বাদামি সংসার পর্ব-৩৫

0
1047

বাদামী সংসার
পর্ব ৩৫
মিশু মনি

অম্লানের টেকনাফে বদলি হওয়ার খবরটা বাড়ির কেউই মানতে পারছেন না। হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠা বিষফোড়ার মতন এই বিষয়টা হৃদয়ের এক কোণে খোঁচার মতো ব্যথা দিচ্ছে নীলাক্ষীকে।

রাত্রিবেলা অম্লানের গলা জড়িয়ে ধরে নীলাক্ষী বললো, ‘ট্রান্সফারের ব্যাপারে অফিসে কথা বলা যায় না? ঢাকার ভেতরেই যদি নেয়ার ব্যবস্থা থাকতো..’
‘আমি চেষ্টা করবো নীলু। ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’
‘চেষ্টাতে কী সব হয় অম্লান! তুমি যদি আমাকে ছেড়ে অতদূরে চলে যাও তবে…’

নীলাক্ষী হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অনেকদিনের জমানো বেদনা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো চোখের জলে। গলার ভেতর থেকে একটা ফোঁসফোঁস আওয়াজ বেরোলো। কান্না আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে সে।

অম্লান নীলাক্ষীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি মন খারাপ কোরো না। আমি চেষ্টা করে দেখি কী হয়। নয়তো তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো। চাকরি করতে হবে না। তুমি আমার সাথে যাবে।’

নীলাক্ষীর ঘন নিশ্বাস পড়ে। তার চাকরি ছেড়ে দেবার বিষয়টা ঠিক সমুদ্রের জল শুকিয়ে যাওয়ার মতো খবর। কারণ নীলাক্ষী জানে স্ত্রী’রা স্বামীর ওপর সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে শুয়ে বসে দিন কাটালে একসময় সব স্বামী’ই খোটা দিয়ে কথা শোনায়। সেই সুযোগটুকু অন্তত কখনো নিজের জীবনে সে আসতে দেবে না। চুপ করে রইলো নীলাক্ষী।

অম্লান বললো, ‘কী ভাবছো নীলু?’
‘কিছু না।’

‘কিছু না’ বলার অন্তরাল থেকে একটা চাপা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো আবারও। ডান হাতে অম্লানের অম্লানের গলা বেষ্টন করে রেখে নীলাক্ষী নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে। অম্লানকে সবদিক থেকেই সে নিজের করে নেয়ার যে ব্রত নিয়েছিলো, অম্লান টেকনাফ চলে গেলে ব্যাঘাত ঘটবে তাতে। হয়তো এতে চিরতরেও হারাতে হতে পারে কিংবা সম্পর্কটা হয়ে উঠবে সরল একটা সম্পর্ক, টিকে আছে অথচ এখানে কোনো মায়া নেই!

অবশেষে টেকনাফেই চলে যেতে হলো। চেষ্টা করেও ঢাকার ভেতরে কিংবা আশেপাশে কোথাও বদলি নেয়া সম্ভবপর হয়নি। নীলাক্ষী অবশ্য চুপচাপ, বিষণ্ণতার ঝুপড়ি খুলে বেরিয়ে আসা কান্নাগুলোকে জোরপূর্বক চেপে রাখতে সে ওস্তাদ।

অম্লান টেকনাফে গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে আসার পর শেষ বিদায় নিতে অফিসের দুজন কলিগ ও বন্ধুবান্ধবদেরকে বাসায় দাওয়াত করলো। একটা ছোটখাটো পার্টির আয়োজন হয়েছে।

পার্টিতে অম্লান ব্লেজার কটি সবকিছুর ভেতরে নিজেকে রাঙালেও নীলাক্ষী খুব সাদামাটা ভাবে ঘরে বসে রইলো। একটা সুতি থ্রি পিছ পরে চুল এলোমেলো করে বিছানার ওপর থ মেরে বসা। অফিস থেকে ফিরে হাতমুখও ধোয় নি। ঘর্মাক্ত ত্বকের ওপর বিবি ক্রিমের হালকা প্রলেপন এখনও চোখে লাগছে। অম্লান নীলাক্ষীকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় জানতে চাইলো, ‘কী গো লক্ষিটি, সবাই চলে এসেছে তো। দেখা করবে না?’
‘হু।’
‘তাহলে এসো? ড্রয়িংরুমে ওরা অপেক্ষা করছে তো। নাকি রুমে আসতে বলবো?’
‘আরে না না। আমি যাচ্ছি।’
‘এইভাবে? জামা পরো। মেক আপ করে চুলগুলো কার্ল করো। এত মনমরা হয়ে বসে থাকলে হবে সোনা?’

