#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_৩৮
#শেষ_পর্ব
#Saji_Afroz
.
.
টকটকে লাল রঙের আশফাকের পছন্দের কাতান শাড়ি পরেছে নয়নতারা । আয়নায় নিজেকে তাকিয়ে দেখছে সে । কি থেকে কি হয়ে গেল! ছোট থেকে ভালোবেসেছিল রাফসানকে । বিয়ে ঠিক হয়েছিল রাদিবের সাথে । আর আজ বিয়েটা হচ্ছে আশফাকের সাথে ।
ভাগ্য বুঝি এটাকেই বলে?
.
পরশের দেয়া খয়েরী রঙের লেহেঙ্গা পরেছে ছোঁয়া ।
এর মাঝে তার মা এসে তাকে গহনা পরিয়ে দিয়ে বলল-
তোর বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি এটা । সাবধানে রাখিস । সব কিছু বিক্রি করে ফেললেও এসব করতে দেয়নি । তার মায়ের দেয়া বলে!
-কিন্তু আপু…
-ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে পেয়েছে ও । তাছাড়া এটা তোর বাবা তোর জন্য রেখেছে । আর না করিস না মা ।
.
মাকে জড়িয়ে ধরলো ছোঁয়া ।
আফিয়া জান্নাত তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন-
অনেক সুখে থাক ।
.
এসব যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা ছোঁয়ার! সত্যিই কি আজ তার বিয়ে? তুষারের সাথে বিয়ে?
সবটায় স্বপ্ন মনেহচ্ছে ছোঁয়ার কাছে ।
.
খয়েরী রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে আজ পরশ । তাকে দেখতে নতুন বরের চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছেনা । বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত সকল মেয়েদের চোখই তার দিকে ।
পরশ বিয়ের সব কিছু সামলাতে ব্যস্ত । বাড়ির সামনে খোলা জায়গাটায় বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে । আফিয়া জান্নাতের যেহেতু কোনো ছেলে নেই, তার ছেলের ভূমিকা পালন করছে আজ পরশ । আফিয়া জান্নাতও তাকে পেয়ে নিশ্চিন্ত ।
কিন্তু সাফিনা আহম্মেদের মনটা অশান্ত । এসব কিছু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না । তিনি জানেন, পরশ এখন স্বাভাবিক থাকলেও ছোঁয়ার বিয়েটা হয়ে গেলে সে স্বাভাবিক থাকতে পারবেনা । বুকের ভেতরের কষ্টটা আর কত লুকোতে পারবে সে!
পরশ বাসায় এসে বলল-
মা তুমি তৈরী হওনি এখনো? একটু পরেই বরপক্ষ চলে আসবে ।
.
রাগে দুঃখে কান্না চলে এল তার । বাচ্চার মতো কাঁদছেন তিনি ।
পরশ তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল-
আমাকে নিয়ে ভাবছো তুমি । কিন্তু ছোঁয়ার কথা একবারো কি ভেবেছ মা? সে আজ তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেতে চলেছে । আজ তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন । আর তুমি কিনা বান্ধবী হয়ে কাঁদছ?
-আমি ওকে আমার কাছে রাখতে চেয়েছিলাম ।
-কিন্তু ওর খুশি তুষারেই ।
-আমি ওকে বললে আমার কথা ফেলতে পারবেনা । বিয়েটা না করতে বলব আমি ।
-তুমি এমন কিছু করবেনা মা । ছোঁয়ার খুশিটা নষ্ট করো না ।
-তোর কি হবে?
-ওর খুশিতেই আমার খুশি ।
.
পরশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন তিনি ।
পরশ তাকে শান্তনা দিয়ে বলল-
শান্ত হও মা, শান্ত হও।
.
.
ছোঁয়া পুরোপুরি তৈরী হয়ে ফোন দিলো তুষারকে । একবার রিং বাজতেই সে রিসিভ করলো ।
-তৈরী হয়েছ?
