কথা বলছেন। নির্ঘাত মাথার তার ফার সব ছিঁড়ে গেছে। নাহলে এমন হলেন কি করে?
‘এই রেস্টুরেন্টের কথা মনে আছে আপনার?’
ধ্রুবর কথায় আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলাম। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালাম৷ আনমনা হয়ে বললাম-
‘হ্যাঁ বিয়ের আগে আপনার সাথে দেখা করেছিলাম এখানে।’
আমার কথার বিনিময়ে তিনি মৃদুস্বরে হাসলেন। গাড়ি রাস্তার একপাশে থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে বসলেন হাসি হাসি মুখে। খানিকক্ষণ রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন-
‘সেদিন আম্মু আমাকে একপ্রকার জোর করেই আপনার সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছিল। আমি রেস্টুরেন্টের এই জানালার পাশেই বসে ছিলাম। রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম অনাকাঙ্ক্ষিত এক মানুষের। ভেবেছিলাম এত এত বছর আগে দেখা সেই ছোট্ট পিচ্চি মেয়েটা হয়তো বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে বিষন্ন, উদাসীন এক রমনীতে পরিনত হয়েছে। তখন হঠাৎ করেই রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মায়াকাড়া চেহারার এক শ্যামলতার দিকে নজর পরে৷ যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। খুবই বিধস্ত লাগছিল তাকে। আচমকাই একটা বাচ্চা দৌড়ে যাওয়ার সময় তার সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পরে যায়। সেই বিষন্ন রমনী খুব মমতার সঙ্গে বাচ্চাকে তুলে দেয়৷ কি যেন কথা বলছিল বাচ্চাটার সঙ্গে। কথার মাঝে হঠাৎ করেই হাসি ফুটলো তার সেই উদাসীন মুখে। রাতের আকাশে থাকা ধ্রুব তারার মতোই ঝলমলে ছিল ওই হাসি৷ একদম তীরে মতো এসে বিধেছিল আমার বুকে। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেছিলাম বুকের বা পাশটায়। খানিকটা সময়ের জন্য থমকেও গিয়েছিলাম। পরমুহূর্তে সেই হাসিটাও থমকে গিয়েছিল। ভীষণ আফসোস হয়েছিল হাসিটা মিলিয়ে যেতে দেখে। আবারও সেই মনমরা মুখ। ঘন আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে গেল সেই হাস্যজ্বল চেহারা। যখন আমার কাছে এসছিল মেয়েটা তখন একদমই ভিন্ন লাগছিল তাকে। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। ঝলমলে চোখ দুটোর নিচে জমানো কালি গুলো নির্ঘুম রাত কাটানোর জানান দিচ্ছিলো। মন খারাপ হয়েছিল ভীষণ।’
ধ্রুব থামলেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলেন সেই রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে বড় হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দিকে ধ্রুবর শান্ত শীতল মুখখানা দেখলাম। উনি আমার প্রতিটি বিষয় এতটা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তা আমার ভাবনার মধ্যেই ছিল না। তাহলে কি উনি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন!
আমি নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করলাম-
‘আপনি আমায় ভালোবাসেন কেন? হঠাৎ এই ভালোবাসার কারণ কি?’
ধ্রুব বরাবরের মতোই তার সহজাত তরল ভঙ্গির হাসি দিলেন। তার শান্ত শীতল চাহনি স্থির করলেন আমার কৌতূহলী চোখের দিকে। কোনো কথা না বলেই গাড়ি নিয়ে ফিরে এলেন বাসার পথে। গেইটের কাছে গাড়ি থামতেই আমাকে বললেন-
‘নামুন। বাসায় এসে পরেছি।’
আমি গাড়ি থেকে নামলাম। আমার সাথে সাথে ধ্রুবও তার সিট থেকে নেমে এলেন গাড়ির বাহিরে। আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত নরম সুরে বললেন-
‘আমি ঠিক করেছিলাম আমি তোমার মুখের হাসি দেখতে চাই। তোমার জন্য নয় আমার নিজের জন্য। সেদিনের মতোই আমি বার বার তোমার হাসি দেখে থমকে যেতে চাই। বুকের সেই চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করতে চাই৷ নিজেকে মুগ্ধ করার জন্য হলেও তোমার হাসিটা আমার খুব প্রয়োজন। আর আমি তোমাকে চাই আমার নিজের স্বার্থের জন্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিজের জীবনটাকে পরিপূর্ণ করার জন্য। তোমার ঠোঁটের হাসি সারাজীবন দেখার জন্য। সবটাই চাই আমার নিজের জন্য এটাই হলো তোমাকে ভালোবাসার কারণ। বুঝলে সানসাইন?’