নীলাক্ষী একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমার ভালো লাগছে না। মাথা ধরেছে।’
‘বিয়ের পর এই প্রথম ওরা এলো। আর এটাই হয়তো শেষ। আবার কবে আসবে তার ঠিক আছে? তুমি আপ্যায়ন করবে ওদেরকে। চলো তো। আসো আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি।’

অম্লান নীলাক্ষীর হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে এলো। নিজের হাতে ফেসওয়াশ লাগিয়ে দিলো নীলাক্ষীর গালে। ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে বললো, নাও মুখ ধোও।

এগিয়ে দিলো তোয়ালে। ঘরে এসে চিরুনি হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো নীলাক্ষীর জন্য। আনমনা নীলাক্ষীর মনটা ততক্ষণে অনেকটাই ভালো হয়ে গিয়েছে। চুল আঁচড়ে হালকা পাউডার লাগিয়ে সাজলো সে। শাড়ি পরে অম্লানের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো, ‘আমাকে কেমন লাগছে?’

অম্লান অনেক্ষণ নীলাক্ষীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিতে নির্নিমেষ প্রেম। ঠোঁটে হাসির আভাসে উষ্ণতার ছোঁয়া। কাছে এগিয়ে এসে নীলাক্ষীর চিবুক ছুঁয়ে অম্লান বললো, ‘কী মিষ্টি লাগছে আমার বউটাকে। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকবো কী করে!’

হঠাৎ নীলাক্ষীর বুকটা যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। অম্লানকে জড়িয়ে ধরে চোখ ভিজে উঠতে শুরু করে ওর। কে জানতো এমন হবে! জানলে কী আর এত আয়োজন করে অম্লানকে পাবার বায়না ধরত সে? ভালোবাসার কঠিন বন্ধনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পরই কেন দূরে চলে যাওয়ার ডাক আসে? কেন? নীলাক্ষী এমন শত শত প্রশ্নে নিজের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অম্লানের বুকে মাথা রেখে ভালোবাসার একটা বুক সমুদ্র গর্জন শুনতে পায় সে। অম্লান তাকে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে। এটা নীলাক্ষীর অজানা নয়, তবুও ভয়; হারাবার।

নীলাক্ষী বললো, ‘আমি কিচ্ছু জানি না। প্রতিদিন, প্রত্যেকটা কাজের ফাঁকে তুমি আমাকে ভিডিও কল দেবে। অফিস থেকে ফিরেই কল, আবার অফিসে গিয়েও কল। আমি কিছু জানিনা অম্লান, কেন দূরে যাচ্ছো?’

অম্লান নীলাক্ষীর চিবুকে চুম্বন করে বললো, ‘আমার লক্ষিটি এমন করে না গো। এমন করলে আমি কী যেতে পারবো? তুমিই আমার সাহস, আমার অনুপ্রেরণা। আমাকে উৎসাহিত করো। সামনে এগিয়ে যেতে হলে আমাদেরকে তো একসাথেই কাজ করতে হবে তাই না? আমি তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বেকার বসে থাকতে পারবো না কলিজা।’

নীলাক্ষী অম্লানের হাত শক্ত করে চেপে ধরে রইলো। সে এসব ভালোমতো বোঝে। সম্পর্ক দূরে গেলেই দূরত্ব বাড়ে এসব মিথ্যে কথা। কিলোমিটারের দূরত্বে যদি দূরত্ব বাড়তো তবে কোনো স্বামী নিশ্চয় স্ত্রী’কে ছেড়ে বিদেশ বিভূইয়ে পড়ে থাকতো না! নিজেকে স্বান্তনা দেয় নীলাক্ষী।

