#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_১
#Saji_Afroz
.
.
পার্কভিউ হসপিটালের কেবিন নাম্বার ৭০২ এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পরশ ।
হঠাৎ চোখ যায় তার লিফট থেকে নেমে দৌড়ে আসা একটি মেয়ের দিকে । অবশ্য শুধু তার চোখ যে ওই মেয়েটির দিকে গিয়েছে তা নয় । উপস্থিত সকলের দৃষ্টিই মেয়েটির দিকে ।
কেননা,,
প্রথমত তার পরণে ছিলো সবুজ আর সোনালী রঙের কাজ করা কাতান লেহেঙা ও ভারী ভারী গহনা ।
সাধারণত হসপিটালে কেউ এভাবে আসেনা ।
দ্বিতীয়ত,,
সে এমনভাবে দৌড়ে আসছিলো যেনো কোথাও আগুন লেগেছে আর সে ছুটছে ।
.
মেয়েটি দৌড়ে এসে পাশের কেবিন ৭০৩ এর দরজায় কড়া নাড়তেই, ভেতর থেকে অন্য একটি মেয়ে দরজা খুলে বললো-
ছোঁয়া তুই এসেছিস!
.
ছোঁয়া…..!
.
নামটি শুনেই পরশের হৃদয় ছুঁয়ে গেলো ।
পরশ জানেনা কে এই ছোঁয়া! কিন্তু একটা কথা সে ভালোভাবেই হৃদয়ে গেঁথে নিলো ।
ছোঁয়া হবে শুধুই পরশের!
.
পরশ…
বেশ আভিজাত্য পরিবারের ছেলে সে । পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট । পরিবারের ছোট ছেলে ।
ছোঁয়া…
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সে । সংসারে মা আর বড় বোন নয়নতারা রয়েছে । বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো বছর খানেক আগেই । বড় বোন একটি বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন । সংসার খরচ তাকেই সামলাতে হয় ।
.
.
কেবিনের ভেতরে এসে নিজের মায়ের দিকে তাকাতেই বুকটা ধুক করে উঠলো ছোঁয়ার । স্যালাইন লাগানো আছে, চোখ দুটো বন্ধ ।
মায়ের এমন অবস্থা দেখতে পারছেনা সে । নিশ্চুপভাবে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে । ছোঁয়ার পিছু নিলো তার বান্ধবী রুপালি ।
কেবিন গুলোর এক পাশে বসার ব্যবস্থা আছে ।
সেখানে বসে আছে পরশ । দৃষ্টি তার কেবিন নাম্বার ৭০৩ এর দিকে ।
কে মেয়েটি? কেনো প্রথম দেখাতেই এতো ভালো লাগলো তাকে!
ভাবতে ভাবতেই ছোঁয়ার দেখা পেলো পরশ । এদিকেই এগিয়ে আসছে সে!
ছোঁয়া এসে বসতেই রুপালি তার পাশে বসে বলতে শুরু করলো-
অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন আন্টি । ডাক্তার বলেছেন শরীর দূর্বলের জন্য এটা হয়েছে । চিন্তার কিছু নেই ।
.
ছোঁয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো-
ভাগ্যিস তোর বাসা আমার বাসার পাশেই । নাহলে কি যে হতো!
-আরে আমিতো জানতামই না । আমাকে রাফসান ভাইয়া ডেকে এনেছে ।
-উনি!
-হ্যাঁ, উনি আন্টির সাথে দেখা করতে এসেছিলেন । আর তখনই এটা ঘটে । নয়নতারা আপু স্কুলে, তুইও তোর কলেজের বান্ধবীর বিয়েতে, তাই আমাকে ডাকলো । ভাইয়াই এই হাসপাতালে আনলো আন্টিকে । ফর্মালিটি সব সেরেই গিয়েছেন তিনি । আসলে অনেক ভালো রাফসান ভাইয়া ।
আমি হলে মেডিকেলে নিয়ে যেতাম ।
.
কথাটি শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো ছোঁয়ার ।
রুপালি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো-
তুই কি মন খারাপ করলি? আমি কিন্তু খারাপ মাইন্ডে বলিনি ।
.
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ছোঁয়া বললো-
জানিরে । এই হাসপাতালের খরচ বহন করার সামর্থ্য আমাদের নেই । বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পরে তার চিকিৎসা খরচে বাড়িটাও বিক্রি করতে হয় । এতো চেষ্টা করার পরেও বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না । বাবার মৃত্যুর পরে আমাদের জীবনের খারাপ অধ্যায় শুরু হয়ে যায় । আপুকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় । চাকরী পায় বেসরকারি স্কুলে । কেননা এই শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে ভালো চাকরীও সে পাবেনা । আপুর টিউশনি ও স্কুলের বেতনের টাকা দিয়ে সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় । মায়ের শরীরটাও যে ভালোনা । এটা সেটা সারাক্ষণ লেগে থাকে । রাফসান ভাইয়া সাহায্য করতে চায় । তবে আর কতো! আমাদের জন্য আপু বিয়েও করতে পারছেনা । আমি কিছুই করতে পারিনিরে নিজের পরিবারের জন্য । কিছুইনা! ছোট মনেহচ্ছে নিজেকে ।
.
কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো ছোঁয়া ।
সামান্য দুরত্বে বসাতে ছোঁয়ার সব কথা
শুনতে পেলো পরশ ।
মেয়েটির মুখ দেখে মনেই হয়নি, এতোটা দুঃখী হতে পারে সে ।
অজান্তেই পরশের চোখের কোণেও পানি চলে এলো ।
এরইমাঝে একজন এগিয়ে এসে বললো-
পরশ তুই এখনো আছিস!
.
পরশ দাঁড়িয়ে বললো-
চাচার শরীর কেমন এখন?
-আছে ভালো । তুই রোগী দেখবিনা আজ?
-হ্যাঁ রাতে । ঠিক আছে, আমি আসি এখন ।
.
পরশের দূরসম্পর্কের চাচাকে ৭০২ এ ভর্তি করানো হয়েছে । তাকে দেখতেই এখানে এসেছে সে । ভাগ্যক্রমে ছোঁয়ার মতো রুপসীর দেখা পেয়েছে!
.
পরশ একটু এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে ছোঁয়া বলে উঠলো-
শুনছেন?
.
এই ডাকের অপেক্ষায় যেনো ছিলো সে! কিন্তু কে ডাকলো? ছোঁয়া নাকি রুপালি? মুখের হাসি লুকিয়ে পেছনে ফিরলো পরশ । ছোঁয়ার হাতে নিজের ওয়ালেট দেখে বললো-
আমাকে বলছেন?
.
ওয়ালেটটি পরশের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছোঁয়া বললো-
এটা নিশ্চয় আপনার? ফেলে যাচ্ছিলেন চেয়ারের উপরে ।
.
পরশ তা নিয়ে বললো-
হ্যাঁ আমার । খেয়ালই করলাম না । ধন্যবাদ ।
-ধন্যবাদের কিছু নেই ।
-অবশ্যই আছে । আজকাল এমন সৎ মানুষ খুব কমই পাওয়া যায় ।
নাহলে মানুষ…
-আমার ফ্যামিলি সেই শিক্ষা দেয়নি আমাকে ।
-সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে । তা কি করেন আপনি?
-অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল দিলাম ।
-বাহ! খুব ভালো ।
-ধন্যবাদ । আসি ।
-শুনুন?
.
পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে পরশ বললো-
আপনি আমার ওয়ালেট আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন । বিনিময়ে কখনো কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন প্লিজ । এটা আমার কার্ড ।
.
মৃদু হেসে পরশের হাত থেকে কার্ডটি নিলো ছোঁয়া ।
কার্ডে চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো, পরশ উধাও । চলে গিয়েছে সে ।
রুপালি এসে ছোঁয়াকে বললো-
এতো কি বলছে রে?
-কোনো প্রয়োজন হলে জানাতে বললো ।
-তাই নাকি! ভারী হ্যান্ডসাম ছেলেটি ।
-ডাক্তার টি ।
-মানে?
-মানে তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট । এই হসপিটালেই তার চেম্বার ।
-সিরিয়াসলি!
-হু ।
.
.
কাজ সেরে বাসায় এসেছে পরশ বেশকিছুক্ষণ হচ্ছে । ছোঁয়া তার চেয়ে বয়সে বেশ ছোট হবে । জীবনের প্রথম কাউকে প্রথম দেখাতে ভালোবেসেছে । তাকে দেখে মনেই হয়নি বয়স কম । ছোঁয়া দেখতে বেশ লম্বা । তাই এই ভুলটা হয়ে গেলো ।
এই বয়সে এসে প্রেমে পড়লো সে । এটার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো?
আনমনে ভেবে চলেছে পরশ ।
তার মা যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, এই খেয়াল নেই তার ।
সাফিনা আহম্মেদ হালকা কেশে বললেন-
আমার ছেলেকে চিন্তিত মনেহচ্ছে!
.
মায়ের দিকে তাকিয়ে পরশ বললো-
তুমি কখন এলে?
-অনেকক্ষণ ।
-তাই! সরি আমি অন্যকিছুতে মগ্ন ছিলাম ।
.
তার পাশে বসে সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
কিসে মগ্ন ছিলিস?
-ভাবনায় ।
-কার ভাবনায়?