-মিসেস তুষার হওয়ার সকল প্রস্তুতি শেষ । তবে..
-কি?
-তোমার দেওয়া নুপুর জোড়া পরা হয়নি ।
-আমার দেওয়া বলতে? আমি সেই কবে…
-ওই জোড়ায় আজ পরবো আমি ।
-রেখে দিয়েছ?
-হু ।
-শুনে খুশি হলাম ।
-তাড়াতাড়ি চলে এসো ।
-হু আসছি ।
.
এমন সময় দরজার পাশে পরশ এসে নক করলো । পরশকে দেখতে পেয়ে তুষারকে বিদায় জানিয়ে তাকে ভেতরে আসতে বলল ছোঁয়া ।
ভেতরে এসে কিছুক্ষণ পলকহীনভাবে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো পরশ ।
নীরবতা ভেঙে ছোঁয়া বলল-
ভালো লাগছে আমাকে?
-পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী বঁধু মনেহচ্ছে ।
-পৃথিবীর সব বঁধু কে যেন দেখেছেন আপনি?
-তোমাকে একবার দেখার পর, অন্য কাউকে দেখার ইচ্ছে মরে গিয়েছে কবেই ।
.
নিজের মনে কথাটি বলে হাসলো পরশ ।
এমন সময় রুপালি এসে বলল-
নয়ন আপুর বর চলে এসেছে । তোর টা কবে আসবে?
-কথা বললাম এই মাত্র । চলে আসবে এখুনি । তোরা দুলাভাই কে বরণ করে আপুকে স্টেজে নিয়ে যা ।
-ঠিক আছে ।
.
সব ব্যবস্থা করে দিলেও চোখের সামনে ছোঁয়ার বিয়েটা দেখতে পারবেনা পরশ । নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেনা সে । তাই ঠিক করলো, কোনো বাহানায় বেরিয়ে যাবে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে । তাই বিয়ের আগে শেষ বারের মতো ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে এসেছে সে ।
পরশ বলল-
ছোঁয়া আমার একটা কাজ পড়ে গিয়েছে । আমায় যেতে হবে ।
-এই সময়ে কি কাজ?
-এখন না গেলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে । তোমাকে পরে সবটা জানাব ।
-আজ আমার বিয়ে! আর আপনি থাকবেন না! এটা কি করে হয়?
-এতক্ষণ তো ছিলামই । এখন আমার যেতেই হবে ।
.
পরশের কথা শুনে ছোঁয়ার কান্না পাচ্ছে । এই মানুষটা অল্প কয়েকদিনেই কতটা আপন হয়ে গেল তার । আজ তার সবচেয়ে খুশির মুহুর্তে এই মানুষটিকেও পাশে চেয়েছিল সে । কিন্তু সে থাকবেনা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল ।
ছলছলে চোখে তাকিয়ে সে বলল-
তাড়াতাড়ি চলে আসবেন? অন্তত আমার বিদায় এর সময়? প্লিজ?
.
ছোঁয়ার ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে না বলতে পারলো না পরশ ।
মৃদু স্বরে বলল-
আসব । চোখটা মুছো । মনে হচ্ছে এখুনি পানি গড়িয়ে পড়বে । এত আগে থেকে সাজ নষ্ট করার কোনো মানে হয়?
.
হেসে ফেলল ছোঁয়া । পরশও হেসে বলল-
আসি তবে?
-জ্বি ।
.
ছোঁয়ার চোখ কেন ছলছলে পরশ জানেনা । হয়তোবা মায়া! কিন্তু সে আর পেছনে ফিরে তাকাতে পারবেনা, এটা সে জানে । কেননা মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার পরেই পরশের চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো । লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব না । আর এভাবে এখানে থাকাটাও সম্ভব না । বিদায় বেলায় ছোঁয়া সবটা জেনে কষ্ট পাক, এটা সে কিছুতেই চায়না ।
.
.