পার্টিতে সবাই মিলে বেশ ভালোই আনন্দ করলো। রূপক গান গাইলো, অম্লান ও কিশোর মিলে নাচলো। মায়ের হাতের একুশটা আইটেম খাবার আর ভাবীর হাতের যত্নে যেন একটা দিন ঈদের দিনের মতোই সুন্দর হয়ে উঠলো। সবার মনে একটা উষ্ণ বিষণ্ণতা। তবুও আনন্দ। যেন আজকে আনন্দময় বিষণ্ণতার দিন।

খাওয়াদাওয়া শেষে অম্লান বন্ধুদেরকে নিয়ে বাসার বাইরে গেলো সিগারেট ফুঁকতে। ঘরে বসে আছেন তৌহিদ ভাই। উনি আবার সিগারেট খান না। ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে জানতে চাইলেন, ‘তো ভাবী আপনি কী কবে যাচ্ছেন?’
‘কোথায় ভাইয়া?’
‘টেকনাফে।’

নীলাক্ষী প্রথমে কিছুটা চমকালেও বললো, ‘যাবো। কিছুদিন পরে। আগে ও সবকিছু গুছিয়ে নিক।’

অম্লানের মা এসে নীলাক্ষীর পাশে বসলেন। বাহুতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার মায়ের সাথে আমরা তো আছি। ও একদমই একাকীত্ব বোধ করার সুযোগ পাবে না।’

নীলাক্ষীর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যতাসূচক হাসি দিলো। মায়াময় হাসি। সেই হাসি দেখে মায়ের প্রাণ জুরিয়ে গেলো। তিনি নীলাক্ষীর থুতনি ধরে বললেন, ‘লক্ষী মেয়েটা আমার।’

মা উঠে গেলে নীলাক্ষী বললো, ‘তৌহিদ ভাই, কোনোভাবে কী ঢাকার ভেতরে ট্রান্সফার নেয়ার ব্যবস্থা করা যায় না? আপনি তো নাকি একবার ট্রান্সফার পেয়েছিলেন, পরে ঢাকাতেই থেকে গেছেন। অম্লানকে কী সেরকম সুযোগ একটা করে দেয়া যেতো না?’

তৌহিদ ভাই ম্যাগাজিন পড়তে পড়তেই বললেন, ‘আমি তো অম্লানকে বলছিলাম ভাবী। ও নিজেই তো ঢাকার বাইরে ট্রান্সফার নিতে চাচ্ছিলো। সেটা তো অনেক আগে থেকেই ও আমাকে বলে রাখছে। এমনকি আমি ময়মনসিংহের জন্যও স্যারকে ধরতে বলছিলাম। অম্লানই তো বললো সে অনেক দূরে নিবে।’

নীলাক্ষীর যেন হঠাৎ করেই দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু জানতে চাইলো, ‘এটা কী বিয়ের আগে বলেছিলো না পরে?’
‘পরে। পরেই তো। এইতো মাস দুয়েক হবে। ওর ট্রান্সফারের ব্যাপারে তো সেই সাত আট মাস ধরে কথা হচ্ছে। আগে শুনেছিলাম ত্রিশালে দেবে। অম্লান নিজেই চায় নি। ও নাকি বউ নিয়ে দূরে থাকবে।’

কথাটি শোনার পর মুহুর্তেই নীলাক্ষীর মুখখানা উজ্জল হয়ে উঠলো। মনের কোণে জমে ওঠা সন্দেহের বীজ বিনষ্ট হয়ে গেলো ক্ষণিকেই। অম্লান নিশ্চয় মনেমনে চাইছে নীলাক্ষী চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার সাথে গিয়ে থাকুক। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নতুনভাবে দুজনে মিলে জীবন শুরু হবে সেখানে। অম্লানের এই ভাবনাকে শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করছে নীলার।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে অম্লানের মুখটাকে দেখার আশায় তাকিয়ে রইলো সে। কখন যে আসবে! মানুষটা এত ভালো কেন?

সারাটা দিন নীলাক্ষীর মনটা ভীষণ ভালো হয়ে রইলো। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশ একটা চাপা অস্থিরতা জেঁকে বসলো ভেতরে। কোথায় যেন একটা অশান্তি লেগে আছে। খুব ছোট্ট অথচ তীব্র। সেই অশান্তির বীণ মৃদু বেজে চলেছে মাথার ভেতর। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে নীলাক্ষী ঠাওরাতে পারছে না।

চলবে..

আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/310794352878919/posts/711648512793499/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here