বাদামী সংসার
৩৯
মিশু মনি
নীলাক্ষীর মিঠে চেহারায় শঙ্কার ছায়া ফুটে উঠতে দেখে ক্ষণিকেই নিজেকে পালটে ফেলে অম্লান। শব্দ করে হাসতে হাসতেই লুটিয়ে পড়ে নীলাক্ষীর গায়ে। ভয়েই শুকিয়ে যাওয়া নীলার মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। সে একইসাথে ভীষণ অবাক ও শঙ্কিত। মানুষটা এমন করে হাসছে কেন!
অম্লান হাসি থামানোর চেষ্টা করেও যেন পারছে না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসেই লুটোপুটি খাচ্ছে। বহু চেষ্টায় হাসি থামাতে হলো এমন একটা ভাব ধরে বললো, “উহু বুঝতে পারোনি তুমি। আমি মজা করে এমন বলেছি।”
অম্লান যে কথাটা মজা করে বলেনি নীলাক্ষী সেটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। তবুও সেও এমন একটা ভাব ধরলো যেন অম্লানের প্রত্যেকটা কথাই সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “যাক বাবা। এটা ফান ছিলো। উফফ আমি কী যে ভয় পেয়েছিলাম অম্লান। তুমি আমাকে বাঁচালে।”
“কেন? মরে যাচ্ছিলে নাকি?”
“মরবো না? একে তো চলে এসেছো দূরে। তার ওপর..”
“তার ওপর?”
“কিছু না। ওই মহিলাটাই যত ভয়ের কারণ। আমি আর ভয় পাচ্ছি না মোটেও। তোমাকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস করি।”
অম্লান চোখ ওপরে তুলে জিজ্ঞেস করলো, “বিশ্বাস করো নাকি করতে চাও?”
নীলাক্ষী অম্লানের চোখে চোখ রেখে কী বলবে অনেক্ষণ ধরে সে-ই ভেবে চললো। দূরে কোথাও একটা পাখি বিচিত্র সুরে ডেকে চলেছে। সেদিকে মন দিয়ে বিষাদময় কণ্ঠে নীলাক্ষী বললো, “পাখিটা ওভাবে ডাকছে কেন?”
“দাড়াও জিজ্ঞেস করে আসি।”
“কী? কাকে জিজ্ঞেস করবে?”
“পাখিটাকে জিজ্ঞেস করে আসি কেন ওভাবে ডাকছে।”
অম্লান বিছানা থেকে নেমে গেলো। নীলাক্ষী মাথা তুলে মলিন মুখ করে তাকিয়ে থাকে। অম্লান বললো, “একটা সিগারেট খেয়ে আসি।”
নীলাক্ষী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বসে রইলো। হাতে সিগারেট ও লাইটার নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো অম্লান। মিনিট দুয়েক বিছানায় এপাশ ওপাশ করে চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে একমনে ভেবে চললো নীলাক্ষী। এই বুঝি চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসবে।
অম্লান ধীরেধীরে তার কাছে একটা রহস্যপিণ্ডে পরিণত হচ্ছে। জট বাঁধানো রহস্য। যেই রহস্যের জট খুলতে গেলে কেবল পেঁচিয়েই যায়। ঘূর্ণিঝড় কী এমনই? অম্লান কী একটা ঘূর্ণিঝড়? উফফ, অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতরে।
খানিকবাদে অম্লান বেরিয়ে এলো হাসিমুখে। যেন কিছুই হয়নি। দিব্যি কাছে এসে নীলাক্ষীর মাথা কোলের ওপর টেনে নিলো। নীলাক্ষীও হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, “কাল বাসা দেখতে বের হবো?”
নীলাক্ষীর চোখের দিকে তাকিয়ে অম্লান ভাবে, “কেন এলে এখানে? কী দরকার ছিলো? একা একা বেশ ভালোই তো ছিলে। ”
গভীর রাত। অম্লান খাবার খেয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। কাজ শেষ করতে করতে রাত অনেক বেড়ে গেলো। নীলাক্ষী বিছানায় শুয়ে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ ভ্রুক্ষেপ নেই। শরীরে একটা হাহাকার করা বেদনা ককিয়ে উঠছে।
অম্লান বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শহরের মতো এত আলো নেই, এত দালান নেই, আছে শুধু বৃক্ষলতা আর নির্জনতা। সবকিছু ভীষণ শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। রাত তো এমনই হওয়া উচিৎ।
নীলাক্ষী বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অম্লান তার হয়েও যেন তার নয়। মাঝখানে একটা সুক্ষ্ম দেয়াল ঘন হয়ে ওপরে উঠে আসছে সেটা ঠিকই অনুভব করতে পারে নীলাক্ষী। যেই দেয়াল তাকে জালের মতো পেঁচিয়ে আলাদা করে দিচ্ছে। আর সহ্য হয় না। বালিশ বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে নীলাক্ষী।
অম্লান সিগারেট শেষ করার পরও অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দায়। ফিরে এসে দেখলো নীলাক্ষী ঘুমে মগ্ন। নিঃশব্দে সেও পাশে শুয়ে পড়ে। আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ কথা বলতে পারলে কতই না ভালো হতো। মনের সমস্ত ব্যথাগুলো তাদেরকে বিলিয়ে দেয়া যেতো!