-রাফসানের কার্যকলাপ আমার একেবারে পছন্দ না ছোঁয়া । সে তোমার বাড়িতে এত ঘনঘন যায় কেন?
.
তুষারের কথা শুনে ছোঁয়া বলল-
তুমি তো সব জানোই । আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে ।
-তাই বলে এত ঘনঘন আসবে সে! বিয়ে তো হয়নি । দেখো ছোঁয়া, এসব আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা ।
-কি করবো বলো?
-কি করবে আমাকে জিজ্ঞাসা করছো! আমার তো মনেহয় তোমারও এসব ভালো লাগে । ওর সঙ্গ পেতে ভালো লাগে।
-তুষার!
-কি লাগেনা?
-এসব কি বলছো তুমি!
-আমি ঠিকই বলছি ।
-এমন কিছু নয় তুষার ।
-এমন কিছু না হলে আমাকে বিয়ে করে ফেলো তুমি ।
-কি বললে?
-এত অবাক হবার কি আছে? বিয়ে করতে বললাম । হ্যাঁ আমি জানি, এখন কেউই মেনে নিবেনা । তবে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব তুমি আমারি থাকবে । একবার বিয়েটা করে কিছুদিন বাইরে থেকে আসি । দেখবে সবাই এমনিতেই মেনে নিবে ।
-কি বলছো ভেবে বলছো? এটা ঠিক না, কাউকে না জানিয়ে…
-আমার কথা শোনো ছোঁয়া ।
.
ছোঁয়াকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালো তুষার । তারা সিদ্ধান্ত নিলো, গোপনে বিয়ে করে নিবে । অর্থ্যাৎ কাল পালাবে তারা ।
-তবে কাল দেখা হচ্ছে আমাদের ।
-হুম ।
-ঘুমাও এখন ।
.
ফোনের লাইন কেটে বসে পড়লো ছোঁয়া । সে কি ঠিক করতে চলেছে? সে আর করবে টায় বা কি! রাফসানকে তুষারের কথা বলার পরেও সে সরেনি । বরং বাসায় বলে দিয়েছে সেসব কথা । এর পর থেকেই উঠতে বসতে মায়ের কথা শুনতে হয় তাকে । এতসব কিছুর পরেও তুষারের ভালোবাসায় সব ভুলে থাকার চেষ্টা করে সে । আজ সে তুষারই কিছু চেয়েছে তার কাছে । অন্যায় কিছু তো চায়নি সে! ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে পেতে চেয়েছে । হ্যাঁ এটা কোনো ভুল নয়। এই ভেবে শুয়ে পড়লো ছোঁয়া ।
এদিকে উত্তেজনায় ছটফট করছে তুষার । কাল বিয়েটা হয়ে গেলেই আর কোনো চিন্তা নেই ছোঁয়াকে নিয়ে । আজীবন নিজের কাছে থাকবে তার ছোঁয়া ।
হঠাৎ টাকার কথা মনে হতেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার ।
বিয়ে করে কিছুদিন বাইরে থাকতে টাকার প্রয়োজন । কিন্তু তার পকেট এখন ফাঁকা । এত টাকা পাবে কোথায় সে!
পরেরদিন বিকেলে কথামত কাজি অফিসের সামনে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরশ ।
একটু পরে ছোঁয়াকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো । সে তার পাশে এসে হাতটা ধরে বলল-
তোমার অপেক্ষায় করছিলাম, চলো বিয়েটা সেরে ফেলি । তারপরেই কক্সবাজার চলে যাব আমরা ।
.
কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলল-
হানিমুনটাও সেরে আসব ।
.
তুষারের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে ছোঁয়া বলল-
আমি এসেছি তবে বিয়ে করতে নয় । কিছু কথা বলতে ।
.
তুষারের সাথে সাথে তার বন্ধুরাও অবাক দৃষ্টিতে ছোঁয়ার দিকে তাকালো ।
ছোঁয়া বলল-
এই বিয়েটা আমি করতে পারব না তুষার ।
-কেন?
