পর্ব ৪
খোলা বারান্দায় শিরশির করে হাওয়া বইছে। বাতাসে ভেসে আসছে হাসনাহেনার ঘ্রাণ। নীলাক্ষী নিশ্চুপ হয়ে সামনের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে এই মুহুর্তে ঠিক কয়টা বাতি টিমটিম করে জ্বলছে, তা গুণে। ওর মনেহয় রাতের সমস্ত নির্জনতা ধীরেধীরে এখানে এসে ভর করছে। নির্জনতা কি জানে তারও একটা নিজস্ব শব্দ আছে? শব্দটা এতই সুক্ষ্ম আর নিরব যে কান বন্ধ হয়ে যায়। মনে হয় আমি আর কখনো ই কিছু শুনতে পাবো না। নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলতে ইচ্ছে করে না নীলাক্ষীর। ও কেবল বসে থাকে অম্লানের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আশায়। ওর মনেও যে কত কি ঘুরপাক খাচ্ছে, জানার জন্য মনটা উদগ্রীব হয়ে আছে। অথচ লাজ ভেঙে মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। ভাবছে, রোলার কোস্টার উপভোগ করা মেয়েটা আজ এত ভীতু হয়েছে কেন? কারো হৃদয়ের পাঠানো তরঙ্গে তোলপাড় হয়ে যাওয়ার ভয়ে? কি জানি, কি এর উত্তর।
বাদামী সংসার
মিশু মনি
অম্লান প্রথম কথা বলে, ‘আচ্ছা মেজো খালার ছেলেটা কি ছোটবেলা থেকেই অসুস্থ?’
নীলাক্ষী অম্লানের দিকে তাকায়। মেজো খালা মানে নীলাক্ষীর ফাতেমা আন্টি। ওনার ছেলের পা ভাঙা, হাঁটতে পারে না। বেশ কিছুদিন আগে খেলতে গিয়ে কেউ আঘাত করেছিল পায়ে। পায়ের হাঁড় ভেঙে বেঁকে গিয়েছে।
বললো, ‘না। কিছুদিন আগে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
অম্লান বললো, ‘ও আচ্ছা। ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে আমার সেটাই মনে হয়েছিল। আমার একজন পরিচিত ডাক্তার আছে। হাঁড়ের চিকিৎসা করেন। আপনি যদি খালার সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে একবার ডাক্তারকে দেখাতে পারি।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘আপনার সম্পর্কে জানার জন্য কি আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে? নাকি নিজে থেকেই বলবেন?’
– ‘জিজ্ঞেস করুন?’
– ‘সে পরে করবো। জিজ্ঞাসার বাইরে নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে বললে আপনি কি বলবেন শুনি?’
নীলাক্ষী খানিক্ষণ চুপ করে রইলো। জড়তা কাজ করছে। কত কথা মাছের কাটার মত দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে অথচ বেরিয়ে আসছে না। কিসের এত সংকোচ সে নিজেও বুঝছে না। অম্লান ভেজা মাটির মত চোখেমুখে কৌতুহল লেপ্টে তাকিয়ে আছে।
নীলাক্ষী ঢোক গিলে বললো, ‘আমি কখনো খুব চঞ্চল হই আবার কখনো খুব শান্ত। সবার সাথে মিশতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় একা থাকতে পছন্দ করি। আমার সম্পর্কে কেউ খারাপ কিছু বললে আমি কেঁদে ফেলি। ছোট ছোট ব্যাপারেও আমার চোখে পানি আসে। আমার একটা ভালো গুণ হচ্ছে আমি কখনো কাউকে কষ্ট দেই না। সবসময় সবকিছু পজেটিভলি নেই। নেগেটিভিটি বলে কোনো শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই। সবাই বলে নিজের চিন্তা ভাবনা আর পৃথিবীটাকে বড় করো। কিন্তু আমার পৃথিবীটা খুব ছোট। তবে এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা উপাদানই অনেক বিশুদ্ধ, নির্মল।’
নীলাক্ষী কথা বলতে বলতে অন্যদিকে তাকায়, আবার কথা শেষ করে একবার অম্লানের দিকে ফেরে। অম্লান পুরোটা সময় নীলাক্ষীর মুখের পানে তাকিয়ে ছিলো। ওর চোখ পিটপিট করা, চোখের পাপড়ির ওঠা নামা, দৃষ্টির ছোটাছুটি, গোছানো শব্দের শান্ত হয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসা, সবকিছু মন দিয়ে লক্ষ করছিল অম্লান। খেয়াল করেছে নীলাক্ষীর চোখের পাপড়ি বেশ ঘন। লম্বা লম্বা। ওর ভ্রু তে কখনো সুতার ছোঁয়া লাগে নি, লাগেনি কাঁচির ছোঁয়াও। ভ্রু যুগল পুরোপুরি প্রকৃতির আপন শোভায় সাজানো। একটু মোটা, তলোয়ারের মত ধারালো না হলেও সুন্দর। মায়া মায়া ভাব আছে।
অম্লান বললো, ‘এত সহজেই নিজেকে ব্যাখ্যা করে ফেললেন?’
