শেষ রাত পর্ব-২৪

0
1590

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৪
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলেন বুঝি তুলতুলের আম্মু!’

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ধ্রুবর গাঢ় কন্ঠস্বর শুনেই আমি চমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে বললাম- ‘আপনি?’

‘নাম্বার না দেখেই কি কল রিসিভ করেন সবসময়?’

ধ্রুবর কাঠকাঠ গলায় পালটা প্রশ্নে আমি খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আসলে খেয়াল করিনি। হঠাৎ করে কল দিলেন কোনো দরকার ছিল?

ধ্রুব ভারী হয়ে আসা কন্ঠে বললেন-

‘অদ্ভুত তো! আপনি সব কিছুতেই দরকার খুঁজে বেড়ান কেন? কারণ ছাড়া কি আপনাকে কল দেওয়া যাবে না! যাইহোক আপাতত আপনার সাথে প্রেম করাই আমার অতি দরকারী বিষয়। আপনার সাথে প্রেম করার চেয়ে দরকারী কিছু আমার কাছে আর নেই। বুঝেছেন আমার কথা!’

ধ্রুব শেষে কথাটা হাল্কা ধমকের স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন। আমি ঘোরলাগা কন্ঠে ছোট করে ‘হুমম’ বললাম। ধ্রুব আবারও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘বলেছিলাম তো আপনাকে ফোনটা দিয়েছি আমার প্রয়োজনে। রাতবিরেতে আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি তখনই কল দিবো। আর ফোন বন্ধ পেলে বা রিসিভ না হলে ডিরেক্টর আপনাদের বাসায় চলে আসবো মনে থাকে যেন। আর হ্যাঁ আমার কথা শুনে আমাকে বখাটে মনে হলে হবে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। নিজের বউয়ের কাছে শুধু বখাটে কেন নির্লজ্জ, অসভ্য, বেহায়া সব কিছুই হওয়া যায়। যাইহোক এখন রাখছি। গাড়ি ড্রাইভ করছি। বাসায় পৌঁছে কল দিবো।’

ধ্রুব আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দিলেন। আর আমি হতভম্ব হয়ে ফোন কানের কাছে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মুহুর্তেই হতচকিত ভাব কাটয়ে লজ্জায় লাল রাঙা হলাম। মানুষটার কন্ঠ শুনলেই এখন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। তার কথা ভাবতেই ভীষণ লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে। কি ভয়ংকর পরিস্থিতি। ভয়াবহ অনুভূতি।

‘অনু তোর কি হয়েছে বল তো!’

সানির আক্রোশ ভরা কন্ঠস্বরে আমার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে এলো। চোখ ছোট ছোট করে সানির মুখের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘আমার আবার কি হবে?’

আমার প্রশ্নে সানির মুখে বিরক্তির রেশ দেখা গেল। ভ্রু জোড়ার সংযোগস্থলে সুতীক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো। বড় বড় চোখদুটোতে সন্দেহ ফুটে তুলে অত্যন্ত অধৈর্য্য হয়ে বলল-

‘কিছুদিন ধরে তুই সব সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকিস। কিছু জিজ্ঞেস করলেই মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছিস। বিনাকারণেই লজ্জা পাচ্ছিস। খুবই অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবহার করছিস। আগে তো কখনো এমন ব্যবহার করিস নি। তোর মাঝে আমি কেমন যেন প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। তুই কি প্রেমে ট্রেমে পরলি না-কি অনু? দুলাভাইয়ের প্রেমে পরেছিস? কিন্তু কবে! কখন? কীভাবে?’

সানির প্রশ্নগুলো তীরের মতো এসে হানা দিলো আমার মনে। প্রতিটি কথা গেঁথে গেল মনের কোণে। প্রেমের কথা শুনেই ক্ষীণ লজ্জার উপস্থিতি টের পেলাম। তবুও নিজেকে যথাসাধ্য সামলে নিলাম। কৃত্রিম রাগ নিয়ে চটপটিয়ে বললাম-

‘চুপ থাকতো সানি। ফালতু কথা বলিস না৷ চুপচাপ আমার সাথে বসে থাকতে চাইলে বস না হলে চলে না।’