-কারণ জানতে চেওনা ।
-এটা আমার অধিকার ।
-বলতে পারব না ।
-এমন করোনা ছোঁয়া । তুমি দূরে সরে গেলে মরেই যাব আমি । কত ভালোবাসি তোমাকে জানোনা তুমি? প্লিজ বলো ।
.
তুষারের জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে ছোঁয়া বলল-
কি আছে তোমার মাঝে? বেকার, এখনো স্টুডেন্ট । অথচ রাফসানকে দেখো! প্রতিষ্ঠিত একটা ছেলে । আমি এতদিন বুঝতে পারিনি । কিন্তু আজ বুঝছি, রাফসানই আমার যোগ্য ।
.
ছোঁয়া থামেনি । আরো অনেক কটু কথা বলে চলে গিয়েছে সে ।
সেদিন রাস্তার ধারে বসে চিৎকার করে কেঁদেছিল তুষার । ছোঁয়ার নাম ধরে কতবার ডেকেছিল তাকে! কিন্তু ছোঁয়া থামেনি ।
.
-কিরে? তুই এখনো তৈরি হসনি?
.
স্মৃতিচারণে ডুবে ছিল তুষার । বাবার ডাকে সে বলল-
তৈরী কেন হবো?
-আজ তোর বিয়ে! আমি ছেলের বাবার হয়ে তৈরী হয়ে গিয়েছি আর তুই এখানে বসে বাতাস খাচ্ছিস!
.
মোবাইলটা নিয়ে রুম থেকে বেরুতে বেরুতে তুষার বলল-
বিয়েটা হচ্ছেনা ।
.
তুষারের কথার মানে বুঝতে না পেরে স্ত্রীর কাছে গেলেন তিনি । নিশ্চয় সে বলতে পারবে, কি ঘটতে চলেছে আজ!
.
.
আশফাক এসেছে বেশ অনেকক্ষণ হচ্ছে । কিন্তু তুষারের কোনো দেখা নেই । এই নিয়ে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে ছোঁয়ার সাথে তার । প্রতিবারই সে বলেছে, খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে । কিন্তু তার দেখা নেই । তাই বাধ্য হয়ে ছোঁয়া, নয়নতারার বিয়েটা সম্পন্ন করতে বলল । তুষার আসলে নাহয় তাদের টা হবে ।
আয়নার দিকে চোখ পড়তেই, নিজেকে বউ সাজে আরেকবার দেখলো ছোঁয়া । তুষারের সাথে বিয়েটা তার অনেক আগেই হয়ে যেত, যদি সেদিন পালাতো সে! কিন্তু সেদিন সে বাসার জন্য একটি চিঠি লিখে বিয়ে করার কথা জানিয়েছিল । চিঠিটা টেবিলের উপরেই রেখে সে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গিয়েছিল । আর তখনি নয়নতারার হাতে চিঠিটা পড়ে যায় । আর সে তার মা কে জানিয়ে দেয়, ছোঁয়া পালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে । এসব জেনে তার মা আত্নহত্যা করতে চান । আর ওয়াদা করিয়ে নেন, সে তুষারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবে ।
যার কারণে তুষারের সাথে সম্পর্কটা শেষ করতে হয় ছোঁয়ার ।
সেদিন তুষারকে এসব জানায়নি সে । কেননা সে জানতো, তুষার এসব মানার পাত্র নয় । উলটো বাসায় এসে ঝামেলা করতো । আর ছোঁয়া নিজের মা ও বোনের জন্যই এসব করতে বাধ্য হয়েছে ।
তখন সে জানতোনা, নয়নতারা রাদিবকে ভালোবাসে না আর তার মায়ের আত্নহত্যা করতে চাওয়াটা ছিল সম্পূর্ণ অভিনয় । জানলে এতটা কষ্ট তুষারকে দিত না সে ।
ভাবতে ভাবতেই ফোন এল ছোঁয়ার মোবাইলে । তু্ষারের ফোন দেখে রিসিভ করে বলল-
কতদূর?