– ‘আমি আসলেই অনেক সহজ। অনেক সরল। আমার মাঝে যদি কোনো দাগও থাকে সেটাও সরলরেখা, বক্ররেখা বলে কিছু নেই।’
– ‘বাহ! চমৎকার। ঘুমাতে ভালোবাসেন?’
– ‘প্রচুর। মাঝেমাঝে অফিসের ডেস্কে মাথা নিচু করে ঘুমিয়ে যাই।’
কথাটা বলে নীলাক্ষী হাসলো। অম্লান মাথা ঝাঁকালো। নীলাক্ষী শাড়ি পরেছে। সাথে কোয়ার্টার হাতার খয়েরী রঙের ব্লাউজ। সুন্দর মানিয়েছে ওকে। ভেজা চুল আচড়ায় নি, গামছা দিয়ে ঝাঁড়েও নি বোধহয়। টপটপ করে পানি পড়ে পিঠের ব্লাউজ ও ভিজে গেছে। রুটি তাওয়ায় দিলে যেমন ফুলে ওঠে, পায়ের কোণায় সেরকম ছোট্ট একটা ফোস্কা পড়েছে।
অম্লান বললো, ‘জুতার সাইজ মাকে বলেননি?’
নীলাক্ষী প্রশ্ন বুঝতে না পেরে অম্লানের দিকে তাকালে দেখে ও পায়ের দিকে চেয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে উত্তর দেয়, ‘আমার পায়ে শুধু দুই ফিতাওয়ালা জুতা খাপ খায়। অন্য রকমের জুতা পরলেই ফোস্কা পড়ে।’
– ‘আহারে।’
নীলাক্ষী এবার প্রশ্ন করেই বসলো, ‘আপনার কি হাসনাহেনা ফুল খুব পছন্দ?’
– ‘আমার শিউলী বেশি ভালো লাগে। আপনার?’
– ‘আমার পদ্ম ফুল।’
অম্লান মুচকি হেসে বললো, ‘তাহলে রাগ করলে রাগ ভাঙানোর জন্য কি আমাকে পদ্ম নিয়ে আসতে হবে?’
নীলাক্ষী হেসে বললো, ‘তাহলে আর রাগ ভাঙানো হবে না। এ শহরে পদ্ম কোথায় পাবেন?’
– ‘বা রে, প্রয়োজনে ধানমন্ডি লেকে পানি ভাড়া নিয়ে পদ্ম চাষ করবো। বউয়ের প্রিয় ফুল বলে কথা।’
নীলাক্ষী হেসে উঠলো। হাসির শব্দটা বেশ আদরমাখা। পদ্মফুলের পাপড়ির মত কোমল হাসি। অম্লান এই প্রথম কিছু একটা শুনে মুগ্ধ হলো। ওর আবারও সেই মুগ্ধতার স্বাদ নিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আরেকবার হাসলেও কি এমন করেই শব্দ বের হবে?
নীলাক্ষী জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার প্রিয় রান্না কি?’
অম্লান বললো, ‘উমম আমার বিরিয়ানি ভালো লাগে।’
– ‘কোনটা?’
– ‘মাটন, হায়দ্রাবাদী, কাচ্চি, হাজীর বিরিয়ানি একটা হলেই হলো।’
নীলাক্ষী দুই ভ্রু’য়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে কি আপনি রেগে গেলে আমাকে বিরিয়ানি রান্না করে বসে থাকতে হবে?’