অম্লান পাশ ফিরে শুতে গেলে টের পায় নীলাক্ষীর হাত কাঁপছে। তারমানে সে ঘুমায় নি। নীলাক্ষীকে ডাকার ইচ্ছে জাগে না। অম্লান চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। দুজন দুদিকে জেগে শুয়ে রয়, দুজনেই টের পায় ওপাশে অপর মানুষটাও জাগ্রত। কিন্তু কেউ কথা বলে না। রাত বাড়ার সাথে ক্রমশ ব্যথারাও পুঞ্জীভূত হয়ে দুচোখে ভর করলো। শেষ রাতে নীলাক্ষীকে বুকে চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো অম্লান।
সকালবেলা একসাথে বাসা থেকে বের হলো দুজনে। অম্লান চলে গেলো অফিসের দিকে আর নীলাক্ষী বাসা খুঁজতে। একটা দুই রুমের বাসা পছন্দও হয়ে গেলো। রাস্তার পাশেই ছোট্ট দোতালা বাড়ি। পেছন দিকে খোলা বারান্দা, বারান্দার সামনে কোনো বাড়ি নেই। ধূ ধূ প্রান্তর। সন্ধ্যায় শিরশিরে হাওয়া আসে ওই বারান্দা বয়ে। নীলাক্ষীর ভালোই লাগবে এখানে।
পরেরদিনই নতুন বাসায় উঠে গেলো অম্লান ও নীলাক্ষী। ঘরে যা আছে তাই দিয়েই শোবার ঘর আর বসার ঘরকে মনের মতো করে সাজিয়ে ফেললো। ঘর সাজানোর মাঝে একটা বিচিত্র সুন্দর আনন্দ আছে। ছোটবেলা থেকে কতই তো ঘর সাজানো হয়েছে তার। অথচ আগে তো এমন সুন্দর শান্তি বোধ হয় নি! দুপুর অবধি মনটা বেশ ফুরফুরে ছিলো। কাজের ব্যস্ততায় প্রহর কেটেছে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই গতকালের বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। অম্লানের জন্য অকারণে মন খারাপ হতে শুরু করেছে।
নীলাক্ষী বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা দিগন্তের দিকে মনমরা হয়ে বসে রইলো দীর্ঘসময়। রান্না করতে না পারা মানুষটা ধীরেধীরে রান্না শিখে যাচ্ছে। সংসারের আনন্দ উপভোগ করছে। সবকিছু আরও সুন্দর হতো যদি অম্লানের কাছ থেকে মাঝেমাঝে অদ্ভুতুরে আচরণটুকু না পেতো।
নীলাক্ষী জোর করে মনকে ভালো রাখতে চেষ্টা করে। অম্লানের মাঝে কোনো দ্বিধা নেই, থাকলেও সেই দ্বিধাকে সে দূর করে দেবে এই বিশ্বাস তার আছে। সে কি রাগ করে থাকবে? নাকি অম্লানকে আরও বেশী ভালোবাসা উচিৎ? প্রেমে নাকি বেদনা মরে!
নীলাক্ষী মোবাইল হাতে নিয়ে অম্লানকে কল দিলো, ‘হ্যালো..’
‘হুমমম বলো।’
‘ব্যস্ত আছো?’
‘না। কেন?’
‘বাসায় আসতে পারবা?’
অম্লান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘হাতে কাজ নেই। আসা যায়। কোনো দরকার?’
‘তুমি চাইলে কি এখন অফিস থেকে চলে আসতে পারবে?’
‘হুম।’
‘তাহলে অফিসের বাইরে আসো। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি।’
গোসল সেরে দ্রুত শাড়ি পরলো নীলাক্ষী। চুল আঁচড়ে পিঠের ওপর এলিয়ে দিলো। ভেজা চুলে নিজেকে দেখতে নিজেরই ভীষণ ভালো লাগে। নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। প্রতিটা মেয়েই কোনো না কোনো সময় নিজের প্রেমে পড়ে।
নীলাক্ষী মোবাইল রেখে খালি হাতে বেরিয়ে পড়লো। দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা বাইরে লুকিয়ে রেখে ফুরফুরে মনে বেরিয়ে পড়লো অম্লানের অফিসের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে অবশ্য অম্লানকে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠিয়ে রাখলো, ‘আমি বের হচ্ছি। ফোন বাসায় থাকছে।’
অম্লান অবাক হলো নীলাক্ষীকে দেখে। স্নিগ্ধ হাস্যোজ্জ্বল মুখ। লাস্যময়ী এই মানবী কেবল তাকেই ভালোবাসে!