-তেমন কিছুনা ।
-তোর ভাবনা তেমন কিছুনা কিন্তু আমার ভাবনা বিশেষ কিছু ।
-মানে?
-মানে আর কতো একা থাকবো আমরা! এবার তো বিয়েটা কর । বাড়িটা একটু প্রাণ ফিরে পাক ।
.
খানিকক্ষণ চুপ থেকে পরশ বললো-
তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ?
-তোর বড় ভাই এর বউ এর মতো না হলেই হলো । সেতো আমাদের ছেড়ে বিদেশে গমন করলো আমার বড় ছেলেকে নিয়ে ।
.
মায়ের কথা শুনে হেসে ফেললো পরশ ।
সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
তোর পছন্দ হলেই হবে ।
-আচ্ছা মা, মেয়ে যদি আমার চেয়ে বয়সে ছোট হয় তবে কি সমস্যা হবে?
-ছোট মেয়ে! এটাতো ভালো কথা । আমার মেয়ে নেই বলে মেয়ের বড্ড শখরে । তুই ক্লাস নাইন বা টেনের মেয়েই বিয়ে কর । পারলে আরো ছোট । আমার কোনো সমস্যা নেই । বরং আদরই করবো সবাই ।
.
মায়ের কথা শুনে পরশ হাসতে হাসতে বললো-
বউ আনবো নাকি বোন! এতো ছোট নয় ।
-তবে?
-অনার্সে পড়ছে এমন ।
-এটা কি ছোট হলো! তুই নিজেকে বয়স্ক কেনো মনে করছিস আমি বুঝলাম না । আমার শুধু একটাই চাওয়া । এমন কোনো মেয়ে আসুক যে আমাদের সাথেই থাকবে, আমাদের সময় দিবে । বাকিটা তোর পছন্দ ।
-হুম ।
-হুম! কাউকে ভালো লেগেছে?
-প্রথম দেখাতে কাউকে ভালো লাগা যায়?
-অবশ্যই যায় ।
-তাহলে ভাবতে দাও আরো ।
.
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন সাফিনা আহম্মেদ । এতোদিন বিয়ের প্রসঙ্গে কোনো কথা উঠলেই তা এড়িয়ে যেতো সে । আজ তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে । কার আগমনে এই পরিবর্তন ঘটলো?
.
.
মায়ের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ছোঁয়া ।
এমন সময় এলো রাফসান । রাফসানকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো সে ।
রাফসান জিজ্ঞাসা করলো-
নয়নতারা কোথায়?
.
সে ক্ষীণ স্বরে বললো-
আপু বাসায় গেলো মাত্র ।
-তুমি খেয়েছো?
-নাহ ।
-নয়নতারা খাবার আনবে?
-নিষেধ করেছি । ক্ষিদে নেই ।
.
ছোঁয়ার মা আফিয়া জান্নাতের দিকে তাকিয়ে রাফসান বললো-
ছোঁয়াকে আমার সাথে নিয়ে যাই একটু? রাতে না খেয়ে থাকবে?
.
তিনি সম্মতি জানিয়ে বললেন-
আমি সেই কবে থেকে বলছি কিছু খেয়ে আয়, খেয়ে আয় । কে শুনে কার কথা! হ্যাঁ নিয়ে যাও ।
.
ছোঁয়া বললো-
তুমি একা থাকবে মা?
-শুয়েই তো থাকবো । সমস্যা নেই ।
.
ইচ্ছে না থাকলেও রাফসানের সাথে বেরুতে হলো ছোঁয়াকে ।
রাফসান ছোঁয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে বললো-
বাইরে কোথাও যেতে হচ্ছেনা । হাসপাতালের উপরেই রেস্টুরেন্ট আছে ।
-হুম ।
-নয়নতারা চলে গেলো কেনো? তুমি একা থাকবে?
-আপুর সকালে স্কুলে যেতে হবে । আমিই পাঠিয়ে দিয়েছি । সমস্যা নেই, পারবো ।
-তুমি চায়লে আমি…
-না থাক । আজও আপনার অফিসের ক্ষতি হয়েছে । ওহ ভালো কথা । মা কেনো ডেকেছিলো?
.
হালকা কেশে রাফসান বললো-
আছে কিছু আমাদের পারসোনাল কথা ।
.
.
তখন ইচ্ছে করেই নিজের ওয়ালেট চেয়ারের উপর রেখেছিলো পরশ । তার বুদ্ধিটা কাজে লাগলো । ছোঁয়াকে নিজের কার্ডও দিলো সে । কিন্তু সে কি পরশের সাথে যোগাযোগ করবে? নাকি কোনো একটা কোনায় তার দেওয়া কার্ডটি ফেলে রাখবে?
.
চলবে