-ছোঁয়া তোমার মনে আছে? এমন কোনো একটা দিনে তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করে কাজি অফিসে দাঁড়িয়ে ছিলাম?
-থাকবেনা আবার!
-সেদিন তুমি এসেছিলে তবে ফিরেও গিয়েছ আমায় ধোঁকা দিয়ে ।
-ধোকা দিইনি তোমায়! নিরুপায় ছিলাম ।
-আমাকে সবটা জানাতে পারতেনা তুমি? এতটুকু ভরসা ছিল না তোমার, আমার উপরে?
-এসব এখন কেন বলছ তুমি তুষার?
-কেন বলছি? তবে শোনো । সেদিন আমি যে কষ্টটা পেয়েছি আজ সেই কষ্টটা তুমি পাবে ।
-মানে?
-আমি তোমার জন্য নিজের বাসায় চুরি করে টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম । বাসায় রেখে এসেছিলাম একটি চিঠি । আমার বন্ধুদের সামনে আমাকে অপমান করে চলে গেলে তুমি । বাসায় যাওয়ার পর আমি হাসির পাত্র হয়ে গেলাম সবার কাছে ।
যার জন্য চুরি করেছি সেই কিনা ধোকা দিলো!
-তুষার আমার কথা শুনো..
-তুমি শুনেছিলে আমার কথা? শুনোনি । তুমি সত্যি আমায় ভালোবাসলে এত কষ্ট দিতেনা । অন্তত সত্যিটা বলে সম্পর্কটা শেষ করতে ।
-আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে ।
-ভুল! এখন মেনে কি হবে? যে দিন গুলো চলে গিয়েছে ফিরিয়ে দিতে পারবে আমায়? এতদিন যে কষ্ট পেয়েছি আমি!
-আমি তোমাকে ভালোবাসি তুষার!
-কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না ।
.
কথাটি শুনে ছোঁয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো । কি বলছে তুষার এসব!
তুষার খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল-
এখন অনেক শান্তি লাগছে । আমার অপমানের প্রতিশোধ, এতদিন কষ্ট পাওয়ার প্রতিশোধ আমি নিয়ে ফেলেছি ছোঁয়া । এখন না পাওয়ার আগুনে জ্বলবে তুমি ।
.
ফোনের লাইনটা কেটে দিলো তুষার ।
আফিয়া জান্নাত এসে বললেন-
নয়নতারার বিয়েটা হয়েই গেল । তুষার কোথায়?
.
ছোঁয়া ভাঙা গলায় বলল-
সে আসবেনা ।
-মানে?
.
মাকে সবটা বলার পর তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-
হলো তো? এত এত মানুষের সামনে বদনাম করে দিলো ওই ছেলে । এই ছেলেকে ভালোবাসিস তুই! এর জন্য আমার সাথে লড়তেও ভাবিস নি । কার জন্য এসব করলি তুই, কার জন্য কষ্ট পেলি এতদিন?
.
নিশ্চুপ ছোঁয়াকে দেখে তিনি বললেন-
কিরে মুখ পুড়ি কথা বলিস না কেনো? এখন কে বিয়ে করবে তোকে? প্রথমে রাফসানের সাথে বিয়েটা ভেঙেছিস আর এখন তুষার বিয়ের আসরে আসলো না । লোকে জানাজানি হলে কি বলবে!
.
ছোঁয়ার অন্তরটা পুড়ে যাচ্ছে আর তার মা কথা বলছে লোক-সমাজের!
তুষার এটা কিভাবে করতে পারলো তার সাথে!
ছোঁয়া ফোন হাতে নিয়ে তুষারের নাম্বারে ডায়েল করলো । তাকে ব্লক করে দিয়েছে তুষার ।
আফিয়া জান্নাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন-
সে ফিরবেনা । প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই ফিরেছিল । হায়! আমি এতবড় বোকা কিভাবে হলাম! ওরা যখন ওদের কোনো আত্নীয়কে জানাবেনা বলেছিল, তখনি সন্দেহ করা উচিত ছিল ।
.