– ‘দাঁড়িয়েও থাকতে পারেন। তবে আইডিয়া খারাপ না, জায়গামত হাত দিয়েছেন।’
নীলাক্ষী আবারও হাসলো। কিন্তু এবারের হাসিতে আগের হাসির সেই ফ্লেভারটা খুঁজে পেলো না অম্লান। ও উন্মুখ হয়ে শুনছিলো। দেখে নীলাক্ষী আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। চোখ পিটপিট করে বললো, ‘ওই দেখুন রকেটে যাচ্ছে।’
অম্লান তাকালো। নীলাক্ষীর ভালো লাগে রকেট দেখতে। ভালো লাগে নিঝুম রাতে শহরের ঘুমন্ত বাড়িগুলোর টিমটিমে বাতি গুণতে। ভালো লাগে বিয়ে বাড়ির রান্নার ঘ্রাণ, হাঁটার শব্দ, চায়ের কাপে দুধ চিনি মেশানোর সময় হওয়া ঝুনঝুন আওয়াজ। সোফায় বসে সোফার হাতলের ওপর এক পা তুলে দিয়ে বসে থাকতেও ওর ভালো লাগে। ভালো লাগে বিছানায় শুয়ে জানালায় পা দিয়ে শুয়ে থাকতে। ভালো লাগে মোটর সাইকেলের ধোঁয়ার গন্ধ আর ইঞ্জিনের পেট্রোলের গন্ধ।’
অম্লান মুগ্ধ হয়ে শোনে নীলাক্ষীর ভালো লাগার কথা। কত চমৎকার হতে পারে কারো ভালো লাগার বিষয়গুলি!
অম্লান বললো, ‘ কেরোসিন তেলের ঘ্রাণ ভালো লাগে?’
নীলাক্ষী হাসতে হাসতে বললো, ‘ওহ গড। এটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ন্যাপথলিনের গন্ধও আমার ভালো লাগে।’
– ‘সত্যি! আমারও এই দুইটা ভালো লাগে। তাহলে দুজন ঝগড়া করলে একজন ন্যাপথলিন এনে ছোঁড়াছুড়ি শুরু করলেই হবে নাকি?’
নীলাক্ষী হাসতে হাসতে বললো, ‘একজন গায়ে কয়েক কেজি কেরোসিন ঢাললেও হবে।’
– ‘হায় আল্লাহ! কি সাংঘাতিক চিন্তা ভাবনা আপনার।’
হেসে ওঠে দুজনেই। হাসতে হাসতে দুজনেরই মনে হয় একজন আরেকজনের প্রতি একটু একটু করে ধাবিত হচ্ছে। দুজনেরই মনে একই অনুভূতি। ভালো লাগছে কথা বলতে, হাসতে। ভালো লাগছে এই রাত, মনে হচ্ছে এভাবেই এখানে বসে সারাটা জীবন পার করে দেয়া যায়।
নীলাক্ষী জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার দাঁত মাজতে ভালো লাগে?’
– ‘না। ডিজগাস্টিং লাগে। আপনার?’
– ‘একদমই না। গোসল করতেও খারাপ লাগে। বিরক্তিকর।’
– ‘আমার সুইমিংপুলে গোসল করতে ভালো লাগে।’
নীলাক্ষী এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারলো না। কারণ ওর কখনো সুইমিংপুলে গোসল করা হয় নি। বাস্তবে কখনো পুল দেখেই নি ও। বললো, ‘ডিম ভাজি ভালো লাগে খেতে?’
– ‘খুব। মাঝ রাতে উঠে আম্মুকে বলি ডিম ভাজি করে দিতে।’
– ‘আমি তো ডিমের পাগল। ডিম সেদ্ধ, ডিমের ওমলেট, ডিম পোচ মানে ডিম হলেই হলো।’
অম্লান একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাই ফাইভ করে বললো, ‘ফ্রিজে সবসময় ডিম রাখতে হবে বুঝেছি। দুইজনেই ডিম পাগল।’
– ‘আচ্ছা আমাদের তো অনেক মিল পাওয়া গেলো। অমিল নেই কোনো?’
– ‘আছে। আপনি কি গান শোনেন?’
নীলাক্ষী চুপ থেকে বললো, ‘রবীন্দ্র, বাউল, আর ঝাঁকানাকা।’
অম্লান হেসে বললো, ‘আমার ঝাঁকানাকা গান একেবারেই পছন্দ নয়। নেহা কাক্কারের গান ভালো লাগে?’