আমার রাগ প্রকাশে সানির তেমন কোনো হেলদোল হলো না৷ সে এখনও কৌতুহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ আগ্রহ নিয়ে আবারও কিছু বলতে চাইলেই আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। সানি হতাশ হয়ে গাল ফুলিয়ে ফেলে৷ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকলো। আমি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেললাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সানির বলা কথা গুলো। আমি কথায় কথায় লজ্জা পাচ্ছি! মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছি? প্রেমে পরেছি? আসলেই কি তাই! কেউ কি তার স্বামীর প্রেমে পরে? আমি কি ধ্রুবর প্রেমে পরেছি? জানা নেই। তবে আমি জানি আমি যখন তখন বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছি। ধ্রুবর স্পর্শে এখন থমকে না গিয়ে কেঁপে উঠছি। তার কথা ভেবেই একা একা লজ্জাবোধে নিজেকে আড়াল করে নিতে চাচ্ছি। তাকে দেখলেই আমার দৃষ্টি থমকে যাচ্ছে। রাত-বিরেতে ধ্রুবর ফোন কল পাওয়া। যখন তখন বাসার নিচে এসে দেখা করা। কিছু অযুক্তিক কারণ দেখিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেওয়া। এসব কিছুতেই নিজেকে এক কিশোরী মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। নতুন নতুন প্রেমে পড়া এক কিশোরী মেয়ে। যে কি-না বিনাকারণেই হাসবে। একা একাই লজ্জায় লাল হবে। প্রেমিক পুরুষের স্পর্শে ভয়ংকরভেবে কেঁপে উঠবে তার শরীর আর মন দুটোই। আবেগি হবে কিছু ভালোবাসাময় কথা শুনেই। যার মস্তিষ্কটা জুরে থাকবে শুধু একজন প্রেমিক পুরুষেরই বিচরণ। আর সেই প্রেমিক পুরুষ হলেন ধ্রুব৷ নাছোড়বান্দা বীর প্রেমিক পুরুষ।

‘কেমন আছো অনন্যা?’

হঠাৎই পাশ থেকে চিরচেনা কন্ঠস্বর শুনে আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। মাথা উঁচু করে পাশে তাকাতেই ভীষণ পরিচিত এক মুখ চোখের সামনে আটকে গেল। উদাসীন তার চাহনি। চোখ দুটো ডেবে গেছে ভীষণ অযত্নে। সব সময় হাস্যজ্বল থাকা মুখখানার বিভৎস অবস্থা। গাল ভর্তি অবহেলায়, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি। ঠোঁটে কালচে পোড়ার দাগ। কতশত সিগারেটের উত্তপ্ত ছোয়া পেয়েছে এই ঠোঁট তার হয়তো নির্দিষ্ট হিসেব নেই। শরীরের কি বাজে বিধ্বস্ত অবস্থা। এসবটা কি আমার জন্যই হয়েছে! আমার চোখাচোখি হতেই তার কালচে পোড়া ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে মলিন হাসি দিলো। আমি যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়ালাম। আমার পাশাপাশি সানিও দারুণ চমকিত ভাব নিয়ে তাকায় সাদাফের দিকে। আমি প্রত্যুত্তর করলাম না৷ নিরুত্তর চোখে তাকিয়ে রইলাম সাদাফের দিকে। সাদাফ মৃদু হেসে ম্লানমুখে বলল-

‘আমি কি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি অনন্যা?’

আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। নিজেকে সহজ করে সানির দিকে চেয়ে ভারী কন্ঠে বললাম-

‘সানি তুই চলে যা। তোর দুলাভাই হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে আমি ওনার সাথেই বাসায় চলে যাবো।’

সানি অবাক চোখেই সাদাফের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার কথা শোনা মাত্রই মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রাস্তার দিকে চাইলাম। ধ্রুবর এতক্ষণে এসে পরার কথা ছিল। কিন্তু এখনও আসছে না কেন? যদি এখানে এসে আমাকে সাদাফের সাথে দেখে তাহলে কি আমাকে ভুল বুঝবে! হুহ্ কখনোই না। উনি আমাকে আগেও বিশ্বাস করেছেন আর সারাজীবন বিশ্বাস করবেন। এটা আমি জানি। উনি কখনই আমাকে ভুল বুঝবেন না।

‘আমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি৷ তাই শেষ বারের মতো তোমায় দেখতে আসলাম। আশাকরি বিরক্ত হলেও আজ অন্তত মুখ ফিরিয়ে নিবে না। সব সময়ের মতোই আমাকে সহ্য করবে।’

আমি নিশ্চুপ তবে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম সাদাফের দিকে। ক্ষীণ স্বরে থেমে থেমে প্রশ্ন করলাম-

‘দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছো মানে কি? কোথায় যাচ্ছো?’