ছোঁয়ার পুরো শরীর কাঁপছে ।
কি করবে বুঝতে পারছেনা সে । আফিয়া জান্নাত আরো কিছু কথা শুনিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ।
গোপন রাখার কথা নয় এটি । নয়নতারাকে আগে জানানো দরকার ।
এদিকে ছোঁয়া ডায়েল করলো পরশের নাম্বারে । পরশ আর তুষার মিলে কোনো সারপ্রাইজ প্লান করছে না তো তার জন্য?
এমনটা যেন হয় ভেবে ভেবে বেশ কয়েকবার পরশকে ফোন দিলো সে ।
কিন্তু রিসিভ করছেনা পরশ । তাহলে কি সত্যিই তুষার ভালোবাসেনা তাকে?
ছোঁয়ার কানে বারবার বাজতে থাকলো, তুষারের বলা কথাটি-
আমি তোমাকে ভালোবাসি না ।
.
হঠাৎ করেই বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো ছোঁয়া । অসহায় হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো সে । তেষ্টায় তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে । ব্যাথা যেন ধীরেধীরে বাড়তে লাগলো । বাড়তে বাড়তে প্রচন্ড আকার ধারণ করলো । দু’হাত দিয়ে বুকের বাম পাশটা চেপে ধরে হাটু গেড়ে বসে পড়ল ঘরের মেঝে ।
তার মনেহতে লাগলো, চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছে । সারা শরীর ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে গেল । খুব চেষ্টা করেও কাউকে ডাকতে পারলো না সে । মুখ থেকে একটি শব্দও বের হলোনা ।
.
এদিকে নয়নতারা সবটা শুনে যেন খুশিই হলো । পরশ ভালোবাসে ছোঁয়াকে । এটা সে জানে । কিন্তু এতদিন এই কথাটি ছোঁয়াকে জানায়নি সে । আজ ঠিক সময়টি চলে এসেছে । পরশের সত্যিটা সে জানাবে ছোঁয়াকে । এই ভেবে ছুটে এল সে ছোঁয়ার রুমে । কিন্তু ছোঁয়াকে মেঝের উপরে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে চেঁচিয়ে বলে উঠল-
ছোঁয়া!
.
.
ছোঁয়ার অনেকবার ফোন পেয়েও রিসিভ করেনি পরশ । এই মুহুর্তে ছোঁয়ার ফোন রিসিভ করা মানে, কষ্টটা আরো বেড়ে যাওয়া । তবে সে ছোঁয়াকে কথা দিয়েছে । বিয়ের সময়ে না থাকলেও বিদায় এর সময়ে অবশ্যই থাকবে । তাই আসার আগে নিজের মাকে বলে এসেছে, বিয়ের পরে যেন ফোন দেয় তাকে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মায়ের ফোন এল না । বিয়ে টা কি হয়নি এখনো?
ভাবতে ভাবতেই তার মায়ের ফোন এল । সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা বলল-
পার্কভিউ তে জলদি চলে আয় পরশ ।
.
.
খুব তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে পার্কভিউ হাসপাতালে চলে আসলো পরশ ।
সকলের চেহারা দেখে আতঙ্কিত সে । কি ঘটেছে তার জানা নেই । তার মা কেনো তাকে তাড়া দিয়ে আসতে বলেছে, সেটাও তার জানা নেই ।
সবাইকে কাঁদতে দেখে সে ঘাবড়ে গেল । মনে এল তার ছোঁয়ার কথা । সবাইকে দেখছে । কিন্তু ছোঁয়া কোথায়?