– ‘হ্যাঁ লাগে।’
– ‘আমার লাগে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে?’
– ‘হ্যাঁ। আপনার?’
– ‘আমার একটুও ভালো লাগে না।’
নীলাক্ষী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন?’
– ‘সর্দি হয় তাই। সর্দি হলে ঝাল খেতে পারি না। নাক দিয়ে ছরছর করে পানি পড়ে। আমি ঝাল খেতে ভালোবাসি ‘
– ‘শিট, আমি একদমই ঝাল খেতে পারি না।’
– ‘এই যে অনেক অমিল পাওয়া গেছে।’
দুজনে হাসে। রাত যত গভীর হচ্ছে, ততই শঙ্কা হচ্ছে এই রাত দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার। কিন্তু এমন সুন্দর একটা রাতকে কেউই ফুরিয়ে যেতে দিতে চায় না। আবার কবে এমন রাত আসবে, যখন বারান্দায় দখিনা হাওয়ার সাথে শহর ঘুমিয়ে যাবে। বাতাসে ভেসে আসবে হাসনাহেনার ঘ্রাণ, দুজনে পাশাপাশি বসে একজন আরেকজনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করবে। জানবে, চিনবে, আরও কত কি!
অম্লান জিজ্ঞেস করে, ‘তনিমা আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড?’
– ‘মোটামুটি বলা চলে। তবে বড় হওয়ার পরে সেরকম কোনো বেস্ট ফ্রেন্ড পাই নি। স্কুল লাইফের মত বন্ধু কি আর কখনো হয়?’
– ‘আমিও সেটাই বলি। স্কুল লাইফের বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ নেই?’
– ‘না।’
– ‘আসলে সময়ের সাথে সাথে কখনো বন্ধুত্ব হারিয়ে যায়, আবার কখনো হারিয়ে যায় যোগাযোগ।’
নীলাক্ষী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘হুম।’
অম্লান আবারও মুখে হারিয়ে ফিরিয়ে আনে। সবুজ লতার পাশে বসে কি গোমরা মুখে থাকা যায়? বারবার সুন্দর করে হাসার পরও মনে হতে থাকে আরেকটু সুন্দর করে হাসি, মানুষটা মুগ্ধ হোক। অপর মানুষটাকে মুগ্ধ করতে চাওয়ার এই প্রবণতা কেন আজকেই হচ্ছে কে জানে।
অম্লান বললো, ‘আচ্ছা আপনি রেগে গেলে পদ্ম আনতে হবে কি না বললেন না তো?’
নীলাক্ষী বললো, ‘না। নীলক্ষেত থেকে মাঝেমাঝে পুরনো বই এনে দিলেই আমি সারপ্রাইজড হয়ে একেবারে বরফের মত গলে যাবো।’
– ‘পুরনো বই কেন?’
নীলাক্ষী উদাস চোখে বললো, ‘পুরনো বইতে আমি কি যেন একটা খুঁজে পাই। একজন আরেকজনকে গিফট দেয়, সেই বইগুলো বিক্রি করে ফেলে। অথচ বইয়ের উপরের পাতায় লেখা থাকে কত স্মৃতি, কত কথা। যা একজন আরেকজনকে উইশ করে লেখে। আমার ওই কথা গুলো পড়তে ভালো লাগে। আর ভালো লাগে পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ। আমার কেন যেন মনেহয় সব নতুন বইয়ের ঘ্রাণ একইরকম। কিন্তু সব পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ এক নয়, আলাদা।’
অম্লান মুগ্ধ হয় কথাটা শুনে। কত সুন্দর একটা দর্শন! সব নতুন বইয়ের ঘ্রাণ একইরকম, কিন্তু সব পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ আলাদা। অদ্ভুত সুন্দর! অম্লানের চোখেমুখে ছড়িয়ে যায় এক বিস্ময়। গল্প করার সাথী হিসেবে নীলাক্ষীকে ওর চমৎকার লাগছে। জীবনসাথী হিসেবে? ওটা গড়ে নেবো। হয় সে আমার মত হবে, নয়তো আমি তার মত হয়ে যাবো। অম্লান মনেমনে হাসে।
চলবে..