সাদাফ হাসার চেষ্টা করে বলল- ‘কানাডা আব্বুর কাছে চলে যাচ্ছি। সাথে আম্মুকেও নিয়ে যাবো। সেখানেই আব্বুর বিজনেসে একটু মন দিবো। সব কিছুই রেডি হয়ে গেছে। হাতে বেশি একটা সময় নেই। কাল রাতেই ফ্লাইট৷ জানি না আবার কখনও কোনো পিছুটানে এই দেশে ছুটে আসবো কি-না।’

‘কিন্তু হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত কেন? তুমি তো কখনই এই দেশে ছেড়ে তোমার আব্বুর কাছে যেতে চাওনি।’

আমি সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন গুলো করেই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার জবাবের আশায়। সাদাফ আম বাগানের অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ঠোঁট প্রসারিত করে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলল-

‘আগে এই দেশটা খুব সুন্দর স্নিগ্ধ লাগতো। সবুজ গাছপালা, নীল আকাশ, রাস্তার চারপাশের কোলাহল সব কিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পেতাম। কারণ তখন আমার মনে তোমার বসবাস ছিল। আমার পাশে তোমার অস্তিত্ব ছিল তাই। আমি প্রকৃতি প্রেমি বাউন্ডুলে ছেলে। সারাদেশ ঘুরেও তোমার কাছে ফেরে এসেছি। এত ভালোবেসেছি এই প্রকৃতিকে। আর সেই প্রকৃতিই কি-না তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এখন আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। মস্ত বড় ভুল মনে হচ্ছে। জানো তো, তুমিহীনা এই শহর বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বিষাদ আর বিষাদ। শহরের প্রতিটি অলিগলিতে শুধুই তোমার স্মৃতি ভেসে ওঠে। নীল আকাশ এখন শুধুই আমার দীর্ঘ শ্বাসের সাথী। এখন আর ভালো লাগে না এই আকাশ৷ তুমি ছাড়া একলা আমি এখানে কি করে থাকি বলো তো অনুপাখি! আমার দম আটকে আসে। ভীষণ কষ্ট হয়। বদ্ধ ঘরেও যেন তোমার স্মৃতিরা এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে। তোমার প্রতি অবহেলা করার অপরাধে আমি নিজের কাছেই অপরাধী। এত এত বোঝা নিয়ে আমি থাকবো কীভাবে?’

আমি আহত দৃষ্টিতে দেখলাম সাদাফের টলমলে চোখ দুটো। সব সময় যে চোখদুটোতে মুগ্ধতা ছেয়ে থাকতো আজ সেই চোখে শুধুই বিষাদ। ঠোঁটের হাসিও যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘নিজেকে দোষী ভেবো না সাদাফ। এটাই আমাদের ভাগ্যে ছিল তাই অতীত ভুলে যাও। নতুন করে সব কিছু শুরু করো। মুভ অন করো।’

সাদাফ আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলল- ‘সব কিছু কি এতটাই সহজ যতটা সহজ ভাবে তুমি বলছো? একটি বারের জন্য কি আমাকে রেখে দাওয়া যায়নি অনন্যা? ভালো না-ই বা বাসতে ঘৃণা নিয়েই না হয় সারাজীবন আমার সাথে থাকতে। কিভাবে আমি নিজেকে সামলাবো? তুমি ছাড়া সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার একটা কারণ কি তুমি আমায় দেখাতে পারো?’

আমি খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। দৃষ্টি তুলে আবারও সাদাফের দিকে চেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘কারও জন্য জীবন থেমে থাকে না সাদাফ৷ তুমিও বাঁচবে আর আমিও বাঁচবো৷ ভিন্ন কোনো উপন্যাসের পাতায়৷ ভিন্ন কোনো গল্পের চরিত্র হয়ে। আমি চাইনা তুমি অতীত আঁকড়ে ধরে পিছিয়ে থাকো৷ এতে আমি নিজেকে অপরাধী মনে করবো। তুমি যদি নিজের জীবন এভাবেই নষ্ট করে আমাকে অপরাধী বানাতে চাও তাহলে তুমি তা-ই করো। আর যদি আমার কথা ভেবে হলেও নিজেকে গুছিয়ে নাও তাহলে আমি কৃতজ্ঞ।’

সাদাফ আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিতে রইলো। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে।

‘মাম্মা.. মাম্মা!’

আচমকাই তুলতুলের ডাকে আমি চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম৷ ধ্রুব তুলতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার হাতে অনেকগুলো রঙিন বেলুন। তুলতুল ছটফট করছে ওনার কোল থেকে নেমে আমার কাছে আসার জন্য। আমি অপলক দৃষ্টিতে ধ্রুবর গাম্ভীর্যপূর্ণ চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। ভীষণ গম্ভীর লাগছে তাকে। সাদাফকে দেখে কি রেগে যাচ্ছেন তিনি!

চলবে…

[বিঃদ্রঃ এটা সাধারণ একটা গল্প। অতীত ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করা আর অতীতের কাছে ফিরে বর্তমানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ থেকেও সেটা না করা। এগুলোই গল্পের মূল বিষয়। তাই এই গল্পে ঝাকানাকা টাইপ কোনো টুইস্ট পাবেন না। খুব সাধারণ ভাবেই ভালোবাসা হবে। নতুন করে সব শুরু হবে। প্রেম হবে। যাইহোক ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here