কাউকে জিজ্ঞেস করতে যাবে ঠিক তখনি ডাক্তার রোকন শেখ এসে পরশের উদ্দেশ্যে বললেন-
আপনি এসেছেন! শুনলাম মেয়েটি আপনার রিলেটিভ । আসলে এখানে আনার আগেই মারা যান তিনি হার্ট ফেল করে । তাই আমরা কিছুই করতে পারিনি । দুঃখিত স্যার ।
.
পরশ মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন-
তুষার বিয়ের আসরে আসেনি । সে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিয়েটায় রাজি হয়েছিল । আর এটা ছোঁয়া মেনে নিতে পারেনি ।
.
কথাটি শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলোনা পরশ । অঝর ধারায় তার দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো । এমন একটা কান্ড তুষার ঘটাবে এটা কিভাবে বুঝলোনা সে!
ছোঁয়ার মায়াবী চেহারাটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে । এই তো সেদিনই তো এই হাসপাতালেই প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের আর আজ কিনা…
নাহ, আর কিছু ভাবতে পারছেনা পরশ । হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে ।
.
.
তিন বছর পর…
সাফিনা আহম্মেদ খুঁজতে লাগলেন পরশকে । শফিউল আহম্মেদ কে দেখে বললেন তিনি-
পরশকে দেখেছ? নাস্তা করানোর জন্য কখন থেকেই খুঁজে চলেছি তাকে ।
.
শফিউল আহম্মেদ বললেন-
আজ কি ভুলে গেলে? কি করে আজ তার দেখা পাবে তুমি?
.
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন-
ছোঁয়ার মৃত্যুবার্ষিকী ।
-তিন বছর হয়ে গেল এখনো তাকে বিয়েতে করাতে পারলাম না । ছোঁয়ার স্মৃতিতেই ডুবে রয়েছে সে । এভাবে পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখলে ছেলেটা একদিন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে ।
-এভাবে বলোনা প্লিজ!
-আজ আফিয়া আপাকে দেখতে যাবে?
-হ্যাঁ যাব ৷ তাকে তো কতবার আসতে বলেছি এখানে । কিন্তু সে নয়নতারার সাথে থাকে । অবশ্য আশফাক তাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে । ছোঁয়ার মৃত্যুর পর নয়নতারার সাথে চলে গেলেন, এখানে একটা বারের জন্যও আসেননি । মেয়ের স্মৃতি আছে তাই । অবশ্য মা বলে কথা…
.
নিজেকে সামলাতে পারলেন না সাফিনা আহম্মেদ । তার চোখেও পানি চলে এল । শফিউল আহম্মেদ বললেন-
শান্ত হও সাফিনা!
.
.
প্রকৃতি যেন মনের ভাষা বুঝতে পারে । পরশের হৃদয়টা যেমন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে, আকাশটাও ঠিক তেমনি মেঘাচ্ছন্ন আজ । দেখেই মনেহচ্ছে, খানিকবাদের তুমুল ঝড় উঠবে ।
আজ ছোঁয়ার তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী । প্রতিবারের মতো এবারও ছোঁয়ার প্রিয় গোলাপ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে, তার কবরের পাশে এসে দাঁড়াতে ভুললোনা পরশ ।
আজ তিন বছরেও ছোঁয়াকে ভুলতে পারলোনা সে । ছোঁয়ার স্মৃতি তাড়া করে ফেরে পরশকে সারাক্ষণ । মনেহয়, এই বুঝি হাসিমুখে তার সামনে এসে দাঁড়াবে ছোঁয়া ।
ছোঁয়াকে ভোলা তার পক্ষে সম্ভব নয় ।
ছোঁয়ার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে সে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চায়….
.
সমাপ্ত
.
বি:দ্র: মনের মানুষের সান্নিধ্য সবারই কাম্য । মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে, কেউ একজন তার অগোছালো জীবনটা এসে গুছিয়ে দিবে । কিন্তু বেলাশেষে সবার আশা কি পূরণ হয়?? কারো হয়, কারো হয়না । এটাই তো জীবন….