আমি মূর্তি ন্যায় থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি অদ্ভুত এক অনুভূতি। নিজের স্বামীর মুখে এমন সব কথা শুনেও যেন অস্বস্তি হচ্ছে। লজ্জা লাগছে। তার চেয়েও বেশি হচ্ছি অবাক। মানুষটা এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! কাউকে ভালোবাসার কারণ কি আদোও এসব হতে পারে? আমাকে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব দু হাত বাড়িয়ে সহজ গলায় বললেন-
‘তুলতুলের আম্মু! আসুন তো আমাকে একটা টাইট হাগ দিন। তুলতুল পাখি হয়তো অপেক্ষা করছে কখন আমি গিয়ে আপনার পক্ষ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরবো সে জন্য। আসুন আসুন জলদি আমাকে জড়িয়ে ধরুন। নাহলে শ্বশুর বাড়ির কেউ দেখে ফেললে আমার লজ্জায় পরতে হবে।’
ধ্রুব জোর করেই আমাকে টেনে নিলেন তার বুকে। আমি হাল্কা কেঁপে উঠলাম। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। অনুভূতিরা সব পাল্লা দিয়ে বিশৃঙ্খল ভাবে ছুটে চলল আমার মস্তিষ্কে। অসাড় হয়ে এলো শরীর। ধ্রুর বুকের ধুকপুকানি শুনে যেন আরও বেশিই চমকে গেলাম। বরফের ন্যায় জমে যেতে লাগলাম আমি। ধ্রুব আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বললেন-
‘তোমাকে ভালোবাসার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না সানসাইন। আমার হৃদ স্পন্দ আমার বেঁচে থাকার জন্য যতটা জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি তোমাকে ভালোবাসা। আমার পারসোনাল বুকের ভাড়া হিসেবে আমার তোমাকেই প্রয়োজন। আমার পারসোনাল বুকটা শুধু তোমার জন্যই বরাদ্দ। এখানে শুধু মাত্র তুমি আর তোমার ভালোবাসারা থাকবে। তোমার অতীত, তোমার বিষন্নতা, তোমার কষ্ট সব কিছু আমি মুছে দিতে চাই আমার ভালোবাসা দিয়ে। তুমি এখন আমাকে ভালো না বাসলেও আমার বিশ্বাস একটা সময় তুমি ঠিক আমায় ভালোবাসবে। আমার চেয়েও বেশি আমায় ভালোবাসবে।’
‘কিরে অনু! তুই এতো রাতে বাইরে থেকে আসলি কীভাবে?’
আম্মুর কথা শুনেই আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম৷ ভয়াতুর চোখে আম্মুর দিকে পিটপিট করে তাকালাম। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন আমার দিকে। আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আম্মুকে কি জবাব দিবো তার উত্তর হাজার ভেবেও খুঁজে পেলাম না। ধ্রুবর সঙ্গে বাহিরে গিয়েছিলাম বলাও ঠিক যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। খুবই লজ্জার ব্যাপার বলেই মনে হলো। আর কোনো মিথ্যা কথা কিংবা বাহানাও খুঁজে পাচ্ছি না। প্রচন্ড রাগ লাগছে ধ্রুবর উপর। নিজে তো চলেই গেল অথচ আমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলে গেল।
‘অনু আমার সাথে ছাদে গিয়েছিল মা।’
ভাইয়ার কন্ঠ শুনে আমি পেছন ফিরে দরজার দিকে চাইলাম। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আম্মুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়া। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আম্মু ধমকে উঠলেন। তিক্ত গলায় বললেন-
‘ এত রাতে ছাদে কি প্রয়োজন? খেয়েদেয়ে কি তোদের কোনো কাজ নাই? রাত-বিরেতে ভূত-পেত্নীর মতো ছাদে ঘুরাঘুরি করছস। এসব কি ধরনের বাজে অভ্যাস?’
‘আহহ মা আমরা তো আর প্রতিদিন ছাদে যাই না। আজকেই তো গেলাম। এখানে এত রাগার কি আছে? এখন যাও খাবার দাও আমরা আসছি।’
ভাইয়ার কথা গুলো বলতে বলতেই সোফায় গাঁ এলিয়ে দিলো। আম্মু তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রাগে গজগজ করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ভাইয়া তৎক্ষনাৎ উঠে আমার কাছে আসলো। আমার মাথায় চড় দিয়ে চাপা কন্ঠে বলল-
‘নিজের আপন জামাইয়ের সাথেও লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে যাওয়া লাগে আপনার? আমি যদি ছাদ থেকে আপনাদের রোমান্টিক সিন না দেখতাম তাহলে আপনাকে কে বাঁচতো আম্মুর এসব বিরতিহীন প্রশ্ন থেকে?’
অন্য সময় হলে হয়তো আমার মাথায় চড় দেওয়ার বিনিময়ে ভাইয়াকে আরও দশটা চড় খেতে হতো। কিন্তু আজ লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ছিঃ কি বিব্রতকর পরিস্থিতি। আর ভাইয়াও কিভাবে লাগামহীন ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল। নিজের ছোট বোনকে এসব বলতে কি তার একটুও লজ্জা লাগলো না? হা’রামি একটা। নির্লজ্জ। সবটাই হিয়েছে ধ্রুবর সঙ্গ পেয়ে৷
‘যা সর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনে লজ্জায় লাল নীল হওয়া লাগবে না তোর। রুমে গিয়ে ফ্রশ হয়ে আয় ডিনার করবি।’
আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এলোমেলো ভাবে পা ফেলে রুমে চলে আসলাম। ধ্রুবর বলা প্রতিটি কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে। ওনার কথা ভেবে ফাঁকা রুমেই লজ্জা পেলাম আমি। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও চলে যাই নিজের লজ্জা নিয়ে। আচমকাই তীক্ষ্ণ শব্দে আমার ফোন বেজে উঠলো। ভাবনার মাঝেই কেঁপে উঠলাম আমি। হুশ ফিরতেই শুকনো ঢোক গিলে অপ্রস্তুত হয়ে ফোন রিসিভ করলাম।
চলবে…
- [পরিক্ষার পড়াশোনা আর মেহমান সব মিলিয়ে ভীষণ চাপের মধ্যে আছি। তাড়াতাড়ি লেখতে চেয়েও পারিনি। দুঃখিত অপেক্ষা করানোর জন্য। রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️]