নীলাক্ষী কাছে এসে অম্লানকে জড়িয়ে ধরলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের আলিঙ্গন অথচ একটা বিশুদ্ধ ভালোলাগা ছেয়ে গেলো অম্লানের মনে। জানতে চাইলো, ‘হঠাৎ শাড়ি পরে? কোথায় যাচ্ছো?’
‘তোমার কাছে এলাম। কেন আসা যাবে না?’
অম্লান চমকে উঠলো। নীলাক্ষীর ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে ওর বুকে এক ধরণের শিরশিরে অনুভূতি হয়। নীলাক্ষী অম্লানের বাহু চেপে ধরে বললো, ‘তোমাকে নিয়ে আজ হাঁটতে বের হবো। প্রেম করবো। এখানে তো আমি কিছুই চিনি না। তুমি চেনো?’
অম্লান নিরুত্তর মুখে নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে রইলো। নীলা অম্লানের বাহু ধরে দুলতে দুলতে হাঁটা শুরু করে। অম্লান আশেপাশে খুব বেশী কিছু চেনে না। তবে শুনেছে কাছেই নাকি সমুদ্র। কাউকে জিজ্ঞেস করে সেদিকে হাঁটা ধরা যায়। নীলাক্ষী নিশ্চয়ই দারুণ খুশি হবে।
দুজনে হাঁটছে। দুটো পাখির মতো। পাশাপাশি নিরবে পথচলা। নীলাক্ষী অপেক্ষা করছে অম্লান কিছু বলুক। অম্লান অন্যমনস্ক। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না একদমই। এক পর্যায়ে নীলাক্ষী বাধ্য হয়েই বললো, ‘আচ্ছা আমার চাকরিটা তবে ছেড়েই দেই কী বলো?’
‘হ্যাঁ?’
চমকে উঠলো অম্লান, ‘চাকরি ছাড়বে কেন?’
‘অদ্ভুত কথা বললে। এখানে এসে সংসার পেতেছি আর বলছো চাকরি ছাড়বো কেন? এখান থেকে অফিস করবো তাইনা? হা হা।’
নীলাক্ষী দাঁত বের করে হাসছে। ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওকে। অম্লানের মোটেও হাসি পাচ্ছে না। বিষণ্ণ বোধ হচ্ছে ওর। নীলাক্ষী বললো, ‘জানো ভাইয়া এখন ভাবীর অনেক কেয়ার করে।’
‘কোন ভাইয়া?’
‘কোন ভাইয়া আবার? আমার তো বড় কোনো ভাই নেই। তোমার ভাইয়া ছাড়া আর কার কথা বলবো? তোমার কী হয়েছে বলোতো অম্লান?’
অম্লান নীলাক্ষীর হাতটা শক্ত করে ধরলো। মুখে শুধু বললো, ‘কিছু না তো।’
তবুও অম্লানকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। নীলাক্ষী বেশ বুঝতে পারছে কোথাও তো একটা গণ্ডগোল ঠিকই আছে। কীভাবে জিজ্ঞেস করা যায় সেটাই ভাবতে লাগলো নীলাক্ষী।
সমুদ্রের তীরে এসে অনেক্ষণ খুশিতে কথা বেরোলো না নীলাক্ষীর মুখ থেকে। ভীষণ মুগ্ধ দুটি চোখে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। অম্লান নীলাক্ষীর বিস্ময় দেখছে। ওর বুকের ভেতর আজ কোনো অনুভূতি নেই। সবকিছুকেই ঘুমন্ত মনে হচ্ছে ওর।
নীলাক্ষী অম্লানকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে গেলো সমুদ্রের দিকে। এটাই ওর প্রথম সমুদ্র দর্শন। তাই উচ্ছ্বাসটাও তুলনামূলক বেশী ই। তীরে পা ভিজিয়ে হাঁটতে লাগলো নীলাক্ষী। অম্লান স্থির চোখে সমুদ্র আর নীল দেখছে। তার নীলাক্ষী। অথচ আজ এমন কেন লাগছে অম্লানের! খুব করে কাঁদতে পারলে ভালো হতো।
চলবে..
গত পর্বের লিংক https://www.facebook.com/310794352878919/posts/723825794909104/